রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩)

টেকনাফ ও তেতুলিয়া (স্বদেশ)

টিপাইমুখ বাঁধ, কিছু কথা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে দেশে সরকার ও বিরোধীদল বলতে গেলে বাকযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। তা দেখে সম্ভবত আমাদের বন্ধুদেশ ‘মুখ টিপে’ হাসছে। পিনাক সাহেব তো ভুলেই গেছেন যে, কূটনৈতিক রীতিনীতি ও শিষ্টাচার বলেও সভ্যজগতে কিছু আছে। মনের সুখে তিনি যখন যা খুশী বলেই যাচ্ছেন। রমেশ চন্দ্র সেন নাম দেখে কেউ যেন ভেবে না বসেন, তিনি ভারতের মন্ত্রী। জ্বি না, তিনি বাংলাদেশের পানিসম্পদমন্ত্রী। সাংবাদিক সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আগে টিপাইমুখ বাঁধ হোক, তারপর দেখা যাবে, বাংলাদেশের জন্য তা ক্ষতিকর কি না!’ অর্থাৎ যেমন ফাঁরাক্কা বাঁধ তৈরী হওয়ার পর আমরা বুঝতে পারছি! তিনি আরো বলেছেন, সব বাঁধ ক্ষতি করে না, টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের ক্ষতি নাও হতে পারে। বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘টিপাইমুখ প্রকল্প হবে ফাঁরাক্কা বাঁধের মত আরেকটি মরণফাঁদ।’ সরকারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন, ‘জোরালো প্রতিবাদ করুন জাতীয় স্বার্থে আমরা সরকারের পাশে থাকবো।’ সরকার কিন্তু তার ব্যতিক্রমী এই সহযোগিতা প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়নি, বরং অসংযতভাবে তাকে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছে। অর্থাৎ টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে কিছু বলা যেন এখন অপরাধ। তবে ফারহাদ মাযহারের কথা সত্য যে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এখন টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে। আমরা অনেকেই জানি না, টিপাইমুখ বাঁধ আসলে কি এবং কেন এর বিরোধিতা? তাই এখানে সংক্ষেপে বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশ ভাটির দেশ। আমাদের প্রায় সকল নদী উজানের দেশ ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক নদী আইনে উজানের দেশ ভাটির দেশের সম্মতি ছাড়া এবং তার স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে নদীতে বাঁধ দিতে পারে না। কিন্তু ভারত তাই করে চলেছে। ভারতের গঙ্গানদী বংলাদেশে প্রবেশ করে পদ্মা নাম ধারণ করেছে। ভারত গঙ্গা নদীতে ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে হুগুলি নদীতে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ফলে শুকনো মৌসুমে পদ্মা হয়ে পড়ে পানিশূন্য, আবার বর্ষা মৌসুমে বাঁধের মুখ খুলে দেয়ার কারণে দেশ ডুবে যায় বন্যায়। বরাক নদীর উৎপত্তি ভারতের মুনিপুর রাজ্যে। মুনিপুর, মিজোরাম ও আসাম রাজ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সিলেটের জাকিগঞ্জ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশকালে তা সুরমা ও কুশিয়ারা নামে বিভক্ত হয়েছে। নদীদু’টি হবিগঞ্জের মারকুলির কাছে একত্র হয়ে প্রথমে কালনী ও পরে মেঘনা নাম ধারণ করেছে। চাঁদপুরের কাছে এসে মেঘনা, যমুনা ও পদ্মার স্রোতধারা একত্র হয়ে মেঘনা নামে সাগরে পড়েছে। মুনিপুর রাজ্যের উৎসমুখ থেকে সাগরসঙ্গম পর্যন্ত নদীপথের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৯৪৬ কিলোমিটার। তার মধ্যে ভারতীয় অংশ হলো ২৭৭ কিলোমিটার, অর্থাৎ একতৃতীয়াংশেরও কম। এখন ভারত যদি টিপাইমুখ বাঁধ তৈরী করে তাহলে পানি ও নদী বিশেষজ্ঞগণ তথ্য-উপাত্তযোগে প্রমাণ করেছেন যে, মেঘনা অববাহিকার তিনভাগের দুই ভাগ পানি থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে, ফলে মেঘনা নদীতে সামান্য তলানি ছাড়া কোন পানি থাকবে না। তাতে মেঘনানদীর মোহনায় মিষ্টি পানির গভীরতা কমে যাবে এবং সমুদ্রের নোনা পানি দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে প্রায় সিলেট পর্যন্ত চলে আসবে। এতে প্রায় ষোলটি জেলা মরুভূমিতে পরিণত হবে। এবং সংশ্নিষ্ট অঞ্চলের জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে এবং পরিবেশভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। সর্বোপরি ভূগর্ভের পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নীচে নেমে যাবে ফলে নলকূপে কোন পানি পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে বর্ষা মৌসুমে বাঁধের উজানে প্রবল বৃষ্টিপাত হলে বাঁধের মুখ ছেড়ে দেয়ার কারণে এখানে ভাটিতে নদীভাঙ্গন ও ভূমিধ্বস অনেক বেড়ে যাবে এবং মেঘনা নদী ভরাট হয়ে যাবে। ফলে সামান্য বৃষ্টিপাতেই এখানে বন্যা দেখা দেবে। সবচে’ আশাংকার বিষয় এই যে, টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা হচ্ছে বিশ্বের ভয়াবহতম ভূমিকম্পের এলাকা। এখানে বিগত একশ দশ বছরে বিশটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। তার মধ্যে ১৮৯৭ সালে সিলং ভূমিকস্প ছিলো ৮.৭ মাত্রার এবং ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্প ছিলো ৭.৬ মাত্রার। বাঁধের কারণে টিপাইমুখে ৫০০ ফুট গভীর জলাধার তৈরী হবে। ফলে তলদেশের প্রতি বর্গমিটার মাটির উপর ১৬০ টনের বেশী চাপ পড়বে, যা ভূমিকম্পকে তন্বিত করবে। এ অবস্থায় যদি ভূমিকম্পের কারণে অশস্মাৎ বাঁধ ভেঙ্গে যায় তাহলে তিনকোটি মানুষের স্রেফ সলীল সমাধি ঘটবে। ফাঁরক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। এখন টিপাইমুখ বাঁধের মাধ্যমে মেঘনার পানি সরিয়ে নিলে মেঘনা অববাহিকার বিস্তীর্ণ ্‌অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করবে। তথ্য-উপাত্তের এই ভয়াবহ চিত্রের পর যদি আমাদের পানিসম্পদমন্ত্রী রমেশ বাবু বলতে চান, টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের জন্য প্রভূত কল্যাণ বয়ে আনবে তাহলে আমরা প্রস্তাব করবো ...।
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা