কাশ্মীরসংখ্যা

কাশ্মীর সংখ্যা (বিশেষ)

ফাঁসির মঞ্চে শহীদ আফযাল গুরু

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

ফাঁসির মঞ্চে শহীদ আফযাল গুরু


আফযাল গুরুর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ নেই। তবে সামাজিক ঝোঁক ও জনসান্ত¡নার জন্য তাকে ফাঁসি দেয়া জরুরি

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রায়

১৯৮৯ খৃ. থেকে কাশ্মীরে শুরু হওয়া সশস্ত্র জিহাদের ত্রিশ বছরের ইতিহাসে যাদের অবদান অনস্বীকার্য এবং যারা শাহাদাতের অনন্য সৌভাগ্য অর্জন করেছেন তাদের একজন হলেন শহীদ আফযাল গুরু। তার পিতার নাম হাবীবুল্লাহ্ গুরু। তিনি ২০ শে নভেম্বর ১৯৬৯ সালে অধিকৃত কাশ্মীরের জেলা বারামূলা,

কছবা দোয়াবগাহ, গ্রাম সোপুর জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা তিনি বারামূলাতেই অর্জন করেন এবং ১৯৮৬ সালে মেট্রিক পাশ করেন। সুপুরে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে এমবিবিএস প্রথমবর্ষ সমাপ্ত করেন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া অবস্থায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।

১৩ ডিসেম্বর ২০০১ সালে ভারতের পার্লামেন্টভবনে যে হামলা হয় তাতে অভিযুক্ত করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আফযাল গুরুকে গ্রেফতার করা হয়।

তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ হলো, হামলাকারী সন্ত্রাসীদের তিনি অস্ত্রসংগ্রহে সাহায্য করেছেন এবং হামলাকারীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছেন।

৯ই ফেব্রুয়ারী ২০১৩ ভোর নয়টায় ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে আফযাল গুরুর মৃত্যুদ-ণ্ড কার্যকর করা হয়।

ভারতের উচ্চ আদালত ২০০৪ এর শুরুতেই দ্রুত বিচারের মাধ্যমে তাকে দোষী সাব্বস্ত করে ফাঁসির আদেশ প্রদান করে। এরপর তাকে দীর্ঘ প্রায় এক দশক তেহার জেলের অন্ধকার ও নির্জন প্রকোষ্ঠে আটক রেখে অবশেষে ফাঁসি দেয়া হয়। এতে এমন সর্বোচ্চ গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয় যে, তার স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকেও আগে জানানো হয়নি।

 

কতৃপক্ষের আশঙ্কা ছিলো যে, জম্মু-কাশ্মীরে এমন গুরুতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই শহীদ মকবূল বাটের মত আফযাল গুরুর জানাযাও তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি, বরং তেহার জেলের ভিতরেই তাকে দাফন করা হয়েছে। তবে সারা কাশ্মীর জুড়ে তার বহু গায়েবানা জানাযা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি জানাযায় জনতার যে ঢল নেমেছে তা দেখে, যেমন ভারতসরকারতেমনি রাজ্যসরকার বিচলিত বোধ করছে। এমন দৃশ্যের অবতারণা হবে, তারা ভাবতেই পারেনি, যদিও শহীদ মাকবূল বাটের বিষয়টি তাদের কিছুটা ধারণায় ছিলো। রাজ্যসরকারের উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ভাগ্য ভালো যে, গুরুকে জেলেই রাখা হয়েছে, নইলে পরিস্থিতি শামাল দেয়া সত্যি কঠিনই হতো এবং হতাহতের সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় অনেক বেড়ে যেতো।

ফাঁসির সময় তিনি পূর্ণ শান্ত ছিলেন

ভারতীয় মিডিয়ার মতে, আফযাল গুরুকে শনিবার ভোররাতে ঘুম থেকে জাগানো হয়। তিনি ধীর স্থিরভাবে নামাযের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং নামায আদায় করেন। তার শান্ত রূপ দেখে সংশ্লিষ্ট সবাই বিস্মিত হন। তেহার জেলের প্রধান ব্যবস্থাপক ওয়াহলা মেহরা বলেন, আফযাল গুরুকে বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছিলো এবং তার স্বাস্থ্য ও রক্তচাপ স্বাভাবিক ছিলো। সেল থেকে বিশমিটার দূরে স্থাপিত ফাঁসির মঞ্চের দিকে তিনি নিজেই দৃঢ় শান্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যান। এসময় তিনি অনুচ্চ কণ্ঠে কালিমা উচ্চারণ করছিলেন। একবার আয়াতে শাহাদাত পড়তে শোনা গিয়েছে।

কাশ্মীরজুড়ে প্রচণ্ড বিক্ষোভ

আফযাল গুরুকে ফাঁসি দেয়ার পর কাশ্মীরের উভয় অংশে লাগাতার বিক্ষোভ হয়েছে। একমাসেরও বেশী সময় বিক্ষোভ অব্যাহত ছিলো। কারফিউ ভঙ্গ করে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। বিক্ষোভ মিছিলের উপর পুলিশের বেপরোয়া গুলি বর্ষণের কারণে বহু সংখ্যক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি বিক্ষোভে ক্রোধের মাত্রা এমনই সীমাহীন ছিলো যে, বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে ভারতীয় পতাকায় আগুন দেয়া হয়েছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ইন্টারনেট ও ক্যাবল সার্ভিস বন্ধ রাখা হয়।

কাশ্মীরী নেতা মীর ওয়াইয ও আলী গীলানীর আহ্বানে কাশ্মীরের জনগণ আফযাল গুরুর ফাঁসির প্রতিবাদে চারদিনব্যাপী হরতাল পালন করে। কাশ্মীরী নেতা ইয়াসীন মালিক ২৪ ঘণ্টা অনশন পালন করেন। আযাদ কাশ্মীরের হুকূমত তিনদিনের সরকারী শোক পালন করেছে।

আফযালপুত্রের জীবন বিপর্যস্ত ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার আফযাল গুরুর পুত্র গালিব গুরুর শিক্ষা ও জীবন বিপর্যস্ত করে রেখেছে। তার জন্য এখন স্বাভাবিক চলা ফেরাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গালিব অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বোর্ড থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে গড় ৮৮ নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন। তবে মনে করা হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবেই তাকে কম নম্বর দেয়া হয়েছে, কারণ যে মেধাবী ছেলে মেট্রিকে গড় ৯৫ নম্বর পেয়েছে, ইন্টার মিডিয়েটে তার নম্বর এত কম কীভাবে হয়? সামাজিক মাধ্যমে

এ বিষয়ে বেশ আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে তার শিক্ষকগণও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে গালিব এমনই বিরল মেধা ও যোগ্যতার অধিকারী যে, তার খাতা থেকে নম্বর কাটা প্রায় অসম্ভব। তুরস্কসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তার কাছে স্কলারশিপের প্রস্তাব আসছে। কিন্তু তার অনুকূলে পাসপোর্ট ইস্যু করা হচ্ছে না, যাতে তিনি কোন স্কলারশিপ  গ্রহণ করে বিদেশ যেতে পারেন।

সম্প্রতি আফযাল গুরুর পুত্র গালিব গুরুর একটি ভিডিও বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে, যাতে গালিব তার কম নম্বরের বিষয়ে কোন মন্তব্য না করে বলেছেন, তুরস্ক, বৃটেন, হল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে স্কলারশিপের প্রস্তাব আসছে, কিন্তু পাসপোর্ট না থাকার কারণে কোন স্কলারশিপ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ‘যদি অনুগ্রহ করে’ আমাকে পাসপোর্ট দেয়া হতো তাহলে আমার পক্ষে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করা সম্ভব হতো।

ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যম গালিব গুরুর পক্ষে বেশ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবূবা মুফতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, পিতার প্রতি শত্রুতার কারণে একটি নিরপরাধ তরুণের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে যা দুঃখজনক। আফযাল গুরুর পুত্র গালিব গুরু একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। তার অধিকার রয়েছে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের এবং স্বাভাবিক ওস্বাধীন জীবন যাপনের।

ন্যাশনাল কন্ফারেন্সের মুখপত্র সাইয়ারা হায়াতে একবার্তায় বলা হয়েছে

‘গালিব গুরু প্রমাণ করেছে যে, কঠিনতম পরিস্থিতিতেও কীভাবে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আমাদের অনেক অনেক শুভকামনা। খুব উদ্ভাসিত হও এবং প্রাগ্রসর জীবন যাপন করো!

আফযাল গুরুকে যখন গ্রেফতার করা হয় তখন গালিব তিনমাসের শিশু ছিলেন। আর যখন তাকে ফাঁসি দেয়া হয়ে তখন গালিব বার বছরের বালক। আফযালের ইচ্ছা ছিলো, তার ছেলে হৃদরোগ-বিশেষজ্ঞ হয়ে কাশ্মীরের জনগণের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করবে। পিতার ফাঁসির সময় গালিব গুরু অত্যন্ত দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেন, ‘শহীদ পিতার ইচ্ছা আমি পূর্ণ করবো ইনশাআল্লাহ।’

শহীদ আফযাল গুরু আশির দশকে জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্টের সঙ্গে যুক্ত হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই শুধু জাতীয়তাবাদী চিন্তা ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতি তিনি হতাশ হয়ে পড়েন এবং প্রখ্যাত স্বাধীনতাকামী নেতা গাজীবাবার অধীনে সশস্ত্র জিহাদ শুরু করেন। হিন্দুস্তানী ফৌজের বিরুদ্ধে তিনি বহু সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর হাতে কোন প্রমাণ ছিলো না। তাই শেষ পর্যন্ত তাকে পার্লামেন্টভবন হামলা কেসে ফাঁসানো হয়।

ব্যক্তিত্ব ও চরিত্র

ব্যক্তি জীবনে আফযাল গুরু ছিলেন অত্যন্ত উদার, মহৎ, পরোপকারী ও সাহসী। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তার তাকওয়া ও ধার্মিকতা ছিলো অতি উচ্চস্তরের। মিথ্যা বলা, কারো হক নষ্ট করা, কটু কথা বলা এগুলো ছিলো তার স্বভাববিরুদ্ধ। মাত্র তিনবছরের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী তাবাস্সুম গুরুর অন্তরে এত বিপুল সুখকর স্মৃতি রেখে গিয়েছেন যে, তিনি আফযাল গুরুর বিধবা স্ত্রীরূপেই সারা জীবন অতিবাহিত করার প্রতিজ্ঞা করেছেন। তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থেই আমার স্বামী ছিলেন একজন ফিরেশতাতুল্য মানুষ। আমি তার ইচ্ছার বাইরে প্রাণরক্ষার আবেদন করেছিলাম। যার কারণে তিনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট হন। ভাবলে এখন খুব অনুতাপ হয়।

আফযাল গুরুর কিতাব ‘আয়না’

শহীদ আফযাল গুরু তার স্মৃতিরূপে ‘আয়ানা’ নামে একটি কিতাব রেখে গিয়েছেন, যা তিনি জেলাখানার অন্ধকার কুঠুরিতে থাকা অবস্থায় নিজের হাতে লিখে গিয়েছেন। শাহাদাতের তিনবছর আগে তিনি কিতাবটি লেখা শুরু করেন এবং একবছরের মাথায় লেখা শেষ করেন।

এ বইয়ের যে বিষয়টি পাঠক হিসাবে আমাদের সবচে’ বেশী মুগ্ধ অভিভূত করে তাই এই যে, শুরু থেকে শেষ লেখকের পুরো বক্তব্যে একটি প্রশান্তি, অবিচলতা এবং আল্লাহ্র প্রতি আত্মনিবেদন -এর আবহ বিরাজ করছে। কঠিন থেকে কঠিন বিপদের সময় অন্তরে প্রশান্তি বিরাজ করা, এটি আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার প্রতি অনেক বড় নেয়ামত। এটাকেই কোরআনে বলা হয়েছে সাকীনাহ, যা জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অবস্থানকারী বান্দার অন্তরেও আল্লাহ্ প্রক্ষেপণ করেন।

শহীদ আফযাল গুরু তার উত্তরসূরী তরুণ মুজাহিদদের জন্য আয়নার মাধ্যমে যে বার্তাটি রেখে যেতে চেয়েছেন তা হলো, দ্রুত ফল পাওয়ার জন্য অস্থির হওয়া এবং ফল না পেলে হতাশ হয়ে যাওয়া মুজাহিদের শান নয়। কারণ মুমিনের জীবনে স্বয়ং জিহাদই এক বিরাট সফলতা, আর শাহাদাত হলো সেই সফলতার সর্বোচ্চ শিখর।

তিনি তার গ্রন্থে এ বিশ্বাসের প্রতিনিধিত্ব করেছেন যে, কাশ্মীরের মুক্তির পথ জিহাদ ছাড়া আর কিছ নয়। রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা, আধাস্বায়ত্ত-শাসনের বিনিময়ে সরকারী দমননিপীড়নের অবসান, তার দৃষ্টিতে প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কিছু ছিলো না। তিনি চেয়েছেন ফাঁসির রজ্জুর খুব কাছে দাঁড়িয়ে নিজের জাতিকে বিশুদ্ধ ঈমানের প্রতি এবং আল্লাহ্র উপর ভরসা ও তাওয়াক্কুলের দাওয়াত দিয়ে যেতে। আরো চেয়েছেন জাতির অন্তরে দাসত্ব ও গোলামির প্রতি ঘৃণার স্থায়ী অনুভূতি তৈরী করে যেতে, যা কোন লোভ ও প্রলোভন এবং ভয়-ভীতি দ্বারা  দূর করা সম্ভব  হবে না ।

তিনি একদিকে প্রথাসর্বস্ব আধ্যাত্মিকতার বৈধতা খণ্ডণ করে বলেছেন, এটাও গোমরাহীর ভয়ঙ্কর একরূপ, যা মানুষকে কর্মহীন ভাগ্যবাদের দিকে নিয়ে যায়। অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষা ও জীবনযাত্রার নামে ভোগবাদে গা ভাসিয়ে দেয়ার গোমরাহি থেকেও কাউমকে তিনি সতর্ক করেছেন। আধুনিক শিক্ষিত যুবসমাজকে যে কোন মূল্যে সংগ্রামী আলিমদের অনুগামী থাকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। মুসলিম নাম ধারণ করেও বিভিন্ন  ছলে ও যুক্তিতে যারা ভারতের পদলেহন করে তাদের মুনাফেকি সম্পর্কেও কাউমকে তিনি সতর্ক করেছেন, তাদের পুরো কর্মকা-কে তিনি মসজিদে যেরারের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

 

জিহাদের পুরো কর্মকা-কে তিনি হারাম কাজ, হারামা চিন্তা ও হারাম সম্পদ থেকে মুক্ত রাখার জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন। তার মতে তাহলেই সেটা হবে আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ। মুজাহিদীন ও তাদের জিহাদে কোন রকম হারাম ও শরীয়তবিরোধী চিন্তা ও কর্মের অনুপ্রবেশকে তিনি বরবাদি ও ধ্বংসের কারণ বলে বিশ্বাস করতেন।

তাছাড়া জিহাদের ক্ষেত্রকে তিনি অত্যন্ত প্রশস্ত বলে সাব্বস্ত করেছেন এবং জিহাদের জন্য উপকারী যে কোন কাজ আঞ্জাম দেয়াকে তিনি জিহাদ বলে গণ্য করেছেন। অমুসলিমদের হক ও অধিকার এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জিহাদেরই অংশ বলে তিনি বিশ্বাস করতেন।

জাতির শ্রদ্ধানিবেদন

আফযাল গুরুর শাহাদাতের পর থেকে কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ শহীদের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করে বক্তব নিবেদন করেছেন। এমনকি বহু ভারতীয় লেখক বুদ্ধিজীবীও তার পক্ষে এখনো কথা বলে যাচ্ছেন। শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে হুররিয়াত নেতৃবৃন্দ (সাইয়েদ আলী গীলানী, মীর ওয়াইয ওমর ফারুক ও ইয়াসীন মালিক) এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, ‘শহীদ মাকবূল বাট এবং শহীদ আফযাল গুরু কোরবানি ও শাহাদাত কাশ্মীরের ইতিহাসের অতি উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে। ভারতে যালেম হুকূম দুই শহীদানকে ফাঁসির মঞ্চ পর্যন্ত নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তাদের জানাযাও আজ পর্যন্ত জেলখানার ভিতরে বন্দী করে রেখেছে।

নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, জাতিসঙ্ঘের মহাসচীবের নামে আমরা স্মারকপত্র প্রেরণ করেছি, যাতে জাতিসঙ্ঘ ভারতকে বাধ্য করে মাকবূল বাট ও আফযাল গুরুর শহীদী দেহাবশেষ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য, যাতে আমরা কাশ্মীরের পবিত্র ভূমিতে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে ‘দেহাবশেষ সমাধিস্থ করতে পারি।

হুররিয়াতনেতা ইয়াসীন মালিকের স্ত্রী যিনি কাশ্মীরে বিশিষ্ট নারিনেত্রীরূপে সুপরিচিত এবং কাশ্মীরী সমাজে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্রী শহীদ আফযাল গুরুর ষষ্ঠ শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন ‘ভারতের আদালত আসলে জুডিশিয়াল মার্ডার (বিচারীয় হত্যাকা-)এর অপরাধ করেছে।

তিনি আরো বলেন, হিন্দুস্তান আমাদের রাজপথে হত্যা করতে পারে, আদালতে ফাঁসি দিতে পারে, জেলখানায় আমাদের লাশ দাফন করতে পারে, কিন্তু ভারত আমাদের স্বাধীনতার স্পৃহাকে দাফন করতে পারবে না।

তিনি আল্লামা ইকবারে কবিতাপংক্তি উল্লেখ করে আরো বলেন, ওরা কতজন মাকবূল বাট ও আফযাল গুরুকে ফাঁসি দেবে, আমাদের ঘরে ঘরে অসংখ্য বাট ও গুরু পয়দা হবে, যারা রক্তপিচ্ছিল পথ পাড়ি দিয়ে একসময় কাশ্মীরের আযাদী ছিনিয়ে আনবে।...

কাশ্মীরের জিহাদে এ পর্যন্ত যারা শহীদ হয়েছেন, আমরা তাদের রূহের মাগফিরাত কামনা করি।

ভারত আফযাল গুরুর চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছে। যেমন বিভিন্ন বলিউডি ও ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরী করে দেখানো হয়েছে, আফযাল গুরু একজন বখে যাওয়া তরুণ, যে অর্থের বিনিময়ে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের পক্ষে কাজ করেছে। কিন্তু ভারতের সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে। আফযাল শহীদের মর্যাদায় সবার অন্তরে অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন। হুরয়িয়াত নেতৃবৃন্দ

 

 

আফযাল গুরুর ফাঁসি ভারতীয় গণতন্ত্রের কলঙ্ক

- অরুন্ধতী রায়

৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ রোয শনিবার, ভোর চারটার পরে দিল্লি হাইকোর্টের আদেশে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে  তেহার জেলে আফযাল গুরুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে ভারত সরকার। ২০০১ সালে ভারতের পার্লামেন্টে হামলার ঘটনায় প্রধান আসামী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয় তাকে। দিল্লির তিহার জেলেই তাকে কবর দিয়েছে সরকার, যেখানে নির্জন কারাবাসে কেটেছে তার জীবনের গত বারোটি বছর। এমনকি তার স্ত্রী-সন্তানকেও আগে অবহিত করা হয়নি। হ্যাঁ এটা তো কোন বিষয়ই না। তারা তো এক সন্ত্রাসীর পরিবার মাত্র! আফযাল গুরুর ফাঁসিকে কেন্দ্র করে এক নজিরবিহীন রাজনৈতিক ঐক্য দেখা গেলো ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। কংগ্রেস, বিজেপি, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কস) একজোট হলো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার উৎসবে উল্লাস করতে। টিভি চ্যানেলগুলো তাদের স্বভাব অনুযায়ী গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে অত্যন্ত আবেগের সাথে বেশ আবেগঘন অনুষ্ঠান করেছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মিষ্টি বিতরণের মাধ্যমে উল্লাস করেছে। ফাঁসির প্রতিবাদে যে জমায়েত হয়েছে তার উপরও তারা হামলা চালিয়েছে। ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর স্টুডিউতে টিভি ধারাভাষ্যকারদের পরস্পরের পিঠ চাপড়ানো এবং রাস্তায় জনতার কাপুরুষোচিত উল্লাস দেখে মনে হয়েছে,

সম্ভবত ভিতরে ভিতরে তারা বুঝতে পারছে, ভারত ভয়ঙ্কর একটা ভুল করেছে।

কি ঘটেছিলো সেদিন?

৩১ ডিসেম্বর ২০০১, বিস্ফোরকভর্তি একটি গাড়ী নিয়ে পাঁচজন সশস্ত্র ব্যক্তি ভারতীয় পার্লামেন্টের মেইন গেট দিয়ে ঢুকে পড়ে। পুলিশের চ্যালেঞ্জের মুখে গাড়ী থেকে নেমে তারা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। নিহত হয় আটজন নিরাপত্তাপ্রহরী এবং একজন সাধারণ মানুষ। পাঁচ আক্রমণকারীও নিহত হয় পুলিশের গুলিতে।

পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের মুখে পরস্পরবিরোধী যেসব জবানবন্দি পুলিশ নিয়েছে সে অনুযায়ী অক্রমণকারীরা ছিলো মোহাম্মাদ, রানা, রাজা, হামযা ও হায়দার। ব্যস এছাড়া আর কোন তথ্যই নেই আমাদের কাছে। এমনকি তাদের কোন ডাকনামও জানা নেই। বিজেপি  নেতা এল কে আদভানী বলেছিলেন, তারা পাকিস্তানীদের মত দেখতে! হ্যাঁ সিন্ধুতে জন্মগ্রহণকারী আদভানী তো জানবেনই পাকিস্তানীরা দেখতে কেমন!

শুধু পুলিশি নির্যাতনের মুখে আফযালের দেয়া স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে (অনুপোযোগী পরিবেশে আদায়কৃত বলে সুপ্রিম কোর্ট যাকে প্রত্যাখ্যান করেছে) ভারত সরকার পাকিস্তান সীমান্তে পাঁচ লাখ সেনার সমাবেশ ঘটায়। এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধের কথা পর্যন্ত উচ্চারিত হয়। কয়েকমাস ধরে চলা এই অচলাবস্থায় ভারতের হাজার হাজার কোটি রুপির অপচয় হয়েছে।

ঘটনার মাত্র চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে দিল্লি পুলিশের বিশেষ শাখা ( বিচারবহির্ভূত হত্যাক-ের জন্য যারা কুখ্যাত) দাবি করে যে, তারা ঘটনার সব তথ্য উদ্ঘাটন করে ফেলেছে। ১৫ই ডিসেম্বর তারা ঘটনার তথাকথিত ‘মাস্টার মাই-’ হিসেবে প্রফেসর এস এ আর গিলানীকে দিল্লির এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং শওকত গুরু ও তার ‘কাজিন’ আফযাল গুরুকে শ্রীনগর থেকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে শওকতের স্ত্রী আফশাঁ গুরুকেও গ্রেফতার করা হয়। ভারতীয় মিডিয়া অতিউৎসাহের সঙ্গে পুলিশের ভাষ্য প্রচার করতে থাকে। একটি জাতীয় টেলিভিশন জেড টিভি “ডিসেম্বর ১৩” নামে একটি ডকুড্রামা পর্যন্ত প্রচার করে। এতে দাবি করা হয়, ‘এটি পুলিশের চার্জশীটের উপর ভিত্তি করে তৈরী সত্য কাহিনী’।

প্রশ্ন হলো, পুলিশি ভাষ্যই যদি সত্য হবে তাহলে আর আইন আদালত কেন? তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আদভানী প্রকাশ্যে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। আবেদন করা সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্ট এই তথ্যচিত্রটির প্রচার বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলে, বিচারকরা এসব দ্বারা প্রভাবিত হবে না। দ্রুত আদালত গিলানী, শওকত এবং আফযালকে ফাঁসির আদেশ দেয়ার অল্প কয়েকদিন আগে এটি প্রচার করা হয়। তবে হাইকোর্টে খালাস পান গিলানী ও শওকত। সুপ্রিমকোর্টও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। কিন্তু ৫ই আগস্ট ২০০৫ এর রায়ে সুপ্রিমকোর্ট আফযাল গুরুকে তিনবার যাবজ্জীবন ও দুইবার মৃত্যুদ- দেয়।

তাৎক্ষণিক ফাঁসি কার্যকর করার দাবি জানায় বিজেপি। তখন তাদের অন্যতম নির্বাচনী শ্লোগান ছিলো এই, “দেশ আভী শারমিন্দা হ্যায়, আফযাল আভী যিন্দা হ্যায়” (দেশ লজ্জিত, আফযাল এখনো জীবিত)।

নতুন মিডিয়া প্রপাগান্ডা

আফযালের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগে বিভিন্ন ফাঁক ফোকর যখন প্রকাশ পাওয়া শুরু করলো তখন সেগুলোকে চাপা দিতে এক নতুন মিডিয়া প্রপাগান্ডা শুরু হয়ে গেলো। চন্দন মিত্র এখন বিজেপি দলীয় সাংসদ, তখন তিনি পাইয়োনিয়ার পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তিনি লিখলেন, “এই আফযাল গুরু পার্লামেন্টে হামলকারীদেরই একজন। নিরাপত্তাপ্রহরীদের লক্ষ্য করে প্রথম গুলি তিনিই ছুঁড়েছিলেন এবং তিন জনকে তিনিই হত্যা করেছেন”। অথচ পুলিশের চার্জশীটেও আফযালের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ নেই। এমনকি সুপ্রিমকোর্টও রায়ের বিবরণীতে স্বীকার করে যে, অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত নয়। কিন্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক হলো রায়ের পরবর্তী অংশ, “এ ঘটনায় বহু হতাহত হয়েছে, যার কারণে সমগ্র জাতি বিচলিত। অভিযুক্তকে চরম সাজা না দেয়া হলে সমাজের সম্মিলিত অনুভূতি সন্তুষ্ট হবে না”।

অর্থাৎ মহামান্য আদালতের রায়ের ভিত্তি যুক্তিপ্রমাণের উপর নয়, সম্মিলিত অনুভূতির সন্তুষ্টির উপর! কিন্তু সংসদে হামালার ঘটনায় আমাদের এই সম্মিলিত অনুভূতিটা কে সৃষ্টি করছে? তথ্য না তথ্যচিত্র?

আইনের শাসন উদযাপনের আগে আসুন প্রকৃত ঘটনার উপর একটুদৃষ্টি দেই।

শক্ত একটা যুক্তি দেখানো হচ্ছে যে, আদালত গিলানীকে খালাস দিয়েছে আর আফযালকে সাজা দিয়েছে। এটাই প্রমাণ যে, বিচার স্বচ্ছ ও ন্যায়ানুগ হয়েছে। আসলেই কি তা হয়েছে?

দ্রুত আদালতে বিচারকার্য শুরু হয়েছিলো ২০০২ সালের মে মাসে। বিশ্বজুড়ে তখন চলছে নাইন ইলেভেনের উম্মাদনা। আফগানিস্তানে বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে আগাম প্রাচারণা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ফেব্রুয়ারী মাসে গুজরাটে প্রশাসন এবং পুলিশের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ঘটা মর্মান্তিক মুসলিম গণহত্যা থেমে থেমে তখনও অব্যাহত। সাম্প্রদায়িকতার দূষিত বাতাসে পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে আছে। এমনই পরিস্থিতিতে সংসদ ভবনে হামলার ঘটনার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। হাইকোর্ট/সুপ্রিমকোর্টে ফৌজদারী মামলার বিচারকার্যের  সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্বে, যখন আদালতে প্রমাণাদি পেশ করা হয়, সাক্ষীদের জেরা করা হয় এবং যুক্তিতর্ক পেশ করা হয়, আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং নতুন কোন প্রমাণ যখন আর হাজির করা যায় না, ঐ পুরো সময়টা আফযাল গুরুকে হাই সিকিউরিটি জেলে ‘নির্জন কক্ষে’ বন্দী করে রাখা হয়। তার কোন আইনজীবী ছিলো না। তার জন্য আদালতকর্তৃক নিযুক্ত জুনিয়র আইনজীবী, এমনকি একবারের জন্যও তার সঙ্গে দেখা করেননি। আফযালের পক্ষে কোন সাক্ষীও তিনি হাযির করেননি এবং রাষ্ট্রপক্ষের কোন সাক্ষীকে জেরা করেন নি। এ সম্পর্কে বিচারকের মন্তব্য ছিলো, ‘আমার কিছু করার নেই।’

সূচনাপর্ব থেকেই পুরো মামলার অসারতা প্রমাণিত হতে থাকে। শত নমুনা থেকে কিছু এখানে তুলে ধরা যায়। আফযালের ‘অপরাধের’ সবচেয়ে বড় দুটি প্রমাণ হিসেবে যা পেশ করা হয়েছে তা হলো একটি মোবাইল এবং একটি ল্যাপটপ, যা গ্রেফতারের সময় ‘উদ্ধার’ করা হয়েছিলো। কিন্তু খুবই উদ্দীপক বিষয় হলো, তা সিলগালা করা ছিলো না, অপরাধের আলামতের ক্ষেত্রে যা অতীব জরুরী। বিচার চলাকালে প্রকাশ পেয়ে যায় যে, আফযাল গ্রেফতার হওয়ার পরও ল্যাপটপের হার্ডডিস্ক ব্যবহার করা হয়েছে! আরো বিস্ময়কর বিষয় এই যে, সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাল পাস এবং জাল পরিচয়পত্রই শুধু ছিলো, আক্রমণকারীরা পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশের জন্য যা ব্যাবহার করেছিলো। আর ছিলো জেড টিভি থেকে নেয়া সংসদ ভবনের একটি ভিডিও ক্লিপ। অর্থাৎ পুলিশের ভাষ্য মতে আফযাল গুরু  হার্ডডিস্কের সবকিছু ডিলিট করে, তার বিরুদ্ধে যা সবচেয়ে বড় প্রমাণ হবে সেটাই শুধু রেখে দিয়েছেন! পুলিশের হাজির করা সাক্ষী জানান, যে সিম কার্ডটি ব্যবহার করে গুরু সবার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন সেটা তিনি ৪ ডিসেম্বর গুরুর কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু কৌসুলিদের কাছে থাকা কল রেকর্ডে দেখা যায়, নভেম্বরের ৬ তারিখ থেকেই সিমটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

আফযাল গুরু পর্যন্ত পুলিশ পৌঁছলো কি করে? পুলিশের বক্তব্য হলো গিলানীই তার সন্ধান দিয়েছেন। কিন্তু কোর্টের কাছে থাকা রেকর্ডে দেখা যায়, গিলানীকে গ্রেফতারের আগেই পুলিশ আফযালকে গ্রেফতারের বার্তা আদান প্রদান করেছে। হাইকোর্ট এটাকে গুরুতর স্ববিরোধীতা বলে উল্লেখ করলেও আর কোন প্রশ্ন না করে বিষয়টি  বেমালুম এড়িয়ে যায়। এরূপ আরো অনেক মিথ্যা ও বানানো প্রমাণের পাহাড় তৈরী করে আফযালকে দোষী সাব্যস্ত করে পুলিশ। আদালতও পুলিশের ‘বানায়োটি’ স্বীকার করে, কিন্তু...। সংসদ ভবনে হামলার ঘটনা উদ্ঘাটনের সদিচ্ছা সত্যিই যদি কারো থাকে তাহলে তাকে অবশ্যই এসব বিবেচনায় নিয়ে আগে বাড়তে হবে। কিন্তু কেউই তা করেনি। ফলে আসল

 অপরাধীরা সবসময় আড়ালেই থেকে যাবে। আফযাল গুরুর সাথে যা হয়েছে সেই ট্রাজেডির গোড়ায় পৌঁছতে হলে আমাদের কোর্টরুম ছেড়ে কাশ্মীর উপত্যকায় আসতে হবে। সম্ভাব্য পারমাণবিক রণক্ষেত্র এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী ‘মিলিটারাইজড’ এলাকা হচ্ছে কাশ্মীর, এখন যেখানে মোতায়েন আছে পাঁচ লাখ ভারতীয় সৈনিক। প্রতি চারজন বেসামরিক ব্যক্তির বিপরীতে একজন সৈনিক। আর্মি ক্যাম্প এবং টর্চার সেলের এক বিশাল নেটওয়ার্ক, আবু গারীব যার কাছে তুচ্ছ। ভারতের মহান ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র এসবই উপহার দিচ্ছে কাশ্মীরীদের। ১৯৯০ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত ৬৮ হাজার মানুষের প্রাণ গিয়েছে এখানে। গুম হয়েছে ১০০০০ এরও বেশী। নির্যাতিত হয়েছে লক্ষাধিক। তবে উপত্যকার লক্ষ হত্যাকা-ের সাথে আফযাল গুরুর হত্যাকা-ণ্ডের পার্থক্য এই যে, তার হত্যাকা-ণ্ডটি ঘটেছে দিনের আলোতে সবার চোখের সামনে বিচারের নামে। গণতান্ত্রিক ভারতের সকল প্রতিষ্ঠান ভুমিকা রেখেছে তার হত্যাক-ণ্ডে।

তো! আফযালকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। আশা করি আমাদের ‘সম্মিলিত অনুভূতি’ এখন তুষ্ট। নাকি আরো রক্তের পিপাসা রয়ে গেছে আমাদের?

আফযালের ফাঁসি আজো রহস্যই রয়ে গিয়েছে। কারো কারো এমনও দাবী যে, পুরো বিষয়টা ভারতের গোয়েন্দাবিভাগেরই পরিকল্পনার ফল! প্রখ্যাত ভারতীয় মানবাধিকার কর্মী এবং বুকারজয়ী  লেখিকা শ্রীমতি অরুন্ধতী রায় লিখেছেন  ‘আফযালের ঘটনাই আমাদের জানান দেয় কাশ্মীরের জীবন এখন কেমন চলছে। আমরা পত্রিকায় কেবল দেখি, চরমপন্থীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে। সাধারণ নাগরিকের প্রাণহানি ঘটছে। আসলে যা ঘটছে তা অন্যকিছু। তবে কাশ্মীরে এখন সত্য বলাটাও বড় বিপজ্জনক। কাশ্মীর বিষয়ে আপনি যত ভিতরে যাবেন ততই ডুবতে থাকবেন।

ভারতের যারা সুশীল সমাজ, বুকে হাত দিয়ে বলুন, আফযাল গুরুকে ন্যায় বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দেয়া হয়েছে! যদি বলতে না পারেন তাহলে এ অপরাধ ইতিহাসে জমা হয়ে থাকবে!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা