জাতিসঙ্ঘে পাকপ্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ভাষণ
(সংক্ষেপিত)
একটি নিরপেক্ষ পর্যালোচনা
... মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বলার মত কথা তো অনেক, তবে এখন আমি চারটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে চাই। প্রথমে জলবায়ুপরিবর্তন সম্পর্কে।.... পাকিস্তান পৃথিবীর ঐ দশটি দেশের একটি যারা জলবায়ুপরিবর্তনের কারণে সবচে’ বেশী ঝুঁকির সম্মুখীন। কৃষিপ্রধান দেশ হিসাবে আমরা নদী ও পানির উপর নির্ভরশীল। আমাদের নদীগুলোর আশিভাগ পানি আসে পর্বতের হিমবাহ বিগলিত হয়ে, যা দ্রুত গলে যাচ্ছে। এটা যদি চলতে থাকে...
জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে পাকিস্তানের একার পক্ষে কিছু করা তো সম্ভব না... তবে এটা বাস্তব সত্য যে, আল্লাহ্ তা‘আলা মানবকে এমন শক্তি দান করেছেন যে, আমরা সম্মিলিতভাবে অনেক কিছু করতে পারি।... আমি আশা করি, জাতিসঙ্ঘ এক্ষেত্রে...।
ধনীদেশগুলোকে বাধ্য করতে হবে যাতে তারা ঐ গ্যাস নিয়ন্ত্রণে রাখে যা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিকর ভূমিকা রাখছে।
দ্বিতীয় যে বিষয়ে কথা বলতে চাই তা পাকিস্তানের জন্য এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর গরীব দেশগুলো থেকে ধনী দেশগুলোতে বিপুল অর্থ পাচার হয়ে যায়। গরীব দেশের বিপুল সম্পদ ধনীদেশগুলোর ব্যাংকে জমা হয়। এই অর্থ পাচার গরীব দেশগুলোকে শেষ করে দিচ্ছে। তারা শুধু ঋণের বোঝার তলে চাপা পড়ছে। দুঃখের বিষয় হলো, ধনীদেশগুলো এটাকে কোন অপরাধই মনে করে না, যেমন অপরাধ মনে করে মাদকদ্রব্যের উৎস থেকে আগত অর্থ এবং সন্ত্রাসবাদের অনুকূলে ব্যবহৃত অর্থকে...
আমরা আমাদের সম্পদ ফিরে পেতে চাই, যাতে দেশের গরীব জনসাধারণের কল্যাণে তা ব্যয় করতে পারি, কিন্তু আইন ওখানে এমনভাবে তৈরী, যাতে অর্থ পাচারকারী অপরাধীরা সুরক্ষা পেয়ে যায়, আর সম্পদ ফেরত আনার প্রচেষ্টায় আমরা জটিলতার মুখে পড়ি। ... আমি মনে করি এ বিষয়ে ধনীদেশগুলোর দায়দায়িত্ব রয়েছে। তাদের ওখানে এমন আইন থাকা দরকার যাতে অপরাধীরা অর্থপাচার করতেই না পারে। আমি সতর্ক করতে চাই যে, এভাবে গরীব যদি আরো গরীব, আর ধনী আরো ধনী হতে থাকে তাহলে পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাবে। সুতরাং আমি আশা করি, আইএম এফ, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন সংস্থা, এসবের মাধ্যমে গরীব দেশগুলোকে শোষণের যে ধারা চলছে তা রোধ করার...
আমার আলোচনার তৃতীয় বিষয় হচ্ছে পাশ্চাত্যের ইসলামভীতি। পৃথিবীতে প্রায় একশ ত্রিশকোটি মুসলিম বাস করে। নাইন ইলাভেনের পর ইসলামভীতি আশঙ্কাজনক পর্যায়ে বেড়ে গিয়েছে। মানবজাতি তো একসঙ্গে বসবাস করে। সুতরাং একে অপরকে সঠিকভাবে বুঝতে হবে। অথচ তিক্ত সত্য এই যে, ইসলাম-ভীতির কারণে আমরা একে অপরথেকে দূরে সরে যাচ্ছি। মুসলিম নারী যদি হিজাব পরে, সেটাকেও কিছু দেশে... হিজাব কি কোন অস্ত্র? কতিপয় দেশে নারী (ইচ্ছা হলে) বস্ত্রত্যাগ করতে পারে, কিন্তু (ইচ্ছামত) বস্ত্রধারণ করতে পারে না। এটা কীভাবে হতে পারে! কারণ আর কিছু না, শুধু ইসলামভীতি। এটা শুরুই হয়েছে এজন্য যে, পশ্চিমা দেশের কতিপয় নেতৃবৃন্দ সন্ত্রাসকে ইসলামের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। ইসলামী সন্ত্রাস, চরমপন্থী ইসলাম, এজাতীয় শব্দ তৈরী করা হয়েছে। চরমপন্থী ইসলাম জিনিসটা কী? ইসলাম তো একটাই যা মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছেন, যা আমরা অনুসরণ করি। এছাড়া আর কোন ইসলাম নেই। তো আপনারা ‘চরমপন্থী ইসলাম’জাতীয় পরিভাষা দ্বারা পশ্চিমা জাতিবর্গকে কী বার্তা দিতে চাচ্ছেন? ... সন্ত্রাসের সঙ্গে তো ধর্মের কোন সম্পর্ক থাকতে পারে না! অথচ ইসলাম ও সন্ত্রাসকে এক করে পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে, যার কারণে মুসলমানদের অনেক কষ্ট হয়। আমরা যখন পশ্চিমা দেশে যাই তখন কঠিন থেকে কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হই।
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আমি কি বলতে পারি যে, ইউরোপীয় দেশগুলোতে মুসলিমদের দাবিয়ে রাখা হচ্ছে, কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে? আর সবারই জানা আছে যে, যখন আপনি বিশেষ কোন সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করেন তখন তাদের মধ্যে চরমপন্থা জন্মলাভ করবে। জঙ্গিবাদের সঙ্গে যাদের সম্পর্ক, তাদের অধিকাংশ এমন যে, কোন না কোনভাবে তারা যুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমি বলতে চাচ্ছি, এ বিষয়টার সমাধান হওয়া দরকার। আফসোসের বিষয়, আমাদের মুসলিম রাষ্ট্রনেতাগণও এর সমাধানের চেষ্টা করেননি। আমরা এটা বুঝাতে চেষ্টা করিনি যে, ইসলামী চরমপন্থা অলিক কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। চরম পন্থা ইহুদি, খৃস্টান, হিন্দু সব সম্প্রদায়ে কিছু না কিছু থাকে। কিন্তু এর অর্থ তো এই না যে, ধর্ম চরমপন্থার শিক্ষা দিচ্ছে! সব ধর্মই শিক্ষা দেয় প্রেম-প্রীতি ও সহমর্মিতা। এটাই তো আমাদেরকে পশু থেকে পৃথক ও বিশিষ্ট করে।
দুর্ভাগ্য, মুসলিম নেতৃবর্গ এ ভয়ে গুটিয়ে ছিলেন যে, তাদের উপরো চরমপন্থার তকমা এঁটে দেয়া হবে। তাই তারা মধ্যপন্থী ও উদারপন্থী সাজার চেষ্টা করেছেন। ...
এটা কী আজীব অবস্থা যে, নাইন ইলাভেনের কারণে মুসলিম জাতিকে সন্ত্রসী বলা হচ্ছে, আত্মঘাতী হামলাবাজ বলা হচ্ছে। অথচ সবচে’ বেশী সন্ত্রাসী ও আত্মঘাতী হামলা তামিলরা করেছে, যারা হিন্দু ছিলো। অথচ এ কারণে তো হিন্দুধর্মকে, হিন্দুজাতিকে...! আমরাও বলি, হিন্দুধর্ম এটা শেখায় না। এটা শ্রীলঙ্কায় তারাই করেছে যাদের বেঁচে থাকাই কঠিন করে তোলা হয়েছিলো। ...
আমি মনে করি, পশ্চিমা বিশ্বকে আসল সত্য বলার প্রয়োজন রয়েছে। আমি দীর্ঘকাল ইউরোপে ছিলাম। আমি জানি, ধর্মকে আমরা যে দৃষ্টিতে দেখি তারা সে দৃষ্টিতে দেখে না। ...
ইসলামকে অসহিষ্ণুতার ধর্ম মনে করা হয়। এটা এজন্য যে, তারা আমাদের নবী সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করে, আর মুসলমানদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়... আমি পশ্চিমা বিশ্বের একটা বিশেষ শ্রেণীকে এজন্য দায়ী মনে করি, যারা বুঝে শুনে মাঝে মধ্যে এধরনের ঘৃণ্য আচরণ করে। কেননা তারা জানে, এর প্রতিক্রিয়া মুসলিম জাহানে কী হবে! পশ্চিমা বিশ্ব সাধারণ-ভাবে এটা জানেই না যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থান আমাদের কাছে কী! আমাদের অন্তরে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা কী পরিমাণ!
আমরাও তাদের এটা বোঝাতে পারিনি। আমি আজ এই বিশ্বমঞ্চ থেকে আপনাদের বলছি, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য কী? তিনি আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের বাহক ও সাক্ষী। আর কোরআন মুসলিম উম্মাহর জন্য ঐশী জীবনবিধান, আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক। আর তাঁর পুরো জীবন ছিলো কোরআনের বাস্তব নমুনা ও জীবন্ত আদর্শ। তিনি ‘মদিনা রাষ্ট্র’ কায়েম করেছিলেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম ‘কল্যাণরাষ্ট্র’ ছিলো। আর এটা ছিলো মুসলিম উম্মাহর তাহযীব তামাদ্দুন ও সভ্যতা-সংস্কৃতির বুনিয়াদ, যা সাতশ বছর পর্যন্ত পৃথিবীর সবচে’ শানদার সভ্যতারূপে বিদ্যমান ছিলো।
সেই মদীনারাষ্ট্র আসলে ছিলো কী? ইসলাম সম্পর্কে আমি আজীব আজীব কথা শুনতে পাই যে, ইসলাম নারীবিরোধী, সংখ্যালঘুবিদ্বেষী, ইত্যাদি। অথচ মদীনাই হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে সেই প্রথম কল্যাণরাষ্ট্র যেখানে অভাবী, প্রতিবন্ধী, এতীম-বিধবা ও দুর্বলদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সেখানে ধনীদের থেকে ‘গ্রহণ’ করা হয়েছে, আর গরীবের মধ্যে ‘বিতরণ’ করা হয়েছে। এ রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে যে, সমস্ত মানুষ হযরত আদমের সন্তান, রক্ত ও বর্ণের ভিত্তিতে কারো উপর কারো কোন বিশিষ্টতা নেই। পয়গম্বরে ইসলাম ঘোষণা করেছেন, গোলাম আযাদ করা অনেক বড় ছাওয়াবের কাজ। তখন পুরো সমাজব্যবস্থাই ছিলো দাসভিত্তিক। তিনিই সর্বপ্রথম মানবজাতিকে দাসত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য প্রথম বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সুস্পষ্ট আদেশ ছিলো, গোলামকে যেন সমান মর্যাদার নাগরিক মনে করা হয়। একারণেই মুসিলম জাহানে গোলামও বাদশাহ হতে পেরেছে। ইসলাম তো সংখ্যালঘুদের সঙ্গে চূড়ান্ত সদাচরণ করেছে। ইসলাম সম্পর্কে এধারণা ভুল যে, সংখ্যালঘু-অধিকার রক্ষা করা হয় না। পয়গম্বরে ইসলাম ঘোষণা করেছেন, অমুসলিম উপাশনালয়-গুলোকে যেন নিরাপত্তা দেয়া হয়; আইনের দৃষ্টিতে সমস্ত নাগরিক সমান অধিকার রাখে...। আমি সবসময় ঐ মোকদ্দমার কথা বলি যেখানে ইসলামের চতুর্থ খলীফা, যিনি রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, এক সাধারণ ইহুদী নাগরিকের সঙ্গে মোকদ্দমায় হেরে গিয়েছিলেন, শুধু সাক্ষীর অভাবে, অথচ তিনি হকের উপর ছিলেন। ...
সুতরাং এটা অবরাধিত যে, কোন মুসলিম সমাজে যদি বিপরীত কিছু ঘটে তাহলে সেটা হবে নবী ও তার আদর্শ থেকে বিচ্যুতি।
তো পশ্চিমা বিশ্বকে এটা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের দিলের মধ্যে বাস করেন। সুতরাং তার শানে গোসতাখি হলে আমাদের দিলে কষ্ট হয়। আর এটা তো আমরা জানি যে, দিলেরদরদ জিসিমের দরদের চেয়ে অনেক যন্ত্রণাদায়ক। এটাই কারণ যে, মুসলিমদের পক্ষ হতে তীব্র প্রতিক্রিয়া আসে। সবসময় আমি চেয়েছি যে, যখনই সুযোগ হবে, বিশ্বসমাজকে, বিশেষ করে পশ্চিমা সমাজকে একথাগুলো আমি বলার চেষ্টা করবো। কারণ তাদের জানাই নেই যে, এটা কতটা নাযুক ও সংবেদনশীল বিষয়।
একজন যুবক হিসাবে যখন আমি ইংল্যান্ড গেলাম, দেখি, সেখানে হযরত ঈসা আ. এর উপর কমেডি ফিল্ম তৈরী করা হয়েছে, তাতে কোন প্রতিক্রিয়াই হয়নি! অথচ কোন মুসলিম সমাজে কোন নবী সম্পর্কে এটা চিন্তাও করা যায় না। সুতরাং বুঝতে হবে, এসব দ্বারা মুসলিম উম্মাহর দিলে কী পরিমাণ কষ্ট যায়! ... মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে, আল্লাহর দোহাই এমন কিছু করবেন না, আমাদের দিলে কষ্ট হয়। আমাদের প্রিয় নবীর শানে কোন গোসতাখি কখনো করবেন না। ইহুদিদের গণহত্যা সম্পর্কে পশ্চিমা সমাজ এতটাই স্পর্শকাতর যে, ... তো সেই স্পর্শকাতরতা মুসলমানদের ক্ষেত্রেও তো মনে রাখতে হবে! সমস্ত বাকস্বাধীনা এখানে কেন? সহিষ্ণুতার সমস্ত উপদেশ এখানে কেন?
মিস্টার প্রেসিডেন্ট এখন আমি চতুর্থ বিষয়টির দিকে আসছি যা আমার দৃষ্টিতে (বর্তমান প্রেক্ষাপটে) সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ। আর এ বিষয়টির কারণেই আমি এখানে এসেছি। ... আমি কাশ্মীর সম্পর্কে বলতে চাই। এর আগে সামান্য একটু ভূমিকা। আশির দশকে যখন সোভিয়েতের বিরুদ্ধে আফগান জিহাদ শুরু হলো তখন আমরা তার অংশ হলাম। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, আর পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা অর্থায়ন করেছে। রুশরা তাদের বলতো সস্ত্রাসী, আমরা এবং পশ্চিমা বিশ্ব বলতাম মুজাহিদীন, ফ্রিডম ফাইটার। এর পর যখন আমেরিকা আফগানিস্তানে ‘এলো’ তখনো পাকিস্তান ঐ যুদ্ধের অংশ হলো। আর তখন তারা হয়ে গেলো সন্ত্রাসী, যাদের আমরাই তৈরী করেছি এবং মুজাহিদীন বলেছি...!
আমি ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করেছি। ক্রিকেটের সূত্রে ভারতে আমার বহু ভক্ত রয়েছে। কারণ উপমহাদেশে ক্রিকেট সীমাহীন জনপ্রিয়। ...
আমি নরেন্দ্র মোদিকে বললাম, দেখুন, আমাদের সমস্যা অভিন্ন। যেমন জলবাযু ও দারিদ্র্য। আসুন আমরা পরস্পর আস্থার ভিত্তিতে একসঙ্গে এগুলোর সমাধান করি এবং সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করি।
নরেন্দ্র মোদি বললেন, পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসী হামলা হয়। আমি বললাম, এ অভিযোগ তো আমাদেরও আছে বেলুচিস্তানে এবং প্রমাণ আছে; বলভূষণ যাদবকে আমরা ধরেছি।... আসো এগুলো ভুলে আমরা আগে বাড়ি। ... কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, এ ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি হলো না। আমরা ভাবলাম, ভারতে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আর এরা হলো চরম হিন্দু-জাতীয়তাবাদী দল। এখন এরা পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চায় না। ভাবলাম, ঠিক আছে, নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করি। ...
এর মধ্যে বিশবছর বয়সের এক কাশ্মীরী তরুন আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে ...। তার বাবার বক্তব্য অনুযায়ী তাকে চরমপন্থী বানিয়েছে ভারতের সিকিউরিটি বাহিনী।
সঙ্গে সঙ্গে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো। আমি টেলিভিশনের মাধ্যমে ভারতীয় জনগণকে বললাম, সামান্য কোন প্রমাণও যদি তারা দিতে পারে, আমি ব্যবস্থা নেবো।
প্রমাণ দেয়ার পরিবর্তে তারা বিমান হামলা চালালো। আমরা দু’টো বিমান ভূপাতিত করলাম। একজন পাইলটকে ধরলাম এবং শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ ছেড়েও দিলাম। এটাকে তারা শান্তির বার্তা মনে না করে আমাদের দুর্বলতা মনে করলো। মোদি তার নির্বাচনী প্রচারণায় সারাক্ষণ বলে বেড়ালো যে, পাকিস্তানকে কী উচিত শিক্ষা দিয়েছে! তারা নাকি তিনশপঞ্চাশ সন্ত্রাসীকে খতম করেছে, যা ছিলো সফেদ ঝুট... নির্বাচনী প্রচারণায় মোদি বললেন, এটা তো শুধু ট্রেলর, পুরো মুভি এখনো বাকি আছে। আমি ভাবলাম নির্বাচনী প্রচারণায় কত কিছুই বলা হয়। নির্বাচনের পর সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নির্বাচনের পর আমরা যোগাযোগ করলাম, কোন জবাব এলো না, উল্টো ... তখন আমরা বুঝলাম যে, মোদির কোন এজেন্ডা রয়েছে। আর সেই এজেন্ডা ফাঁস হলো ৫ই আগস্ট। ভারত নিরাপত্তাপরিষদের এগারোটি প্রস্তাব লঙ্ঘন করে, যাতে বলা হয়েছে যে, কাশ্মীর একটি বিরোধপূর্ণ অঞ্চল এবং কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার রয়েছে। তারা শিমলা চুক্তিও লঙ্ঘন করেছে যাতে বলা হয়েছে, সমস্যাগুলো দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে। আসলে তারা ভারতীয় সংবিধানেরও বিরুদ্ধাচরণ করেছে। তারা সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করেছে যার মাধ্যমে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছিলো। এরপর কাশ্মীরে তারা অতিরিক্ত একলাখ আশি হাজার সৈন্য পাঠিয়েছে। এখন কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর মোট সংখ্যা হচ্ছে নয় লাখ। তারা আশি লাখ কাশ্মীরীকে কারফিউ লাগিয়ে বন্দী করে রেখেছে।
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, কেউ এটা কীভাবে করতে পারে?
এখন আমাকে স্পষ্ট করতে হবে যে, আরএসএস কী? নরেন্দ্র মোদি আরএসএস-এর আজীবন সদস্য। আরএসএস হিটলার ও মুসলিনি দ্বারা প্রভাবিত। এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯২৫ সালে। এ দলটা সাম্প্রদায়িক বৈষম্যে বিশ্বাস করে এবং মনে করে যে, হিন্দুরা আর্যরক্তের অধিকারী। একই বিশ্বাস পোষণ করতো নাৎসীদল। ... এটা জানা খুব জরুরি, যাতে বোঝা সম্ভব হয় যে, ভারতে এখন কী হচ্ছে। আরএসএস ভারতে মুসলিম জাতিগত উচ্ছেদের নীতিতে বিশ্বাস করে। হিন্দুজাতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং মুসলিম ও খৃস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা, প্রথম থেকেই এটাই হলো তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। তারা মনে করে, হিন্দুত্ববাদের স্বর্ণালী সময়ের ধারাবাহিকতা মুসলিম শাসন ও বৃটিশশাসনের কারণে ছিন্ন হয়েছে। এটা আরএসএস প্রতিষ্ঠাতাদের প্রকাশ্য বক্তব্য। আপনি গুগুলে যান, সব জানা হয়ে যাবে। ... এ বিশ্বাস থেকেই মোদি ২০০২ সালে গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মুসলিম গণহত্যা চালিয়েছে। আরএসএস-এর গু-ণ্ডারা তিনদিন পর্যন্ত লাগাতার মুসলমানদের পাইকারী হত্যা করতে থাকে। ... কংগ্রেসের সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন যে, আরএসএস-এর শিবিরগুলোতে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। একারণেই নরেন্দ্র মোদির আমেরিকায় প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিলো। আমাকে এগুলো বলতে হচ্ছে এটা বোঝানোর জন্য যে, এ কেমন ভয়াবহ মানসিকতা, যার কারণে নয় লাখ ফৌজ দ্বারা আশি লাখ জনতাকে আবদ্ধ রাখা হয়। নরী-শিশু-বৃদ্ধ-অসুস্থ সবাইকে পশুর মত আটকে রাখা হয়েছে। বৃটেন সম্পর্কে আমি জানি যে, ওখানে যদি আশি লাখ পশুকেও আটকে রাখা হতো তাহলে অনেক বেশী শোরগোল হতো। এরা তো তবু মানুষ।
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, রক্ত ও বর্ণের বৈষম্যবোধ থেকেই অহঙ্কারের জন্ম। আর অহমিকা ও অহঙ্কারই যুলুম -অত্যাচার ও পাশবিকতা-বর্বরতার উৎস। এ অহঙ্কারের কারণেই মোদি অন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার জানা নেই, কারফিউ তুলে নেয়ার পর কী হবে? সে কি মনে করে যে, কাশ্মীরের জনগণ নীরবে সব মেনে নেবে?...
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, বিগত ত্রিশবছরে একলাখ কাশ্মীরী শহীদ হয়েছে। কারণ তাদেরকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেয়া হয়নি, যা জাতিসঙ্ঘ তাদের দেয়ার কথা বলেছিলো। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সংস্থার দু’টি প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছে যে, কাশ্মীরে এগার হাজার নারীর সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে। সরা পৃথিবী এ বিষয়ে কিছুই করেনি। কারণ ভারত একশ বিশকোটি মানুষের বাজার। আফসোস, বস্তবাদকে মানবতাবাদের উপর অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এর পরিণতি ভয়াবহ হবে। আমি একথাটা বলতেই এখানে এসেছি। দেখুন, যখন কারফিউ ওঠানো হবে তখন ‘খুনের দরিয়া’ বয়ে যাবে। মানুষ বাইরে বের হবে যেখানে নয়লাখ ফৌজ রয়েছে। ফৌজ তো কাশ্মীরে সমৃদ্ধ আনার জন্য যায়নি, যেমন মোদি বলছে। মানুষ বের হবে, তখন ফৌজ কী করবে? মোদি কি বিষয়টা চিন্তা করে দেখেছে?
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, কোন একজন মানুষও কি চিন্তা করেছে যে ওখানে কী ঘটবে? আপনার ধারণায় কাশ্মীরী জনগণের উপর এর কী প্রতিক্রিয়া হবে? আপনার কী মনে হয়, যেভাবে পশুর মত তাদের বেঁধে রাখা হয়েছে; নেতৃবৃন্দের সঙ্গে, এমনকি যারা ভারতবান্ধব তাদের সঙ্গেও যে আচরণ করা হয়েছে: তেরহাজার যুবক নিখোঁজ হয়েছে! আপনার ধারণায় কাশ্মীরী জনতা কী করবে যখন কারফিউ ওঠবে? ...
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, কতলে আমের প্রতিক্রিয়ায় কাশ্মীরে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা বাড়বে, তখন আরেকটা পুলওয়ামা হবে। আর ভারত, যে আগে থেকেই আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে, নতুন নতুন অভিযোগ করবে যে, সব কিছু পাকিস্তানের কারণে হচ্ছে।...
নরেন্দ্র মোদি কি ভাবছে, ভারতের কোটি কোটি মুসলিম কিছুই দেখছে না, কিছুই ভাবছে না যে, কাশ্মীরে মুসলমানদের সঙ্গে কী হচ্ছে? আপনার কি মনে হয় না যে, এতে করে ভারতের আঠারো কোটি মুসলিম ক্যমুনিটিতে চরমপন্থার উন্মেষ ঘটতে পারে? তখন আবার অভিযোগ আসবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আমি আপনাকে সতর্ক করছি যে, আবার আমাদের উপর অভিযোগ আসবে।
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, একশ ত্রিশ কোটি মুসলিম সম্পর্কে আপনার কী ধারণা, যারা সবকিছু নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছে? তারা জানছে যে, কাশ্মীরে যা হচ্ছে তা ওখানকার হিন্দুদের সঙ্গে নয়, বরং শুধু মুসলমানদের সঙ্গে হচ্ছে! তারা জানে যে, যা কিছু হচ্ছে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই হচ্ছে।
আপনি কী মনে করেন, আশি লাখের পরিবর্তে যদি শুধু আট হাজার ইহুদির সঙ্গে এ আচরণ হয়, পশ্চিমা বিশ্ব কী ভাববে? কী করবে? তো আমরা কি নি স্তরের কোন জীব? এতে কি আমাদের কষ্ট হয় না? তখন কী হবে? একশ ত্রিশকোটি মুসলিমের মধ্যে কিছু মুসলিম অস্ত্র হাতে তুলে নেবে। ...
ওয়েস্টার্ন সিনেমাগুলোতে দেখানো হয় যে, যখন কারো উপর যুলুম হয় তখন সে অস্ত্র তুলে নেয়, আর যালিমদের ‘কচুকাটা’ শুরু করে দেয়, পুরো সিনেমা হল তালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে।
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আপনি কি জানেন, আমরা মুসলিম উম্মাহ এখন কী ভাবছি? যদি কতলে আম হয় তখন কিছু মুসলিম চরমপন্থার দিকে যাবে। এটা ইসলামের কারণে নয়, ইনছাফ থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে। একলাখ রোহিঙ্গা মুসলিম নিহত হলো, জাতিগত উচ্ছেদ হলো! বিশ্বসম্প্রদায়ের কী দায়িত্ব ছিলো? আপনার ধারণায় একশ ত্রিশকোটি মুসলিমের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে! নিজেকে আমি কাশ্মীরী কল্পনা করছি, যারা ‘পঞ্চান্ন’ দিনধরে আবদ্ধ। আমি কাশ্মীরী নারীর আবরুলুণ্ঠনের ঘটনা শুনি হানাদার ভারতীয় সেনাদের হাতে, যখন তারা ঘরে ঘরে হানা দেয়। (একজন কাশ্মীরী হিসাবে) আমি কি এই যিল্লাতিসহ বেঁচে থাকবো? বেঁচে থাকতে চাইবো? আমি তো হাতিয়ার তুলে নেবো! আপনারাই জবরদস্তি চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন! মানুষের মধ্যে যখন ‘মর্যাদাপূর্ণ জীবনের’ কোন আশাই থাকবে না তখন কিসের জন্য বেঁচে থাকবে?
এজন্য আমি আবার বলবো, খুবই নাযুক সময় এখন। প্রতিক্রিয়া হবে, পাকিস্তান অভিযুক্ত হবে। দু’টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ মুখোমুখি হবে। এটা হওয়ার আগেই যেন জাতিসঙ্ঘ তার কর্তব্য পূর্ণ করে। এ উদ্দেশ্যেই তো ১৯৪৫-এ জাতিসঙ্ঘের জন্ম। আপনাদের এটা রোধ করতে হবে। আমি মনে করি, আমরা ১৯৩৯ সালে ফিরে গিয়েছি যখন জার্মানি চেকোশ্লোভাকিয়া দখল করে নিয়েছিলো। জাতিসঙ্ঘ কী করবে? একশ বিশকোটির বাজারকে খুশী করবে নাকি ন্যয় ও মানবতার পাশে দাঁড়াবে? এ পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আপনি সঙ্গিনতম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকুন।
মিস্টার প্রেসিডেন্ট, যখন দু’টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে প্রচলিত যুদ্ধ শুরু হয় তখন যে কোন কিছুই ঘটতে পারে। যদি প্রতিবেশীর চেয়ে সাতগুণ ছোট দেশকে এ ফায়ছালা করতে হয় যে, হয় হাতিয়ার ফেলে দাও, না হয় মউত পর্যন্ত আযাদির জন্য লড়াই করে যাও। আমি কী করবো? নিজেকেই আমি প্রশ্ন করছি। আমার ঈমান ও বিশ্বাস, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবূদ নেই। সুতরাং আমি লড়াই করবো। আর যখন এটমিক দু’টো দেশ শেষ পর্যন্ত লড়াই করে তখন তার প্রভাব সীমান্ত পার হয়ে সামনে চলে যায়। সারা দুনিয়ার উপর তার প্রভাব পড়বে। এটাই হলো কারণ আমার এখানে আসার। আমি খবরদার করছি, এটা ধমকি নয়, অস্থিরতার প্রকাশ।
আমরা কোন্দিকে যাচ্ছি? আমি জাতিসঙ্ঘকে একথা বলার জন্য এসেছি যে, আজ এটা আপনার পরীক্ষা। আপনিই তো কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিয়েছিলেন। এটা কার্যকর না হওয়ার কারণে তারা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে।
এখন কিন্ত কাউকে খুশী করার সময় না, যেমন ১৯৩৯ সালে করা হয়েছিলো। এটা হলো আশু পদক্ষেপ গ্রহণের সময়। প্রথম কাজ হলো, ভারত অবশ্যই যেন দীর্ঘ পঞ্চান্ন দিনের অমানবিক আটকদশার ইতি ঘটায়; সমস্ত বন্দীকে মুক্তি দেয়।
তেরহাজার নিখোঁজ যুবকদের এখনই ফিরিয়ে দিতে হবে। মা-বাবা তো জানেই না তাদের সন্তান কোথায় আছে!
সর্বশেষ কথা হলো, বিশ^সম্প্রদায় যে কোন মূল্যে কাশ্মীরীদের যেন তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ফিরিয়ে দেয়। ধন্যবাদ!
আমাদের পর্যালোচনা
প্রথমেই আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব ইমরান খান নিয়াযী ছাহেবকে, জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে তার অনবদ্য ভাষণের জন্য। মুসলিম বিশ্বে তো এখন এমনই ‘কাহর্তু-রিজাল’, এমনই ‘মানবদুর্ভিক্ষ’ যে, কাজের মানুষ তো নেই-ই, ঠিকমত কথা বলার মানুষও নেই। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব ইমরান খান নিয়াযী কেমন কাজের মানুষ তা তো প্রমাণ করবে সামনের সময়, বর্তমানের জন্য এটুকুও অনেক বড় পাওয়া যে, জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের মত বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি অন্তত কথা বলতে পেরেছেন, সাহসের সঙ্গে, প্রজ্ঞা ও কুশলতার সঙ্গে এবং অত্যন্ত উচ্চ স্তরের ভাব ও ভঙ্গির সঙ্গে। ইংরেজী আমি জানি না, একটু আধটু বুঝতে হয়ত পারি, মাশাআল্লাহ্ ... যেমন ভাষা, যেমন শব্দচয়ন, তেমনি কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামা, তেমনি আবেগের স্থানে আবেগের সুসংযত প্রকাশ!
তবে এই ফাঁকে একটা কষ্টের কথা বলি, এ লেখাটা যখন লিখছি, কুয়ালালামপুরে যথারীতি শুরু হয়ে গিয়েছে মুসলিম উম্মাহর বহু প্রতীক্ষিত ‘পাঁচশীর্ষ সম্মেলন’। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বক্তব্যও রেখেছেন। কিন্তু পাঁচজনের অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন ইমরান, যিনি এত উচ্ছ্বাস ও আশাবাদ প্রকাশ করছিলেন এই নতুন ফোরাম সম্পর্কে, হঠাৎ তিনি ‘অনুপস্থিতি’র ঘোষণা দিয়ে বসলেন! পুরো মুসলিম উম্মাহ্ স্তম্ভিত হয়েছে তার এ ঘোষণায়। প্রতিটি গণমাধ্যম বলছে, যে সউদী যুবরাজের ‘প্লেনে’ চড়ে তিনি জাতিসঙ্ঘে গিয়েছিলেন তার চাপের কারণে শেষ মুহূর্তে তিনি পিছু হটেছেন! এ ধারণার কারণ, সিদ্ধান্তটি ঘোষণার আগে তিনি যুবরাজের সঙ্গে দেখা করেছেন সউদী আরব গিয়ে। আমরা তো আশাবাদী হতে চাই,
ফিরে আসি আগের কথায়, পাকপ্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সম্পর্কে প্রশস্তিমূলক আরো অনেক কথাই বলা যেতে পারে। পাশ্চাত্যের ইসলামো ফোবিয়াকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ বক্তব্যে তিনি যা বলেছেন, যদিও তা নতুন কিছু নয়; বহু মুসলিম স্কলার তাদের মুখে ও কলমে বহুবার তা বলেছেন, তবে নতু বিষয় হলো, এই প্রথম কোন মুসলিম রাষ্ট্রনেতার কণ্ঠে এভাবে তা উচ্চারিত হয়েছে। সেই সঙ্গে যদি বক্তব্যের মঞ্চটি বিবেচনায় আনি তাহলে বলতেই হবে, ‘আপনাকে ধন্যবাদ ইমরান!’
এটি ছিলো তার বক্তব্যের তৃতীয় বিষয়। তার মূল বক্তব্য যেহেতু সামনে, সেহেতু আমার মনে হয়ভুলও হতে পারে বক্তব্যে কাটছাট না করেও কিছুটা সংক্ষিপ্ত হতে পারতো। আর আগের দু’টি বক্তব্য তো সংক্ষিপ্ত হওয়াই সঙ্গত ছিলো।
অর্থপাচার সম্পর্কে প্রশ্ন হলো, মূল অপরাধী কারা? গরীব দেশের অর্থ যারা পাচার করছে তারা, না যে দেশে পাচার করা হচ্ছে সেই দেশ? অর্থপাচারকারী ব্যক্তিকে আপনি আইনের আওতায় আনছেন না কেন? ধনী দেশকে আইন করার অনুরোধ করছেন, সে আইনটা আপনার দেশে হচ্ছে না কেন? আপনি বলুন না অপরাধীকে, অর্থ ফেরত আনো, না হয় মৃত্যুদ-ণ্ডের জন্য প্রস্তুত হও! নওয়ায ও তার পরিবারকে এভাবে নাজেহাল করা হলো! দু’টো ডলার কি বের হয়েছে? কোন শর্ত ছাড়াই চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে দিতে হলো আপনাকে, আর আইন করবে ধনী দেশ তার পাচার করা অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য! দুঃখিত মিস্টার ঢ়শ ঢ়স, এ বিষয়টা নিয়ে ‘ঐখানে’ সময়ের অপচয় করার কারণে, আমার মনে হয় কাশ্মীর-প্রসঙ্গটির প্রেজেন্টেশন যথেষ্ট দুর্বল হয়ে গেছে। কারণ সাধারণ পরিষদের মঞ্চ জনতার মঞ্চ নয়।
আমাদের মনে আছে ‘নির্বাচন’-এর আগে ইমরান বলেছিলেন, আইএমএফের কাছে তিনি কিছুতেই যাবেন না! যেতে তাকে হয়েছে! এখন জাতিসঙ্ঘকে বলা হচ্ছে, বিশ^ব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের শোষণ থেকে উদ্ধার করার জন্য! স্যরি, তাহলে জাতিসঙ্ঘকে চিনতেই তাহলে ভুল করা হচ্ছে। বরং ভালো হতো তুরস্কের এরদোগানের পরামর্শ নেয়া। কীভাবে ওদের ঋণের বিরাট বোঝা থেকে তুরস্ককে তিনি বের করে এনেছেন! সদিচ্ছা থাকলে এসব ‘স্থানীয় সমস্যা’ বিশ্বমঞ্চে না নিয়ে তুরস্কের ও এরদোগানের পথ অনুসরণ করা যায়।
এবার কাশ্মীর প্রসঙ্গ। ইমরানের ভাষায় এটাই তার বক্তব্যের মূল অংশ এবং এজন্যই তিনি সাধারণ পরিষদের সভায় উপস্থিত হয়েছেন। আবারো বলতে হয়, এক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। বেশ জীবন্ত ও মর্মস্পর্শীভাবে কাশ্মীরের ‘খুন ও আঁসু’ বিশ্বসম্প্রদায়ের সামনে তিনি তুলে ধরতে পেরেছেন। সবাই জানে, একটা ভাষণে বড় কিছু হয়ে যাবে না, তবে কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। এখন ‘ফাইট’ করার জন্য, আশা করি, নিজেকে এবং দেশের মানুষকে, তারপর মুসলিম উম্মাহকে তিনি প্রস্তুত করবেন। আশা করি, কাশ্মীর উপত্যকার, পাকিস্তানের পবিত্র ভূমির এবং মুসলিম জাহানের প্রত্যেক ‘বান্দায়ে খোদা’কে তিনি পাবেন তিনি ভূমিকাবক্তব্যে আফগানপ্রসঙ্গ এনেছেন, সম্ভবত একটা বড় উদ্দেশ্য ছিলো এবিষয়টি তুলে ধরা যে, রুশরা যাদের বলেছে সন্ত্রাসী, আমরা এবং আমেরিকা তাদের বলেছে মুজাহিদীন, কেন? সেই মুজাহিদীন যখন আমেরিকার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলো, তখন আমাদের কাছে এবং আমেরিকার কাছেই তারা হয়ে গেলো সন্ত্রাসী, কেন? ইমরান খান সম্ভবত বলতে চেয়েছেন, ভারত তার দিক থেকে যাদের সন্ত্রাসী বলছে, আমরা আমাদের দিক থেকে তাদেরই বলতে চাই কাশ্মীরের স্বাধীনতা-কামী মুজাহিদীন। আমরা সন্ত্রাসকে মদদ দিচ্ছি না, আমরা কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামে মদদ দিচ্ছি, আর সে অধিকার আমাদের আছে।
কথাটার খেই সম্ভবত তিনি হারিয়েফেলেছেন সামনে নোট না থাকার কারণে।
ইমরান খেলার প্রসঙ্গ এনেছেন। বলেছেন, ক্রিকেটের সুবাদে ভারতে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। কথাটা সত্য, তবে বোধহয় প্রয়োজন ছিলো না, ভাবগম্ভীর সিরিয়াস আলোচনায় এরূপ তরল প্রসঙ্গের অবতারণার?
উল্লেখ্য, জাতিসঙ্ঘ থেকে দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে প্রদত্ত সম্বর্ধনার জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হচ্ছে বিশ্বকাপ জয় করে ফিরে এসেছি!’ আমার ভালো লাগেনি এবং ভালো না লাগার অধিকার আছে আমার। সবকিছু খেলোয়াড়ি দৃষ্টিতে দেখা বিপজ্জনক।
অনেক কথাই বলার ছিলো, তবে আশা করি যথেষ্ট হয়েছে। পরিশেষে বলতে চাই, ইমরান কীভাবে নির্বাচনের বেড়া পার হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন সে সম্পর্কে এখন কিছুই বলার ইচ্ছে নেই এবং ইচ্ছে নেই তার অতীতের ব্যক্তিজীবন ও খেলোয়াড়ী জীবন সম্পর্কেও কিছু বলার। সবকিছু ভুলে ‘বুশরা বিবির ভাষায়’ আমরা সামনের দিকে দেখতে চাই। আমরা আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি, আল্লাহ্ তাওফীক দান করুন, তিনি যেন তার কথার মতই কাজের ময়দানে মর্দে মুজাহিদ-রূপে দুশমনের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারেন।
আন্তরিকভাবে প্রার্থনা করি, কাশ্মীরের নিপীড়িত মুসলিমানের জন্য তিনি যেন হতে পারেন এ যুগের আহমদ শাহ আব্দালী! মনে রাখতে হবে, জাতিসঙ্ঘ দ্বারা পঞ্চাশ বছরে কিছু হয়নি, আগামী পঞ্চাশ বছরেও কিছু হবে না! যা হওয়ার জিহাদের মাধ্যমেই হবে, ইমরানের ভাষায় ভরমযঃ দ্বারাই হবে! সে জন্য দরকার সর্বাত্মক প্রস্তুতির!
وَأعِدُّوا لَـهُم مَّا اسْـتَـطَعْــتُـم مِّنْ قُـوَّةٍ
দুশমনের জন্য যতদূর পারো, শক্তি প্রস্তুত করো...।