কিছুটা হলেও বিশ্ব-সম্প্রদায়ের চাপের মুখে মিয়ানমার সরকারের অলিখিত প্রধান অং সান সূ চী ‘রাখাইন’ রাজ্যের রোহিঙ্গাসঙ্কট সমাধানের কথা বলে জাতিসঙ্ঘের সাবেক মহাসচীব কফী আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন। এটা ছিলো সম্ভবত জুলাইয়ের ঘটনা। কমিশনে ছয়জন সদস্য ছিলো মিয়ানমারের এবং লেবানন ও নেদারল্যান্ডের একজন করে নাগরিক। দেখাই যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে কোন সদস্য নেয়া হয়নি। যেন বাংলাদেশ উদ্ভুত সঙ্কটের কোন পক্ষ নয়! আমাদের ‘মাদার অব হিউমিনিটি’ কী বুঝতে পারছেন কত অবজ্ঞা আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের প্রতি?! যাক, আনান কমিশন (২৪শে আগস্ট) যথাসময়ে ৮৮ দফা- সম্বলিত তার সুফারিশমালা অং সান সূ চী-এর কাছে অর্পণ করেছেন। প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা বা বাঙ্গালী শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। বলা হয়েছে ‘রাখাইনের মুসলিম সম্প্রদায়’। বলাই বাহুল্য, এটা করা হয়েছে মিয়ানমারের জান্তাকে খুশী করার জন্য, অন্তত তাকে অখুশী না করার জন্য। ন্যায় ও সত্যকে এবং জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকারের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়নি। এমনকি সুফারিশের মূল বিষয়গুলোতেও যথেষ্ট পরিমাণ স্বচ্ছতা রাখা হয়নি এবং রোহিঙ্গাদের বৈষম্য থেকে রক্ষার কোন নিশ্চয়তা রাখা হয়নি। কারণ এতে মোটাদাগে যে কথাটি বলা হয়েছে তা হলো ‘নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী রাখাইনের বাসিন্দাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। অথচ সমস্ত জটিলতা ও অন্যায়ের মূল হচ্ছে ঐ নাগিরকত্ব আইন! তারপরো কেউ কেউ মনে করেন, আনান কমিশনের সুফারিশমালা সঠিক অর্থে বাস্তবায়িত হলে রোহিঙ্গাসঙ্কটের মোটামুটি একটা সম্মানজনক স্থায়ী সমাধান হবে বলে আশা করা যায়। কত দূর কী হবে সে সম্পর্কে এখনই আমরা কিছু বলতে চাই না, আশা বা হতাশা কোনটাই প্রকাশ করতে চাই না। আমরা সবকিছু ভবিষ্যতের আয়নায় দেখতে চাই এবং ভবিষ্যতের কাছ থেকেই শুনতে চাই।ইতিমধ্যেই কিন্তু আনান কমিশনের সুপারিশমালা হিমাগারে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহলের অব্যাহত চাপের মুখে সূ চী গত ১৩ই সেপ্টেম্বর আনান কমিশনের সুফারিশমালা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ হতে এ ঘোষণাটি আসে নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তাপরিষদে রোহিঙ্গাসঙ্কট নিয়ে জরুরি বৈঠক বসার ঠিক পূর্বমুহূর্তে।পনের সদস্যের ঐ কমিটির চেয়ারম্যান হলেন সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মিয়াত আয়। কো-চেয়ারম্যান হলেন রাখাইনরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নি পু।কমিটির কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ এই কমিটি আনান কমিশনের সুফারিশ বাস্তবায়নে কাজ করবে। আর তা হচ্ছে উপদ্রুত অঞ্চলের জাতিগত গ্রামগুলোতে নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেয়া। নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে দেশের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী যাচাই কার্যক্রমে গতি আনার চেষ্টা করা।একই সঙ্গে এ কমিটির আরেকটি দায়িত্ব হচ্ছে রাখাইনে সহিংসতার অভিযোগ তদন্ত করার জন্য গঠিত স্থানীয় কমিশনের সুফারিশ -গুলোর বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। উল্লেখ্য, এ কমিটির প্রধান হলেন (বিতর্কিত) ভাইস প্রেসিডেন্ট জেনারেল মিন্ট সু। এই কমিটির অধিকাংশ সুফারিশ রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যমূলক হওয়ার কথা। ফলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন থেকে যায়, দুই কমিশনের সুফারিশ-মালায় সঙ্গতিবিধান কীভাবে সম্ভব হবে?!
যা আছে আনান কমিটির সুফারিশমালায়
মূল পয়েন্টসমূহ ঃ * রাখাইনের জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন * নাগরিকত্ব ও চলাচলের স্বাধীনতা * অভ্যন্তরীন বাস্তুচ্যুতির সুরাহ * মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার * গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার * শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা লাভের অধিকার * সাম্প্রদায়িক অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব * আন্তসাম্প্রদায়িক সংহতি ও সম্প্রীতি * বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তসমস্যা ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক * আঞ্চলিক সম্পর্ক।সুফারিশমালায় বলা হয়েছেÑ** ক্ষতিগ্রস্তদের নাগরিকত্ব প্রদান এবং মিয়ানমার ও বাংলাদেশের যৌথ যাচাই-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের নিরাপদে (বাংলাদেশ থেকে) প্রত্যাবাসন করতে হবে।** ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব যাচাই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। নাগরিক হিসাবে যাচাই হওয়া ব্যক্তিদের সবধরনের অধিকার ও স্বাধীনতা দিতে হবে।** মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইনটি আন্তর্জাতিক রীতিনীতি, নাগরিকত্ব ও জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে।** যারা মিয়ানমারের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি তাদেরকে ঐ দেশে অবস্থানের বিষয়টি হালনাগাদ করে ঐ সমাজের অংশ করে নিতে হবে।** জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার অবাধ চলাচলের সুযোগ দিতে হবে।** রাখাইনে উন্নয়ন ও বিনিয়োগের পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীগুলোও উপকৃত হতে পারে।** মিয়ানমারের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সবগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের সদস্যদের সম্পৃক্ত করতে হবে।অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুহারাদের শিবিরগুলো বন্ধ করে সমাজেই তাদের সম্পৃক্ত করার নীতি গ্রহণ করতে হবে।** সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।** সীমান্ত সমস্যাসহ অভিন্ন সমস্যাবলী মোকাবেলায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সুসম্পর্ক জোরদার করতে হবে।কফি আনান কমিশনের সুফারিশমালা যদিও কিছু প্রশ্ন দ্বারা কঠিনভাবে বিদ্ধ, তারপরো বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনে করে, এসকল সুফারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে রোহিঙ্গাসঙ্কটের একটি গ্রহণযোগ্য স্থায়ী সমাধান সম্ভব। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সূ চী এ বিষয়ে মোটেই আন্তরিক নন, বরং আগাগোড়া কৌশলী বলেই মনে হচ্ছে। সম্ভবত ঠিক একারণেই কমিশনের প্রধান কফি আনান বারবার মিয়ানমার সরকারকে তাগাদা দিচ্ছেন অবিলম্বে সুফারিশমালা বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়ার।তিনি নিজেও ভালোভাবেই জানেন, তার রিপোর্টের সবচে’ দুর্বল দিক কোনটি। তাই বিভিন্ন ফোরামে, এমনকি সম্প্রতি নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে আমন্ত্রিত হয়েও স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনকে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সংশোধন করতে হবে।সম্প্রতি নিউইয়র্কে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছেন, এখনো রোহিঙ্গাদের অব্যাহতভাবে বাংলাদেশে আগমনের বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও এখনো পর্যন্ত সঙ্কট অব্যাহত থাকার প্রকৃত কারণ অবশ্যই অনুসন্ধান করতে হবে।তিনি আরো বলেন, এখনো রাখাইন রাজ্যে অবস্থানরত দুর্গত মানুষদের মাঝে আস্থার মনোভাব সৃষ্টি করা সম্ভব, যদি কমিশনের যাবতীয় সুফারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য প্রথমেই এবং নিঃশর্তভাবে সর্বপ্রকার সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। দুর্গত এলাকাগুলোতে জাতিসঙ্ঘ, বিভিন্ন মানবিক সহায়তাসংস্থা এবং গণমাধ্যমের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।জাতিসঙ্ঘ সদরদফতরে আয়োজিত একটি সভায় যোগদানের জন্য স্পিকারের নিউইয়র্কে উপস্থিতির সুযোগে কফি আনানের সঙ্গে উক্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
অং সান সূ চীর উদ্দেশ্য
যে কোন কাজের পিছনে, যিনি কাজটি করেন বা করান তার উদ্দেশ্যই হচ্ছে মূল চিন্তার বিষয়। সুতরাং সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন ওঠে আনান কমিশন গঠনের পিছনে অং সান সূচীর উদ্দেশ্য কী ছিলো? অবস্থা বিচারে আমাদের আশঙ্কা, তিনি তার উপর আন্তর্জাতিক চাপ কমাতে চেয়েছেন এবং সময়ক্ষেপণ করতে চেয়েছেন, আর দু’টো উদ্দেশ্যেই তিনি সফল। তার উপর বাড়তি সুবিধা হলো, এরই মধ্যে তিনি একটি অভ্যন্তরীণ তদন্তকমিশনের সুফারিশমালাও তৈরী করে নিয়েছেন।প্রশ্ন হতে পারে বাংলাদেশ বলছে আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সমর্থকরাও জোর দাবী জানাচ্ছেন, আনান কমিশনের সুফারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। এমনকি আমাদের মহান প্রতিবেশী ভারতও নাকি এটা চায়!এদিকে অং সান সূ চী যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলছেন, আনান কমিশনের সুফারিশ অবশ্যই বাস্তবায়ন করা হবে!তাহলে আসল কারিশমাটা কী? অং সান সূ চী-এর দিক থেকে তো পরিষ্কার যে, প্রতিবারই তিনি তার কথার লেজের সঙ্গে ছোট্ট একটি সুতা বেঁধে দিচ্ছেন যে, নাগরিকত্বের প্রমাণ দিতে হবে।এখন নাগরিকত্বের প্রমাণ এই বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত ও সহজ সরল মানুষগুলো কোত্থেকে যোগাড় করবে?! যাদের ঘরে নাগরিকত্বের কাগজপত্র ছিলো তাদের ঘর তো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঐ ছাইভস্মের মধ্যে যদি তালাশও করা হয় পাওয়া যাবে কিছু, আপনজনদের কয়লা হয়ে যাওয়া কঙ্কাল ছাড়া?!আমাদের এখানে যেমন ভাবা হয় আমার ইচ্ছাই আইন, আমার কথাই শেষ কথা, মিয়ানমারের ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ অং সান সূ চীও কি ভাবেন, তিনি যাকে বলবেন রোহিঙ্গা সে হবে রোহিঙ্গা, আর যাকে বলবেন বাঙ্গালী সে হয়ে যাবে বাঙ্গালী?! তিনি কি জানেন, তার দেশের এরূপ আচরণকেই আমাদের দেশে বলা হয় ‘মগের মুল্লুক’!! আনান কমিশনের বাস্তবায়ন ভারতও চায়?!... ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। আমাদের দেশের আনাড়ী কূটনীতিক ও রাজনীতিকগণ কিছু না বুঝেই বলতে শুরু করেছেন, ভারতের নীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে, আর সেটা অমুকের সংযমী ও প্রজ্ঞাপূর্ণ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফল। একটু চিন্তা করলেই তারা বুঝতে পারতেন, সুষমা এমন কিছু বলেননি যাতে মিয়ানমারের নেত্রী বা জান্তা কারো সমস্যা হতে পারে! সূ চী নিজেই যখন বলছেন বাস্তবায়নের কথা তাহলে সুষমার তা বলতে আপত্তি কোথায়? তিনি নিজেও তো জানেন, সূ চী কী বলেছেন এবং তার মনে কী আছে? এজন্যই বারবার বলি, শিশুর সরলতা নিয়ে কূটনীতির পক্ষ হওয়া যায় না।