জিহাদে কাশ্মীরের
এক অজানা অধ্যায়
সুবেদার মেজর আব্দুররাজ্জাক
রাজনীতির গাড়ী পূর্ণ গতিতে গন্তব্যের অভিমুখে ধাবমান ছিলো। হতে হতে রামাযানের মোবারাক মাস এসে গেলো এবং সাতাইশে রামাযান শবে কদরের মোবারক সময় পাকিস্তানের এলান হলো। আল্লাহ্ তা‘আলা উপমহাদেশের মুসলমানদের তোহফা দান করলেন ‘পাকিস্তান’!
সীমান্তপ্রদেশ পাকিস্তানে শামিল হওয়া ছিলো আল্লাহ্ তা‘আলার বিশেষ গায়বি মদদ। হিন্দুভারত, হিন্দুকংগ্রেস এবং কংগ্রেসপন্থী কিছু মুসলিম তো ‘চেষ্টাচরিত্র’ কম করেছিলো না!
কাশ্মীর নিয়ে ষড়যন্ত্র তো অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো। অবিভক্ত ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সরদার বলদেব সিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর অত্যন্ত হুঁশিয়ারির সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর মুসলিম ইউনিটগুলো সাগরপারেই থামিয়ে রাখলেন। যারা ফিরে এলো তাদেরও এককথায় ছাঁটাই করা হলো। কোনভাবে যারা বাহিনীতে বহাল থাকলো তাদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নেয়া হলো এবং........
আমাদের নেতাদের তখনই বোঝার কথা ছিলো যে, কিছু একটা হতে চলেছে! হয়ত তারা আঁচ করেছেন, কিন্তু কিছু করার মত অবস্থায় ছিলেন না।
***
আমি তখন অবসরে চলে এসেছি এবং নিজের এলাকায় কৃষিকাজে জড়িয়ে পড়েছি। এর মধ্যে মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ হতে কাশ্মীরের জিহাদে শরীক হওয়ার ডাক এলো। আমাকে হাযারা-এর ডেপুটি কমিশনার ছাহেব ডেকে খুব শফকতের সঙ্গে বললেন, বেটা! তোমাকে কিছু কাবায়েলী মুজাহিদীনের কামান্ডার নিযুক্ত করা হয়েছে। তুমি কাশ্মীরের জিহাদের জন্য তৈয়ার হও।
আমি ১৯৪৪ সালে পাঞ্জাব রেজিমেন্টে ‘জঙ্গল ওয়ারফেয়ার ইনস্টেক্টর’রূপে নিযুক্ত ছিলাম। আমার কাজ ছিলো ভর্তি হওয়া হিন্দুস্তানী জোয়ানদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বার্মার যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেয়া। ....
সীমান্তের আযাদ গোত্রগুলোর অবস্থা আমার জানা ছিলো। ফৌজি নিয়মশৃঙ্খলার সঙ্গে ওদের কোন পরিচয় ছিলো না। জংধরা বন্দুক ছাড়া আর কিছু ছিলো না ওদের কাছে। অন্যকোন হাতিয়ার সম্পর্কে ধারণাও ছিলো না। ওরা ভাবতো, যুদ্ধ মানে ‘জান দেনা আওর জান লেনা’!
কিন্তু সমস্য হলো, এখানে গোত্রীয় লড়াই ছিলো না। এখানে যুদ্ধ ছিলো মহারাজার সুপ্রশিক্ষিত ডোগরা ফৌজের সঙ্গে!
আমি বললাম, জনাব, যে কোন
কোরবানির জন্য আমি তৈয়ার। তবে ঘটনা এমন নয় তো যে, এরা হলো কোরবানির বকরা, আর আমার কাজ হলো শুধু জবাইখানায় পৌঁছে দেয়া!
তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, বেটা, আমি জিহাদের কথা বলছি।
আমি বললাম, জিহাদের জন্য জরুরি গুণ হলো জোশ-জাযবা, মাকছাদের প্রতি ফানাইয়্যাত ও আত্মনিবেদন এবং শৃঙ্খলা ও মশক। এদের তো জোশ জাযবা কিছু থাকলেও জিহাদের মাকছাদ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা নেই, শুধু জোশের মাথায় ‘নিকাল পড়ে’। আর শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণও নেই। তো এ বিষয়ে কিছু বুনিয়াদি কাজ করার জন্য আমি অন্তত পনেরো দিন সময় চাই।
ডিসি ছাহেব পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে আমার কথা শুনলেন। তারপর ‘ফায়ছালাকুন’ আওয়াযে বললেন, ‘পনেরো ঘণ্টা সময় তোমার হাতে আছে, কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে ‘মার্চ’ করার। গাড়ী তৈয়ার আছে, তেলপানিও কিছু আছে, রেশন ও এমুনেশন কিছুই নেই।’
ভালো মানুষটি এই বলে তার বক্তব্য শেষ করলেন, ‘ব্যস, মনে করো, সময় এখন এমন যে, খালি হাতে লড়াই করতে হবে, জান দিতে হবে, জান নিতে হবে এবং দুশমনকে হটিয়ে কাশ্মীরে পাও জমাতে হবে, ইনশাআল্লাহ্।
***
হায়, কী দিন ছিলো! কী রাত ছিলো! কী সন্ধ্যা ছিলো, আর কী ভোর ছিলো! শাহাদাতের খুবসুরত তাসবীর যেন কল্পনায় জ্বলজ্বল করতো! একবারের জন্যও মনে হয়নি, মউত আমাদের সামনে, আর আমরা নিরস্ত্র! শুধু মনে হতো, সামনে বুযদিল দুশমন, আরো সামনে জান্নাতের হূর! ব্যস, ঝাঁপিয়ে পড়ো দুশমনের উপর, আর হূরানে জান্নাতের হাত ধরে পৌঁছে যাও জান্নাতের বাগানে। পান করো জান্নাতের শারাবান তাহূরা!
কাবায়েলী জোয়ানদের কাছে ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে এ খবর যে, ‘আমি হলাম তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া কমান্ডার’!
ফজরের পর চা পান করে ক্যাম্পের নিকটবর্তী ময়দানে উপস্থিত হলাম। কাবায়েলী জোয়ান ছোট ছোট দলে চায়ের মজলিস জমিয়ে বসেছে। আমি তাদের দেখলাম, তারাও আমাকে দেখলো। স্পষ্টই বোঝা গেলো, আমি তাদের কাছে আজনবী! পারলে এখনই যেন আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে! আসলে এটাই হলো কাবায়েলী চরিত্র।
ঐ মুহূর্তে নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ অসহায় মনে হলো। হায়, যদি এ কঠিন দায়িত্ব আমাকে দেয়াই না হতো!
হঠাৎ করেই ভিতর থেকে প্রেরণা সৃষ্টি হলো, রাব্বে কারীমের কাছে দু‘আর জন্য হাত ওঠানোর! হাত ওঠানোর দেরী ছিলো, চোখ থেকে ‘আঁসু’র দরিয়া প্রবাহিত হওয়ার দেরী ছিলো না!
জারজার কেঁদে বললাম, ইয়া খোদা, আব তো জূ ক্যরনা হ্যয় তুঝেহী ক্যরনা হ্যয়!
(ইয়া আল্লাহ, এখন তো যা করার তোমাকেই করতে হবে!)
দু‘আ-মুনাজাতের পর দিলের মধ্যে এক আজীব সুকূন ও প্রশান্তি অনুভূত হলো। যেন দেখতে পাচ্ছি, আল্লাহর গায়বি মদদ নাযিল হচ্ছে।
আমি খোলা জিপের উপর দাঁড়ালাম। দুই হাতকে মুখের চারপাশে ‘চোঙ্গা’ বানিয়ে গুরুজদার আওয়াযে বললাম, ‘কে আছে, শুধু মুসলিম পরিচয়ে শুধু আল্লাহর নামে নিজের গর্দান পেশ করবে!’
আলহামদু লিল্লাহ্, তীর নিশানায় লাগলো! পুরা মজমা বিলকুল খামোশ হয়ে গেলো। স্তব্ধ বিস্ময়ে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। দেখতে দেখতে অনেকের চেহারার রঙ বদলে গেলো। এ যেন ‘আন্দার কা মুসলমান জাগ ওঠ্ঠা’-এর দৃশ্য! লোন্দ খোড় কবিলার এক ভরপুর জোয়ান পূর্ণ গাম্ভীর্যের সঙ্গে আগে বাড়লো। রাইফেল ও গুলির থলিয়া সঙ্গে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো
জনাব, ম্যঁয় যায়নুল্লাহ্ খান হুঁ। আল্লাহ্ কে নাম প্যর মেরা স্যর হাযির হ্যয়।’
এভাবে শুরু হয়ে দশজনে এসে শেষ হলো। আমি আল্লাহর শোকর আদায় করলাম যে, না ফরমান ভিড়ের চেয়ে, শেরদিল ফরমাবরদার মুজাহিদের মুখতসর কাফেলা অনেক ভালো। ডিসি সাহেবকে পুরো হালাত জানিয়ে দশজনের কাফেলা নিয়ে আমি রওয়ানা হলাম।
***
পথে পথে আম মুসলমান কী মুহব্বত ও জোশ-জাযবার সঙ্গে আমাদের ইস্তিকবাল করেছে এবং বিদায় জানিয়েছে, সে এক আলাদা দাস্তান! ক্যভী ফুরসত মিলে তো...
পুরো সফর আমি সাথীদের যেহেন তৈয়ার করার কাজে ব্যয় করলাম। বিশেষ করে (পাহাড়ে ও সমতলে এবং জঙ্গলে লড়াই করার) বিভিন্ন জঙ্গি চাল, হামলা ও আত্মরক্ষার কার্যকর কৌশল, বিমানহামলা থেকে বাঁচার উপায়, আগে বাড়ার এবং পিছিয়ে আসার আন্দায, এগুলো যদ্দুর সম্ভব বুঝাতে চেষ্টা করলাম। স্থানীয় গাদ্দারদের বিষয়েও হুঁশিয়ার করলাম।
সবচে’ বেশী জোর দিলাম, লুটতারাজ ও জুলুম ফাসাদ দ্বারা জিহাদের পবিত্রতা যেন কলঙ্কিত না হয়। ফসল ও বাগানের যেন ক্ষতি না করা হয়। শেষে বদর-হোনায়ন ও হোদায়বিয়ার ঘটনা স্মরণ করিয়ে আলোচনা শেষ করলাম। সফরও শেষ হয়ে এলো। মাগরিবের পর সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যে আমরা কাশ্মীরের সীমানায় দাখেল হলাম।
সীমান্তে দু’জন স্থানীয় মুজাহিদ আমাদের খোশামদেদ জানালেন। তারা জম্মু-কাশ্মীরের চতুর্থ ব্যাটালিয়ানের সিপাহী ও অফিসার ছিলেন। তাদের রাহবারিতে আমাদের মুখতাসার কাফেলা ফ্রন্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
আগে থেকেও কিছু ধারণা ছিলো, স্থানীয় মুজাহিদের কথায় পুরা জানা গেলো যে, মুজাহিদীনের মধ্যে কোন সমন্বয়, কোন শৃঙ্খলা নেই এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলতে কিছু নেই। সবাই বিক্ষিপ্ত অবস্থায় যার যার মত করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে খতরনাক বিষয় হলো, স্থানীয় ও বাইরে থেকে আগত মুজাহিদীনের মধ্যে বিশেষ কোন যোগাযোগ নেই; এমনকি সুসম্পর্কেরও ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ....
এতসব প্রতিকূলতার মধ্যেও যা শোকরের বিষয় তা হলো, মুজাহিদীন অপ্রতিরোধ্য ঢলের মত পাহাড়-সমতল সব অতিক্রম করে এগিয়ে চলেছে, আর বুযদিল দুশমন ‘ভেড়বকরি’র মত ভেগে পিছপা হয়ে চলেছে। আসলে এটা কুদরতের গায়বি কারিশমা ছাড়া আর কিছু ছিলো না। ....
***
রাত বারোটার দিকে আমরা ওড়ী পৌঁছলাম। চারদিকে সুনসান এবং ঘোর অন্ধকার। থ্যকান ও ক্লান্তিতে সবাই ছিলো চুরচুর। তাঁবু টানিয়ে সবাই শুয়ে পড়লো। ঘুমে অচেতন হতে বিলম্ব হলো ন। আমি একা পাহারায় থাকলাম। ভাবতে অবাক লাগে, আল্লাহ্র কী কুদরত, ঘুমের কোন তাকাযাই আমার মধ্যে ছিলো না! শেষ রাতের দিকে একজন ক্লান্ত শ্রান্ত মুসাফির তাঁবুর কাছে এসে সালাম দিলেন। দেখেই বোঝা যায়, বহু দূর থেকে ‘মুরদাদম’ অবস্থায় এসেছেন। পরিচয় দিয়ে বললেন, আমি কর্নেল মুহম্মদ আকবর খান, ডিএসও. জিএইচকিউ রাওয়ালপিন্ডি থেকেকোহালা হয়ে মাত্রই এখানে পৌঁছেছি।
তার কাছ থেকে তাজা তথ্য পাওয়া গেলো যে, মুজাহিদীন শ্রীনগরের দিকে ঝড়ের বেগে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে মহারাজা হরি সিং জম্মু-কাশ্মীরের ভারতভুক্তির ঘোষণা দিয়ে ফেলেছে। শেখ আব্দুল্লাহ্কে রাজ্যের ওযীরে আলা নিযুক্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষ হতে সরদার আব্দুল কাইঊমকে আযাদ কাশ্মীরের ছদর এলান করা হয়েছে। সবচে’ উদ্বেগজনক খবর হলো হিন্দুস্তানী ফৌজ নেমে পড়েছে এবং ব্যাপক মুসলিম গণহত্যা শুরু করেছে। খুবই আশঙ্কা আছে যে, দুশমন তিনদিক থেকে মুজাহিদীনকে ঘেরাও করে ফেলবে। তখন পিছপা হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না।
কর্নেল আকবর খান, পরে এই সেক্টরে যাকে ‘জেনারেল তারেক’ নামে ডাকা হতো, আমি তাকে স্যালুট করে বললাম, ‘স্যার, আমাদের জান হাযির!’
***
এই মরদে মুজাহিদ খুব বেশী হলে ত্রিশমিনিট বিশ্রাম করার পর পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল তৈয়ার করে ফেললেন। তিনি মুহূর্ত ব্যয় না করে আমাদের কাজে লাগাতে চাইলেন। বললেন, আমরা ওড়ী থেকে ছয়মাইল আগে বেড়ে শ্রীনগর সড়কে মহূরা পোল উড়িয়ে দেবো।...
মুহূর্তের জন্য আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম যে, আমাদের কাছে না আছে নকশা, না আছে স্থানীয় গাইড। তাছাড়া কিছুই জানা নেই, স্থানীয়দের মধ্যে পোল ধ্বংস করার প্রতিক্রিয়া কী হবে!
তবে এটা ছিলো মুহূর্তের দ্বিধা! সঙ্গে সঙ্গে আমার ফৌজি দেমাগ হুঁশিয়ার হয়ে গেলো যে, ‘কমান্ড ফলো করো!’
***
রওয়ানা হয়েছি, এমন সময় ছয়জন ডোগরা তরুণী ভীত সন্ত্রস্ত ও ছিন্নবস্ত্র অবস্থায় এসে আমাদের আশ্রয় চাইলো। প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদের পর একজন বয়স্ক মুজাহিদের যিম্মায় তাদের রেখে আমরা রওয়ানা হয়ে গেলাম। মাহূরার অবস্থান হচ্ছে ওড়ী ও রামপুরার মাঝামাঝি। এলাকাটা রেকি করা হলো। এখানে বড় একটা খাল আছে যার মাধ্যমে সারা বছর ঝিলাম নদীতে পানি যায়। খালের ওপারে উপরের দিকে ‘বিজলীঘর’, যেখান থেকে এলাকায় বিজলীর সাপ্লাই হয়। পরে অবশ্য বিজলীঘর আমরা বেকার করে দিয়েছিলাম। খালের পানি যেখানে গিয়ে ঝিলামে পড়ে তার একটু পরেই হলো ষাটগজ লম্বা মযবূত লোহার পোল, যা আমাদের ধ্বংস করতে হবে। এর অর্থ হলো ফৌজের গতিবিধি সম্পূর্ণ নিশ্চল করে দেয়া!
আমাদের কাছে বিস্ফোরক দ্রব্য ছিলো প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তবে আল্লাহ্র গায়বি মদদের উপর আমাদের পূর্ণ ভরসা ছিলো।
পোলের ওপারে দুশমনের দিকে বিস্ফোরক ও ফিউজ যুক্ত করলাম। এমন সময় একটা ফৌজি ট্রাক, দেখা গেলো ঝড়ের বেগে ধেয়ে আসছে। আমাদের উদ্বেগ খুব বেড়ে গেলো। আরো কাছে আসার পর মনে হলো, মুজাহিদীনের ট্রাক। আমরা রেড এলার্ট অবস্থায় অপেক্ষা করলাম।
ধারণা ঠিক ছিলো। ফ্রন্টিয়ার মিলিশিয়ার ট্রাক। কামান্ডার হলেন ক্যাপ্টেন রিয়ায, সাবেক আইএনএ।
তার কাছ থেকে জানা গেলো, হিন্দুস্তানী ফৌজের একটি পূর্ণাঙ্গ ‘আর্মড ব্রিগেডিয়েটর’ এগিয়ে আসছে। তিনি ছুটে এসেছেন, যদি পোলের কিছু করা যায়! তার কাছেও সমান্য বিস্ফোরক ছিলো। দু’টো মিলিয়েও প্রয়োজনের অর্ধেক হবে। তবে আমার বিশ্বাস হলো, অবশ্যই এটা গায়বি মদদ এবং পোল আমরা ওড়াতে পারবো ইনশাআল্লাহ্।
***
সলিতায় আগুন দিয়ে চোখ বন্ধ করে আমরা আল্লাহ্, আল্লাহ্ করতে থাকলাম। হঠাৎ ধামাকা হলো, আর আনন্দের আতিশয্যে আমরা তাকবীর ধ্বনি দিয়ে উঠলাম। ঘড়িতে তখন নয়টা। পোলের ঐ পারের অর্ধেক উড়ে গিয়েছে। এত বড় ও মযবূত পোল এভাবে এমন সামান্য বিস্ফোরকে উড়ে যাওয়া যুক্তি ও প্রযুক্তির দিক থেকে সত্যি অবিশ্বাস্য ছিলো! আল্লাহর মদদ যখন শামিলে হাল হয় তখন এমনই হয়!
ক্যাপ্টেন রিয়াযের কাছ থেকে আমি একটি ব্রেনগান, একপেটি অ্যামুনেশন এবং কিছু ম্যাগেজিন চেয়ে নিলাম। তিনিও উদারতার সঙ্গে দিলেন। তারপর তার ট্রাক পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলো।
আমি প্রথমে সর্বোচ্চ নিরাপদ পজিশন নির্বাচন করলাম। তারপর সাথীদের, ব্রেনগান গ্রুপ ও রাইফেল গ্রুপ, এ দু’ভাগে বিভক্ত করে ঠিক ঠিক পজিশনে বসিয়ে দিলাম।
দশটার দিকে পাহাড়ের আড়াল থেকে ধোঁয়া ও ধূলো দেখা গেলো। আমার ধারণা ছিলো, প্রথমে হাওয়াই জাহায আসবে পর্যবেক্ষণের জন্য, তারপর পরিস্থিতি বুঝে যমীনী ফৌজ আগে বাড়বে। কিন্তু গোয়ালিয়ার ও পটিয়ালা ফৌজের ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড শ্রীনগর বিমানবন্দরে অবতরণের পর পথে কোন প্রতিরোধের মুখে না পড়ার কারণে কিছুটা বেপরোয়া হয়েই এগিয়ে আসছিলো। আসলে তাকদীর তাদেরকে মউত ও বরবাদির দিকে তাড়িয়ে আনছিলো!
দুশমন ফৌজ ময়দানি এলাকায় প্রায় একমাইলের বিস্তার নিয়ে শত শত সৈন্য সাজোয়া যানে করে আগে বাড়ছিলো। নিরাপদ আড়াল থেকে সবকিছু আমাদের চোখের সামনে ছিলো।
আমরা মাত্র দশজন। হাতিয়ার ও গোলাবারুদ খুব সামান্য। তবে আমাদের অবস্থান ছিলো পোল থেকে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে এবং আড়াল ছিলো নিরাপদ। মনোবল চাঙ্গা করার জন্য সাথীদের বললাম, ভাইসব, আমরা তো ফায়ার করবো না, ফিরেশতারা ফায়ার করবে। শুধু আল্লাহ্কে স্মরণ করো।
আগে থেকেই নির্দেশ দেয়া ছিলো, যখন আমি আল্লাহু আকবার ধ্বনি দেবো তখন একসঙ্গে ফায়ার হবে।
‘নাগালে’ আসামাত্র আমি তাকবীর দিলাম, আর ফায়ার শুরু হয়েগেলো। আমার হাতের এলএমজিও আগুন উগরাতে লাগলো। হামলা এমন আচানক ও অপ্রত্যাশিত ছিলো যে, দুশমন কিছু বুঝে ওঠার আগেই ‘মউতের লোকমা’ হতে লাগলো। বেশকিছু গাড়ীতেও আগুন লেগে গেলো। দুশমন পিছনের দিকে হটতে লাগলো। শেষে ময়দান বিলুকল সাফ হয়ে গেলো।
***
প্রায় ত্রিশমিনিট পর এক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি দেখা দিলো। আমাদের পিছনের ছোট পাহাড়ের উপর থেকে হালকা তোপের গোলাবর্ষণ শুরু হলো। ধোঁয়া, ধূলা ও বারুদের গন্ধে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। পিপাসায় আমার এবং সাথীদের তখন মুমূর্ষু অবস্থা। নদী এত কাছে, অথচ নদীতে নামার উপায় নেই! তখন একটা বুদ্ধি মাথায় এলো। বলা উচিত, যিনি মাথায় পাগড়ী দান করেছেন, তিনিই বুদ্ধিটা মাথায় দিলেন। মাথার পাগড়ী খুলে একপ্রান্তে জুতা বেঁধে নদীতে ঝুলিয়ে দিলাম। তারপর যখন টেনে আনলাম, জুতাভর্তি পানি! এভাবে আল্লাহ্র রহমতে সবার পিপাসা দূর হলো। জুতার পানিকেই তখন ‘অমৃতজল’ মনে হলো। ......
কিছুক্ষণ গুলিবিনিময়ের পর হঠাৎ দুশমনের পক্ষ হতে ‘তৎপরতা’ থেমে গেলো। সূর্য তখন পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। দুশমন চুপ মেরে আছে তো আছেই! আমি সাথীদের হুঁশিয়ার করলাম যে, এই খামোশির পিছনে কোন রহস্য অবশ্যই আছে।
আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয় তখন বলছে, অবিলম্বের আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করা জরুরি।
আমরা হামাগুঁড়ি দিয়ে এবং যথাসম্ভব আড়াল রক্ষা করে পিছিয়ে আসতে লাগলাম। ‘এক ফরলাঙ্গ’ দূরত্ব অতিক্রম করে আমরা ছেট্ট একটি টিলায় আরোহণ করলাম। আর তখন আমাদের অবাক হওয়ার পালা! পাকা সড়ক থেকে প্রায় পঞ্চাশ গজ উপরে ছয় সাত ফুট প্রশস্ত একটা সমতল রাস্তা, যাতে আসানির সঙ্গে জিপ চলাচল করতে পারে! আমার তখন মানচিত্র ও কম্পাসের অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হলো! এর মধ্যে দেখি, দুশমনের দিকে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। খুব দ্রুতই ওরা আগে বেড়ে আমাদের ছেড়ে আসা অবস্থানে পৌঁছে গেলো। একজন অফিসার একবার নকশার দিকে তাকায়, আবার দূরবীনে চারদিক পর্যবেক্ষণ করে। আমি তখন আল্লাহর শোকর আদায় করলাম যে, যথাসময়ে অবস্থান ত্যাগ করেছি। কিন্তু ঘটনার তখনো কিছু বাকি ছিলো। সেটা ছিলো আরো বড় শোকরের বিষয়! .....
***
রাস্তার দু’পাশে আপেলবাগান অনেক দূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে। মাঝে মাঝে কাঠের তৈরী ছোট ছোট ঘর, তবে মানুষের উপস্থিতি বোঝা গেলো না। যদি থাকে, আর ওরা যদি হয় ভারতপন্থী...
কিন্তু আমাদের তখন ঝুঁকি না নিয়ে উপায় ছিলো না। কারণ দুশমন আগে বাড়ছে, আর পিছনের পাহাড়ে রয়েছে তোপ। সম্ভবত আমাদের বর্তমান অবস্থান এখনো দুশমন চিহ্নিত করতে পারেনি। এই সামান্য সুযোগটাই আমাদের কাজে লাগাতে হবে, দুশমনের ‘চঙ্গল’ থেকে বের হয়ে আসার জন্য।
সূর্য ডোবে ডোবে, এমন সময় শ্রীনগরের দিক থেকে দু’টি জাহায এলো এবং আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো। আমাদের তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা! কী দেখি, আমাদের ছেড়ে আসা অবস্থানে, যেখানে দুশমনের বর্তমান অবস্থান, জাহাযদু’টি প্রচ- গোলাবর্ষণ করলো! আমরা শুধু দেখলাম আগুনের কু-ণ্ডলী, আর ধোঁয়া উপরের দিকে উঠে আসছে! শোকরে বিহ্বলতায় আমরা তখন সেজদায় লুটিয়ে পড়লাম।
আসল ঘটনা এই যে, পাইলট ‘প্রাপ্ত তথ্য’ অনুযায়ী চিহ্নিত স্থানে গোলাবর্ষণ করেছে। কিন্তু তথ্যটা ছিলো ত্রিশমিনিট পুরোনো! ফলে নিজেরই বাহিনীর অবস্থানক্ষেত্রকে তছনছ করে ‘পাইলটছাহাব খোশ খোশ’ ফিরে গেলেন! আর আমরা গায়বি মদদের এই ‘আনোখা আন্দায’-এর উপর শুধু সুবহান! সুবহান! করতে থাকলাম!!
***
রাত নয়টায় জেনারেল তারেকের আচানক পায়গাম এলো। ‘পিছনে ফিরে এসো।’
মনে হলো, এই মাত্র হিন্দুস্তানী জাহায থেকে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ হলো! পায়গাম যিনি এনেছিলেন, ক্যাপ্টেন তাসকীনুদ্দীন (পরবর্তীকালে পাকফৌজ থেকে রিটায়ার্ড), তারই উপর যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলাম, ‘জেনারেলের বাচ্চাকে বলে দাও...!’
কিন্তু না, ভিতরের ফৌজি দেমাগ এখানেও সতর্ক করলো, ‘কমান্ড ফলো করো।’ ফলো করলাম। কিন্তু আমার মনের অবস্থা তখন এমন যে, যার দিকে তাকাই তাকেই মনে সন্দেহভাজন!
***
ওড়ীতে পৌঁছে দেখি, অন্যরকম চিত্র! সমস্ত গুদাম এবং হাইস্কুলের সমস্ত কামরা রেশন, অ্যামুনেশন, পেট্রল ও অন্যান্য জরুরি সামানে পরিপূর্ণ। গত রাতেই নাকি ট্রাকবহর এসেছিলো! তাহলে আমাদের পর্যন্ত ‘রসদ’ পৌঁছানোর ব্যবস্থা না করে ফ্রন্ট ছেড়ে পিছনে ফেরার আদেশ কেন?! কেন?! কেন?!
অনেকগুলো ‘কেন’ একসঙ্গে যেন আমাকে ক্ষতবিক্ষত করতে লাগলো! কিন্তু কোন জবাব ছিলো না! সিপাহী শুধু ময়দানে জান দিতে পারে। ফায়ছালা নিতে পারে না।
কাবায়েলীরা ‘ডেগ পাকিয়ে’ বিজয়ের জশন শুরু করেছে। এরই মধ্যে দুশমনের জাহায আমাদের উপর ‘গোত্তা’ খেয়ে গুলি বর্ষণ করলো। আর তাতেই সব জশন ‘কাফুর’ হয়ে গেলো।
পুরো ওড়ীকে সুনসান রেখে আমরা ফিরতি সফর শুরু করলাম। সব অর্থেই যেটা ছিলো ‘পশ্চাদপসরণ’, যদিও সবকিছু ছিলো রহস্যের চাদরে ঢাকা!
অমুসলিম ছয় তরুণী, যাদের, এখানেই বৃদ্ধ মুজাহিদের নিরাপদ হেফাযতে রেখে গিয়েছিলাম তাদের ডেকে বললাম, ‘এখান থেকে ছয়মাইল সামনে মাহূরা পোলের কাছে চলে যান, ওখানে আপনাদের ফৌজ রয়েছে। আপনারা ওখনে চলে যান।
ওরা একসঙ্গে রোনাযারি শুরু করলো, ‘আমরা তো ওদের ভয়েই আপনাদের আশ্রয় নিয়েছি। খোদার ওয়াস্তে আমাদের পানাহ দিন।’
কিন্তু ওদের তো আর বলার উপায় নেই যে, আমরা এখন তোমাদের চেয়ে লাচার!
আমি দ্রুত রসদসামগ্রীর উপর পেট্রল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলাম, যাতে দুশমনের হাতে না পড়ে, আর আমাদের রসদ আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত না হয়।
যখন ট্রাকে উঠছি তখনো দুশমন সম্প্রদায়ের ছয়তরুণী কাকুতি-মিনতি করে তাদেরই ফৌজের বিরুদ্ধে আশ্রয় প্রার্থনা করে চলেছে। যদিও বড় হৃদয় -বিদারক দৃশ্য! কিন্তু...
ট্রাক রওয়ানা হয়ে গেলো। তবে জানা নেই মনযিল কোনদিকে? গন্তব্য কোথায়?
ভোরে যেখানে নামলাম, কোহালার দূরত্ব সেখান থেকে সত্তর মাইল।
চিনারি পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া দুশমনের জন্য কঠিন কিছু ছিলো না। কারণ মাহূরা থেকে তার দূরত্ব মাত্র ছাব্বিশ মাইল। আমি প্রস্তাব দিলাম যে, কাঠের দু’তিনটা পোল আমরা পার হয়ে এসেছি। অন্তত একটা পোল যদি জ্বালিয়ে দিই...
আল্লাহর মেহেরবানি, আমার প্রস্তাব গ্রহণ করা হলো। ইসলামাবাদের (অনন্তনাগের) পোল ওড়ী থেকে প্রায় দু’ মাইলের দূরত্বে ছিলো, সেটাই জ্বালিয়ে দেয়া হলো।
***
আসলে এই পোলটাই ছিলো আমাদের এবং দুশমনের মধ্যে ‘আড়াল’। ডিসেম্বর ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত হিন্দুস্তান বারবার পেলটা মেরামত করতো, আর আমরা কোন না কোনভাবে তা ‘অকেজো’ করে দিতাম।
আমাদের মূল কেন্দ্র নির্ধারিত হয়েছিলো চিনারি। আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, জান যায় বা থাকে, এখান থেকে আর পিছনে হটবো না, কোন ফিরেশতার হুকুমেও না। আমাকে বা-কায়দা সেক্টর এডজুয়েন্ট নিযুক্ত করা হলো। কোহালা ও হাবীবুল্লাহ-এ প্রতিবন্ধক স্থাপন করা হলো। যোগাযোগ ব্যবস্থা যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে আনা হলো। এর মধ্যে মাকবূযা এলাকা থেকে মুহাজিরীনের ঢল আসা শুরু হয়ে গেলো।
আমরা আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মযবূত করার কাজে মনোনিবেশ করলাম। কাশ্মীরের, বিশেষ করে পুঞ্ছ এলাকার শত শত বাহাদুর নওজোয়ান আমাদের কাছে এসে জড়ো হলো। আমরা তাদেরও কাজে লাগালাম। ওড়ীর পূবে যাম্বুরপটন ও সুলতান ডকি-এর পর্বতচূড়াগুলো দখলে নিয়ে বিভিন্ন মুজাহিদীন গ্রুপকে মোর্চায় মোর্চায় মোতায়েন করা হলো। ইসলামাবাদের পশ্চিমে গোহালান পবর্তচূড়ার উপরও আমাদের দখল পাকাপোক্ত হলো। ফলে মুযাফফারাবাদ-সড়কের দিকে আগে বাড়া দুশমনের জন্য অসম্ভব হয়ে গেলো। কিন্তু ...
ওড়ী থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পুঞ্ছের পুরো এলাকা বিনাপ্রতিরোধে দুশমনের কবযায় চলে গেলো! আমরা হাতের উপর হাত রেখে শুধু দেখে থাকলাম। নীতিনির্ধারকদের অন্তত মৌন সম্মতিও যদি পাওয়া যেতো, ওড়ীতেই দুশমনকে আমরা ঘেরাও করে খতম করে দিতে পারতাম। .....
তারপরো মুজাহিদীন তখন মোটামুটি শৃঙ্খলার মধ্যে এসে গিয়েছে অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করে দুশমন ফৌজকে তিনদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিলো। তুষারপাত সুবর্ণ সুযোগও এনে দিয়েছিলো। কিন্তু আল্লাহ্ মালূম নিতীনির্ধারকদের দেমাগে কী চিন্তা কাজ করছিলো, আমরা আর আগে বাড়তে পারলাম না। দুশমন আমাদের স্থবিরতার সুযোগ পুরোপুরি নিয়েছিলো।
***
হিন্দুস্তানী ফৌজ ক’দিন খামোশ থাকলো। হাওয়াই হামলা অবশ্য অব্যাহত ছিলো। আমরা যমীনী ফৌজের গতিবিধির উপর কড়া নযর রাখছিলাম।
এর মধ্যে খবর এলো, শ্রীনগর থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ বহনকারী গাড়ীর বিশাল কনভয় ওড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। একশ গাড়ীর কনভয় সত্যি বড় লোভনীয় টার্গেট ছিলো। যদিও তুষার ঝড় চলছে। পাহাড়-গুলোতে বেশ ভারী বরফ জমেছে, তবু একশ মুজাহিদীনের একটা কাফেলা ‘নৈশ হামলা’ চালানোর জন্য রওয়ানা হয়ে গেলো। দুর্ভাগ্যক্রমে বিশজন মুজাহিদীন বরফচাপা পড়ে নিখোঁজ হয়ে গেলো! তাতেও মুজাহিদীনের মনোবলে চিড় ধরেনি। তারা ওড়ী ও মহূরা-এর মাঝখানে ঝিলামনদী অতিক্রম করে ওত পেতে থাকলো। কনভয় যখন নাগালে মধ্যে এলো, মুজাহিদীন আচমকা এমন প্রচ- হামলা চালালো যে, দেখতে দেখতে ত্রিশটা গাড়ী তাদের দখলে চলে এলো। কয়েকটা গাড়ীতে আগুন ধরে গেলো। বাকি গাড়ীগুলো পিছনে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলো। মুজাহিদীন, ঝটিকা হামলার নীতি পরিপূর্ণ অনুসরণ করতে বর্থ হয়েছিলো, অন্যথায় পুরো কনভয় দখলে এসে পড়ার কথা ছিলো। যাই হোক, দুশমনের জন্য এটাও ছিলো এক অপূরণীয় ক্ষতি। এরপর সড়কপথে রসদ পাঠানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। শুধু আকাশপথে...!
ওড়ীর তিনদিকে, পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তরের পাহাড়গুলোতে মুজাহিদীনের মোর্চা এত মযবূত ছিলো যে, দুশমনের জন্য ওড়ী থেকে বের হওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছিলো। পক্ষান্তরে মুজাহিদীন ছোট ছোট দলে বের হয়ে, বিশেষ করে রাতের বেলা দুশমনকে যথেষ্ট ভালো ‘আপ্যায়ন’ করতো। দুশমনের অবস্থা এতটাই নাযুক হয়ে পড়েছিলো যে, হিন্দুস্তানী কামান্ডারদের বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক ওয়ারলেস বার্তা আমাদের হস্তগত হতো। একটা বার্তা ছিলো, ‘দক্ষিণ ভারতের সিপাহীরা কাশ্মীরের ‘ঠা-ণ্ডা’ বরদাশত করতে পারছে না। জরুরি ভিত্তিতে শরাবের কোটা বৃদ্ধি করা হোক।’
আরেকটা বার্তা ছিলো, ‘সিপাহীদের পা শিকলবাঁধা করো, যাতে পালাতে না পারে...!
এদিকে আমাদের অবস্থা ছিলো এই যে, মুজাহিদীন আগে বাড়ার জন্য টগবগ করছে। কিন্তু আমার কাজ ছিলো একটা কথা রটতে থাকা যে, উপরের আদেশ নেই।
***
একটা ঘটনা বলেই শেষ করি। হিন্দুস্তানী ফৌজের মশহূর ব্রিগেডিয়ার ওছমান অগ্রবর্তী ব্রিগেডের কমান্ড গ্রহণ করেছেন বলে খবর পাওয়া গেলো। আরো জানা গেলো সিপাহীদের মোরাল বাড়ানোর জন্য খানাপিনা, নাচগানা ও জশনের ইনতিযাম করা হয়েছে। আমরা ভাবলাম, আমাদের পক্ষ হতে কিছু ‘গিফট’ যাওয়া দরকার! গভীর রাতে জশন যখন পূর্ণ জোয়ানিতে তখন আমাদের ঝটিকা হামলা শুরু হলো। ব্রিগেডিয়ার ওছমানসহ বহু লাশ আমরা হিন্দুস্তান পাঠালাম। দুশমনের জশন, শাব্দিক অর্থেই হয়ে গেলো আমাদের জশন।
পরিশেষে আমি একথা বলার দুঃসাহস করতে চাই যে, এটা কোন কর্মকৌশল ছিলো না, বরং ছিলো চক্রান্ত যে, বারবার সুবর্ণ সুযোগ হাতে আসা সত্ত্বেও আমাদের অগ্রাভিযানের সবুজসঙ্কেত দেয়া হয়নি। নইলে দুশমনবাহিনী গুলমার্গ, বারামূলা ও হিন্দুওয়াড়া থেকে এককদমও আগে বাড়তে পারতো না। খুব সহজেই আরো বিস্তীর্ণ এলাকা আমরা দখলে নিতে পারতাম, আর দুশমনের ‘জানি মালি’ নোকছান হতো বে-ইনতিহা! কিন্তু.... আমাদের হাত বাঁধা ছিলো ‘আমাদেরই হাতে!’ *