আরাকান সংখ্যা (৩/১)

আরাকানসংখ্যা (বিশেষ).

সূ চী ও জেনারেলচক্র কেন ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

আরাকানের মযলূম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের জাতিগত উচ্ছেদের মূল অপরাধী যে পাঁচজন, একজন নারী ও চারজন সেনাবাহিনীর শীর্ষপদের জেনারেল। তাদের সম্পর্কে এখানে কিছু বলার ইচ্ছা। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের ধিক্কার উপেক্ষা করে তারা আজ তাদের পৈশাচিক চাহিদাই যেন পূরণ করে চলেছে। অং সান সূচী। প্রথমেই তার কথা বলতে হয়। কারণ বাহ্যত তিনিই এখন সরকারের এবং সরকারী দলের শীর্ষব্যক্তি। তাছাড়া একসময় তিনি ছিলেন, মানবতাবাদ ও গণতন্ত্রের জন্য বিশাল ত্যাগ স্বীকারকারী নেত্রী। মিয়ানমারের ভূমিতে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে তিনি যে ত্যাগ ও যুলমু নির্যাতন ভোগ করেছেন সামরিক শাসকের হাতে, তা সত্যি নযিরবিহীন। এজন্য বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে ছিলো তার দেবীতুল্য মর্যাদা। অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত। নোবেল শান্তিপরস্কুার, শাখারভপুরস্কার, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিগ্রী। মার্কিন কংগ্রেসের সর্বোচ্চ সম্মাননা কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব ইত্যাদি।

কালকের সূ চী  ( নোবেল পুরস্কার গ্রহণকালে)

আসুন, আমরা এমন বিশ্ব গড়ে তুলি যেখানে কোন উদ্বাস্তু, গৃহহারা ও আশাহীন মানুষ থাকবে না। আসুন, আমরা এমন শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তুলি, যেখানে সবাই নিরাপত্তার মধ্যে ঘুমাতে পারে এবং জেগে উঠতে পারে সুখের মধ্যে।

আজকের সূচী  (মার্কিন রাষ্ট্রদতূকে লক্ষ্য করে)

রাখাইনে মুসলিম সংখ্যালঘুদের রোহিঙ্গা বলবেন না, ওরা বাঙ্গালী। ওরা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। সেনাবাহিনী শুধু পর্যাপ্ত সংযমের সঙ্গে সন্ত্রাস দমন করছে। ওরা কী কারণে পালাচ্ছে, আমি তা খুঁজে দেখবো।

কিন্তু আজ তিনি ক্ষমতার ক্ষুধায় হিতাহিতজ্ঞানশূন্য! এক সময়ের গণতন্ত্রের দেবী আজ গণহত্যার প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী!! তিনি একবারও কি ভাবার সুযোগ পাবেন, সারা জীবনের অর্জিত সমস্ত সম্মান ও সম্মাননা বিসর্জন দিয়ে তিনি কী অর্জন করেছেন ক্ষমতার সামান্য একটু প্রসাদ ছাড়া!! কিন্তু না, তিনি আজ বেপরোয়া। সর্বশেষ রোহিঙ্গা ট্রাজেডি শুরু হওয়ার দীর্ঘ ... নীরবতা ভঙ্গ করে তিনি জাতির উদ্দেশ্যে তিনি যে ভাষণ দেন তার মূল কথা ছিলো, ‘আমি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে ভীত নই। রাখাইনে কিছুই হচ্ছে না। সেনাবাহিনী সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে তাদের উপরঅর্পিত দায়িত্ব পালন করছে মাত্র।’ সূ চীকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় ১৯৯১ সালে যখন তিনি বার্মায় সামরিকচক্রের হাতে বন্দী। তাই এ পুরস্কার তাকে গ্রহণ করতে হয় একুশ বছর পর ১৬ই জুন ২০১২ সালে। নোবেল পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে সেদিনের সূ চী বলেছিলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন বিশ্ব গড়া যেখানে কেউ উদ্বাস্তু, গৃহহারা ও আশাহীন থাকবে না। আসুন, আমরা এমন শান্তিময় বিশ্ব গড়ে তুলি যেখানে সবাই নিরাপত্তার মধ্যে ঘুমুেত পারে এবং জেগে উঠতে পারে সুখের মধ্যে।’ সূ চীর বক্তব্যে গোটা বিশ্ব উজ্জীবিত হয়েছিলো এবং আশাবাদ জাগ্রত হয়েছিলো যে, সূ চী পারবেন মিয়ানমারকে শান্তির দেশে পরিণত করতে। কিন্তু হায়..! ক্ষমতার ক্ষুধা একজন বড় মাপের মানুষকে কত উচ্চতা থেকে কত নীচতায় নামাতে পারে ‘গণতন্ত্রের মানস- কন্যা ও মানসপুত্ররা’ বারবার তা প্রমাণ করছেন!
মিয়ানমারে সূচী এমন ‘বিশ্বই’ গড়েছেন যেখানে নিরস্ত্র অসহায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে শত শত বছর শান্তিতে বাস করার পর আজ জ্বলন্ত জনপদ হতে প্রাণ হাতে আশ্রয় নিতে হচ্ছে প্রতিবেশী দেশে!
সূ চী এমনকি তার জন্মদাতা বাবার সঙ্গে আজ বিশ্বাস- ঘাতকতা করেছেন! কারণ মূল সংবিধানে সকল নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সমমর্যাদায় রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকেও বার্মাদেশের নাগরিক বলে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলো। পিতা অং সান তার মন্ত্রিসভায় একজন রোহিঙ্গা মুসলিম মন্ত্রীও গ্রহণ করেছিলেন।
অং সান সূচী যদি বধির না হয়ে থাকেন তাহলে তাকে বলতে চাই, ইতিহাস থেকে যারা শিক্ষা নেয় না, একসময় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই তারা নিক্ষিপ্ত হয়। আন্তর্জাতিক গণ আদালত অং সান সূ চী সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছে এখানে সেটাই আমরা তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ‘আপনি যদি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে ভয় না পান তাহলে সমগ্রমানব জাতির ঘৃণা, ক্রোধ ও অভিশাপ-এর ভয়ে ভীত হোন!!
মিন অং হি লাইং ইনি এখন মিয়ানমারের কসাই নামে সারা বিশ্বে পরিচিত। তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন াস্থনে কুকুেরর নাম রাখা হচ্ছে তার নামে। তিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল। ২০১২ সালে রোহিঙ্গানিধনের যে ভয়ঙ্কর নীলনক্শা তৈয়ার করা হয় ইনিই তার রূপকার ও বাস্তবায়ক।
১লা সেপ্টেম্বর ১৭ তিনি সদম্ভে ঘোষণা করেন, এবার তারা যা করতে পেরেছেন অতীতের কোন সরকার তা পারেনি। সূ চী সরকার এবার ‘বাঙ্গালী’ প্রশ্নের চূড়ান্ত সমাধান করবেন। এই অভিযানে সূ চীর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। তিনিও তথাকথিত রোহিঙ্গাদের বাঙ্গালী বলছেন।
রোহিঙ্গানির্মলূ অভিযানের দায়িত্বপ্রাপ্ত আরো তিনজন হচ্ছেন রস্বাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত লে.জেনারেল কায়াও সূ। সীমান্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত লে, জেনারেল ইয়ে অং এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত লে, জেনারেল সেইন উইন।এ চারজনই সামরিক বাহিনীতে যোগদানের পূর্ব থেকেই উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ এবং চরম মুসলিমবিদ্বেষে আক্রান্ত ছিলেন বলে অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে।
আজ এটা দিবালোকের মত সত্য যে, রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর নিধনযজ্ঞের পিছনে যে মূল উন্মাদনাটি কাজ করছে সেটা হলো চরম মুসলিমবিদ্বেষে চালিত উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদ, যেমন ভারতে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার পিছনে মূল উন্মাদনা হলো উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ। মিয়ানমারের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৌদ্ধধর্মভিত্তিক উগ্রতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূল অপরাধী ব্যক্তিটি হচ্ছেন বৌদ্ধ জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী ধর্মগুরু উনরাথু। মূলত তিনি তার ফেসবুকের মাধ্যমেই বৌদ্ধ উন্মাদনা ও মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়েছেন। তাই আন্তর্জাতিক মহলে এ দাবী এখন ক্রমেই জোরদার হচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক কসাই, সামরিক কসাই ও ধর্মীয় কসাই, সবাইকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। বস্তুত মানুষ নামের এ পশু মিয়ানমারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত মুসলিম- বিদ্বেষের ভয়ঙ্কর দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছেন। ধর্মের হলুদ আলখেল্লাই ছিলো এক্ষেত্রে তারবড় শক্তি, যার সামনে এখন ‘অসহায়’ শান্তিকামী প্রতিটি মানুষ।
তবে মানবতার হন্তারক এই কুচক্রী দল যদি মনে করে থাকে যে, বিচারের ‘ফাঁসিকাষ্ঠ’ থেকে তারা বেঁচে যাচ্ছেন তাহলে বলবো, তারা বোকার স্বের্গ বাস করছেন। তাদের চেয়ে কম শক্তিধর ছিলেন না বসোনিয়ার গণহত্যার অপরাধী সার্ব কসাই রাদোভান কারাদজিস। তিনিও বাঁচতে পারেননি শেষ পর্যন্ত বিচারের হাত থেকে। ১৯৯২ থেকে ৯৫ পর্যন্ত তিনি ভয়ঙ্কর গণহত্যা চালিয়েছেন উন্মত্ত উল্াøসে। শেষ পর্যন্ত ২০১৬ সালের ২৬শে মার্চ হেগের আন্তর্জাতিক আদালত চল্লিশ বছরের কারাদ- দিয়েছে তাকে। তাকদীরের ফায়ছালা যখন নেমে আসে তখন বাঁচতে পারে না কোন যালিম।




শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা