চৌ ধু রি গো লা ম আ ব্বা স
ও
শেখ আব্দুল্লাহ্
এখানে আমরা কাশ্মীরের শেষ সময়ের রাজনীতির দুই মেরুর দুই প্রধান নেতার পরিচয়, কর্ম ও কীর্তির সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরবো। ১৯৩১ সালের আগে ও পরে কাশ্মীরের রাজনীতি --তে উভয়ের অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। চৌধুরী গোলাম আব্বাস ছিলেন কাশ্মীরী মুসলমানদের জন্য মযবূত ঢালস্বরূপ। আজীবন তিনি কাজ করেছেন কাশ্মীরের পাকিস্তানভুক্তির পক্ষে। তবে সস্তা জনপ্রিয়তার প্রতি ছিলো তার প্রচ- অনীহা! পক্ষান্তরে শেখ আব্দুল্লাহ, নিজের কেরিয়ার গড়ে তোলার জন্য বেছে নিয়েছিলেন ডোগরারাজা-বিরোধী অবস্থান, যার হাতে কাশ্মীরের মুসলিম জনগোষ্ঠী ছিলো অনবরত যুলুম-নির্যাতনের শিকার। এভাবে একসময় তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন ‘সস্তা’ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, যা সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছিলেন গান্ধী-নেহরু-প্যাটেল। শেখ ছাহেবের বোধোদয় ঘটতে অবশ্য সময় লাগেনি, তবে তত দিনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিলো। ...
***
চৌধুরী গোলাম আব্বাস ৪ঠা ফেব্রুয়ারী ১৯০৪ সালে জম্মুর এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চৌধুরী নওয়াব খান কাশ্মীর হাইকোর্টের দাপ্তরিক কোন পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেছেন জম্মু মিশন স্কুলে। মেট্রিক পাশ করেছেন ১৯২১ সালে গর্ভরমেন্ট হাই স্কুল জম্মু থেকে। তারপর ভর্তি হন জম্মু প্রিন্স ওয়েলস কলেজে। ১৯২৫ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি থেকে বিএ করেছেন। ১৯৩১ সালে ল কলেজ লাহোর থেকে আইনের সনদ অর্জন করেছেন।
রাজনৈতিক জীবনে প্রথমে তিনি ইয়ং মুসলিম এসোসিয়েশনে অংশগ্রহণ করেন। পরে তিনি এর সভাপতি নির্বাচিত হন। কাশ্মীরী মুসলমানদের জাগরণের ক্ষেত্রে তিনি মৌলিক অবদান রাখেন। কাশ্মীরী মুসলমানদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি জেলযুলুম বরদাশত করেছেন। তিনি প্রথম গ্রেফতারি বরণ করেন এল এল বি-এর পরীক্ষা দেয়ার সময়। কোরআন অবমাননার বিরুদ্ধেডোগরা মহারাজা কাবায়েলী মুজাহিদীনের হস্তক্ষেপের কারণে বাধ্য হয়ে ভারতের আশ্রয়প্রার্থী হয়েছেন, এটা আজ প্রায় সত্য হতে চলেছে। অথচ এটা ছিলো অজুহাত ভারতকে হস্তক্ষেপের আমন্ত্রণ জানানোর; এটা নিছক জালিয়াতি। কেননা নেহরু, মাউন্ট ব্যাটন ও রেডক্লিফ আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, গুরুদাসপুর ও পাঠানকোট মুসলিমপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও ভারতকে দেয়া হবে, যাতে ভারত কাশ্মীরে তার বাহিনী পাঠানোর স্থলপথ পেয়ে যায়। তার মানে তখন থেকেই চক্রান্ত তৈয়ার ছিলো। কাবায়েলীরা না এলেও এটা হতো।
তাছাড়া ভারত সুপরিকল্পিত ভাবেই কাবায়েলী হামলার শোর মাচায়। কাবায়েলের লোকেরা তো পরে এসেছে। কাশ্মীরী মুসলমানদের যে উত্তাল বিক্ষোভ-আন্দোলন তাতে তিনি প্রথম কাতারে থেকে নেতৃত্ব দান করেন।
১৯৩২ সালের অক্টোবরে তিনি শেখ আব্দুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে মুসলিম কন্ফারেন্স প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর সাধারণ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন। শেখ আব্দুল্লাহ্কে সভাপতির পদ দেয়া হয়, যদিও শেখের আগ্রহ ছিলো সাধারণ সম্পাদক পদের প্রতি।
১৯৪২ সালে মুসলিম জিহাদ তো আগে আমরা কাশ্মীরী জোয়ানেরা শুরু করেছি।
আমরা তো দীর্ঘ পনেরো মাস ডোগরা ফৌজের বিরুদ্ধে বলতে গেলে খালিহাতে লড়াই চালিয়ে গিয়েছি। কাশ্মীরী জোয়ানদের জিহাদের কথা ভারত এবং গান্ধী-নেহরু জেনে বুঝেই চেপে যায়। যাতে এ মিথ্যা বিশ্বকে বিশ্বাস করাতে পারে যে, কাশ্মীরের মুসলমান এবং মহারাজা তো কাবায়েলী হামলা থেকে বাঁচার জন্য ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেছে। দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের পক্ষ হতে এ প্রাচরণার বিরুদ্ধে কোন জবার দেয়া হয়নি।
কাবায়েলীরা পরে আমাদের সাহায্যের জন্য এসেছে। ঘটনা এমন নয় যে, কাবায়েলীরা এসেছে বলে মহারাজা ভারতে ছুটে গিয়েছেন। এটা তো ছিলো বাহানামাত্র। *
কন্ফারেন্সের ঐতিহাসিক বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে চৌধুরী গোলাম আব্বাস পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে শেখ আব্দুল্লাহর প্রবল বিরোধিতা এবং ভারতের সামরিক আগ্রাসনের মুখে চৌধুরি গোলাম আব্বাস ও তার সহকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। তিনিই কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী যুবকদের একত্র করে জিহাদের সূচনা করেন, যাদের সাহায্যের জন্য সীমান্তের গোত্রগুলো দলে দলে কাশ্মীরে আসে।
গোটা জীবন তিনি কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য ‘জান বাজি রেখে’ কাজ করেছেন। প্রথমে ডোগরা রাজার শাসন ও শোষণ থেকে কাশ্মীরের মুসলমানদের রক্ষা করাই ছিলো তার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। পরবর্তী-কালে পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। কয়েবার তার উপর প্রাণঘাতী হামলা হয়, তবে আল্লাহর রহমতে তিনি বেঁচে যান। ১৮ই ডিসেম্বর ১৯৬৭ সালে তেষট্টি বছর বয়সে তিনি রাওয়ালপি-ণ্ডি পাকিস্তানে ইনতিকাল করেন।
***
শেরে কাশ্মীর লকব ধারণকারী শেখ আব্দুল্লাহ্ ১৯০৫ সালের ৫ই ডিসেম্বর কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরের উপকণ্ঠে সোয়ারা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের মাত্র এগার দিন আগে তার পিতা শেখ মুহম্মদ ইবরাহীম মৃত্যুবরণ করেন। তার মা অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা ও ধৈর্যশীলা নারী ছিলেন। আব্দুল্লাহ্ ছিলেন মা-বাবার কনিষ্ঠ সন্তান। সন্তানদের লালন পালনের জন্য তার মা অত্যন্ত কষ্টের জীবন যাপন করেছেন, কিন্তু মুখে কখনো অনুযোগের কোন শব্দ উচ্চারণ করেননি। (তিনি ছিলেন তার বাবার তৃতীয় স্ত্রী)। শেখ আব্দুল্লাহ্ লিখেছেন, তার সৎভাইয়েরা তার মায়ের সঙ্গে ভালো আচরণ করেনি। তবে তার এমনই ক্ষমাশীলা ও ‘অটুট’ ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী ছিলেন যে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সবাইকে নিয়ে একান্নবর্তী পরিবারের ঐতিহ্য রক্ষা করেছেন। আব্দুল্লাহ্ তার মায়ের ব্যক্তিত্ব দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহর বাবা শালতৈরীর ব্যবসা করতেন। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারেই তার জন্ম হয়েছিলো। তবে পিতার মৃত্যুর পর তার মাকে অভাব ও কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো।
যুবকবয়সে তিনি যখন হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করছে তখন ঈদুল আযহার আগের দিন হঠাৎ তার আম্মার মৃত্যু হয়, যাকে তিনি বলেছেন জীবনের কঠিন আঘাত ও শোক। তিনি তার মৃত্যুর সন উল্লেখ করেননি।
শেখ আব্দুল্লাহর প্রাথমিক শিক্ষা ছিলো স্থানীয় দ্বীনী মাকতাবে। মকতবের শিক্ষক ও তার স্ত্রীর পিতৃ¯স্নেহ ও মাতৃমমতার কথা তিনি বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উল্লোখ করেছেন। মকতবে কোরআন পড়েছেন। এবং ফার্সি কিতাবসমূহ পড়েছেন। তার কণ্ঠ ছিলো হৃদয়গ্রাহী এবং তার কোরআন শুনে সবাই মুগ্ধ হতো। ধর্মপ্রাণ কাশ্মীরীদের হৃদয় জয় করার ক্ষেত্রে তিনি তার এ গুণটি বেশ কাজে লাগিয়েছেন। তার মক্তবে দাখেলা হয়েছিলো ১৯৯ সালে।
সোয়ারা মহল্লার নিকটবর্তী নওশহরা বস্তির একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে ভর্তি করা হয় ১৯১১ সালে। বিদ্যালয়টি আঞ্জুমানে নুছরাতুল ইসলাম নামক একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের অধীনে পরিচালিত ছিলো। হাই স্কুলে পড়ার জন্য প্রতিদিন তাকে পায়ে হেঁটে দশ দশ করে বিশ মাইল পথ অতিক্রম করতে হতো। তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু লেখাপড়ার সুযোগ পাওয়ার যে আনন্দ, তাতে পথের কষ্টকে আর কষ্টই মনে হতো না।
১৯২২ সালে তিনি পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির অধীনে মেট্রিক পাশ করেন।
তিনি ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন। তখন তার আসা-যাওয়ার কষ্ট অনেক বেড়ে গিয়েছিলো এবং শেস পর্যন্ত তাকে বোর্ডিংজীবন গ্রহণ করতে হয়েছিলো। ১৯২৪ সালে শ্রীনগরের শ্রী প্রতাপ কলেজ থেকে বেশ কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি এফএসসি পাশ করেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের শিকার হয়ে তিনি মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি, যা তার ভিতরে বড় ধরনের বিদ্রোহের অনুভূতি সৃষ্টি করে।
কাশ্মীরে বিএসসি পড়ার কোন ব্যবস্থা ছিলো না, তাই তিনি জম্মুর প্রিন্স অব ওয়েলস কলেজে ভর্তির চেষ্টা করেন, কিন্তু ধর্মপরিচয়ের কারণে তাকে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। তখন বাধ্য হয়ে তাকে বাধ্য হয়ে লাহোরের ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হতে হয়। কিন্তু সেখানেও তাকে ‘উন্নতির রুদ্ধপথের’ সম্মুখীন হতে হয়। পরে তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং দ্বিতীয় বিভাগে এমএসসি পাশ করেন। ১৯৩০ সালে তিনি আলীগড়ের শিক্ষা সমাপ্ত করে কাশ্মীরে ফিরে আসেন। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বিলাত যাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। কিন্তু মুসলিম পরিচয়ের কারণে তা সম্ভব হয়নি। এমনই কঠিন ছিলো জম্মু-কাশ্মীরে মুসলিম তরুণদের শিক্ষা অর্জনের পথ।
তার কর্মজীবন শুরু হয় রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে। শুরু থেকেই কাশ্মীরের মজদূর শ্রেণীর উপর ডোগরা রাজের পক্ষ থেকে যে অবর্ণনীয় যুলুম নির্যাতন হতো তাতে তিনি ভিতরে ভিতরে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। এর মধ্যে শালশ্রমিকেরা তাদের অধিকারের জন্য প্রতিবাদ শুরু করে। তিনি লিখেছেন, ‘এটা ছিলো এধরনের প্রথম প্রতিবাদ যা আমি নিজের চোখে দেখতে পেয়েছি।
১৯২৪ সালের অক্টোবর মাসে ভারতবর্ষের লর্ড রেডিং সস্ত্রীক কাশ্মীরভ্রমণে এসেছিলেন। তখন কাশ্মীরের নেতৃস্থানীয় কিছু মুসলিম (মীর ওয়াইয কাশ্মীর মৌলভী আহমাদুল্লাহ্ হামদানী, মুফতী শরীফুদ্দীন, খাজা সাদুদ্দীন প্রমুখ) লিখিতভাবে ডোগরা রাজার জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করেন। যদিও এতে শেষ পর্যন্ত কোন সুফল আসেনি, বরং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের উপর রাজরোষ নেমে আসে, তবে শেখ আব্দুল্লাহর অন্তরে এর গভীর প্রভাব পড়ে।
শেখ আব্দুল্লাহ্ মুসলিমানে কাশ্মীরের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য চৌধুরী গোলাম আব্বাসের নেতৃত্বের মুসলিম কান্সফারেন্স প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণ করেন। এরই মধ্যে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা নেহরুর সান্নিধ্যে চলে আসেন এবং মূলত তারই পরামর্শে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে ন্যাশনাল কন্ফারেন্স গঠন করেন।
শেখ আব্দুল্লাহর জীবনে বড় একটা দ্বৈততা এই ছিলো যে, একদিকে তিনি মহারাজা হরিসিং-এর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন কাশ্মীরের আম জনতার পক্ষে, অন্যদিকে বিভিন্নভাবে মহারাজার সুদৃষ্টি লাভেরও সযত্ন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একটি উদাহরণ শুধু এখানে পেশ করা হচ্ছে। সস্ত্রীক মহারাজার ইউরোপের সফরে থাকা অবস্থায় তার পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে। এ জন্য মহারাজাকে অভিনন্দন জ্ঞাপনের জন্য মুসলমানদের পক্ষ হতে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তাদের মধ্যে শেখ আব্দুল্লাহ্ ছিলেন অগ্রগামী। পক্ষান্তরে চৌধুরী গোলাম আব্বাস এধরনের দ্বৈতচরিত্র থেকে মুক্ত ছিলেন।
মুসলিম কন্ফারেন্স ও ন্যাশনাল কনফারেন্স এর বিরোধ চরম আকার ধারণ করে যেমন মূল ভারতে মুসলিম লীগ ও ন্যাশনাল কংগ্রেসের মধ্যে ছিলো। ফলে চৌধুরী গোলাম আব্বাসে নেতৃত্বে একদিকে যেমন কাশ্মীরের ভারতভুক্তির জোদার প্রয়াস চলছিলো, অন্যদিকে শেখ আব্দুল্লাহ্র নেতৃত্বের কাশ্মীরের ভারতভুক্তির প্রয়াস আরো জোরদারভাবে চলছিলো। দুঃখজনক বাস্তবতা এই যে, ভারতে হিন্দুনেতৃত্ব যেভাবে শেখ আব্দুল্লাহ্ পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে, মুসলিম নেতৃত্ব চৌধুরী গোলাম আব্বাসকে তা দেয়নি। তিনি যা কিছু করছিলেন নিজের বিশ্বাস ও প্রত্যয় থেকে এবং নিজের সীমিত সাধ্যকে কাজে লাগিয়েই করে যাচ্ছিলেন।
শেখ আব্দুল্লাহর গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন ‘মীর ওয়াইয মুহম্মদ ইউসুফ শাহ দেওবন্দী আলিম ছিলেন। কাশ্মীরী মুসলমানদের জীবনে তার বিপুল প্রভাব ছিলো। তিনি আমাকে এভাবে পরিচয় করিয়ে দিতেন যে, তার বক্তব্যকে যেন আমারই বক্তব্য মনে করা হয়।...
শেষ কথা এই যে, কাশ্মীরী মুসলমানদের অধিকার আদায়ের জন্য ডোগরা রাজের বিরুদ্ধে তার যে সোচ্চার ভূমিকা ছিলো তার সঙ্গে ‘ব্যক্তিত্বের কাশিমা’ যুক্ত হওয়ার কারণে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তবে এ জনপ্রিয়তা হিন্দুস্বার্থ রক্ষার কাচে ব্যবহৃত হয়েছে। হয়ত তিনি ভেবেছিলেন ভারতের অংশ হলেই তার রাজনৈতিক ভবিশ্যত নিরাপদ হবে। পক্ষান্তরে পাকিস্তানে কায়েদে আযম জিন্নাহ সূর্যসমান ব্যক্তিত্বের সামনে তার ব্যক্তিত্ব নিষ্প্রভ হয়ে পড়বে।
এটা ছিলো শেখ আব্দুল্লাহ্র ভুল চিন্তা, যা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে সামনে এসে গিয়েছিলো।....
অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে ১৯৮২ সালের চৌঠা ডিসেম্বর জম্মু-কাশ্মীরের সরকারে থাকা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ততদিনে তার জনপ্রিয়তায় বিরাট ধ্বস নেমেছে। ...
সংবাদ পত্রের ভাষ্যমতে ২০১৫ সালে শাহাদাত লাভকারী বোরহান ওয়ানির জানাযায় যে জনসমাগম হয়েছে, আব্দুল্লাহর জানাযায় তার অর্ধেকও হয়নি। সংবাদপত্রের আরো মন্তব্য ছিলো, যদি ১৯৪৭/৪৬ সালে তার মৃত্যু হতো তাহলে অন্তত এর চারগুণ বেশী জনসমাগম হতো এবং শোকের কান্নার অন্যরকম রোল উঠতো।
শেষ জীবনে এমনিতেই শেখ সাহেবের জনপ্রিয়তা তলানীতে এসে ঠেকেছিলো। তারপরো যতটুকু ছিলো তাও শেষ হয়ে গিয়েছিলো ‘বন্ধুপুত্রী’ ইন্দীরা গান্ধীর সামনে তার নতজানু চরিত্রের প্রকাশে।
‘শেরে কাশ্মীর’-এর আসল চেহারা
তখনকার কাশ্মীরের ষাটভাগ, বর্তমান কাশ্মীরের পচানব্বই ভাগ মুসলমান শেখ আব্দুল্লাহ্ ও তার পরিবারকে মনে করে কাশ্মীরের দুর্ভাগ্য ও দুর্গতির প্রধান কারণ। তাদের মতে, তিনি যদি শুধু একটি ‘না’ এবং একটি ‘হাঁ’ বলতেন তাহলেই আজ পুরো কাশ্মীর অন্তত ‘আযাদ কাশ্মীরের’ মত জীবন লাভ করতে পারতো, বরং কাশ্মীর যথার্থরূপেই হতে পারতো ‘কাশ্মীর’! কিন্তু ...
আগের এবং পরের অনেকের মত শেখ আব্দুল্লাহ্রও বড় বেশী দুর্বলতা ছিলো উপাধির প্রতি। শত্রুরাও স্বীকার করবে জিন্নাহর সেটা ছিলো না। এ ধারণা আমি পেয়েছি খোদ শেখের আত্মজীবনী থেকে। তাছাড়া করম চাঁদ গান্ধী তার উপাধি নিয়ে যে কৌতুক করেছেন, প্রশংসার ছলে সেটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
আত্মজীবনীতে শেখ নিজের সম্পর্কে ‘ভাবমূর্তি’ উপস্থাপন করতে চেয়েছেন সে সম্পর্কে আমাদের কোন মন্তব্য নেই। আমরা শুধু ইতিহাস থেকে একটা ঘটনা এখানে তুলে ধরতে চাই। কাশ্মীরের প্রভাবশালী পত্রিকা ছিলো দৈনিক খিদমত। সম্পাদক ছিলেন গোলাম আহমদ কাশফী। ভীতি ও প্রলোভন, দু’ভাবেই তাকে চাপ দেয়া হলো তার পত্রিকায় শেখের জন্য ‘কায়েদে আযম’ উপাধি লেখার জন্য। কোন ভাবেই যখন তাকে রাজী করানো গেলো না তখন শেখ নিজে তার দলবলসহ হাজির হলেন খিদমাত-দফতরে। শেখের হাতে ছিলো হকিস্টিক, যেমন থাকে সাধারণ কর্মীর হাতে! সেই স্টিক দিয়ে প্রকাশ্যে কাশফীকে তিনি বেদম প্রহার করলেন এবং তাকে সীমানার ওপারে পাঠিয়ে দিলেন। সে যুগের সর্বজনমান্য সাংবাদিক কাশফী মারাত্মক আহত অবস্থায় হাসপাতালে নীত হলেন। ...
ঘটনাবলী প্রমাণ করে, তিনি কেমন প্রতিশোধপরায়ণ ছিলেন। সেই সাতচল্লিশে যখন আব্দুল্লাহ্র হাতে কাশ্মীরের প্রশাসন এসে গেলো, প্রথম কাজ যেটা তিনি করলেন তা হলো মুসলিম কনফারেন্সের নেতৃবৃন্দকে এককালে যারা তার ‘হামসফর’ ছিলেন, প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগ করে তাদের তিনি বিভিন্নভাবে নাজেহাল করেছেন, কাশ্মীর থেকে তাদের নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। জলীল ইন্দারবী-এর ঘাতককে সাজা তো দেয়া হলো, তবে তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্যও করা হলো। প্রচ- গণদাবীর মুখেও তাকে ফিরিয়ে আনার এবং সাজা নিশ্চিত করার কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সেটা অবশ্য আলাদা কথা যে, কানাডায় পালিয়ে যাওয়া ঘাতক মেজর অবতার ও তার পরিবার কুদরতের ইনতিকাম ও প্রকৃতির প্রতিশোধ থেকে বাঁচতে পারেনি।
এটা সবার জানা কথা যে, ক্ষমতার লোভেই শেখ নিজে ডুবেছেন, কাশ্মীরকে ডুবিয়েছেন। স্বাভাবিক কথা যে, কেউ বলে না, ‘আমি ক্ষমতার লোভী’, বরং বিপরীত কথাই বলে, ‘আমি ক্ষমতা চাই না, ক্ষমতার মোহ আমার নেই, আমি চাই দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে...! মানুষের প্রকৃত চেহরা প্রকাশ পায় নিরপেক্ষ ও নির্মোহ পর্যবেক্ষণের দর্পণে। আত্মজীবনীতে শেখ আব্দুল্লাহ্র যে আন্দাযে বয়ান তাতে তার ক্ষমতাপ্রীতির দুর্গন্ধই শুধু বের হয়ে এসেছে। এ প্রশ্নের কোন উত্তর কারো কাছেই নেই যে, যে ডোগরা রাজার বিরুদ্ধে তিনি ‘কাশ্মীর ছাড়ো’ আন্দোলন করেছেন এবং স্বয়ং গান্ধী-নেহরু কাশ্মীরে এসে আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছেন, সেই ডোগরা রাজার কারগার থেকে বের হয়ে তারই অধীনে কী কারণে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করলেন?
বলাবাহুল্য এই ক্ষমতাপ্রীতিই শেষ বয়সে ‘ইন্দীরা’র মত বাচ্চা মেয়ের সামনে তাকে মাথা নোয়াতে বাধ্য করেছে, যার কোন প্রয়োজন ছিলো না এবং যার দ্বারা কাশ্মীর ও তার জনগণ আলাদা কিছু অর্জন করেনি। ...
ক্ষমতার প্রতি নির্মোহতা কাকে বলে তার নমুনা শেখ আব্দুল্লাহ্র সামনেই ছিলো। চৌধুরী গোলাম আব্বাস!
আযাদ কাশ্মীরের নেতৃত্বের ভাঙ্গন ও ফাটল ধরানোর গভীর চক্রান্ত সামনেরেখে ভারত সরকার অকস্মাৎ চৌধুরী গোলাম আব্বাসের মুক্তি ঘোষণা করলো। গোলাম আব্বাস যিনি দু’বছর ধরে বিনাবিচারে কারাগারে ধুঁকছিলেন, তিনি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে, কাশ্মীরের আযাদীর জিহাদ যখন চরম স্তরে উপনীত, তখন তার মত শীর্ষস্থানীয় নেতাকে মুক্তি দেয়া হবে! কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটলো। ডোগরা সিপাহীরা তাকে সসম্মানে সুচিতগড় পৌঁছে দিলো এবং ৪ঠা মার্চ ১৯৪৮ মুক্ত করে দিলো!
ভারত সরকার আশা করেছিলো, চৌধুরি গোলাম আব্বাস এবং সরদার ইবরাহীমের মধ্যে ক্ষমতা দ্বন্দ্ব শুরু হবে, আর আযদীর জিহাদ বড় ধরনের একটা হোঁচট খাবে। ভারত সরকারের অবশ্য দোষ নেই; এমন ভাবতেই পারে! কারণ তাদের সামনে নমুনা ছিলেন শেখ আব্দুল্লাহ্!
ওদিকে কী ঘটলো! আযাদ কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট সরদার মুহম্মদ ইবরাহীম সবার আগে চৌধুরী গোলাম আব্বাসকে অভিনন্দনবার্তা পাঠালেন, ... আপনি আসুন, আযাদ কাশ্মীরের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করুন...! চৌধুরী গোলাম আব্বাস সরদার ইবরাহীমকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, আপনি দায়িত্ব পালন করুন, আমি আমার অবস্থান থেকে আপনাকে সাহায্য করে যাবো।
মহারাজা হরি সিং, শেখ আব্দুল্লাহা ও ভারত সরকার নিজের চোখে তাদের কূটচালের ব্যর্থতা দেখে শুধু আঙুল কামড়াতে থাকলো।
কাশ্মীর উপত্যকায় এবং ভারতবর্ষে যারা ইতিহাসের প্রধান চরিত্র ছিলেন, তারা সবাই এখন ইতিহাসের বিচার পর্যালোচনার পাত্র। ইতিহাসই এখন তার ফায়ছালা ঘোষণা করছে যে, জাতির শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা এবং জাতির ক্ষোভ ও ঘৃণা কার কতটুকু প্রাপ্য!