সফর ১৪৩১ হি:(১৫)

টেকনাফ ও তেতুলিয়া (স্বদেশ)

প্রধানমন্ত্রী, কী পেলেন আপনি?!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকে কেন্দ্র করে যুগপৎ দেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সরকারী দল এবং তাদের অুনগত গণমাধ্যম ও তথাকথিত সুশীল সমাজ প্রধানমন্ত্রীর সফর শতভাগ সফল হয়েছে বলে দাবী করেছেন। অন্যদিকে বিরোধীদল সরাসরি অভিযোগ আরোপ করে বলেছে, শেখ হাসিনা ভারতের কাছে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছেন। কারো কারো মতে ভারত বিগত আটত্রিশ বছরে যা আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তার চেয়ে অনেক বেশী দিয়ে এসেছেন। অন্যদিকে খোদ ভারতীয় মিডিয়া উল্লাস প্রকাশ করে লিখেছে, ’বাংলাদেশের গত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় ভারতের জন্য দারুণ সুসময় বয়ে এনেছে এবং বাংলাদেরশের প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে ভারত প্রাপ্ত সুযোগগুলো দু’হাতে লুফে নিয়েছে।’

ভারতীয় কর্মকর্তারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলেছেন, ‘আমরা ঠিক যেভাবে চেয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই সবকিছু হয়েছে।’

দু'দেশের পক্ষ হতে প্রকাশিত যৌথ ইশতিহার মতে বাংলাদেশ ভারতকে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে দেবে। বাংলাদেশের উপর দিয়ে সড়ক, রেল ও নৌপথে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য আনা-নেয়া করতে পারবে।

বিশেষজ্ঞদের আশংকা, এই ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ফলে বাংলাদেশ ভারতের উত্তর- পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর স্বাধীনতকামী যোদ্ধাদের আক্রমণের শিকার হবে। কেননা  পুরো মাত্রায় আশঙ্কা রয়েছে যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহ দমনের জন্য বাংলাদেশের  বুকের উপর দিয়ে ভারত সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনা-নেয়া করবে।অর্থাৎ বাংলাদেশ ইচ্ছে করেই একটি ‘সশস্ত্র উপদ্রব’ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তাছাড়া যে তিনটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে তার খোলাসা কথা হলো, উভয় দেশ সন্ত্রাস দমন এবং সন্ত্রাসী ও জঙ্গীগোষ্ঠীকে পাকড়াও করার জন্য একযোগে কাজ করবে। বলাবহুল্য যে, এতে ভারতীয় সন্ত্রাস বাংলাদেশেও বিস্তার লাভ করবে। কারববিদ্রোহীরা বাংলাদেশে ঢুকে ভারতের সরবরাহ লাইন অকেজো করে দেয়ার জন্য সশস্ত্র হামলা চালাতে পারে। তখন ভারত হয় আমাদের চাপ দেবে, যেন আমরা নিরপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করি, আর না হয় ভারতীয় বাহিনীকে ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ দেই। বলাহুল্য যে, দু'টো বিষয়ই আমাদের জন্য হবে আত্মঘাতী। সেভেন সিস্টারের বিদ্রোহী গ্রুপগুলো ইতিমধ্যেই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশকে তার বর্তমান অবস্থানের জন্য চড়া মূল্য দিতে হবে।

ট্রানজিট প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থা এমনিতেই যথেষ্ট দুর্বল। সুতরাং ভারতীয় ভারী যানবাহনের চাপে বাংলাদেশের নরম মাটির সড়কগুলো অল্প সময়েই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে। ফলে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়বহুল দায় আমাদের উপর চেপে বসবে।

বিশেষজ্ঞগণ আরো বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনারজট সামলাতে যেখানে আমরা হিমশিম খাচ্ছি, সেখানে ভারতের এতগুলো নিজস্ব বন্দর থাকার পরও কেন আমরা তাদের বিশাল পণ্য বহনের চাপ বরদাশত করবো? এতে আমাদের লাভ কোথায়? সামান্য কিছু ভাড়া! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে ‘না চাইতেই বৃষ্টি’র মত ভারতের আরেকটি প্রাপ্তি হলো, নিরাপত্তাপরিষদে স্থায়ী ও অস্থায়ী সদস্যপদের প্রার্থিতায় ভারতের প্রতি বাংলাদেশের আগাম সমর্থন প্রদান। এটাকে অনেকেই আত্মাঘাতী পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের বক্তব্য হলো, একদিকে এটা যেমন স্বাভাবিক কূটনৈতিক প্রক্রিয়াবিরোধী তেমনি অন্যদিকে নতজানু ও দিল্লীমুখী পররাষ্ট্রনীতির বহিঃপ্রকাশ। তারা আরো বলেছেন, বাংলাদেশের সবচে’ বড় দাতাদেশ জাপানও  নিরাপত্তা- পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ লাভের জন্য আগ্রহী। সুতরাং বাংলাদেশের এরকম প্রকাশ্য অবস্থান জাপানকে ক্ষুব্ধ করতে পারে; তদুপরি ভারতীয় প্রার্থিতার ঘোরতর বিরোধিতাকারী চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও টানাপড়েন সৃষ্টি হতে পারে।

এবার আমরা দেখতে চাই ভারতের এই অফুরন্ত প্রাপ্তির বিপরীতে আমাদের বিচক্ষণ ও দেশঅন্তপ্রাণ প্রধানমন্ত্রী তার দেশের জন্য কী কী প্রাপ্তি বয়ে এনেছেন?

পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য, ভারতের সকল চাওয়া-চাহিদা পূর্ণ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার দেশের জন্য নিয়ে এসেছেন ‘একঝুড়ি আশ্বাস’! প্রধানমন্ত্রীর বাবা সেই কবে বেরুবাড়ী দান করে জান্নাতবাসী হয়েছেন, কিন্তু প্রতিশ্রুত তিনবিঘা আমরা পাইনি। সেই দূর অতীতের বিস্মৃতপ্রায় প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার পূর্ণ আশ্বাস আমরা পেয়েছি প্রধানমন্ত্রীর ভারতসফরের প্রথম ‘সন্দেশ’রূপে।

ফারাক্কা বাংলাদেশের জন্য জীবন- মরণ সমস্যা, একথা বোধকরি ঘোর ভারতপ্রেমিক বুদ্ধিজীবিরাও স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। ফারাক্কার অভিশাপে দেশের    বিস্তৃত অঞ্চল আজ প্রায় মরুভূমি হতে চলেছে। গঙ্গায় কত জল প্রবাহিত হয়, বাংলাদেশে আসে না, এমনকি চুক্তি-পরিমাণ পানিও আমরা পাই না। তার উপর এখন যুক্ত হতে যাচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। এ বিষয়ে বিশাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিশাল একটি আশ্বাস দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষতি হয়, টিপাইমুখ বাঁধে ভারত এমন কিছু করবে না,’ (যেমন করেনি ফারাক্কাবাঁধেরও ক্ষেত্রে!)

তিস্তার পানিবন্টন সমস্যাটি অবশ্য আলোচনায় এসেছে, তবে কোন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবর্তে যথারীতি তা ছেড়ে দেয়া হয়েছে যৌথনদীকমিশনের হাতে, যেখানে দীর্ঘ ৩৭ বছরেও কোন সমঝোতায় আসা সম্ভব হয়নি।

অর্থাৎ একদিকে দিতে দিতে আমাদের নাভিশ্বাস, অন্যদিকে প্রাপ্তি শুধু আশ্বাস, আর আশ্বাস! এই হলো প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, আপনিই বলুন, এত কিছু দিয়ে আপনি কী পেলেন? শুনেছি, আপনি বলেন, নগদ প্রাপ্তি হচ্ছে একশ কোটি ডলার বা সাতহাজার কোটি টাকার (সুদসহ) ‘ঋণসহায়তা’, যা আমাদের বেশ উপকারে আসবে।

হায়, কত সহজ-সরল আপনি হে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী! আপনার বাবা কিন্তু এতটা সরল ছিলেন না! না!৭

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা