(শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি মুহম্মদ তাক্কী উছমানী মু. বর্তমান মুসলিম জাহানের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আলিম। সঠিক অর্থেই তিনি মুসলিম উম্মাহ্র অমূল্য সম্পদ। গত ২২শে মার্চ শুক্রবার পাকিস্তানের করাচী শহরে তাঁর উপর সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে, তবে আল্লাহ্র রহমতে তিনি ও তাঁর পরিবার নিরাপদ ছিলেন, আর মুসলিম উম্মাহ্ এক অপূরণীয় ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছে। তবে এ বেদনাদায়ক ঘটনায় তাঁর সঙ্গে থাকা দু‘জন শহীদ হয়েছেন, আর দু’জন মারাত্মক আহত হয়েছেন। দৈনিক উম্মত পত্রিকার পক্ষ হতে উপরোক্ত সন্ত্রাসী হামলা প্রসঙ্গে হযরত মুফতি ছাহেবের একটি বিশদ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে যা ঐ পত্রিকার ২৬শে মার্চ সংখ্যায় ছাপা হয়েছে। আমাদের সম্মানিত পাঠকদের উদ্দেশ্যে এখানে তার বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।)
***
প্রশ্ন- আমাদের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী হামলা থেকে আপনার বেঁচে যাওয়া অলৌকিক ঘটনার চেয়ে কম নয়, আপনি বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করছেন।
উত্তর- সত্যি এটা অলৌকিক ঘটনা। গুলিবৃষ্টির মধ্যেও আল্লাহ তা‘আলা এমনভাবে আমাকে নিরাপদ রেখেছেন একটি আঁচড়ও লাগেনি। তবে দু’জন সঙ্গীর শাহাদত এবং দু’জনের আহত হওয়ার কারণে আমি অত্যন্ত বেদনাহত। তারা তো হামলার ‘টার্গেট’ ছিলো না, শুধু আমার সঙ্গে থাকার কারণে...!
প্রশ্ন- হামলার সময় কি আপনি কোন দু‘আ পড়ছিলেন?
উত্তর- দেখুন, আমি কখনো দু‘আ পড়ি না, দু‘আ করি এবং দু‘আ চাই। দু‘আ পড়ার জিনিস নয়। ভিখারী যেভাবে ভিক্ষা চায় দু‘আ সেভাবে চাওয়ার বিষয়।
প্রশ্ন- জি¦, তো আপনি তখন কী দু‘আ করছিলেন?
উত্তর- সাধারণত সূরা কাহাফ আমি শুক্রবার রাতেই নফলের মধ্যে তেলাওয়াত করে নেই। সেদিন রাতে করা হয়নি। তাই ঐ সময় সূরা কাহাফ তিলাওয়াত করছিলাম। তিলাওয়াত শুরু করামাত্র হামলা শুরু হয়ে গেলো। কয়েকটি গুলি আমার গাড়ীর উইন্ডস্ক্রিনে এসে লাগলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো, প্রথমে গুলির আওয়াযকে আমার কাছে প্রচ- বৃষ্টির আওয়াযের মত মনে হয়েছে। আমি ভেবেছি, হঠাৎ বুঝি ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গাড়ীর উইন্ডস্ক্রিনের উপর যখন নযর পড়লো তখন বুঝলাম যে, বৃষ্টি নয়, গুলিবৃষ্টি। ...
প্রশ্ন- তখন আপনার কী ধারণা হলো?
উত্তর- প্রথমেই আমার ধারণা হয়ে গেলো যে, এটা কোন সন্ত্রাসী হামলা, যা আমাকে লক্ষ্যস্থল বানাতে চাচ্ছে। হামলাকারীরা মোটর সাইকেলে করে সামনে পিছনে ছিলো, ঐ অবস্থায় গুলি চালিয়ে যাচ্ছিলো।
প্রশ্ন- খবরে যেমন এসেছে, হামলা- কারীরা তিনটি মোটর সাইকেলে ছিলো?
উত্তর- হাঁ, প্রতিটিতে দু’জন করে ছিলো। তবে প্রথম দিকে হামলা-কারীদের সংখ্যা আমি আন্দায করতে পারিনি। আমার হাতে কোরআন শরীফ ছিলো, আর তিলাওয়াতে আমি এমন নিমগ্ন ছিলাম যে, আমার কোন ধারণাই ছিলো না, পথের কোন্ স্থানে আমরা আছি। এ কারণে হামলাকারীদের সংখ্যার দিকেও আমার চিন্তা যায়নি।
সফরে আমি হয় তিলাওয়াত করি, না হয় কোন কাজে থাকি। তাই সাধারণত আমার জানা থাকে না যে, গাড়ী কোন্ পথ অতিক্রম করছে। হামলার দিনও এ অবস্থাই ছিলো। আমার ধারণা ছিলো না, আমরা কোন্ জায়গায় আছি, বা আমার চারপাশে কী হচ্ছে। হঠাৎ করেই গুলিবৃষ্টি শুরু হলো, আর আমি ভাবলাম, হঠাৎ বুঝি বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পরে দেখি, গাড়ীর উইন্ডস্ক্রিন ভেঙ্গে গিয়েছে। ডান দিকের কাঁচও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রশ্ন- গুলি আপনার কতটা নিকট দিয়ে যাচ্ছিলো?
উত্তর- পুলিশ প্রহরী চালকের পাশের আসনে বসা ছিলো। আমি আমার স্ত্রী ও পৌত্র-পোত্রীর সঙ্গে পিছনের আসনে ছিলাম। আমি বাম দিকের দরজার পাশে ছিলাম। গুলি তখন লাগাতার চলছিলো। বিশেষ করে পিছন থেকে আসা গুলি আমাদের মাথার প্রায় চুল ছুঁয়ে সামনের আসনের পিছনে বিদ্ধ হচ্ছিলো। এর মধ্যে ডান দিক থেকে আসা একটি গুলি আমার গাড়ীর চালক হাবীবের শরীরে বিদ্ধ হলো। সে নিজের কথা চিন্তা না করে আমাকে চিৎকার করে বললো, আপনি নীচে শুয়ে পড়–ন। তখন তিনদিক থেকেই গুলি বর্ষিত হচ্ছিলো। আহত অবস্থায়ও চালক হাবীব পূর্ণ গতিতে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছিলো।
প্রশ্ন- খবরে বলা হয়েছে, হামলা দু’দফা হয়েছিলো?
উত্তর- জি¦। প্রথমে তো মনে হয়েছিলো সন্ত্রাসীরা কাজ সেরে ফিরে গিয়েছে। কিন্তু একটু পরেই হাবীব আওয়ায দিলো যে, হামলা-কারীরা ফিরে আসছে; আপনি আরেকটু নীচু হয়ে থাকুন।
হামলাকারীরা ততক্ষণ ফিরে এসে দ্বিতীয় দফা গুলিবর্ষণ শুরু করে দিয়েছে। এবার তাদের হামলা ছিলো ডানে বামে সামনে পিছনে চারো দিক থেকে।
আপনাকে একটা আশ্চর্যের কথা বলি। আমি তো বাম দিকের দরজার পাশে ছিলাম। একটি গুলি বামপাশের দরজায় ঠিক ঐ স্থানে আঘাত করলো যেখানে আমার পা ছিলো। এখনো ভেবে পাচ্ছি না যে, গুলিটা পায়ে না লেগেদরজায় কীভাবে বিদ্ধ হলো! হয়ত কোনদিনই এ রহস্য জানা যাবে না। আসলে এটা আল্লাহ্র কুদরত ছাড়া আর কিছু না।
আমি এবং আমার পরিবার যেহেতু পিছনের আসনে ছিলাম সেহেতু হামলার জোরটা পিছন দিক থেকেই ছিলো। পিছনের কাঁচ তো চুরচুর হয়ে গেলো, তারপরো গুলিবৃষ্টি চলছিলো, কিন্তু আল্লাহর কী শান! একটা গুলিও আমাদের স্পর্শ করেনি!
প্রশ্ন- ঐ সময় আপনার স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া কী ছিলো? নিষ্পাপ বাচ্চা দু’টির অবস্থাই বা কী ছিলো?
উত্তর- পৌত্র ইয়ামান হলো পাঁচ বছরের, আর পৌত্রী দীনা হলো সাত বছরের। সুতরাং তাদের তো জানাই ছিলো না যে, আসলে কী হচ্ছে। তবে চালক ও প্রহরী যখন গুলিবিদ্ধ হলো তখন ইয়ামান বুকে হাত রেখে বললো, ‘বাবা, আমার এখানে লেগেছে।
আমার তখন হতভম্ব অবস্থা, বলতে পারেন, একধরনের কেয়ামত হয়ে গেলো। ইযতিরার ও বে-কারারির হালতে আমি শুধু দু‘আ করলাম, ‘আয় আল্লাহ, আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান!’
আমি তাড়াতাড়ি ইয়ামানের জামার বুতাম খুলে দেখলাম। তখন বুঝতে পারলাম গুলিতে চূর্ণ হওয়া কাঁচের টুকরো ওর বুকে লেগেছে। কাঁচের টুরো আমার স্ত্রীর হাতেও লেগেছে। তাঁর হাতেও কোরআন ছিলো। তিনিও তিলাওয়াত করছিলেন। আলহামদু লিল্লাহ, আমার মত তারও অন্তরে কোন ভয়ভীতি ছিলো না। হামলার সময় তিনি সূরা ইয়াসীন তিলাওয়াত করছিলেন। ঠিক ঐ সময়টায় তিনি যে আয়াত তিলাওয়াত করছিলেন তা হলো-
وَجَـعَـلْنـا مِن بَـيْنِ أَيْدِيهِمْ سَدًّا وَّمِنْ خلْفِهِمْ سَدَّا فَـاَغْشَـيْـناهُمْ فَهُمْ لا يُــبْــصِرونَ
‘আমরা তাদের সামনে ও পিছনে দেয়াল তুলে দিলাম, আর তাদের চোখ ঢেকে দিলাম, ফলে তারা কিছুই দেখতে পেলো না।
সত্যি সত্যি আল্লাহ তা‘আলা আয়াতের মু‘জিযা দেখিয়েছেন। নইলে এটা অকল্পনীয় যে, এত কাছে থেকে ছোঁড়া একটা গুলিও আমাদের চারজনের কাউকে স্পর্শ পর্যন্ত করলো না!
প্রশ্ন- আপনাদের দু’টি গাড়ী ছিলো?
উত্তর- জি¦, প্রথম গাড়ীতে পিছনের আসনে ছিলাম আমি, আমার স্ত্রী এবং পৌত্র ও পৌত্রী। সামনে চালক হাবীবের পাশে ছিলো পুলিশ প্রহরী।
পিছনের গাড়ীতে ছিলো চালক আমির এবং আমার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী ছানাওবার। আমির তো গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তার অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক, পক্ষান্তরে ছানাওবার শহীদ হয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন- গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আপনার গাড়ীর চালক হাবীবের কী প্রতিক্রিয়া ছিলো?
উত্তর- হাবীবের উভয় কাঁধে গুলি লেগেছিলো, তৃতীয় গুলিটি হাতের কনুইয়ে লেগেছিলো, আর চতুর্থ গুলিটি তার চিবুক ছুঁয়ে চলে গিয়েছিলো। তার সারা শরীর খুনে ‘লতপত’ হয়ে গিয়েছিলো। এ অবস্থায়ও সে লাগাতার গাড়ী চালিয়ে গিয়েছে। আসলে সন্ত্রাসীরা চালকের মাথা লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েছিলো, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাকে রক্ষা করেছেন। তার মাথায় যদি গুলি লাগতো তাহলে তো সবই শেষ হয়ে যেতো। শেষ পর্যন্ত সে-ই গাড়ী হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছে।
প্রশ্ন- হামলাকারীরা কখন ফিরে গেলো?
উত্তর- আসলে তারা গাড়ীর গতির সঙ্গে পেরে উঠেনি। একসময় দেখা গেলো, তারা পিছনে পড়ে গিয়েছে, আমরা আগে চলে এসেছি।
প্রশ্ন- চালক হাবীবের শারীরিক অবস্থা তখন কেমন ছিলো?
উত্তর- তার অবস্থা তখন খুবই আশঙ্কাজনক ছিলো। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তার বাঁ হাত অবশ হয়ে গিয়েছিলো। এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে রাখা তার জন্য কষ্টকর হচ্ছিলো। আমি তখন বললাম। তুমি পিছনে এসে পড়ো। আমি নিজেই গাড়ী চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
সে অস্বীকার করে বললো, হযরত, এটা কিছুতেই হতে পারে না। আপনার জীবন এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। হামলাকারীরা আবার ফিরে আসতে পারে। এ অবস্থায় গাড়ী থামিয়ে আমি কোন ঝুঁকি নিতে পারি না। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি পিছনেই বসে থাকুন।
এর মধ্যে ওর ডান হাতও অবশ হয়ে আসছিলো। তারপরো সে কোন না কোন ভাবে লিয়াকত নেশনাল হাসপাতাল পর্যন্ত গাড়ী পৌঁছিয়ে তবে দম নিয়েছিলো।
প্রশ্ন- হাসপাতালকর্তৃপক্ষের আচরণ কেমন ছিলো?
উত্তর- তাদের আচরণ ছিলো খুবই সহমর্মিতাপূর্ণ। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত অবস্থায় গাড়ী চালানোর কারণে চালক হাবীব নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলো। জরুরি বিভাগের লোকজন ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তাকে চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার কাজ শুরু করেছিলো। আমি প্রথমেই প্রহরীর স্ট্রেচারের দিকে গেলাম এবং ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলাম যে, তার বর্তমান অবস্থা কী? আমি আশাবাদী ছিলাম যে, হয়ত সে এখনো বেঁচে আছে। কিন্তু ডাক্তার জানালেন, সে এখন এ দুনিয়ায় নেই। মাথায় গুলি লাগার কারণে পথেই সে শাহাদাত লাভ করেছে।
চালক হাবীব সম্পর্কে ডাক্তার জানালেন, তার অপারেশন হবে এবং তার অবস্থা ঝুঁকিমুক্ত।
এর মধ্যে হাসপাতালের প্রধান উপস্থিত হলেন এবং হামদর্দি প্রকাশ করলেন। আমি তাকে বললাম, জুমার নামায আদায় করতে চাই।
তিনি আমাকে হাসপাতালের মসজিদে নিয়ে গেলেন। তখন খুতবার আযান হচ্ছিলো। সেখানেই জুমা আদায় করলাম। একঘণ্টার মত সময় আমি হাসপাতালে ছিলাম।
প্রশ্ন- এর মধ্যে ঘটনার খবর দিয়ে কোথাও ফোন করেননি?
উত্তর- আমি যেহেতু জুমা পড়ানোর জন্য বাইতুল মুর্কা-রাম মসজিদে যাচ্ছিলাম। সেখানে সবাই আমার অপেক্ষায় ছিলো। তাই হামলার পরপর পথের মধ্যেই ফোন করে তাদের জানালাম যে, অপ্রীতিকর একটি ঘটনার কারণে আমি আসতে পারছি না। এছাড়া আর কাউকে ফোন করিনি।
প্রশ্ন- এত দীর্ঘ সময় ধরে সন্ত্রাসীদের হামলা হলো। পুলিশ আসেনি?
উত্তর- ঘটনাস্থলে তো পুলিশের দেখা পাইনি। তবে হাসপাতালের পথে পুলিশ মুবাইলের দেখা পেয়েছিলাম। সেখানে গাড়ী থামিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে যখন বললাম, আমাদের চালক গুরুতর আহত। আপনাদের কেউ একজন যদি গাড়ী চালিয়ে আমাদের হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছে দেন, বড় উপকার হয়। কিন্তু পুলিশ কর্মকর্তা অত্যন্ত অনুভূতিহীনতার পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনারা নিজেরাই হাসপাতালে যাওয়ার আমি চিন্তা করলাম, এদের সঙ্গে কথা বলার অর্থ সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু না। তখন তো প্রতিটা মুহূর্ত ছিলো মূল্যবান। সৌভাগ্যক্রমে রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা ছিলো। দশ মিনিটের মধ্যেই চালক হাবীব প্রায় বেহুঁশ অবস্থায় আমাদের হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলো।
প্রশ্ন- শুনেছি, অনেক দিন থেকে আপনাকে হুমকি দেয়া হচ্ছিলো?
উত্তর- সম্প্রতি তো কোন রকম হুমকি কোন পক্ষ হতে পাইনি। দু’ আড়াই বছর আগে অবশ্য হুমকি আসতো। তবে এগুলো আমি কখনোই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করিনি। তাই প্রশাসনকেও জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। আমি মনে করি, হুমকিদাতারা নিজেদের যে দল ও সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে দাবী করতো, তার সঙ্গে তাদের আদৌ কোন সম্পর্ক ছিলো না। অর্থাৎ আমার ধারণায় এগুলো ছিলো ভুয়া হুমকি।
প্রশ্ন- কী ধরনের হুমকি দেয়া হতো এবং কোন মাধ্যমে?
উত্তর- সাধারণত বেনামা চিঠির মাধ্যমে। কখনো বলা হতো, ‘আমি দাইসের কমান্ডার। আপনার কর্মকা- ঠিক নয়। আমরা আপনাকে ছাড়বো না।
প্রশ্ন- কোন কর্মকা-?
উত্তর- আমি শুরু থেকেই দেশের মধ্যে সশস্ত্র কর্মকা- এবং আত্মঘাতী হামলার বিরোধিতা করে এসেছি। সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়ে থাকবে।
কখনো টি টি পি-এর নামেও হুমকিমূলক চিঠি আসতো। অথচ টি টি পি এর পক্ষ হতে বলা হতো, এসবের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। দু’একবার লোকাল নম্বর থেকে ফোন এসেছে যে, আপনার সময় শেষ। আমি শুধু শান্ত কণ্ঠে বলতাম, সবকিছুর মালিক তো আল্লাহ্।
প্রশ্ন- জীবননাশের হুমকি, অথচ আপনি গুরুত্ব দেননি?!
উত্তর- না। আমার ভিতর থেকে গুরুত্ব দেয়ার তাগাদা আসেনি।
প্রশ্ন- তাহলে সিন্ধের গভর্নর ইমরান ইসমাঈল কিসের ভিত্তিতে বলে দিলেন যে, সম্প্রতিও আপনাকে হুমকি দেয়া হচ্ছিলো?
উত্তর- আমার খেয়ালে গভর্নর সাহেবের কোন কারণে ভুল ধারনা হয়েছে। আসলে যখন আলিমদের সিকিউরিটি তুলে নেয়া হলো তখন আমাদের বেফাকুল মাদারিসের কোন কোন যিম্মাদার প্রশাসনকে এই বলে সতর্ক করেছিলেন যে, কতিপয় আলিমকে এখনো হুমকি দেয়া হচ্ছে। হয়ত এ প্রেক্ষাপটেই গভর্নর সাহেব উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন। তবে আমার জানা নেই। হামলার পর তিনি কুশল জানার জন্য এসেছিলেন। এ সৌজন্য সাক্ষাতের আগে তো তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি।
প্রশ্ন- আপনার কাছে সরকারী সিকিউরিটি কী পরিমাণ ছিলো?
উত্তর- শুরুতে আমার কাছে কোন সিকিউরিটি ছিলো না। বছরখানেক আগে শুধু একজন সিপাহী দেয়া হয়েছিলো। আমি ভাবলাম ফিরিয়ে দেবো। কারণ আমার আসা-যাওয়া এমনিতেই কম, তাছাড়া নিজস্ব দেহরক্ষীও রয়েছে। কিন্তু কাছের লোকেরা একমত হয়নি বলে ফিরিয়ে দেয়া হয়নি।
সরকার যখন আলেমদের থেকে সিকিউরিটি প্রত্যাহার করে নিলো তখন আমার একমাত্র সিপাহীকেও তুলে নেয়া হলো। কিন্তু এর পর কী কারণে যেন একদিনের মাথায় একজনের পরিবর্তে দু’জন সিপাহী দেয়া হলো। এর মধ্যে হামলার আগের দিন একজনকে প্রত্যাহার করে নেয়া হলো। সুতরাং হামলার সময় আমার সঙ্গে ছিলো একজন সিপাহী মুহাম্মদ ফারূক, যে শহীদ হয়ে গেলো।
সাধারাণত বলা হয়, মানুষের ষষ্ঠেন্দ্রিয় আগাম অনেক কিছু বলে দেয়। আপনার কি এমন কিছু হয়েছিলো?
উত্তর- বিলকুল না। আপনাকে আমি সত্য বলছি, যখন গুলিবৃষ্টি হচ্ছিলো তখনো আমার দিলে পুরা ইতমিনান ছিলো যে, এসব গুলি আমার গায়ে লাগবে না। ইতমিনানের কারণ তো বলতে পারবো না, ব্যস বিশ্বাস ছিলো যে, আল্লাহ আমার হেফাযত করবেন।
প্রশ্ন- বলা হচ্ছে, হামলা অত্যন্ত পরিকল্পিত ছিলো এবং পূর্ণ রেকি করার পরই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিলো?
উত্তর- আমারও তাই মনে হয়। দেখুন, ঐ দিন আমার জুমা পড়ানোর কথা ছিলো না। এমনকি সবার জানা ছিলো, ঐ দিন আমি করাচী থাকছি না। মুলতানের জন্য বিমানে আমার সিট বুক করা হয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ ফ্লাইট বাতিল হয়ে গেলো, আর আমার মুলতান যাওয়া সম্ভব হলো না। কিন্তু খুব কম লোকেরই এটা জানা ছিলো। সবাই ধরে নিয়েছিলো, আমি মুলতান চলে গিয়েছি। কিন্তু হামলাকারীদের কাছে নির্ভুল তথ্য ছিলো।
পরে জানা গিয়েছে, নিশ্চিত হওয়ার জন্য সেদিন বারটার দিকে কিছু অজ্ঞাত ব্যক্তি দারুল উলুম এসে আমার খোঁজ নিয়েছে।
প্রশ্ন- আপনার মতে ফ্লাইট বাতিলের বিষয়টা খুব কম মানুষের জানা ছিলো। এর মধ্যে কি বাইরের মানুষও ছিলো?
উত্তর- সেটাই স্বাভাবিক। কারণ মুলতানে খবর পাঠানো হয়েছিলো যে, ফ্লাইট বাতিল হওয়ার কারণে আমার আসা হচ্ছে না।
প্রশ্ন- হামলার তদন্তের বিষয়ে আপনাকে কি আস্থায় নেয়া হয়েছে? আপনি কি তদন্ত প্রক্রিয়ায় আশ্বস্ত?
উত্তর- অবশ্যই। আমাকে সব বিষয় অবহিত করা হচ্ছে। আমি মনে করি, পূর্ণ তৎপরতার সঙ্গেই তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কয়েকটি সংস্থা যৌথভাবে তদন্ত পরিচালনা করছে। কিছু কথা এখানে বলা সম্ভব হচ্ছে না। তদন্তের স্বার্থে অফ দি রেকর্ড রাখতে হচ্ছে। তবে আমি আশ্বস্ত আছি যে, তদন্ত সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে।
প্রশ্ন- এ হামলাকে আপনি কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন?
উত্তর- আমি আগেও বলেছি, আমার উপর পরিচালিত এই ‘কাতিলানা’ হামলাকে সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা কিছুতেই ঠিক হবে না। বাহ্যত এটা ছিলো দেশের দুশমনদের ষড়যন্ত্র। তারা চেয়েছিলো পাকিস্তান দিবসে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে। আল্লাহ তা‘আলা সে অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছেন। তবে এর পুরো কৃতিত্ব আমার শহীদ ও যখমী সঙ্গীদের। আল্লাহ্ তাদের উত্তম বিনিময় দান করুন।
প্রশ্ন- সন্ত্রাসীদের আপনি কী বার্তা দিতে চাইবেন?
উত্তর- তাদের বলবো, ভুল পথ ছেড়ে শান্তির পথে ফিরে আসতে। তাদের আরো বলবো, অস্ত্রের ভাষায় কথা না বলে যুক্তির ভাষায় কথা বলতে। আল্লাহ যেন তাদের হেদায়াত নছীব করেন।
হঠাৎ গুলিবৃষ্টি শুরু হলো। বহু গুলি খুব নিকট দিয়ে গেলো, কিন্তু একটি আঁচড়ও লাগেনি। মারাত্মক আহত অবস্থায়ও চালক চূড়ান্ত সাহসের পরিচয় দিয়ে গাড়ী চালিয়ে গিয়েছেন। সঙ্গিদের শাহাদতের কারণে আমি বেদনাহত। আশ্চর্য, ফ্লাইট ক্যান্সেল হওয়ার খবর হামলাকারীরা কীভাবে জানলো?
একটি গুলি বামপাশের দরজায় ঠিক ঐ স্থানে আঘাত করলো যেখানে আমার পা ছিলো। এখনো ভেবে পাচ্ছি না যে, গুলিটা পায়ে না লেগে দরজায় কীভাবে বিদ্ধ হলো! হয়ত কোনদিনই এ রহস্য জানা যাবে না।
এ হামলা আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে ছিলো, তবে সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। এটা ছিলো দেশবিরোধীদের ষড়যন্ত্র।
অনুবাদ- আফনান বিন সালমান
যারা আমার উপর হামলা করেছে, আমি তাদের কল্যাণ কামনা করি। তাদের সত্যের পথে, হিদায়াতের পথে আসার আহ্বান জানাই।
সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় ইমামুল হারামের টেলিফোন এলো, তিনি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শায়খুল ইসলামের কুশল জানতে চাইলেন। তিনি বললেন, আল্লাহ গায়বী কুদরত দ্বারা আপনাকে হিফাযত করেছেন।
মৃত্যুর হুমকিকে গুরুত্ব দেয়ার কিছু নেই। কারণ তাকদীর ফায়ছালা করে রেখেছে, কার মৃত্যু কখন হবে এবং কীভাবে হবে।
আঘাত শুধু প্রত্যাঘাতের পথ তৈরী। আঘাত ও সঙ্ঘাত এবং হিংসা ও প্রতিহিংসা অন্তত এ যুগে কারো জন্যই কোন কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না।