আরাকান সংখ্যা (৩/১)

আরাকানসংখ্যা (বিশেষ).

রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর নিধনযজ্ঞের পিছনে মিয়ানমারের ভিক্ষুসমাজ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

ভিক্ষুক আর ভিক্ষু শব্দদু’টি দেখতে একরকম হলেও এক নয়। ভিক্ষুক হলো যারা মানুষের দুয়ারে হাত পেতে বেড়ায়। কেউ ভিক্ষুক হয় শুধু পেটের ক্ষুধার তাড়নায়, আর কেউ ভিক্ষুক হয় এটাকে উপার্জনের জন্য সহজ পেশা হিসাবে। এরা হলো পেশাদার ভিক্ষুক! আর ভিক্ষু! এটা হলো একটি ধর্মের সম্মানজনক পদবী, আমাদের ধর্মে যেমন ইমাম, মাওলানা, শায়খ, হিন্দুধর্মে যেমন পুরোহিত, যাজক, সেবায়েত, আর খৃস্ট ধর্মে যেমন পাদ্রী, বিশপ, ফাদার। ইহুদি ধর্মে আছে রাব্বী। এভাবে বৌদ্ধধর্মে হলো ভিক্ষু। তবে ভিক্ষার সঙ্গে সেটারও কিছু সম্পর্ক রয়েছে। ভিক্ষু প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটু ধারণা থাকা ভালো। ইহুদি, ঈসাঈ, ইসলাম এগুলো আসমানী কিতাবের ধর্ম। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কেও কারো কারো ধারণা যে, মূলে এটা তাওহিদ-ভিত্তিক আসমানি ধর্মই ছিলো। বৌদ্ধ কোন আসমানি ধর্ম নয়। এজন্য এর কোন ধর্মগ্রন্থ’ নেই। এটি গৌতম বুদ্ধ-এর আধ্যাত্মিক ধ্যানসাধনা হতে সৃষ্ট একটি ধর্ম বা জীবনদর্শন। ২৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি রাজপুত্ররূপে প্রাসাদে অবস্থান করেন, বিবাহ করেন এবং রাহুল নামে একটি পুত্র সন্তান লাভ করেন। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, জগত-সংসারের মোহে আবদ্ধ থেকে আত্মার মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করা সম্ভব নয়। তাই তিনি একরাত্রে ঘুমন্ত স্ত্রীপুত্রকে বিদায় জানিয়ে নির্বাণ লাভের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। দীর্ঘ ধ্যান ও মৌন সাধনার মাধ্যমে তিনি অন্তদৃষ্টি ও দিব্যজ্ঞান অর্জন করেন সেটাই
হলো আত্মার নির্বাণ। বুদ্ধের প্রধান শিক্ষা হলো ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ এবং ‘জীবহত্যা মহাপাপ’। বুদ্ধ তার প্রথম কয়েকজন অনুসারীকে নিয়ে প্রথম ভিক্ষুসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেন। সংসারের সকল ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মিক নির্বাণ লাভের উদ্দেশ্যে এরা কোন উপার্জন করেন না, বরং ভিক্ষা সংগ্রহ করে ক্ষুধা নিবারণ করেন। মূলত এখানে এসেই ভিক্ষু ও ভিক্ষুক এক হয়ে যায়। বৌদ্ধধর্ম ভারতীয় ধর্ম হলেও হিন্দুত্ববাদী ভারতে এ ধর্মের অনুসারীদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালায় যে, ভারতের ভূমি থেকে উৎখাত হয়ে এ ধর্ম চীন, তীব্বতসহ অন্যান্য দেশে গিয়ে আশ্রয় ও প্রশয়্র লাভ করে। বৌদ্ধধর্মের যে সকল অনুসারী সংসারের মোহ থেকে মুক্ত হয়ে আত্মার নির্বাণ ও সিদ্ধিলাভের বাসনা পোষণ করেন তারাই মূলত বুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত ভিক্ষু- সঙ্ঘের অন্তর্ভক্তু হন। সারা জীবন তিনি ‘অহিংসা পরম ধর্ম’ এবং ‘জীবহত্যা মহাপাপ’ বুদ্ধের এ বাণী প্রচার করাকেই ব্রতরূপে গ্রহণ করেন। বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ভিক্ষুসমাজ অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। তাদের ধর্মীয় ক্ষমতা অপরিসীম। চরম তিক্ত হলেও এটাই আজ বাস্তব সত্য যে, একসময় যে ভিক্ষুসমাজ ভারতবর্ষের বুকে সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, এমনকি সমগ্র
ভারতভূমি থেকে উৎখাত হয়েছিলেন, যাদের জীবনের মূলমন্ত্রই ছিলো অহিংসা তারাই আজ মিয়ানমারে, বিশেষ করে রাখাইনে মুসলিম নিধনযজ্ঞের পিছনে প্রধান ভূমিকা পালন করছেন। এখানে ইতিহাসের এ সত্যটিও জেনে রাখা দরকার যে, পৃথিবীর কোথাও, বিশেষ করে এ উপমহাদেশে কোন মুসলিম শাসক দ্বারা বুদ্ধধর্ম কখনো ন্যূনতম নিগ্রহের শিকার হয়নি, বরং যুগে যুগে তারা মুসলিম শাসকবর্গের নিবিড় পৃষ্ঠপোষকতাই লাভ করেছেন। আজ হিন্দুভারত সেই ভিক্ষুসমাজের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে মুসলিমনিধনযজ্ঞে সমর্থন যোগানোর জন্য!
ইতহিাসরে কি নর্মিম পরহিাস ! মিয়ানমারে বৌদ্ধভিক্ষুসমাজের এখন একমাত্র মিশন হলো মিয়ানমারকে মুসলিম মুক্ত করা। এজন্য অহিংসার পূজারীরা এখন তাদের অনুসারীদের মাঝে হিংসার আগুন প্রজ্জ্বলিত করার এক সর্বগ্রাসী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রখ্যাত সাংবাদিক জেফরি জ্যাটলম্যান লিখেছেন, ‘দশকের পর দশক রোহিঙ্গারা শিকারীর ধাওয়া খেয়ে ফিরেছে। রুয়ান্ডা গণহত্যার সময় তুতুিসদের যেমন পোকামাকড় মনে করা হতো, বৌদ্ধদের দেশ বার্মায় সংহিসবাদী ভিক্ষুরা তাদের আগ্রাসী প্রচারণার মাধ্যমে মুসলমানদের ঠিক পোকামাকড়ের স্তের নামিয়ে এনেছে। একজন স্কটিস পণ্ডিৎ তার ‘এ বুক অন রোহিঙ্গা’ এ লিখেছেন, ‘অনেক প্রভাবশালী বৌদ্ধ ভিক্ষু মনে করে, রোহিঙ্গারা হলো পুনরায় জন্ম নেয়া শাপ বা পোকামাকড়। ক্ষতিকর পোকামাকড় যেমন দেখলেই মেরে ফেলতে হয় রোহিঙ্গাদেরও তেমনি মেরে ফেলা উচিত। মিয়ানমারে মুসলিম নিধনযজ্ঞের পিছনে যে ভিক্ষুসংগঠনটি সবচে’ বেশী সক্রিয় তার নাম হলো মা,বা,থা আন্দোলন। ২০১৩ সালের ২৭শে জুন মা বা থা নামের এ বৌদ্ধ ভিক্ষু সংগঠনটি জন্মলাভ করে। মা বা থা হচ্ছে মূল নামের সংক্ষেপণ, যার অর্থ দাঁড়ায়, ধর্ম ও জাতিসত্তা রক্ষার সংস্থা, ইংরেজিতে ‘পিএবি’ও বলা হয়। নাম থেকে যেমন বোঝা যায়, এদের মূল লক্ষ্য হলো মিয়ানমারের বৌদ্ধজন-গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র জাতীয়তাবাদী সহিংস চেতনা সৃষ্টি করা। যে কোন অঞ্চলে যে কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টির প্রধান উপাদন হলো অন্য কোন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হিংসা, বিদ্বেষ ও হিংশ্রতার বীজ বপন করা। বস্তুত হিংসা ও হিংশ্রতা ছাড়া এবং আত্মঅহঙ্কার ছাড়া জাতীয়তাবাদ কখনো বেঁচে থাকতেই পারে না, এগুলোই জাতীয়তাবাদের প্রাণশক্তি, বা জ্বালানী শক্তি। মিয়ানমারের ভিক্ষুসমাজ বৌদ্ধধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে পুষ্টি যোগানোর জন্যই মূলত গোটা সমাজে আগুনের লেলিহান শিখার মত মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য শুরু থেকেই উঠে পড়ে লেগেছিলো। মিয়ানমারে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আরো অনেক ছিলো। এর মধ্যে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘প্রথম পছন্দ’রূপে গ্রহণ করার কারণ হলো, ইসলামই একমাত্র ধর্ম, যার রয়েছে পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন ও বিধানব্যবস্থা। মুসলিম জনগোষ্ঠী পৃথিবীর বুকে একমাত্র জনগোষ্ঠী যা যে কোন মূল্যে নিজের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ও আকীদা-বিশ্বাসগত কস্বীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর। এ জন্যগোষ্ঠী তার দীর্ঘ ইতিহাসে কখনো কোন বৃহৎ জানগোষ্ঠীর স্রোতধারায় নিজেকে বিলীন করতে প্রস্তুত নয়। এজন্যই পৃথিবীর যেখানে যখন যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়াবাদের আন্দোলন দানা বেঁধেছে সেখানে ইসলাম ও মুসলিম জনগোষ্ঠীই হয়েছে তার প্রথম টার্গেট ও সহজ লক্ষ্যবস্তু। বৌদ্ধ ধর্মের সংসার বিরাগী, ভোগবিলাসত্যাগী এবং অহিংসার পূজারী ভিক্ষুরা একসময় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে সামনে অগ্রসর হয় এবং রাজনীতির মঞ্চ দখলের চেষ্টায় মেতে ওঠে। তাদের মূল লক্ষ্য হলো শাসনক্ষমতা দখল এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে মিয়ানমারের মাটি থেকে, বিশেষ করে রাখাইনের জনপদ থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমূলে উচ্ছেদসাধন। রাজনীতির মঞ্চে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলো অং সান সূ চীর গণতন্ত্রপন্থী দল এন এল ডি। এ কারণে মা বা থা অং সান সূ চী- এর বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা চালায় যে, তিনি বৌদ্ধ মতাদর্শের বিরোধী এবং মুসলিমতোষণবাদী নেত্রী। এ দিকে নির্বাচনের সময় দেখা গেলো মুসলিম জনগোষ্ঠী সূ চীর দলকে একতরফা সমর্থন দিচ্ছে। এতে মা বা থা-এর সূ চীবিরোধী প্রচারণায় আরো যেন জোর হাওয়া লাগে। এক্ষেত্রে সূ চীও তাই করলেন যা করে থাকে ক্ষমতার মোহে অন্ধ যে কোন রাজনীতিবিদ। রাজনীতিতে সাহসিকতার সঙ্গে আদর্শবাদকে আকড়ে ধরার পরিবর্তে তিনিও গা ভাসিয়ে দিলেন সস্তা জনপ্রিয়তার স্রোতে। মিয়ানমারের বৌদ্ধসমাজে ভিক্ষুসঙ্ঘ তত দিনে এতটাই অপ্রতিরোধ্য প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী হয়ে উঠেছে যে, বিচলিত সূ চীও বলতে শুরু করলেন, মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি তার কোন সহানুভূিত নেই। তিনিও বৌদ্ধসমাজ ও ভিক্ষুসঙ্ঘের নীতিতে বিশ্বাসী। এদিকে ক্ষমতার অন্যতম শক্তিশালী দাবীদার সামরিকচক্র পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূেল ব্যবহার করার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে। এভাবেই ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, ক্ষমতালোভী গণতন্ত্র ও সমরতন্ত্র ভিক্ষুসঙ্ঘের জাতীয়তাবাদী চেতনার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে আজ মেতে উঠেছে মিয়ানমার ও রাখাইনের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গানিধনের জঘন্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আপোশহীন নেতৃতদ¡ানের মাধ্যমে যখন অং সান সূ চীর অভাবিতপূর্ব উত্থান ঘটলো এবং বিশ্বব ্যাপী তার পর্বতপ্রমাণ ইমেজ গড়ে উঠলো, আর তিনি গণতন্ত্রের ‘দেবী’রূপে সারা বিশ্বে বরিত হলেন তখন অনেকে আশা করেছিলেন, সূ চী এবার হয়ত রুখে দাঁড়াবেন ভিক্ষুসঙ্ঘের সহিংস প্রচারণার বিরুদ্ধে। সূ চীর আন্তরিক শুভাকাক্সক্ষী প্রখ্যাত রোহিঙ্গা মুসলিম নেতা উ কিনি তাকে যথেষ্ট সাহস যোগালেন, অনুপ্রাণিত করলেন নিজের ব্যক্তিত্বকে ঋজু করে দাঁড়ানোর জন্য। খুব কম মানুষেরই জানা যে, সূ চী আসলে কখনোই ঋজু ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন না। উকিনিই ছিলেন তাকে প্রেরণা দানকারী। আর এ জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষুসঙ্ঘ তাকে লক্ষ্যস্থল বানায় এবং প্রকাশ্য রাজপথে তাকে হত্যা করে। সূ চী তার শোকবার্তায় এ হত্যাকা-কে ঘৃণ্য সন্ত্রাসবাদ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, আর ভিক্ষুসমাজ প্রকাশ্যে এটিকে স্বাগত জানিয়েছিলো। এর পর সূ চীর সামনে ক্ষমতার মসনদ রক্ষা করার জন্য মাবাথা- এর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কোন পথ খোলা থাকলো না। একটি পথ ছিলো সাহসিকতা ও আত্মমর্যাদার পথ, কিন্তু মেরুদ-হীন ব্যক্তিত্বের অং সান সূ চী সহজ পথটাই গ্রহণ করলেন। পৃথীবির সবচে’ নন্দিত আসন থেকে সবচে’ নিন্দিত াস্থনে যে তার পতন হলো তাতেও আজ তার কোন পরোয়া নেই। মুসলিম রক্তে যত গা-ধোয়ার প্রয়োজন হোক তিনি তা করবেন। বিশ্বসম্প্রদায়ের যত নিন্দা-ঘৃণা ও ধিক্কার কুড়াতে হয় তিনি কুড়াবেন, তবু ক্ষমতার উষ্ণ উত্তাপ যত সামান্য পরিমাণেই হোক তাকে পেতেই হবে। আজ সামরিক জান্তা গর্বের সঙ্গে বলছে, সূ চী আমাদের সঙ্গে আছেন, ভিক্ষুসঙ্ঘ বলছে, সূ চী আমাদের সঙ্গে আছেন। অর্থাৎ হীনস্বার্থে তিনি সবপক্ষকে ছাড়পত্র দিয়ে রেখেছেন তার নামের আড়ালে রোহিঙ্গানিধনযজ্ঞ চালানোর, শুধু শর্ত হলো ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোজ দ্বারা তাকে আপ্যায়ন করতে হবে। হায়, সূ চী! হায়, গণতন্ত্রের দেবী!! অশ্বিন বিরাথু মাবাথা-এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরে তিনি মাবাথা-এর ভাইস চেয়ারম্যান পদে বরিত হন। মাবাথা- আন্দোলন সমগ্র মিয়ানমারে তখন এমই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, ষাট শতাংশ যুবক মাবাথা-এর সহিংস আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। মাবাথা তখন ইয়াঙ্গুন ও অন্যান্য অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম স্থগিত রেখে রাখাইন-প্রদেশকে বেছে নেয় এবং উগ্র বৌদ্ধ যুবগোষ্ঠীকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে শুরু করে। তারপর তারা বিভিন্ন অজুহাতে, বা নিজেরাই অজুহাত তৈরী করে ঝঁপিয়ে পড়ে একের পর এক রোহিঙ্গা জনপদের উপর। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য তার প্রধান অস্ত্র ছিলো এই প্রচারণা যে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক বা রাখাইনের নৃতাত্ত্বিক কোন জনগোষ্ঠী নয়। এরা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী। আশ্চর্য! এমন একটা ইতিহাসবিরোধী অবাস্তব প্রচারণাকে অং সান সূ চীও আজ সমর্থন করছেন নিছক ক্ষমতাকে আকড়ে থাকার লক্ষ্যে। তিনি কিন্তু সহজেই এর প্রতিবাদ করতে পারতেন এবং তা গ্রহণযোগ্যতাও অর্জন করতে পারতো। কিন্তু তিনি তা করলেন না। এক্ষেত্রে সেনাবাহিনী প্রথমে পূর্ণ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। পরে সুদরূপ্রসারী চিন্তার ভিত্তিতে সেনাবাহিনীও এ প্রচারণায় শামিল হয়ে যায়, বরং ক্ষমতা ধরে রাখার মোক্ষম উপায় মনে করে নিজেই রোহিঙ্গানিধন- যজ্ঞের নেতৃত্ব গ্রহণ করে। সূ চী আর কিছু না হোক, সেনাবাহিনীর এ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রতিবাদ করতে পারতেন। প্রয়োজনে মহান জাতীয় নেতা তার পিতা অং সান-এর মত প্রাণ বিসর্জন দিতে পারতেন, কিংবা হতে পারতেন গণতন্ত্রের বিজয়ী কন্যা। কিন্তু তিনি প্রতিবাদ করার সাহস পেলেন না। তার ভয় হলো, ভিক্ষুসঙ্ঘ ও সামরিক -চক্র এক হয়ে তাকে ক্ষমতার নড়বড়ে মসনদ থেকে ছিটকে ফেলে দিতে পারে। মাবাথা আন্দোলনের বর্তমান প্রধান পুরুষ অশ্বিন বিরাথু তেমন শিক্ষিত, সংস্কৃিতবান ব্যক্তি নন
তরুণ বয়সে পরীক্ষায় ফেল করার কারণে ঘরছাড়া পলাতক হয়ে তিনি ভিক্ষুবেশ গ্রহণ করেন। তার সমগ্রকর্মকা-ে এবং কথা ও বক্তব্যে অশিক্ষা ও হিং¯্রতার ছাপ রয়েছে। তিনি অতি কর্কস স্বভাবের মানুষ। বিভিন্ন উগ্রতাপূর্ণ অপরাধের কারণে তাকে ২০০৫ সালে ২৫ বছরমেয়াদে কারাদ- দেয়া হয়। কিন্তু ২০১০ সালে রহস্যজনক কারণে তিনি ছাড়া পান। তারপর থেকে তিনি আগুনঝরা ভাষায় সমগ্র মিয়ানমারে মুসলিমবিরোধী হিংসাত্মক বক্তব্য ব্যাপকভাবে প্রচার শুরু করেন। আজ অবস্থা এই দাঁড়িয়েছে যে, সমগ্র মিয়ানমার যেন এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি, যার গর্ভ শুধু মুসলিম বিদ্বেষ, চরম হিংশ্রতা ও নৃশংসতার লাভা উদ্গীরণ হচ্ছে। এটাই এখন বৌদ্ধসমাজের মহান ভিক্ষু নামে নন্দিত বিরাথু-এর মহান ব্রত, যার মাধ্যমে হয়ত তিনি আত্মার নির্বাণ লাভের স্বপ্ন দেখেন। তীব্বতের বৌদ্ধধর্মগুরু ঠিকই বলেছেন, মুসলিমবিদ্বেষী প্রতিটি ভিক্ষুর আজ কর্তব্য হলো মহান গৌতম বুদ্ধের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নেয়া। রাখাইনরাজ্যের বাইরে মান্দালে হচ্ছে মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। অশ্বিন বিরাথু এখন তার সহিংস আন্দোলন ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করে মান্দালে নিয়ে এসেছেন। হাজার বছর ধরে এখানে বসবাসকারী মুসলিমরা অত্যন্ত বিত্তশালী এবং যাবতীয় ব্যবসা বলতে গেলে তাদেরই হাতে। এখানে চীনারাও ব্যবসা করে। কিন্তু মুসলিম কমুনিটির মুকাবেলায় তেমন সুবিধা করতে পারে না। সুচতুর বিরাথু চীনাদের ব্যবসায়িক ব্যর্থতার ক্ষোভকে তার সহিংস আন্দোলনের পক্ষে সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করেন। দেখতে দেখতে সারা মান্দালেতে
যেন মুসলিম বিদ্বেষের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম ব্যবসায়ীদের বয়কটের ডাক দিয়ে সারা শহরে পোস্টার টানানো হয় এবং প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়। শহরবাসীকে সতর্ক করে দেয়া হয়, কেউ যেন মুসলমানদের দোকানে না যায়। মুসলিম কমুনিটি এতে খুবই আতঙ্কিত ও দিশেহারা হয়ে পড়ে। কারণ এতদিন তারা ধরে নিয়েছিলো ব্যবসাই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। সওদাগরির বাইরে তাদের কোন জাতীয় দায়দায়িত্ব নেই। ২০১৩ সালে মাবাথা-এর আন্দোলন এক নতুন মোড় গ্রহণ করে। তারা দাবী জানাতে থাকে মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মাবাথা বড় মাপের একটা প্রচারণা শুরু করে যে, ওরা সুপরিকল্পিতভাবে বহু বিবাহের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটিয়ে চলেছে। স্পষ্টতই এটা ছিলো রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাপ্রসতূ প্রচারণা। কিন্তু ধর্মমন্ত্রণালয় মাবাথা-এর প্রচারণা ও দাবীর মুখে ‘জনসংখ্যানিয়ন্ত্রণ ও একবিবাহ আইন’ পাশ করে। বস্তুত এটা ছিলো রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি সরাসরি এক নগ্ন হস্তক্ষেপ। রাখাইন ও মগ পুরুষেরা স্বভাবতই অলস, মদ্যপ ও ভোগবাদী। তাদের মেয়েরা প্রচরু কাজ করে। আর ঐ কষ্টার্জিত উপার্জন পুরুষেরা ভোগবিলাসে উড়িয়ে দেয়। এ কারণে বর্মী পুরুষদের প্রতি বর্মী নারীদের ভিতরে রয়েছে অব্যক্ত একটা ঘৃণা। তাই রাখাইন নারীরা রোহিঙ্গা পুরুষদের বিবাহ করতে পছন্দ করে, যাদের সংখ্যা কম নয়। এটাও ছিলো মাবাথা-এর দ্বিতীয় লক্ষ্য। তাদের দাবীর মুখে আন্তধর্মীয় বিবাহ বা ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমে বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য রাষ্ট্রীয় অনুমোদনপ্রাপ্ত একটি সংগঠন রয়েছে, যার নাম সঙ্ঘ মহানায়ক। মিয়ানমারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা রয়েছে এবং রয়েছে বিভিন্ন পথ ও পন্থার প্রচার। এগুলোকেএকটা কাঠামোতে এনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই হলো উদ্দেশ্য। কারণ যে কোন জাতীয় ইস্যুতে বৌদ্ধদের সম্মিলিত শক্তি অতি সিদ্ধান্তমলূক হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এই ভিক্ষুরাই ‘গেরুয়া বিপ্লব’ ঘটিয়েছিলো। সঙ্ঘমহানায়কের সঙ্গে মাবাথার ভয়াবহ রকমের বিরোধের কথা বলা হয়। মাবাথা হচ্ছে সহিংসতাবাদী ভিক্ষুদের সংগঠন। এরা রাষ্ট্রপরিচালিত সঙ্ঘমহানায়কের আদেশ অমান্য করে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না। ফলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, পুরো বিষয়টি আইওয়াস ছাড়া আর কিছু নয়। ৭ইমে ২০১২ সালে মাবাথা চারবছর পূর্তি উপলক্ষে প্রায় দুই হাজার চরমপন্থী ভিক্ষুদের দু’দিনব্যাপী সম্মেলন করেছে ইয়াঙ্গুনে। সেখানে তারা সোজাসাপ্টা ভাষায় জানিয়ে দেয়, সঙ্ঘমহানায়কের কোন নির্দেশ তারা মান্য করবে না। তবু এর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি ।আসলে অশ্বিন বিরাথুর ক্যারিশমাটিক ভাবমর্যাদা তৈরী করাই হচ্ছে এর আসল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে সবচে’ বড় দুঃখের বিষয় এই যে, ভিক্ষুসঙ্ঘের মুসলিম- বিদ্বেষ ছড়ানোর যে আন্দোলন তা কিন্তু একদিনে বর্মিজসমাজে এতটা গভীর শেকড় লাভ করেনি। দশকের পর দশক তারা কাজ করেছে ইসলাম ও মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে। সেই পঞ্চাশের দর্শকে বার্মার মুসলমানদের উদ্দেশ্যে এ বিষয়েই অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন মুসলিম উম্মাহর অন্তর্জ্ঞানী ও অন্তদর্র্শী চিন্তানায়ক আল্লামা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রাহ.। বার্মার মুসলমমানদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তার ঐতিহাসিক বয়ানের অনুবাদ আমরা বর্তমান সংখ্যায় প্রকাশ করেছি। বস্তুত এ ছিলো এমন এক সতর্কবাণী যার উপর আমল করলে ভিক্ষুসঙ্ঘের এ সহিংস আন্দোলন কিছুতেই আজকের ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারতো না। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপরও নেমে আসতে পারতো না এত ভয়াবহ নিধনজ্ঞ। তিনি বলেছিলেন, আমার কথা এখন যদি তোমরা না শোনো, আর তোমাদের উপর সেই বিপদ নেমে আসে যার আশঙ্কা আমি করছি, যার আলামত আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি তাহলে মনে রেখো, তখন কেউ তোমাদের সাহায্য করতে পারবে না। আজ থেকে দীর্ঘ চারদশক আগে যে ভবিষ্যদ্বাণী উম্মাহর এই দরদী মানুষটি করেছিলেন, কেউ তখন সেটাকে গুরুত্ব দেয়নি। ওয়ায শুনতে এসেছিলো, ওয়ায শুনে চলে গিয়েছিলো। এর বেশী কিছু যেন নয়। কিন্তু সে আশঙ্কাটাই আজ এত বড় আযদাহার রূপ ধারণ করে মুখ হা করে পুরো আরাকানের মানচিত্রকে গ্রস করতে উদ্যত হয়েছে। উম্মাহর দরদীদের সতর্কবাণীকে কখনো উপেক্ষা বা অবহেলা করতে নেই। *

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা