কয়েক যুগ ধরে আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলে আসছে নিষ্ঠুরতম গণহত্যা ও জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান। বস্তুত দুঃখ, কষ্ট, আর লাঞ্ছনা-বঞ্চনা দিয়েই যেন গড়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবন। সমগ্র বিশ্বের চোখের সামনে এটা চলছে অনবরত, লাগাতার ও বিরামহীন। পার্থক্য শুধু এই যে, কখনো ঘটে অল্পমাত্রায়। তখন নির্যাতনের শিকার মানুষগুলো সবকিছু সহ্য করে কোনভাবে মাটি কামড়ে পড়ে থাকে জন্ম-ভূমিতে। বিশ্ব, এমনকি মুসলিম বিশ্ব তখন ভাবে ‘সবকিছু ঠিক আছে’। আর কখনো হিং¯্রতা ও নৃশংসতা সর্বপ্রকার সীমা ছাড়িয়ে যায়। তখন মানুষ দিশেহারা হয়ে শুধু প্রাণটুকু বাঁচানোর তাগিদে জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। যদিও সেখানেও তাদের দুর্গতির শেষ থাকে না, যদিও সেখানে তাদের বাস করতে হয় দুর্বিষহ মানবেতর জীবন।ভারত, ইন্দোনেশিয়া, থাইলেন্ড, মালয়েশিয়া, এসব দেশে বিভিন্ন সময়ে পাড়ি দিয়েছে বেশ কিছু মুহাজির। তবে নিকট ও লাগোয়া প্রতিবেশী হওয়ার কারণে মুহাজিরীনের মূল ¯্রােতটি সবসময় বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশেই এসে আছড়ে পড়ে।আরাকানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা বড় বড় গণহত্যা ও উচ্ছেদ অভিযানের কারণে রোহিঙ্গা মুহাজিরীনের বিপুল সংখ্যায় আগমন ঘটেছে ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার অনমনীয় ও কঠোর অবস্থানের কারণে মিয়ানমার সরকার তখন আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়বার আগমন ঘটে ১৯৯২ সালে। বেগম জিয়ার আমলে। তখনো জোর কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে পরিস্থিতির সম্মানজনক সমাধান সম্ভব হয়। সর্বশেষ এবং সবচেয়ে ব্যাপক ও নৃশংস গণহত্যা শুরু হয়েছে গত ২৫শে আগস্ট থেকে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু এবার শুরু থেকেই সরকার দুর্বল অবস্থান থেকে পরিস্থিতি শামাল দেয়ার চেষ্টা করছে। প্রতিপক্ষও সরকারের দুর্বলতার পুরো ফায়দা নিচ্ছে।সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত প্রায় দশলাখ আরাকানী মুহাজির বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।বাংলাদেশ ছোট ও গরীব দেশ। তদুপরি অতি উচ্চ ঘনত্বসম্পন্ন জনসংখ্যার দেশ। তারপরো এদেশের মুসলিম জনগণ মানবিক মূল্যবোধ এবং ঈমান ও ভ্রাতৃত্বের দাবীতে সাড়া দিয়ে আশ্রয়গ্রহণকারী মুহাজিরদের সাহায্য সহযোগিতায় জানমাল নিয়ে এগিয়ে এসেছে। সরকার শুরুতে তার ভাষায় ‘অনুপ্রবেশ’ ঠেকাতে কঠোর পদক্ষেপ নিলেও পরবর্তী পর্যায়ে সবদিক বিচার বিবেচনা করে যথেষ্ট উদার নীতি গ্রহণ করেছে। এজন্য বাংলাদেশের সরকার ও আমজনতা অবশ্যই সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রশংসা করছে, এমনকি সরকার প্রধানকে ‘মাদার অব হিউমিনিটি’ খেতাব প্রদান করে খুশী করেছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান এখন সেই প্রচার-পত্রের অপূর্ব সাজ ধারণ করেছে।কিন্তু প্রশ্ন হলো শুধু মৌখিক প্রশংসার কী মূল্য আছে? তাতে বাংলাদেশের জনগণ কীভাবে উপকৃত হতে পারে, আর আরাকানের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত কয়েক লাখ মজলুম মুহাজিরীনই বা কীভাবে উদ্ধার পেতে পারে তাদের এ বিপর্যয়দশা থেকে?! এ কারণেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কিছু দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘শুধু কথা বললে, শুধু মৌখিক নিন্দা জানালে, বা উপরে উপরে সান্ত¦না দিলে তো কাজ হবে না। কার্যকর ও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আপনারা যথাযথ চাপ সৃষ্টি করুন, যাতে মিয়ানমার সরকার অবিলম্বে তার নাগরিকদের সম্মান, মর্যাদা ও অধিকারের সঙ্গে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।’ বাস্তব অবস্থা তো এই যে, এখনো পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে কোন বৃহৎ বা আঞ্চলিক শক্তি সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের পাশে দাঁড়ায়নি। কিছু প্রশংসা, আর নামমাত্র কিছু ত্রাণ দিয়েই যেন বড় বড় দেশ নিজেদের দায়মুক্ত ভাবছে। অথচ সবাই জানে, সর্বাত্মক আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়া জনবহুল গরীব অর্থনীতির বাংলাদেশের পক্ষে আট দশলাখ মুহাজিরীনের অন্ন-বস্ত্র, খাদ্য ও জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। দীর্ঘ সময়ের জন্য তো সম্ভব নয়ই, এমনকি স্বল্প মেয়াদের জন্যও বিষয়টি কঠিন। ইতিমধ্যেই ভয়াবহ রকম খাদ্যভাব ও ঔষধপত্রের সঙ্কটের কারণে মুহাজিরীনের আশ্রয়-শিবিরে গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে। আসন্ন শীতমৌসুমে পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ ও মহামারী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। অথচ দেখা যাচ্ছে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগেও অর্থসংগ্রহের ক্ষেত্রে তেমন কোন অগ্রগতি নেই। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বিশ্বসম্প্রদায় ধরে নিয়েছে, এটা বাংলাদেশের দায়, বাংলাদেশ ও তার জনগণকেই এ দায় বহন করতে হবে। বিশ্বসম্প্রদায় দয়াবশত যেটুকু সাহায্য দিচ্ছে, ত্রাণ পাঠাচ্ছে সেটাই অনেক। একমাত্র মুসলিম দেশ তুরস্ক জোরালোভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং সাধ্যমত সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে ত্রাণতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নইলে ইতিমধ্যে পরিস্থিতি কোন্ ভয়াবহ রূপ ধারণ করতো, তা কল্পনা করাও কঠিন।মিয়ানমার বাহিনী আজ দীর্ঘ দু’মাস ধরে আরাকান ভূখ-ে যে ভয়াবহ গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালিয়ে আসছে তার বীভৎসতা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। প্রাণহাতে পালিয়ে আসা বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত মুহাজিরীনের কাছ থেকে যে সব বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে তা রীতিমত লোমহর্ষক! এমনকি বিশ্ব-গণমাধ্যমে অনেক রেখে ঢেকেও যে সকল চিত্র ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোও বিশ্ববিবেককে বিচলিত করার জন্য যথেষ্ট।‘গণতন্ত্রবাদী’ অং সান সূ চী বলুন, বা সামরিক জান্তাই বলুন, বিশ্বনেতৃবৃন্দের ‘প্রবল চাপের মুখেও’ এখনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে, কিংবা বিশ্বগণমাধ্যমের কোন সাংবাদিককে অবাধে আরাকানের অভিযানকবলিত অঞ্চলে যাওয়ার অনুমতি দিতে চাচ্ছে না, যাতে তারা বাস্তব পরিস্থিতি জানতে পারেন এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরতে পারেন। তারপরও কি বোঝার বাকি থাকে, কী অকল্পনীয় নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে বার্মিজ বাহিনী এবং তার সহযোগী উগ্রতাবাদী বৌদ্ধজনগোষ্ঠী ও মগসম্প্রদায়!!বস্তুত বিশ্বসম্প্রদায়ের এটা আজ বুঝতে বাকি নেই যে, আরাকানের অসহায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর পরিচালিত নির্যাতন, নিপীড়ন এখন এমন পর্যায়ে পৌঁচেছে, যার পরে হিং¯্রতা ও নৃশংসতার আর কোন স্তর থাকে না। তাই জাতিসঙ্ঘকে পর্যন্ত বলতে হচ্ছে, ‘বিশ্বের সবচে’ নিষ্পেষিত ও ‘পারসিকিউটেড’ জনগোষ্ঠী হচ্ছে রোহিঙ্গারা।’কিন্তু প্রশ্ন হলো এসব মৌখিক নিন্দা প্রতিবাদ এবং কাগুজে হুমকি ধমকি ও হুঁশিয়ারির কী মূল্য আছে? বরং আমাদের তো জানতে ইচ্ছে করে, এগুলো কি হুঁশিয়ারি, না প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়?!বিশ্বসম্প্রদায়ের, বিশেষত বিশ্বসংস্থা জাতিসঙ্ঘের কর্তব্য ছিলো কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রথমে গণহত্যা ও উচ্ছেদ-অভিযান বন্ধ করা, কিন্তু কাগুজে প্রতিবাদ ও মৌখিক নিন্দা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি। আরো নেক্কারজনক ঘটনা হলো, নিরাপত্তা পরিষদে সাধারণ একটি নিন্দাপ্রস্তাব পর্যন্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি, দু’টি বিশ্ব-শক্তির ভেটো প্রয়োগের ফলে। আমাদের মনে হয়, বিশ্বসম্প্রদায় এ লজ্জা ও কলঙ্ক থেকে এবং এর দায় থেকে কখনো মুক্ত হতে পারবে না।যদিও অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। প্রায় সবকটি জনপদ জ্বলে পুড়ে সারখার হয়ে গেছে, যদিও প্রায় পুরো জনগোষ্ঠীকে শিকড়শুদ্ধ উচ্ছেদ করা সম্পন্ন হয়ে গেছে, তবু আমরা মনে করি, এখনো শেষ সময়টুকু আছে। বিশ্ব-সম্প্রদায় ও জাতিসঙ্ঘ যদি ইচ্ছা করে, এখনো পারে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে শায়েস্তা করতে এবং যুক্তির পথে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু কোথায়?! এখনো তো কোন বৃহৎ শক্তির পক্ষ হতে এমন সদিচ্ছার আলামত দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রেসিডেন্ট সাধারণ পরিষদের ভাষণে যেমন জান্তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলেনি, তেমনি বর্তমানে কিছুটা বোধোদয়ের পরিচয় দিলেও বলতে চাচ্ছে, ‘মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে বিচারের সম্মুখীন করার কথা তারা চিন্তা করছে না, বরং জান্তাকে যুক্তির পথে আনার চেষ্টা করাটাই হবে উপযুক্ত কাজ, যাতে মিয়ানমারের নাযুক গণতন্ত্র বাধাগ্রস্ত না হয়। আমাদের কাজ হবে জান্তাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দাবী মেনে নিতে বাধ্য করা, আর তা হলো, রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং ...!!’আমরা সত্যি বুঝতে অক্ষম যে, মিয়ানমারের মত একটি ক্ষুদ্র শক্তি এতটা দানব কবে কীভাবে হয়ে গেলো যে, মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করেছে, এটা স্বীকার করেও তাকে বিচারের সম্মুখীন করার সাহস পাচ্ছে না আমেরিকা, অন্তত শক্ত একটা অবরোধ আরোপ করার চিন্তা পর্যন্ত করতে পারছে না বিশ্বের সর্বদেশের অভিভাবক জাতিসঙ্ঘ!!সর্বশেষ খবরে জানা যাচ্ছে, বিগত ৬ই নভেম্বর রোয সোমবার আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর সেনাবাহিনীর ‘বলপ্রয়োগ’ বন্ধ করার এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া শরণার্থিদের ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে সর্বসম্মত বিবৃতি দিয়েছে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ। আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করে সব নাগরিককে রক্ষা করা যে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেকথাও মিয়ানমার সরকারকে মনে করিয়ে দিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদ। সেই সাথে ‘রাখাইন রাজ্যে’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে জাতিসঙ্ঘকে সহায়তা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।’উল্লেখ্য যে, এই বিবৃতি হচ্ছে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের জন্য যে খসড়া প্রস্তাব তৈরী করেছিলো তার বিকল্প। কারণ ভেটো ক্ষমতার অধিকারী রাশিয়া ও চীনের বিরোধিতার আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত প্রস্তাবটি বাদ দেয়া হয়েছে।সত্যি চিন্তার বিষয়! মানবতার বিরুদ্ধে সঙ্ঘটিত অপরাধ কত জঘন্য, আর তার বিরুদ্ধে আনিত প্রস্তাবটি কত নিরীহ ও শান্তিপূর্ণ!! তারপরো মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং গণতন্ত্রবাদী নেত্রী অং সান সূ চী উক্ত প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে। সূ চীর মতে, এতে বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ‘গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত’ হতে পারে। ধৃষ্টতা আর কাকে বলে!! কিন্তু জাতিসঙ্ঘ ও তার নিরাপত্তা পরিষদ, কিংবা বৃহৎ শক্তিবর্গ কারো কাছেই যেন এর শক্ত কোন জবাব নেই!এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন তুলে যারা জানতে চান, কী হতে পারতো জাতিসঙ্ঘ বা আমেরিকার ভূমিকা, যদি নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয় অন্য কিছু হতো?! যারা এ প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হয়েছেন আমরা এখনো তাদের পথে যেতে চাই না। আমরা আশা করতে চাই যে, বিশ্ববিবেক এখনই জাগ্রত হবে এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে। আমরা আরো আশা করতে চাই যে, বিশ্বশক্তিবর্গ মিয়ানমার সরকারের উপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধ প্রয়োগ করার কথা চিন্তা করবে, যাতে এই মুহূর্তে জান্তা সমস্ত সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে বাধ্য হয়।আমরা আরো আশা করতে চাই বিশ্বশক্তিবর্গ জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে, এমনকি প্রয়োজনে নিজস্ব উদ্যোগে এমন শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা চিন্তা করবে যাতে কোন রকম অজুহাত ও কালক্ষেপণ ছাড়াই মিয়ানমারের জেনারেলচক্র আলোচনায় বসতে এবং কোনপ্রকার টালবাহানা ছাড়া ভিটেভূমি থেকে উচ্ছেদকৃত প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। অং সান সূ চীকে অবশ্যই এমন অনুকূল পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে উচ্ছেদকৃত পুরো জনগোষ্ঠী নিজেদের ভূমিতে ফিরে যেতে পারে। এজন্য রোহিঙ্গাদের হরণকৃত সকল নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। জীবন ও জীবিকা এবং শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এধরণের গুরুতর মানবিক সঙ্কট সৃষ্টি না হয়।বিশ্বশক্তি বা জাতিসঙ্ঘ কী করতে পারে?!এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হলো, বিশ্বশক্তিবর্গ এবং জাতিসঙ্ঘ যদি ইচ্ছা করে তাহলে রোহিঙ্গাসমস্যার সমাধানে অনেক কিছুই করতে পারে। এর চেয়ে অনেক কম মানবিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেও জাতিসঙ্ঘ তার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন দেশে শান্তিবাহিনী প্রেরণ করেছে। রাখাইন রাজ্যে মানবিক বিপর্যয় বন্ধ করা এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জাতিগত উচ্ছেদ থেকে রক্ষা করা, ‘আর মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে আরসার হামলা থেকে রক্ষা করা’র জন্য জাতিসঙ্ঘ শান্তিবাহিনী পাঠাতে পারে।পূর্বতিমূরের ক্ষেত্রে এবং দক্ষিণ সুদানের ক্ষেত্রে জাতিসঙ্ঘ যা যা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্যও ঐ সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।একটি বেলফোর ঘোষণা কি হতে পারে না?! আমাদের সর্বশেষ কথা হলো, এখন ‘গ্রেট বৃটেন’ বেলফোর ঘোষণার শতবর্ষপূর্তি উৎসব করছে বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে। ১৯১৭ সালের দোসরা নভেম্বর তৎকালীন বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনী ভূখ-ে ইহুদিদের জন্য কথিত আবাসভূমি বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন, যা বেলফোর ঘোষণা নামে প্রসিদ্ধ। উছমানী খেলাফতের প্রতি আরব নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ফিলিস্তিন তখন হয়ে পড়েছিলো বৃটেনের উপনিবেশ।বেলফোর ঘোষণার ৩১ বছর পর ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ ইহুদিরা ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্র ছিলো না, বরং তাদেরকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে, যেখানে তারা স্বাধীন নাগরিকের মর্যাদা ভোগ করছিলো, সেখান থেকে তুলে এনে ইসরাইলের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। এজন্য ইহুদি সন্ত্রাসীরা ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্র মুসলমানদেরকে তাদের হাজার বছরের বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করে এক ভাগ্যাহত শরণার্থী জাতিতে পরিণত করে। এটাও প্রমাণিত সত্য যে, ঐ সন্ত্রাসী ইহুদি গোষ্ঠীকে সর্বপ্রকার প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে আজকের গ্রেটবৃটেন। আর এজন্য প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে গর্ব প্রকাশ করেছেন এবং শতবর্ষপূর্তি উৎসবের ঘোষণা দিয়েছেন।আমরা মনে করি, বেলফোর ঘোষণা ছিলো শতাব্দীর সবচেয়ে জঘন্য মানবতাবিরোধী ঘোষণা। এটা হচ্ছে বৃটিশজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক কাজ, যার জন্য গর্ব প্রকাশ ইতিহাসের সঙ্গে উপহাস ছাড়া আর কিছু নয়।ইহুদিরা তো ফিলিস্তিন থেকে উচ্ছেদকৃত কোন জনগোষ্ঠী ছিলো না। তো একটি বৈধ জনগোষ্ঠীকে তাদের জন্মভূমি থেকে উচ্ছেদ করে যদি ইহুদিদের জন্য ‘রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে তো আমরা আশা করতেই পারি, আজকের বৃহৎ শক্তি আমেরিকা রোহিঙ্গাদের জন্য ‘টিলারসন ঘোষণা’ জারি করুক। সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন হবে আরাকানে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বতন্ত্র আবাসভূমি তৈরীর মাধ্যমে। এটা তো অবশ্যই করা যায়। কারণ আরাকান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের বহু শত বছরের আবাসভূমি, যেখান থেকে চরম নৃশংসতার মাধ্যমে আজ তাদের উৎখাত করা হয়েছে! তাছাড়া আরাকান রাজ্য একসময় ছিলো স্বাধীন সার্বভৌম একটি মুসলিম রাষ্ট্র, যা ১৭৮৪ সালে তৎকালীন বর্মী রাজা আগ্রাসনের মাধ্যমে দখল করে বার্মার অন্তর্ভূক্ত করে নিয়েছিলো।মুসলিম উম্মাহর অংশ হিসাবে এবং রোহিঙ্গাবিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসাবে আমরা তো এটা আশা করতেই পারি! অথচ এত বিরাট নির্যাতন ও বিপর্যয়ের পরো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দাবী কিন্তু আলাদা আবাসভূমি বা স্বাধীন রাষ্ট্র নয়। দাবী শুধু এই যে, মিয়ানমারের অধীনেই পূর্ণ নাগরিক মর্যাদায় তারা ফিরে যেতে চায় তাদের আবাস ভূমিতে। ফিরে পেতে চায় শুধু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সারখার করে দেয়া বাস্তুভিটা এবং ফসলের মাঠ!আমাদের প্রশ্ন শুধু এই যে, শুধু মুসলিম হওয়ার অপরাধেই কি রোহিঙ্গারা আজ তাদের ন্যায্যতম ও ন্যূনতম দাবি থেকেও বঞ্চিত হবে? বিশ্বশক্তি ও বিশ্ববিবেকের এই যে অমার্জনীয় নীরবতা, নির্লিপ্ততা, আজ হোক, কাল হোক এর পরিণতি কী হতে পারে তা কি ঠা-ামাথায় একবার ভেবে দেখা কর্তব্য নয়? *