কাশ্মীরসংখ্যা

কাশ্মীর সংখ্যা (বিশেষ)

প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণা!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণা!

 

কাশ্মীর জিহাদের বিষয়ে অধ্যয়ন করতে গিয়ে দু’টা কিতাব হাতে এসেছে। ‘টি’-এর স্থানে ‘টা’ বলেছি সচেতনভাবে। কারণ আমার মনে হয় এগুলো ‘কিতাবে ছালেহ্ নয় বরং কিতাবে সু’; সুগ্রন্থ নয় কুগ্রন্থ।

বইদু’টা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি, আর অবাক হয়ে ভেবেছি, সেই খায়রুল কুরূনের যুগে চতুর্থ খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী রা. তাঁর আল্লাহ্ --প্রদত্ত নূরানী ও ঈমানী ফারাসাত দ্বারা কত বড় হাকীকতের উদ্ঘাটন করেছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত আনেওয়ালী উম্মতের জন্য পাথেয় ও যাদেরাহরূপে রেখে গিয়েছেন! বহুবার পড়েছি, বহু উপলক্ষে তা উচ্চারণ করেছি, কিন্তু এ বইদু’টার পাতায় পতায় ঐ সত্যটি যেভাবে অনুধাবন করেছি তার জন্য শুধু বলতে পারি, হে আল্লাহ্ তোমার শোকর। তোমার নেক বান্দা, পাক বান্দা, দামাদে নবী শেরে খোদা হযরত আলী রা.কে তুমি তোমার শায়ানে শান জাযা দান করো। খারেজি ফেরকার শ্লোগান

إن الـحـكـم إلا لله

এর জবাবে হযরত আলী রা. বলেছিলেন

كلمـة حـق إريـد بـها الباطل

যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, কথা তো ঠিক, তবে মতলব খারাপ।

ভূমিকা দীর্ঘ না করে মূল বক্তব্যে আসি। একটা কিতাবের নাম হলো

مسئلہ کشمیر کا حل

কাশ্মীর সমস্যার সমাধান

দ্বিতীয় কিতাবটা হচ্ছে

کشمیر میں امن

কাশ্মীরে শান্তি

উভয় কিতাবের খোলাছা বক্তব্য হলো। কাশ্মীরে এ পর্যন্ত জিহাদের নামে যা কিছু হয়েছে এবং বর্তমানে যা কিছু হচ্ছে, ইসলামের আহকামে জিহাদের সঙ্গে তার দূরতম সম্পর্ক নেই। বরং বিভিন্ন দল নিজেদের মতলব হাছিল করার জন্য জিহাদের নামে সহজ সরল কাশ্মীরী জনগণকে যুদ্ধের চুল্লীতে জ্বালানীরূপে ব্যবহার করছে। কাশ্মীরে শান্তি নিশ্চিত করাই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে জিহাদের নামে সন্ত্রাসের পথ ছেড়ে আলোচানার মাধ্যমে সমাধানের পথ খঁজে বের করতে হবে। আর সে জন্য উভয় পক্ষকে কিছু ছাড় দিয়ে কিছু অর্জনের নীতি গ্রহণ করতে হবে। যদি ভাবাবেগের পথ ছেড়ে বাস্তবতার জগতে আমরা পা না রাখি তাহলে ভবিষ্যতে হয়ত শান্তির বর্তমান সুযোগটাও হাতছাড়া হয়ে যাবে, তখন আফসোস করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।

কিতাব দু’টা পড়ে সাধারণ দৃষ্টিতে যে কারো মনে হবে, কত দরদের কথা বলছেন! কত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার কথা বলছেন! এর চেয়ে বড় সত্য আর কিছু নেই। এটাই শান্তির একমাত্র পথ। কিন্তু আসলেই কি তাই? এমন তো নয় যে, ‘কথা তো সত্য তবে মতলব খারাপ’!

এখানে আমরা এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত একটি পর্যালোচনা তুলে ধরতে চাই, যাতে সরলচিত্ত পাঠকের সামনে প্রকৃত সত্য প্রকাশ পায়।

***

প্রথম কিতাবের লেখক পাকিস্তানের সুপ্রদ্ধি বক্তা ও স্কলার ড. আসরার আহমদ।

দ্বিতীয় কিতাবের লেখক হিন্দুস্তানের সুপরিচিত ‘মাওলানা’ ওয়হিদুদ্দীন খান, যিনি সঙ্গত কারণেই হিন্দু মিডিয়ায় যথেষ্ট প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ড. আসরার আহমদ তো ঐ পরম সত্তার কাছে চলে গিয়েছেন, যিনি প্রতিটি কথা ও কাজের হিসাব গ্রহণ করবেন এবং ‘জাযা ও সাজা’-এর ফায়সালা করবেন। আমরা কামনা করবো, আল্লাহ্ যেন প্রত্যেক মুসলমানকে মাফ করে দেন এবং ...!

তিনি জন্মগহণ করেছেন ২৬ শে এপ্রীল ১৯৩২ এবং মৃতুবরণ করেছেন ২রা এপ্রীল ২০১০ সালে ৭৮ বছর বয়সে।

দ্বিতীয় জন, জন্ম ১লা জানুয়ারী ১৯২৫, জীবিত  ৯৪ বছর বয়সে।

এ দু’জনের প্রতিটা বক্তব্য ও মন্তব্য এমনই ‘শিশুতোষ’ যে, কোন ইচ্ছাই ছিলো না এ বিষয়ে কলম ধরার এবং কিছু লেখার। কিন্তু আম মুসলমান এতই গাফেল এবং অসচেতন যে, বহু মানুষ তাদের কথায় জিহাদ ও কাশ্মীরের জিহাদ সম্পর্কে বিভ্রান্ত হচ্ছে। ওয়াহীদুদ্দীন খান নিজেও লিখেছেন

‘আমার কলম-প্রচেষ্টার ফলে হাজারো কাশ্মীরীর কল্যাণ হয়েছে। তারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ -এর পথ ছেড়ে শিক্ষা ও উন্নয়নের পথে আগুয়ান হয়েছে...।

তাই বাধ্য হয়ে এ বিষয়ে কলম ধরতে হলো, যাতে সাধ্যমত মানুষের কাছে প্রকৃত সত্য তুলে ধরা যায়। বাকি সত্যকে বোঝা ও গ্রগণ করার তাওফীক তো আল্লাহর হাতে।

***

আসরার আহমদ লিখেছেন

কাশ্মীরে যা চলছে সেটাকে জিহাদ বলা হচ্ছে। জিহাদ হলে তো আল্লাহ্র সাহায্য অপরিহার্য। যেমন ইরশাদ হয়েছে

إن يَّـنْـصُـــرْكُــمُ الله فَلا غالِبَ لَكُمْ

 কিন্তু মুসলিম সমাজের বর্তমান অবস্থায় কি আল্লাহ্র সাহায্যের সামান্য আশাও করা যায়, যেখানে সুদী অর্থব্যবস্থায় ডুবে থাকার কারণে স্বয়ং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছি, যেমন ইরশাদ হয়েছে

وإنْ لَـمْ تَـفْـعَـلوا فَـأذَنُـوا بِـحَـرْبِ مِّـنَ الله وَ رَسُـولِـه

যদি তোমরা (সূদ ত্যাগ) না করো তাহলে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও।

অন্যদিকে ফরমানে নববী হলো

فَـأنّـى يُـسْـتَـجابُ لِـذلكَ؟

এমন ব্যক্তির দু‘আ কীভাবে কবুল হতে পারে?

সুতরাং আমাদের লড়াই করতে হবে শুধু উপায় উপকরণ দ্বারা এবং এগুলোর মান ও পরিমাণ দ্বারা। আর এক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে তুলনা ও পার্থক্যের খবর তো হররোয পত্রপত্রিকার শোভা বর্ধন করছে।...

জানি না, এটা পাপ, না জ্ঞানপাপ! আমরা শুধু বলতে চাই, এটা অবশ্য সত্য যে, আমাদের জিহাদ সংখ্যা ও শক্তি দ্বারা হতে পারে না। কারণ এ ক্ষেত্রে শত্রুর সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এত বিপুল যে, পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। আমাদের একমাত্র কর্তব্য হলো সাধ্যপরিমাণ শক্তি প্রস্তুত করা, যেমন ইরশাদ হয়েছে ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যতটুকু পারো শক্তি প্রস্তুত করো...।

তারপর আল্লাহর সাহায্য ও গায়বি মদদ লাভ করা, তখন প্রবল থেকে প্রবল শত্রুও আমাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না।

এখন ড. সাহেব তো আল্লাহ্র সাহায্য ও মদদ থেকেই আমাদের হতাশ করে দিচ্ছেন! কিন্তু কথা হলো। আল্লাহ্র সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ কোথায়? আমরা কি সূদব্যবস্থার প্রতি সন্তুষ্ট? মুসলিম উম্মাহ্ তো নিরন্তর সংগ্রাম ও জিহাদ চালিয়ে যাচ্ছে  সূদের অভিশাপ মুক্ত হওয়ার জন্য? এবং এক্ষেত্রে অগ্রগতি কি আশাব্যঞ্জক নয়? সর্বোপরি আমরা কি অমার্জনীয় সকল ত্রুটিবিচ্যুতি সত্ত্বেও আল্লাহ্র গায়বী মদদ লাভ করছি না। সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে এবং আরবশাসকদের উপেক্ষার মুখে  দাঁড়িয়ে ফিলিস্তীনে হামাস এখনো লড়ে যাচ্ছে কীভাবে? ৪৭ সালে নিরস্ত্র অসহায় মুজাহিদীন ভয়ঙ্করতম প্রতিকূলতার মুখে কীভাবে আযাদ কাশ্মীর হাছিল করেছে? কী ফল হতো, যদি ভারতের পিছু পিছু আমরা জতিসঙ্ঘের দ্বারস্থা না হয়ে জিহাদ অব্যাহত রাখতাম? আরো রক্ত ঝরতো, আরো ... কিন্তু পুরো কাশ্মীর আমাদের হাতে এসে যেতো। আর যদি আল্লাহ্র গায়বি মদদ ‘অসম্ভব’ মনে করে জিহাদ না করা হতো, তাহলে তো পুরো কাশীরই হতো ‘অধিকৃত’ কাশ্মীর!

ড. ছাহেব আরো লিখেছেন

ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো সরলমনের মুসলমানদের ধোকা দিতে চায় এই আয়াতের কথা বলে

তোমাদের কী হলো যে, তোমরা লড়াই করছো না আল্লাহ্র রাস্তায় এবং দুর্বল অসহায় লোকদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে...

কিন্তু এ সত্যটি বুঝে শুনে এড়িয়ে যাওয়া হয় যে, এ আয়াতের সম্বোধন তো ছিলো মদীনার ঐ মুসলমানদের প্রতি যারা নিজেদের সমাজকে...

এদিকে আমাদের সমাজের অবস্থা হলো...! কোথায় মদীনার ছাহাবা কেরাম, আর কোথায় পাকিস্তানের মুসলিমান! আকাশের সঙ্গে পাতালের তুলনা!

এ আয়াতের হাওয়ালায় যারা কাশ্মীরজিহাদের উন্মাদনা সৃষ্টি করতে চান তারা হয় নিজেরা বোকার স্বর্গে বাস করেন, আর না হয় ‘চান্দার লোভে’ আম মানুষকে বোকার স্বর্গে নিয়ে যেতে চান।...

০০ ডক্টর হলে কি এভাবে বলতে হয়! বক্তব্য আরেকটু শালীন ও সংযত হলে ক্ষতি কী!

শুধু জানতে চাইবো, তাহলে কী বিভিন্ন জনপদে দুর্বল অসহায় নরী-পুরুষ আর্তনাদ করে ডাকতে থাকবে, আর আমরা বসে থাকবো এই যুক্তিতে যে, আগে তো মদীনার সমাজ কায়েম করো এবং আয়াতের সম্বোধনের উপযুক্ত হও তারপর...! এটা করবো নাকি আত্মসংশোধন, সমাজসংশোধন এবং অসহায় মানুষের সাহায্যের জন্য জিহাদ একসঙ্গে চালিয়ে যাবো! শরীয়তের দাবী কী? আহলে ইলম ও ওলামায়ে উম্মত কী বলেন? শরীয়তের দাবী আমরা কাদের কাছ থেকে জানবো?

কাবায়েলী মুজাহিদীন ভিতরের ও বাইরের সব ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ওলামায়ে উম্মতের আদেশে এ আয়াতের উপর আমল করেই তো ছুটে গিয়েছিলেন কাশ্মীরে। পুঞ্ছে ততদিনে ভয়াবহ গণহত্যা সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিলো! কাবায়েলীরা বিলম্বে হলেও ছুটে না গেলে,  কী হতো কাশ্মীরের মুসলমানদের অবস্থা?

তিনি আরো লিখেছেন

‘মুসলিমানে কাশ্মীরের জিহাদী জাযবা ও শাওকে শাহাদাতের কথা বড় জোরে শোরে বলা হয়। আসলে আবেগসর্বস্বতা থেকে মুক্ত হয়ে আকল ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে একটু ঠা-ণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখি, ভারতের মত বিশাল শক্তির বিরুদ্ধে বাইরের কারো সাহায্যসহযোগিতা ছাড়া কাশ্মীরের ‘মুজাহিদীন’ কত দিন টিকতে পারবে? পাকিস্তান তো ‘নৈতিক’ সাহায্য দিয়েই খালাস!

০০ সত্তর বছর তো টিকে আছে! হারার আগে হার মেনে নেয়ার কথা কেন বলা হচ্ছে! হিন্দুস্তানকে বরং বলা যায়, সত্তর বছরেও কাশ্মীর হাতের মুঠোয় আনা গেলো না, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি আর কত! ছেড়ে দাও না, শেষ হয়ে যাক মাথাব্যথা! ড. সাহেবের শেষ কথা হলো কাশ্মীর সমস্যার সবচে’ গ্রহণযোগ্য সমাধান হচ্ছে জাতিসঙ্ঘ থেকে পত্রপাঠ চলে আসা। আঙ্কেল শ্যামকে সালাম বলে দেয়া। তারপর ভারত-পাকিস্তান উভয়পক্ষ শিমলাচুক্তির আলোকে আলাপ আলোচনায় বসা এবং ‘কিছু দাও, কিছু নাও’ ভিত্তিতে সমঝোতায় উপনীত হওয়া। ...

যদি এটা না করা হয় তাহলে অচিরেই দেখা যাবে, ভারত ও পাকিস্তান গল্পের বিবাদমান দুই বেড়ালের মত দেখতে থাকবে, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বইহুদি শক্তির ‘বানর’ রুটির মত সমগ্র কাশ্মীর হযম করে ফেলবে।

০০ ড. সাহেবকে শুধু বলবো, যে আশঙ্কার কথা আপনি বলছেন, আমদেরও মনে সেই আশঙ্কা। তবে সমাধান হলো মুসলিম উম্মাহর মধ্যে জিহাদি চেতনা সৃষ্টি করা এবং জিহাদের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা। জিহাদই সমাধান হবে! এ ছাড়া যা কিছু, তা সমাধান নয়, বরং জিল্লতি।

***

জনাব ওয়াহীদুদ্দীন খান লিখেছেন ‘পরিস্থিতির ফায়ছালা এই যে, কাশ্মীরীরা স্বাধীনভাবে, মজবূরির কারণে নয়, এই সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে যে, তাকদীর তাদেরকে ভারতের অংশ বানিয়ে দিয়েছে। এখন খুশিমনে তাকদীরের ফায়ছালা মেনে নেয়া ছাড়া তাদের জন্য আর কোন উপায় নেই! তাছাড়া সর্বদিক থেকেই তাদের জন্য এটা কল্যাণকর। কারণ ইন্ডিয়া বড় দেশ। এখানে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রয়েছে। এখানে প্রায় বিশ কোটির মত স্বধর্মের মুসলিম রয়েছে। ....

০০ মাশাআল্লাহ্! ইন্ডিয়া বড় দেশ, তাতে আর সন্দেহ কী! আর স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র, দু’টোই তো মুসলিম সম্পদ্রায় উত্তমরূপে ভোগ করে আসছে, যার সাম্প্রতিক নমুনা হলো গুজরাট এবং বাবরি মসজিদ! তবে কিনা স্বয়ং বহু হিন্দু উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী বলছেন, মুসলমানদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত হওয়ার কথা!

জানতে ইচ্ছে করে পরিস্থিতির ফায়ছালা পর্যন্ত হয়ত ঠিক আছে, তাকদীরের কথা তিনি জানলেন কীভাবে?

খান ছাহেব বড় একটা দ্বীনী ফায়দা দেখিয়েছেন এভাবে ‘ইন্ডিয়াতে দ্বীনী দাওয়াতের এমন বিরাট সুযোগ রয়েছে যার উপর হাদীছ শরীফে নাজাতে আখেরাতের খোশখবরি রয়েছে।...

০০ এজন্য তো জনাব, আপনিসহ ভারতের বিশকোটি মুসলিম যথেষ্ট হওয়ার কথা। কাশ্মীরীদের টেনে আনার কী প্রয়োজন?

০ একবার আমি কিছুদিনের জন্য করাচি ছিলাম। সেখানে এক শিল্পপতির সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, আপনারা ইন্ডিয়াতে আমাদের চেয়ে ভালো পজিশনে আছেন। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, দেখুন পাকিস্তান এক ছোট দেশ। আমাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার খুব ছোট। অথচ আপনাদের উৎপাদিত পণ্যের জন্য রয়েছে বিরাট বাজার।

০০ আপনি তো একজনের কথা বলছেন; পঞ্চাশজন শিল্পপতি এমন পাওয়া যাবে যারা আরাম সে বলে দেবেন, ‘আপনার বাজার নিয়ে আপনি থাকুন। আমাদের জন্য ছোট দেশের ছোট বাজারই যথেষ্ট।’ তাছাড়া মহাশয়ের কি জানা আছে, ভারতের বাজারে হিন্দুরা মুসলিমের দোকানে পারতপক্ষে যেতেই চায় না!

আপনি বলছেন, ইন্ডিয়ার মুসলমান পুরো উপমহাদেশে সবচে’ বেশী তরক্কী করেছে।... কিন্তু পরিসংখ্যান কী বলে? সেনাবাহিনীতে, বেসামরিক ক্ষেত্রে চাকুরিতে মুসলিমানের উপস্থিতির হার কী?

০ রাজনৈতিক দিক থেকেও কাশ্মীরীদের জন্য উন্নতির বিরাট সুযোগ রয়েছে। কাশ্মীরীরা যদি সঙ্ঘাতের নীতি ত্যাগ করে দিল দিয়ে হিন্দুস্তানকে কবুল করে তার অংশ হয়ে যায় তাহলে আগামী গণতান্ত্রিক ভারতে যে প্রথম মুসলিম প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি কাশ্মীরী মুসলমান হবেন। এতে আমার কোন সন্দেহ নেই।

০০ ভারতে মুসলিম রাষ্ট্রপতি সামনেও একদু’জন হতে পারেন, কিন্তু একশ বছরেও কি মুসলিম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ‘আশঙ্কা’ আছে? তাহলে কাশ্মীরীরা বলতে পারে, আমরা তাতে ভাগ বসাতে চাই না, ঐ প্রাধানমন্ত্রিত্ব আমাদের বিশকোটি মুসলমান ভাই-ই ভোগ করুন।

আমরা  তো চেয়েছিলাম, আমাদের মুখ্যমন্ত্রীকে শুধু নামকা ওয়াস্তে হলেও প্রধানমন্ত্রী বলা হোক, হিন্দু ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা রক্ষা করেনি। কেন? প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো কেন? রক্ষা করলো না কেন?

০ নিজেদের অধিকার আদায় করার উপযুক্ত সময় হলো, যখন সিদ্ধান্তের সুতোটা নিজের হাতে থাকে। কিন্তু আমাদের নেতৃবৃন্দ ঐ সময় হুঁশে আসেন যখন তার কেসটা নিছক মানবিক কেস হয়ে যায়। শেখ আব্দুল্লাহ একজন মুখলিছ কাশ্মীরী। সাহসিকতার কারণে যথার্থই তিনি শেরে কাশ্মীর উপাধির উপযুক্ত

০০ গান্ধীজী এভাবেই শেখের পিঠ চাপড়ে বলতেন,‘আব্দুল্লাহ্ আছলি শের হ্যয়, বিলকুল তাগড়া শের, নকলি শের ন্যহীঁ।’

সেই আছলি শেরকে জেলে পুরতে কতদিন লেগেছে হিন্দু ভারতের?

০ ১৯৪৭ সালে তিনি ঐ পজিশনে ছিলেন যে, যদি বাস্তবতাবোধের পরিচয় দিতেন তাহলে নিজের ফায়ছালা নিজের মর্জি মত করতে পারতেন।

০০ ঠিক একথাই জিন্নাহ তাকে বুঝিয়েছিলেন যে, এখন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে, এখন যদি ভুল করেন তাহলে পরে পস্তাতে হবে।...

০ কিন্তু সিদ্ধান্তের সময় তিনি অবাস্তব স্বপ্নে বিভোর ছিলেন...

০০ কেন? তিনি তো ভারতভুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন! আপনার মত তিনিও ভেবেছিলেন, ভারত বড় দেশ... প্রথম যে মুসলিম প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনি শেরে কাশ্মীর ছাড়া অন্য কেউ নন...

০ এখন সিদ্ধান্তের সুতো তার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। এখন চেচামেচি করছেন, যা মানবিক দয়া প্রার্থনা ছাড়া আর কিছু নয়। আর পৃথিবীতে মানবিক দয়া প্রার্থনার কোন মূল্য নেই!

০০ আমাদের আফসোসও এখানেই। সাতচল্লিশে তার সুযোগ ছিলো মুসলিম ভূখ-ণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার, সে সুযোগ তিনি হারিয়েছেন। এখন তিনি খুব সামান্য সুযোগ সুবিধার জন্য দোহাই পাড়ছেন, কিন্তু কোন ‘হিন্দু কান’ তা শুনতে প্রস্তুত নয়। বরং বিরক্তিকর মনে হলে জেলে পুরে রাখে!

০ কাশ্মীরে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়েছে ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে...

০০ কেন শুরু হলো? কারণ বারবারের নির্বাচনী জালিয়াতি থেকে, ভারতের প্রতি যাদের দুর্বলতা ছিলো তারা পর্যন্ত বুঝে গিয়েছিলো যে, নিজেদের নেতা নিজেদের পছন্দমত নির্বাচনের অধিকারও কাশ্মীরীদের নেই...

০০ আমি সেপ্টেম্বরে কাশ্মীরে গিয়েছিলাম। একদিন ক’জন কাশ্মীরী মুসলমানের সঙ্গে শ্রীনগরের বাইরে উন্মক্ত উপত্যকায় বেড়াতে গেলাম। পাহাড়ের উপর থেকে নীচে সমতলের দিকে ঝর্ণা প্রবাহিত হচ্ছে। প্রবাহের পথে একটি বড় প্রস্তর ছিলো। তাতে প্রবাহ বিঘ্নত হচ্ছিলো। তখন ঝর্ণার প্রবাহ পাথর ভেঙ্গে সামনে বাড়ার চেষ্টা করেনি। কারণ তা সম্ভব ছিলো না। বরং প্রবাহটি সামনের পাথর এড়িয়ে, পথ পরিবর্তন করে পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে। আমি, কাশ্মীরী মুসলমানদের বললাম, দেখুন, এখানে আপনাদের জন্য কুদরতের কী বাস্তবামুখী বার্তা রয়েছে! প্রকৃতি আপনাদের জন্য এখানে এই নীরব বার্তা রেখে দিয়েছে যে, তোমাদের যিন্দেগির সফরে কোন প্রতিবন্ধক যদি আসে, তোমাদের উচিত নয় প্রতিবন্ধকটির সঙ্গে ‘টকরাও’ করা এবং প্রতিবন্ধকের পাথর গুঁড়িয়ে সোজা আগে বাড়ার চেষ্টা করা। কারণ তাতে পাথর ভাঙ্গবে না, ভাঙ্গবে তোমাদের মাথা। তোমাদের কর্তব্য হবে, প্রতিবন্ধক এড়িয়ে সামনে চলার পথ করে নেয়া। ...

০০ প্রকৃতি থেকে শিক্ষাগ্রহণ খুবই ভালো! প্রশ্ন হলো, ভারতবাসী যদি  প্রকৃতির কাছ থেকে এ শিক্ষাটাই গ্রহণ করতো, ইংরেজ যখন পাথরের মত প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো উপমহাদেশের স্বাধীনতার পথে?

প্রকৃতির এ শিক্ষা তো, কোন সংগ্রাম সঙ্ঘাতের বৈধতাই আর রাখছে না! শুধু কৌশলী আত্মসমর্পণের দিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে!

০ আমি তো কাশ্মীরে ইন্ডিয়ার রাজনৈতিক বা সামরিক উপস্থিতিকে কাশ্মীরীদের জন্য কোন প্রতিবন্ধকই মনে করি না। বর্তমান গণতান্ত্রিক যুগে তো রাজনীতি হলো একটা মাথাব্যথা!

০০ সুতরাং রাজনীতি নিয়ে কাশ্মীরীদের মাথা ঘামানোই ঠিক না! ওটা ইন্ডিয়ার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা শুধু উন্নয়নের কথা ভাবলেই ভালো!

০ ৮৯-এর আগে তো ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরের সীমান্তে ছিলো। কাশ্মীরের জনপদে তো তারা প্রবেশ করেনি। কিন্তু লোকেরা যখন হাতিয়ার হাতে নিলো এবং শক্তিপ্রয়োগের পথে চলা শুরু করলো তখন ভারতীয় বাহিনী হাতিয়ারের মোকাবেলা করার জন্য জনপদে প্রবেশ করেছে!

০০ প্রশ্নটা আবার করতে হয়, কাশ্মীর কেন হাতিয়ার তুলে নিয়েছিলো?

দ্বিতীয় প্রশ্ন, গণতান্ত্রিক দেশের সেনাবাহিনী কি শুধু অস্ত্রধারীদের পর্যন্তই তাদের কার্যক্রম সীমিত রেখেছে? তৃতীয় প্রশ্ন, ঘরে ঘরে ইজ্জত আবরু লুণ্ঠনের ঘটনা কি ঘটেছে? তাতে কি কাশ্মীরীদের অন্তর ক্ষতবিক্ষত হয়েছে?

ভারতের বিরুদ্ধে কি পুরো কাশ্মীর না গুটিকতেক সন্ত্রাসী? দ্বিতীয়টি হলে এত বিপুল সেনাসমাবেশ কেন? প্রথমটি হলে ভারত কেন পুরো জনগোষ্ঠীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাশ্মীরের টুপি চেপে ধরে আছে?

০ বর্তমান পৃথিবীতে সফল জীবনের একটি নীতি এই যে, কোন কিছু নিয়ে যখন বিরোধ দেখা দেয় তখন প্রথম সুযোগে  যা পাওয়া যায় তাই সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করা উচিত। তা না করে যদি বেশী পাওয়ার আশায় সমস্যাটিকে প্রলম্বিত করা হয় তাহলে দিন দিন তা জটিল আকার ধারণ করে। এমনকি প্রথম সুযোগে যা পাওয়া যাচ্ছিলো শেষে তাও হাতছাড়া হয়ে যায়।

এর একটা উদাহরণ হলো ফিলিস্তীনসমস্যা। ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণায় ফিলিস্তীনকে ভাগ করা হয়েছিলো এভাবে যে, তিনভাগের একভাগেরও কম ভূমি দেয়া হবে ইহুদিদের, পক্ষান্তরে দুইভাগেরও বেশী দেয়া হবে আরবদের। আরবরা যদি তা মেনে নিতো তাহলে আজ তাদের এ দুরবস্থা হতো না, বরং তারা উন্নতি অগ্রগতির ক্ষেত্রে ইহুদিদেরও ছাড়িয়ে যেতো।... যা পাওয়া যাচ্ছিলো তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে পুরো ফিলিস্তীন চেয়েছে বলেই ফিলিস্তীনীদের ভাগ্যে বরবাদি ছাড়া আর কিছুই আসেনি।...

০০ ইয়া রাব্ব! জনাব খান সাহেব! আপনার বাড়ীতে প্রতিবেশী এসে দখল জমালো। আর কেউ মীমাংসা করে দিলো যে, তিনভাগের দুই ভাগ তুমি নাও, আর মাত্র একভাগ প্রতিবেশীকে দিয়ে দাও। ঝগড়া মিটে যাক!

আশা করি আপনি সব ঝগড়া ছেড়ে ...!

এটা তো ব্যক্তির বিষয়। আর যেখানে জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন!

বাকী রইলো ফিলিস্তীনীদের বর্তমান দুগর্তি। তো সেটার কারণ কিন্তু একভাগ ভূমি ইহুদিদের জন্য ছেড়ে না দেয়া নয়। সেটার কারণ হলো আরব শাসকদের বিলাসপ্রিয়তা ও জিহাদবিমুখতা এবং ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়া। ...

জনাব, আপনার কি ধারণা, ইহুদিরা ঐটুকু ভূমি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতো। ওরা যে প্রতিশ্রুত ভূমি এবং বৃহৎ ইসরাইলের কথা বলে, তার সীমানা কত দূর?

০ কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে...

০০ না, জনাব, ফিলিস্তীনের দুর্ভাগ্য যে, শুরু থেকেই ইসলামের বন্ধন এবং  আরবরক্তের বন্ধন থাকা সত্ত্বেও মিশরসহ কোন আরব দেশ ফিলিস্তীনের পাশে দাঁড়ায়নি। কিন্তু পাকিস্তান ও তার জনগণ ঈমানের দাবী রক্ষা করে কাশ্মীরের মযলূম মুসলমানদের পাশে ছিলো, আছে এবং থাকবে।

০ কাশ্মীরের মুসলমান খোলা মনে ভারতের সঙ্গে একাত্ম হলে ভারতীয় মুসলমানদের মতই স্বাধীনতা ভোগ করবে।...

০০ সত্যি বিরক্তি ধরে গিয়েছে! এমন একটা দিন কি গিয়েছে জনাব, যখন ভারতে দাঙ্গা হয়নি এবং মুসলিমের রক্ত ঝরেনি, কোন না কোন নারীর সম্ভ্রমহানি হয়নি।

অথচ পাকিস্তানে ধর্মের পরিচয়ে এ পর্যন্ত কোন দাঙ্গাই তো হয়নি। শুধু এই একটি কারণেই তো কাশ্মীরের মুসলমান ভারতের পরিবর্তে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে চাইবে!

০ আমি মনে করি, পাকিস্তান ও ভারতের জন্য সবচে’ উত্তম হলো জম্মু-কাশ্মীরের যে অংশ যার কাছে আছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা এবং নিজ নিজ অংশের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া যা উভয় অংশে দীর্ঘ দিন থেকে বন্ধ হয়ে আছে।...

০০ এ পর্যন্ত আপনি যত মূল্যবান নীতি ও মূলনীতি বয়ান করেছেন তাতে তো পাকিস্তানের ভাগে কাশ্মীরের একইঞ্চি জমিও আসার কথা ছিলো না! জিহাদ বলুন, যুদ্ধ বলুন, আযাদ কাশ্মীর তো তারই সুফল!

জনাব ওয়াহীদুদ্দীন খান ছাহেবের শেষ কথা হলো, ‘কাশ্মীরের উন্নতির জন্য এটা জরুরি নয় যে, কাশ্মীরী জনগণের রাজনৈতিক শাসন থাকতে হবে। শাসন যার হাতেই থাক, কাশ্মীর তো কাশ্মীরই থাকবে! কাশ্মীরীদের জন্য উন্নয়ন ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজনই নেই। আযাদী ও স্বাধীনতা নিছক প্রতারণাপূর্ণ শব্দ। কোরআনে কোথাও এ শব্দ নেই!

একথার উপর কোন মন্তব্য না করে আমরা শুধু এটা প্রতারণা হয় তাহলে আমরা ঘৃণার সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করছি। আর যদি আত্মপ্রতারণা হয় তাহলে দু’জনকেই করুণা করছি।

 

কাশ্মীরের ভূমিগত সম্পর্ক হলো পাকিস্তানের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের কোন ভূসম্পর্ক ছিলো না। রেডক্লিফ ষড়যন্ত্র করে গুরদাশপুর জেলা মুসলিমপ্রধান হওয়া সত্ত্বেও ভারতকে দিয়ে দেয়, যেখান থেকে দীর্ঘ একটা পথ কাশ্মীরে গিয়েছে। এছাড়া সমস্ত পথ গিয়েছে পাকিস্তান থেকে।

 

ভারতের সাপ্তাহিক ছুটির দিন হলো রোববার, কিন্তু কাশ্মীরের মুসলিমগণ ছুটির দিন পালন করে শুক্রবার। কাশ্মীরে ঘড়িতে ভারতীয় সময়ের পরিবর্তে পাকিস্তানের স্থানীয় সময় অনুসরণ করা হয়। এরূপ আরো বহু বিষয় রয়েছে, যা প্রমাণ করে কাশ্মীরের প্রাণ ভারতে নয়, পাকিস্তানে।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা