২৩শে সেপ্টেম্বর/ শনিবার রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে যে মামলা দায়ের করা হয়েছিলো আন্তর্জাতিক গণআদালতে, ব্যাপক তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম পরিচালনা শেষে গণআদালত গতকাল তার রায় প্রকাশ করেছে। গত ১৮ই সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে পার্মানেন্ট পিপলস ট্রাইবুনাল (পিপিটি) নামের গণআদালতে এই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রায় জারি করা হয়। রায় ঘোষণার আগে আদালতে দুইশর উপর নির্যাতন, হিং¯্রতা, নৃশংসতা ও যৌননির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা নারীপুরুষ এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠীর কিছু মানুষের জবানবন্দী গ্রহণ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন তথ্যচিত্র ও বিশেষজ্ঞমতামত পর্যালোচনা করা হয়। আদালতে মোট পাঁচদিন ধরে শুনানি চলে। আদালত তার রায়ে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সূ চী এবং সেনাপ্রধান মিন অং লাইং- সহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে অপরাধী ও দোষী সাব্যস্ত করেছে। গতকাল শুক্রবার আন্তর্জাতিক অপরাধ তদন্তে যুক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত সাতসদস্যের বিচারক প্যানেল প্রতীকী এই রায় ঘোষণা করেন। এই রায় প্রকাশের পর সূ চীই হলেন প্রথম কোন নোবেলজয়ী যিনি গণআদালতে বিচারের সম্মুখীন এবং দোষী সাব্যস্ত হলেন। অবশ্য প্রতীকী বিচারের এই রায় কার্যকর করার আইনি ক্ষমতা গণআদালতের নেই। রায় পড়ে শোনান ট্রাইব্যুনালের সভাপতি (আর্জেন্টিনার সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা) দানিয়েল ফিয়েরেস্তে ইন। রায় ঘোষণাকালে ‘মাননীয়’ প্রধান বিচারক বলেন, মিয়ানমার সরকার গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে করা অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। মিয়ানমারে বাসকারী কাচীন এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অপরাধে সমর্থন দানের মাধ্যমে প্রধান দোষী হচ্ছেন রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সূ চী। রায় ঘোষণার পর সুফারিশ উপস্থাপনকালে বলা হয়, ট্রাইব্যুনালের অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য ও সুফারিশ অবশ্যই আন্তর্জাতিক মহল ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানানো হবে। যাতে সেগুলোর আলোকে তারা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। উল্লেখ্য ১৯৭৯ সালে ইতালিতে ৬৬ জন বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে সদস্য করে পার্মানেন্ট পিপল ট্টাইব্যুনাল (পিপিটি) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই এ উদ্যোগ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। বিশেষ করে মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এ উদ্যোগকে াস্বগত জানান। যে ৬৬ জন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তারা সকলেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিজীবন অত্যন্ত উজ্জ্বল ও পরিচ্ছন্ন। উদ্যোগটির গ্রহণযোগ্যতার পিছনে এটি ছিলো বড় একটি কারণ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই আদালতে বিভিন্ন মামলায় ৪৩টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণআদালতের রায় আইনি বাধ্যবাধকতামুক্ত হলেও বিশ্বজনমত তৈরীর পিছনে বিপুল ভূমিকা পালন করে থাকে। বসোনিয়া ও হার্জেগোভিনিয়ার গণহত্যার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গণআদালতের তদন্ত ও রায় পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভুমিকা রেখেছে বলে ওয়াকিফহাল মহল মনে করেন। উল্লেখ ্য, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আদালত প্রায় দুই দশক আগে সঙ্ঘটিত বসোনিয়া ও হার্জেগোভিনার মুসলিমগণহত্যার বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করে বিভিন্ন সাজা প্রদান করে। সাজাপ্রাপ্ত যারা বেঁচে আছে ইতিমধ্যে তাদের উপর সাজা কার্যকর করা শুরু হয়েছে। সর্বশেষ সাজা হয়েছে গণহত্যায় অভিযুক্ত সাবেক বসোনিয়ার সার্ব কমান্ডার রাতকো ম্লাদিচ-এর। তাকে ¯্রেেব্রনিসায় গণহত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদ- প্রদান করা হয়েছে গত২২শে নভেম্বর বুধবার। ১৯৯৫ সালের ১১ই জুলাই ম্লাদিচের সার্ববাহিনী ¯্রেেব্রনিসা শহরে হামলা চালায়। অথচ সার্বিয়ার সীমান্তে অবস্থিত শহরটিকে জাতিসঙ্ঘ নিরাপদ অঞ্চল বলে ঘোষণা করেছিলো। তিনি শহরের সব পুরুষ ও বালককে হত্যা করেন এবং নিজে উপস্থিত থেকে হত্যাদৃশ্য উপভোগ করেন। আন্তর্জাতিক মহল আশা প্রকাশ করছেন মিয়ানমারে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকারীদের যে বিচার আন্তর্জাতিক গণআদালতে অনুষ্ঠিত হয়েছে সেটা এখনকার জন্য শুধু শুরু। একদিন এরই ধারাবাহিকতায় এই অপরাধীরা অবশ্যই বিচার এবং সাজার সম্মুখীন হবেন।
গণআদালতের কিছু প্রস্তাব
আন্তর্জাতিক গণআদালত শুধু প্রতীকী রায় ঘোষণা করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেনি, বরং রায় ঘোষণার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে ১৭ দফা সুফারিশও পেশ করেছে। অস্ট্রেলিয়াল সিডনির মেকুইয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক প্রধান, বিচারক গিল এইচ বোয়েরিঙ্গার সুফারিশগুলো উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, * মিয়ানমারে রোহিঙ্গা, কাচীন ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ
তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য জাতিসঙ্ঘের তথ্য অনুসন্ধান দলকে অবশ্যই সে দেশে সহজ ও অবাধ প্রবেশাধিকার দিতে হবে। * মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই সংবিধান সংশোধন করতে হবে এবং নিপীড়িত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্যমূলক আইনের সংস্কার করতে হবে। * রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তাদের নাগরিক পরিচয় ও নাগরিকত্ব এবং সর্বপক্রার নাগরিক সুবিধা ফিরিয়ে দিতে হবে।