মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬)

তোমাদের জন্য

কীভাবে হতে পারে বদ নযরের এলাজ? হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তক্বী উছমানী দা.

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট


الحمد لله رب العالمين والعاقبة للمتقين؛ والصلاة والسلام على رسوله الكريم؛ وعلى آله وأصحابه أجمعين؛ أما بعدএকব্যক্তি তার দিলের হালাত  পেশ করার জন্য হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রহ. এর খেদমতে লিখেছেন- ‘দিলের অবস্থা এই যে, প্রবৃত্তি ও খাহেশাত সবসময় সক্রিয় থাকে। গায়র মাহরামের দিকে মন্দ দৃষ্টিতে তাকাতে কোন দ্বিধা হয় না, ভয়ও জাগে না। (আনফাসে ঈসা-১৪৩)আত্মার সংশোধন ও নফসের এছলাহের এটাই হলো সঠিক তরীকা যে, কোন শায়খের সঙ্গে ইছলাহী তা‘আল্লুক হবে, তখন শায়খকে নিজের সব অবস্থা অবশ্যই জানাবে। যদি লজ্জা বা অন্য কোন কারণে অবস্থা গোপন করে তাহলে কীভাবে এলাজ ও চিকিৎসা হবে?দৈহিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেমন রোগের কোন অবস্থা গোপন রাখা হয় না, আর গোপন রাখা হলে সঠিক চিকিৎসা হয় না, আত্মিক চিকিৎসা ও নফসের এলাজের ক্ষেত্রেও একই কথা। সব অবস্থা -যত লজ্জাকর বিষয়ই হোক- শায়খকে জানাতে হবে, যাতে তিনি সঠিক এলাজ ও চিকিৎসা দিতে পারেন।এমন চিন্তা যেন না আসে যে, সবকিছু যদি শায়খকে জানাই, তাহলে আমার প্রতি তার দিলে মন্দ ধারণা হবে। আর এটা তো মুরীদের জন্য ক্ষতির কারণ!এ চিন্তা ঠিক নয়। কারণ আল্লাহ তা‘আলা যখন কারো দ্বারা মানুষের ইছলাহ ও সংশোধনের কাজ নেন তখন তার অন্তরে মানুষের প্রতি দয়া ও মায়া দান করেন। সুতরাং মন্দ থেকে মন্দ বিষয় জানার পরো মুরীদের প্রতি তার দিল বিমুখ হয় না, বরং তার প্রতি অত্যন্ত সমবেদনা সৃষ্টি হয়। যেমন মাযূর ও রুগ্ন সন্তানের প্রতি মা-বাবার চিন্তা-খেয়াল ও ¯েœহ-মমতা সুস্থ সন্তানের চেয়ে বেশী থাকে। সারা দুনিয়া ঐ বাচ্চাকে ঘৃণা-অবজ্ঞা করলেও মা-বাবা তার জন্য কোরবান এবং দিন-রাত তার খেদমতে মশগূল। নিজের হাতে মা তার মাযূর সন্তানকে ছাফ-সুতরা করেন, নিজের হাতে তার মুখে লোকমা তুলে দেন। নফস ও খাহেশাতের হাতে মজবূর মুরীদের জন্য শায়খ সেই মা-বাবার মত। শায়খের দিলে তার প্রতি ঘৃণা-অবজ্ঞা আসা তো দূরের কথা, বরং খাহেশাতের হামলা থেকে মুক্ত মুরীদানের চেয়ে অনেক বেশী দয়া ও সমবেদনা তার প্রতি সৃষ্টি হয়।মুরুব্বির কাছে নিজের দোষ-আয়েব প্রকাশ করাআহলে ইলমের দিলে প্রশ্ন জাগে যে, হাদীছ শরীফে তো আছে, কেউ যেন নিজের আয়েব-গোনাহ অন্যের কাছে প্রকাশ না করে। হাঁ, শুধু আল্লাহর কাছে যেন কাকুতি-মিনতি করে, আয় আল্লাহ, তুমি তো জানো, আমি কী গোনাহে লিপ্ত! হে আল্লাহ, তুমি আমাকে মাফ করো এবং উদ্ধার করো।এ হাদীছের ব্যাখ্যায় হযরত হাকীমুল উম্মত থানবী রহ. বলেছেন, এর অর্থ হলো, মুরুব্বি ছাড়া অন্য কারো কাছে প্রকাশ না করা। সুতরাং আল্লাহর শরণ নেয়ার পর ইলাজ ও চিকিৎসা এবং ইছলাহ ও সংশোধনের নিয়তে মুরুব্বির কাছে হালাত অবশ্যই প্রকাশ করবে। এটা ঐ হাদীছের নিষেধের আওতায় আসবে না। যেমন কারো সামনে সতর খোলা তো জায়েয নেই, কিন্তু অনিবার্য প্রয়োজনে চিকিৎসকের সামনে সতরের সংশ্লিষ্ট অংশ খোলা জায়েয।তদ্রƒপ গোনাহের আয়েব-বিমারিও কারো সামনে প্রকাশ করা জায়েয নেই, বরং গোপন রাখা জরুরি। কারণ এগুলো তো গান্দা-গলীয ও দুর্গন্ধপূর্ণ। তাই  তা ঢেকে রাখো, আর আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তিগফার করো। কিন্তু শায়খ ও মুরুব্বি তো রূহানী চিকিৎসক। তার কাছে তো সব হালাত প্রকাশ করতেই হবে, যাতে তিনি তার ইলাজ ও চিকিৎসা করতে পারেন।সুতরাং যার সঙ্গেই তোমার ইছলাহী তা‘আল্লুক ও আত্ম-সংশোধনের সম্পর্ক রয়েছে তার সামনে নিজের হালাত প্রকাশ করতেই হবে। হতে পারেন তিনি তোমার বাই‘আতী শায়খনন, বরং তোমার উস্তাদ বা পিতা। ইলাজ ও চিকিৎসা এবং ইছলাহ ও সংশোধনের প্রয়োজনে নিজের অবস্থা তার কাছে প্রকাশ করতেই হবে।এটা হাদীছের নিষেধের অন্তর্ভুক্ত নয়।এ উছূলের ভিত্তিতেই জনৈক মুরীদ হযরত থানবী রহ.-এর খেদমতে নিজের হালাত প্রকাশ করে পত্র লিখেছে, আলোচনার শুরুতেই যা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ- ‘অন্তরে সবসময় খাহেশাতের চিন্তা সক্রিয় থাকে। গায়র মাহরামের দিকে নযর দিতে কোন ভয়-সঙ্কোচ জাগ্রত হয় না।’অর্থাৎ আমি তো নযরের গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়েছি। এখন এর থেকে বাঁচার উপায় কী?নযরের গোনাহ যেহেতু খুব আম ও ব্যাপক সেহেতু হযরত হাকীমুল উম্মত রহ. এর জবাবও দিয়েছেন বিশদ ও পরিপূর্ণরূপে। সবার জন্যই ইনশাআল্লাহ তা উপকারী হবে।নযরের হেফাযতে হিম্মতের প্রয়োজনীয়তাহযরত হাকীমুল উম্মত থানবী রহ. বলেন-‘নযরের গোনাহ এতই জঘন্য ও খতরনাক যে, এর কারণে নেক আমলের সমস্ত নূর চলে যায় এবং দিল অন্ধকার হয়ে যায়। তাই এর ইলাজ ও চিকিৎসা খুব ইহতিমাম ও গুরুত্বের সঙ্গে করা চাই। এটা তো স্পষ্ট বিষয় যে, নযর ও দৃষ্টি হচ্ছে ফিতরী ও সৃষ্টিগত বিষয়। সুতরাং তা খারাপ কিছু নয়, বরং মানুষের জন্য তাতে অনেক ফায়দা ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে। তবে নযরের না-পাক চাহিদা পুরা করা, এটা হলো খারাপ এবং গোনাহ, যা মানুষের ইচ্ছাধীন বিষয়। আর ইচ্ছাধীন বিষয় দমন করাও ইচ্ছাধীনই হবে। সুতরাং বোঝা গেলো, নযর থেকে বিরত থাকা ইচ্ছাধীন বিষয়। এতে কোন অপরাগতা নেই। ব্যস, হিম্মত করো, বিরত থাকার চেষ্ট করো, কাজ হয়ে যাবে। এটাই একমাত্র ইলাজ। এটাই তোমার প্রশ্নের একমাত্র জবাব। প্রথমে কিছুদিন কষ্ট হবে। তারপর অভ্যাস হয়ে যাবে এবং নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। এরপর তো একপর্যায়ে আত্মিক প্রশান্তিও অনুভূত হবে।রোগীর অন্তরে রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা ও উপলব্ধি থাকা জরুরি। তাহলেই তার মাথায় চিকিৎসার চিন্তা আসবে। রোগ সম্পর্কে যদি তার সঠিক ধারণাই না থাকে; যদি সে নাই জানে যে, এটা কোন রোগ কি না, বা এর ক্ষতি ও ভয়াবহতা কী, তাহলে আর চিকিৎসার বিষয়ে কীই বা চিন্তা করবে!তো এ কারণেই হযরত হাকীমুল উম্মত রহ. প্রথমে নযর-রোগের ভয়াবহতা তুলে ধরেছেন যে, এটা এমন ভয়াবহ ব্যাধি ও খতরনাক বিমারি যে, এর ফলে সমস্ত নেক আমলের নূর দূর হয়ে যায় এবং দিল অন্ধকার হয়ে যায়।চিন্তা করে দেখো, বদনযরির কী ভয়াবহ পরিণাম যে, তোমার নামায-রোযা, যিকির-তাসবীহ ও তাহাজ্জুদ এবং আরো যত ইবাদত-বন্দেগি, এগুলো দ্বারা তোমার কলবে যে নূর পয়দা হলো, এই এক বদআমলের কারণে সব অন্ধকার হয়ে গেলো এবং জুলমতে ভরে গেলো। নেক আমলের সমস্ত কল্যাণ ও নূরানিয়াত বরবাদ হয়ে গেলো। আল্লাহ আমাদের হিফাযত করুন।নেক আমলের বড় ফায়দা ও উপকারিতা এই যে, একটি নেক আমল দ্বিতীয় নেক আমলের দিকে নিয়ে যায়, দ্বিতীয়টি তৃতীয়টির দিকে নিয়ে যায়। এভাবে নেক আমলের সিলসিলা ও ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। আর রূহানিয়াতের পথে মানুষ তরক্কী ও উন্নতি করতেই থাকে। কিন্তু যখন নেক আমলের নূরই বিলুপ্ত হয়ে যায়, আর যুলমত ও অন্ধকার ছেয়ে যায় তখন তার ফায়দা ও উপকারিতাও কমে যায় এবং নেক আমলের সিলসিলা ও ধারাবাহিকতা দুর্বল হয়ে যায়, এমনকি একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়।আমরা তো ইবাদতের নূর এবং তার স্বাদ ও শান্তি সম্পর্কেই অবগত নই। তো সেই নূর বিলুপ্ত হওয়ার এবং সেই স্বাদ নষ্ট হওয়ার হাকীকত কীভাবে বুঝে আসবে? আর দিলের মধ্যে আফসোস-অনুশোচনা কীভাবে জাগ্রত হবে? যার দিলে নেক আমল ও ইবাদতের নূরানিয়াত এবং স্বাদ ও শান্তি অর্জিত হয়েছে সে-ই শুধু বুঝতে পারবে যে, বদনযরির কারণে অন্তর থেকে ঐ নূরানিয়াত এবং স্বাদ ও শান্তি দূর হয়ে গেছে। সে-ই শুধু বুঝতে পারবে, এর ক্ষতি কত ভয়াবহ! তখন সেই অনুপাতে অন্তরে অনুশোচনা জাগ্রত হয়। আমাদের তো স্বভাব ও রুচি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে ইবাদতের নূর ও গোনাহের যুলমত সম্পর্কে কোন অনুভব-অনুভূতিই নেই; যারা আল্লাহওয়ালা তাঁরা স্পষ্টভাবেই তা অনুভব করেন। হযরত মাওলানা ইয়াকূব রহ-এর ঘটনা; একবার তিনি একলোকের দাওয়াতে খাবার গ্রহণ করলেন। তার জানা ছিলো না যে, মেযবানের কামাই হারাম। তিনি বলেন, ঐ দাওয়াতি খানার বদআছরে বহুদিন পর্যন্ত আমার দিলে যুলমত ও অন্ধকার অনুভূত হয়েছে, যার কারণে বিভিন্ন খারাপ চিন্তা আসতো এবং খারাপ জিনিসের প্রতি দিলের টান হতো। পরে জানা গেলো যে, ঐ লোকের কামাই ছিলো সন্দেহযুক্ত।মোটকথা, আল্লাহর নেক বান্দা যারা তাদের দিল এমনই ছাফ ও নূরানী হয় যে, তাতে সামান্য আঁচড় লাগলেও তাদের মনে হয়, মহাসর্বনাশ হয়ে গেছে!তো যেহেতু বদনযরের গোনাহে লিপ্ত হওয়ার অনিবার্য ফল হলো দিল থেকে ইবাদতের নূর বিলুপ্ত হওয়া এবং যুলমত পয়দা হওয়া সেহেতু হযরত থানবী রহ. বলেছেন, ‘এই গোনাহের ইলাজ ও চিকিৎসা খুব ইহতিমাম ও গুরুত্বের সঙ্গে করা চাই।’রোগের মূল উৎস মন্দ কিছু নয়তারপর রোগের ইলাজ ও চিকিৎসা সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘এটা তো স্পষ্ট যে, বদনযরির রোগের যে উৎস তা আল্লাহরই সৃষ্টি এবং তা মানুষের স্বভাব ও ফিতরতের অন্তর্ভুক্ত, সুতরাং তা মন্দ কিছু নয়।’ অর্থাৎ খাহেশাত ও প্রবৃত্তিগত চাহিদা নিজস্ব সত্তায় মন্দ কিছু নয়, বরং তা মানুষের জন্মগত ও সহজাত বৈশিষ্ট্য এবং তাতে অনেক কল্যাণ ও উপকারিতা রয়েছে, সুতরাং তা না থাকাই বরং দোষের। উপকারিতা এই যে, এর দ্বারাই মানববংশ রক্ষা পায় এবং আগে বাড়ে। এর উপর ভিত্তি করেই দুনিয়ার নেযাম ও ব্যবস্থা চলছে। এটা না হলে মানববংশের বিস্তারই থেমে যেতো এবং দুনিয়ার নেযাম বরবাদ হয়ে যেতো।মোটকথা, স্বভাব ও ফিতরত হিসাবে খাহেশাত ও প্রবৃত্তিগত চাহিদা মন্দ নয়, তবে নাজায়েয ক্ষেত্রে এই চাহিদা পূর্ণ করা বড় ধরনের গোনাহ এবং এর ক্ষতি অত্যন্ত ভয়াবহ।পক্ষান্তরে খাহেশাত ও প্রবৃত্তির স্বাভাবচাহিদা হালাল ও জায়েয তরীকায় পূর্ণ করা শুধু উত্তমই নয়, বরং তাতে ছাওয়াবও রয়েছে।খাহেশাতের জায়েয ব্যবহারে ছাওয়াবহাদীছ শরীফে এসেছে, ‘কেউ যদি ঘরে স্ত্রীর দিকে মুহাব্বাতের নযরে তাকায়, আর স্ত্রীও স্বামীর প্রতি মুহাব্বাতের নযরে তাকায় তাহলে আল্লাহ তা‘আলা উভয়ের দিকে রহমতের নযরে তাকান এবং তাদেরকে ছাওয়াব দান করেন।তো এই স্বভাবচাহিদার বৈধ ব্যবহারে রয়েছে ছাওয়াব, পক্ষান্তরে অবৈধ ও নাজায়েয ক্ষেত্রে এই চাহিদা পুরা করার মধ্যে রয়েছে গোনাহ ও বরবাদি। আর যেহেতু এই চাহিদা পুরা করা মানুষের ইচ্ছাধীন বিষয় সেহেতু তা থেকে বিরত থাকাও ইচ্ছাধীন বিষয়। এটা সাধ্যের বাইরে নয় এবং এতে কোন অপারগতা নেই। সুতরাং হিম্মত করো এবং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা শুরু করে দাও। এটাই একমাত্র ইলাজ ও চিকিৎসা। প্রথমে কিছু কষ্ট হবে, তারপর অভ্যাস হয়ে যাবে এবং নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে। তখন অন্তরে অত্যন্ত স্বাদ ও শান্তি এবং সুকূন ও প্রশান্তি অনুভূত হবে।হিম্মতই হলো এ রোগের একমাত্র এলাজএ কথা বলে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, বদনযরের মরয দূর করার জন্য এমন কোন ঔষধ নেই যা পানি দিয়ে গিলে ফেললে রোগ দূর হয়ে যাবে; এমন কোন মন্ত্রও নেই যা পড়ে ফুঁক দিলে এর ইলাজ হয়ে যাবে; দিলের মধ্যে আর বদনযরের চাহিদা এবং খাহেশাতের চাপ অনুভূতই হবে না।মরয ও ইলাজের পুরো বিষয়টিকে তিনি ধাপে ধাপে বুঝিয়েছেন। প্রথমে বলেছেন, এই স্বভাবচাহিদা ও ফিতরী খাহিশ আসলে মন্দ কিছু নয়; তারপর বলেছেন, বরং জায়েয ও বৈধ পথে এটা পূর্ণ করার মধ্যে অনেক কল্যাণ ও ছাওয়াব। তারপর বলেছেন, হাঁ, না-জায়েয ও অন্যায় পথে পূর্ণ করা অবশই গোনাহ এবং তা বরবাদির কারণ।তারপর ইলাজপ্রসঙ্গে প্রথমে বলেছেন, খাহিশাত ও প্রবৃত্তির এ চাহিদা পূর্ণ করা সম্পূর্ণরূপে ইচ্ছাধীন বিষয়; আর যা সম্পন্ন করা ইচ্ছাধীন তা ত্যাগ করা বা দমন করাও ইচ্ছাধীন। চূড়ান্ত স্তরে বলেছেন, ইচ্ছাধীন কাজে ইচ্ছা প্রয়োগ করার জন্য হিম্মতের প্রয়োজন। সুতরাং হিম্মতকে ব্যবহার করতে হবে এবং হিম্মতের মাধ্যমেই এলাজের পথে আগে বাড়তে হবে।অনেক সময় মনে হতে পারে যে, নযরের লজ্জত এবং খাহেশাত ছেড়ে দিলে তো আমার জানই বের হয়ে যাবে; বাঁচাই মুশকিল হয়ে যাবে। যুক্তিতে তো বুঝে আসে যে, এটা ইচ্ছাধীন এবং সম্ভব, কিন্তু বাস্তবতার বিচারে তো এটা ইচ্ছা ও সাধ্যের সম্পূর্ণ বাইরে এবং অসম্ভব। তো কীভাবে বলা যায়, এটা ইচ্ছাধীন বিষয়, ইচ্ছা করলে এবং হিম্মত করলেই ত্যাগ করা সম্ভব?অভ্যাস ও নেশা ত্যাগ করার কষ্ট আপেক্ষিকমূলকথা হলো, ইচ্ছাধীন যাবতীয় বিষয়ের প্রতি আকর্ষণ, চাহিদা ও আসক্তি এবং সেগুলো ত্যাগ করা বা দমন করার কষ্ট সম্পূর্ণরূপে আপেক্ষিক। চাহিদার প্রবলতা এবং দমন-কষ্টের প্রবলতা দু’টোই আপেক্ষিক। বাস্তবে এর নিজস্ব সত্তাগত কোন পরিমাণ নেই। এজন্যই তা ছাড়ার ক্ষেত্রে কারো কষ্ট হয় বেশী, কারো কষ্ট হয় কম, বেশ কম, একেবারেই কম, এমনি কারো কষ্ট হয় প্রায় শূন্যের কাছাকাছি কম। সুতরাং বদনযর ও খাহেশাত পূর্ণ করা যেমন ইচ্ছাধীন, তেমনি তা পরিত্যাগ বা দমন করাও ইচ্ছধীন বিষয়, তবে পরিত্যাগ বা দমনের কষ্টটা একেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে একেক রকম। কেউ মনে করে, অনেক কষ্টের ব্যাপার, আবার কেউ মনে করে, সামান্য কষ্ট। তাছাড়া অভ্যাস যত দীর্ঘ দিনের এবং তার শিকড় অন্তরের যত গভীরে, তা নির্মূল করার কষ্ট স্বাভাবিক কারণেই তত বেশী। আরো বড় কথা হলো, ইচ্ছা ও হিম্মতও তো সবার একমাত্রায় থাকে না! কারো থাকে সবল, কারো থাকে দুর্বল। সবলতা ও দুর্বলতারও থাকে মাত্রাতারতম্য।তো বদনযর ত্যাগ করার কাজটা মূলত কঠিন কিছু ছিলো না। কিন্তু স্বেচ্ছায় অব্যাহত লিপ্ততা দ্বারা নিজেকে তাতে অভ্যস্ত ও আসক্ত করে ফেলার কারণে তোমার জন্য তা কঠিন হয়ে পড়েছে। তো নিজেই কঠিন বানিয়ে এখন বলছো, এটা আমার ইচ্ছাধীনই নয় এবং তা ছাড়তে আমি অক্ষম! আরে ভাই, যেভাবে ধারাবাহিক লিপ্ততা দ্বারা অভ্যাসে পরিণত করেছো সেভাবেই ছাড়ার ধারাবাহিক চেষ্টা দ্বারা ছাড়াটাকেও অভ্যাসে পরিণত করতে পারো।দেখো, বিড়ি-সিগারেট, গুল-তামাক, মদ ও মাদকদ্রব্য, এগুলো যদি প্রথমবার কাউকে খাওয়াও, এমন মাথা চকরাবে যে, তোমাকে ছাড়ার জন্য বলতে হবে না, নিজেই সে দ্বিতীয়বার এগুলোর কাছেও যেতে চাইবে না। বিভিন্ন কলাকৌশল করে দ্বিতীয়বার যদি খাওয়াও, দেখা যাবে কষ্ট আগের চেয়ে কম হয়েছে। এভাবে খাওয়াতে থাকলে একসময় তা অভ্যাস ও নেশায় পরিণত হবে, যা ত্যাগ করা হয়ে যাবে কঠিন এবং অসম্ভব।তো দেখো, যেটা করার চেয়ে না করা এবং ত্যাগ করাই ছিলো সহজ, সেটাকেই সে স্বেচ্ছায় ধীরে ধীরে এমন অভ্যাস ও নেশায় পরিণত করেছে যে, এখন ত্যাগ করাকেই অসম্ভব মনে করছে। তো কঠিন হওয়ার জন্য দায়ী তো সে নিজেই। সুতরাং স্বেচ্ছায় করে করেযেটাকে তুমি নেশায় পরিণত করেছো সেটাকেই এখন ইচ্ছা-শক্তি প্রয়োগ করে করে ত্যাগ করার অভ্যাস করতে হবে। যদি চেষ্টা করতে থাকো, অবশ্যই একসময় তা ছুটে যাবে।আমার নিজের অভিজ্ঞতা- কাহওয়া ও যায়তুনআমার ছাত্রাবস্থায় দারুল উলূমে আরবের এক মেহমান এসেছিলেন। তার মজলিসে  ছোট ছোট পেয়ালায় কাহওয়া পরিবেশন করা হলো। আমারও সামনে এলো ছোট্ট একটি কাপ। জানতাম না, কাহওয়া কী ও কেমন?! প্রথম চুমুকেই আমার তো অবস্থা কাহিল। বুঝতেই পারলাম না, আরবরা এত স্বাদের সঙ্গে এটা পান করে কীভাবে?!পরে যখন আরবদের সঙ্গে ওঠা-বসা শুরু হলো, বুঝতেই পারিনি, ধীরে ধীরে কীভাবে এমন অভ্যাসে পরিণত হলো যে, এখন মনে হয় কাহওয়া কত না স্বাদের পানীয়!!যায়তুন সম্পর্কেও হলো একই অভিজ্ঞতা ১৯৬৩ সালে হিজাযে গিয়ে। যায়তুনের প্রতি শাওক তো কোরআনুল কারীম থেকেই দিলের মধ্যে ছিলো। তবে এর আগে তা চোখে দেখিনি। শুধু শুনেছি, বেশ নাকি মজাদার ফল! কিন্তু মুখে দিয়ে ...!পরে ধীরে ধীরে এমন অভ্যাসে পরিণত হলো যে, আমার কাছেও যায়তুন এখন বে-হদ মজাদার ফল।তো মোটকথা হলো, অমুক অভ্যাস ত্যাগ করা যুক্তির বিচারে তো ইচ্ছাধীন বিষয়, কিন্তু বাস্তবতার বিচারে তা আমার সাধ্যের বাইরে এবং অসম্ভব, একথা বলা ঠিক নয়। কারণ এখন তা সাধ্যের বাইরে এজন্য মনে হচ্ছে যে, আমি নিজেই সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় তা অভাসে পরিণত করেছি। তবে এখনো বাস্তবতা এই যে, যদি তা ত্যাগ করার ইচ্ছা করো এবং হিম্মতের সঙ্গে সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা করো তাহলে একসময় তা এমন ছোটা ছোটবে যে, মনেই পড়বে না, কখনো এর ‘অভ্যাস’ ছিলো!হিম্মত ও ইচ্ছাশক্তির কদর করোহযরত থানবী রহ. খুব গুরুত্বের সঙ্গে এটা আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন যে, কিছুতেই ভেবো না, বদনযরের মন্দ অভ্যাস ত্যাগ করা ইচ্ছাধীন নয়, বরং তা সাধ্যাতীত। হাঁ, শুধু হিম্মতের প্রয়োজন। হিম্মত করো এবং প্রতিজ্ঞা করো যে, এটা আমাকে ছাড়তে হবে; বরবাদি থেকে বাঁচতে হলে এটা আমাকে ছাড়তেই হবে!! আমার দিলের মধ্যে যদি করাতও চলে; আমার উপর যদি পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়ে, এটা আমি ছাড়বোই ছাড়বো। এভাবে কিছুদিন তো কষ্ট হবে এবং ভুল হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে তা ছুটে যাবে। সামনে কখনো যদি দিলের মধ্যে ঐ চাহিদা জেগেও ওঠে তখন বেঁচে থাকা কঠিন হবে না, বরং তাতে এমন আত্মিক প্রশান্তি অনুভূত হবে যে, ঐ গোনাহের আনন্দ তার সামনে তুচ্ছ হয়ে যাবে।চুলকানি ও বদনযরির স্বাদ একই রকম!একটি অদ্ভুত মেছালের মাধ্যমে হযরত হাকীমুল উম্মত বিষয়টি বুঝিয়েছেন যে, চুলকানি হলে চুলকাতে খুব মজা লাগে। কিন্তু এর পরিণাম! যত চুলকাবে ক্ষত ততই ছড়িয়ে পড়বে এবং চুলকানি বাড়তে থাকবে। ডাক্তার বলবেন, চুলকানি থেকে আরোগ্য পেতে হলে চুলকানো তোমাকে ছাড়তেই হবে। তুমি বলবে, চুলকানি যখন ওঠে তখন বিরত থাকা তো আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে না। চুলকানো ছাড়া কোনভাবেই তো শান্তি হয় না।কিন্তু যখন বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে তখন বিরত থাকার চেষ্টা শুরু করে। শুরুতে কষ্ট তো খুব হয়, এবং ভুলও হয়, ভুলেও যায়, কিন্তু চেষ্টা বন্ধ করে না। এর সুফল কী হয়! ধীরে ধীরে বিরত থাকার কষ্ট কম হতে থাকে এবং চুলকানোর পরিবর্তে না চুলকানোটাই অভ্যাসে পরিণত হয়। ওদিকে তার রোগেরও উপশম হতে থাকে। তখন নিজেরই মনে হয়, সুস্থতার শান্তির সামনে চুলকানোর স্বাদ তো কিছুই না! এ স্বাদ ছিলো কৃত্রিম ও অস্বাভাবিক, আর সুস্থতার শান্তি হলো অকৃত্রিম ও স্বাভাবিক।বদনযরের বিষয়টিও এরূপ। এই খাহেশ পুরা করার মধ্যে যে স্বাদ পাওয়া যায়, আসলে তা চুলকানির স্বাদ এবং তা ত্যাগ করার কষ্ট, আসলে চুলকানো বন্ধ করার কষ্ট। বদনযরের খাহেশ থেকে বিরত থাকতে কষ্ট তো হবে, অবশ্যই হবে, তবে ধীরে ধীরে কষ্ট কমে আসবে এবং একসময় বরবাদির এ অভ্যাস ছুটেই যাবে। যখন তার নযর পাক-পাকীযা হয়ে যাবে; ভিতরে ইফ্ফাত ও নৈতিক শুচিতা সৃষ্টি হবে, তাকাওয়ার লজ্জত এবং আত্মিক পবিত্রতার স্বাদ পেতে শুরু করবে তখন সেগুলোর সামনে গোনাহের স্বাদ, মনে হবে তুচ্ছ, বে-হাকীকত!! কারণ গোনাহ থেকে বাঁচার মধ্যে একদিকে রয়েছে (হৃদয় ও আত্মার) সুস্থতার স্বাদ ও শান্তি; অন্যদিকে রয়েছে এই অনুভবের আত্মিক প্রশান্তি যে, আমি তো আমার মাহবূবে হাকীকির জন্য একটি বড় খাহেশ কোরবান করেছি! যে সত্তার সঙ্গে হৃদয় ও আত্মার পবিত্র প্রেমের সম্পর্ক হয়, আর সেটাই হলো চিরন্তন প্রেম এবং প্রকৃত প্রেম, তো সেই প্রেম ও প্রেমাস্পদের জন্য খাহেশাতকে দমন করার মধ্যে, প্রবৃত্তিগুলোর শেকড় উপড়ে ফেলার মধ্যে বড় স্বাদ ও আনন্দ, বড় শান্তি ও প্রশান্তি এবং বড় তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তি অর্জিত হয়। তখন তো হৃদয় ও আত্মার আকুতি হয় এমন-

তোমারই পথে জান করি কোরবান, সে তো তোমারই দান/ হক কথা তো এই, হক তোমার আদায় হলো না হে মহান!!অন্যস্থানে হযরত রহ. বলেছেন, এরূপ ক্ষেত্রে প্রথমে তো তুমি হিম্মত করে মুজাহাদা শুরু করবে, দ্বিতীয়ত আল্লাহর দরবারে খুব ইহতিমাম ও মিনতির সঙ্গে মুনাজাত করবে, হে আল্লাহ আমার হিম্মত কমযোর, আমার ইচ্ছাশক্তি দুর্বল। নিজের দিক থেকে আমি তো দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছি, ভুল পথে নযর যাবে না! কিন্তু হে আল্লাহ, আমি কী, আর আমার হিম্মতই বা কী! আমার হিম্মত ও প্রতিজ্ঞা তো আপনারই কুদরতের কবযায়। আপনার রহমত ও করুণার দোহাই হে আল্লাহ, আমার হিম্মত ও প্রতিজ্ঞার মধ্যে শক্তি দান করুন এবং আমাকে অবিচলতা দান করুন। হে আল্লাহ বরবাদির এ অভ্যাস থেকে আমাকে দূরে রাখুন। বিশেষভাবে এই ইউসুফী দু‘আ তো অবশ্যই করবে-إن لا تصرف عني كيدهن أصب إليهن وأكن من الجاهلينযদি আপনি তাদের চক্রান্ত আমার থেকে সরিয়ে না দেন, তাহলে তো আমি তাদের প্রতি ঝুঁকে পড়বো এবং জাহেলদের দলে ভিড়ে যাবো।বান্দা যখন কাকুতি-মিনতির সঙ্গে এ দু‘আ করবে তখন আল্লাহ তা‘আলা তার হিম্মতকে এত মযবূত এবং প্রতিজ্ঞাকে এত বলীয়ান করে দেন যে, ঐ গোনাহ ও গান্দেগি থেকে সে উদ্ধার পেয়েই যায়। হাদীছ শরীফেও এসেছে-مَنِ اسْــتَـــعَــفَّ يُــعِــفُّـهُ اللهযে শুচিতা ও পবিত্রতা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাকে শুচিতা ও পবিত্রতা দান করেন। এটা আল্লাহর ওয়াদা। আর আল্লাহর ওয়াদা কখনো খেলাফ হয় না। আল্লাহ আমাদের সবাইকে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার হিম্মত ও তাওফীক দান করুন, আমীন।হিম্মতে মযবূতি হাছিলের উপায়জনৈক ব্যক্তি হযরত থানবী রহ.কে লিখেছেন, ‘হযরতের তামবীহ ও সতর্ক করার পর এটা তো জানা হয়েছে যে, বদনযরের গোনাহ ইচ্ছাধীন, আর তার এলাজ ও চিকিৎসা হচ্ছে ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার, কিন্তু সব বোঝার পরো ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করার হিম্মতই হয় না। হিম্মতের কমযোরিতে গোনাহ হয়েই যায়।(আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৪৪)এটা তো গোনাহে লিপ্ত ৯৯ ভাগ মানুষেরই কথা! যে যেই গোনাহে লিপ্ত, সেই গোনাহ সম্পর্কে তার একই কথা যে, জানি, ত্যাগ করা ইচ্ছাধীন, তবু ত্যাগ করার হিম্মত হয় না, কারণ হিম্মতের মধ্যে সেই শক্তি নেই। কবি গালিবের ভাষায়-
বুঝি, ত্যাগ ও আনুগত্যেই পূণ্য/ কিন্তু মন ও মানসের নেই সায় ও সাড়া!অর্থাৎ জ্ঞান ও যুক্তির বিচারে তো জানা আছে, এ পথ ভালো, ঐ পথ মন্দ; বিশ্বাসও করি, কিন্তু মনের ঝোঁক যে পাপের পথে! পুণ্যের পথে যে মনের সাড়া নেই! এর কী এলাজ?!তো ঐ ব্যক্তির পত্রের জবাবে হযরতওয়ালা লিখেছেন, ‘হিম্মতের মধ্যে মযবূতিও আসে হিম্মতের ব্যবহার দ্বারা।’এমন যেন না হয় যে, প্রথমেই ধরে নিল, তার হিম্মত কমযোর। ব্যস, এটা ধরে নিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলো। না, বরং হিম্মত কাজে লাগাও। যত কাজে লাগাবে ততই তার মধ্যে শক্তি আসতে থাকবে।দুনিয়ার বেশীর ভাগ জিনিস অধিক ব্যবহারে দুর্বল হতে থাকে; যেমন গাড়ী-বাড়ী, আসবাবপত্র, ইত্যাদি। কিন্তু কিছু জিনিস আল্লাহ তা‘আলা এমনো বানিয়েছেন যে, যত বেশী ব্যবহার করবে তাতে তত বেশী শক্তি আসবে। যেমন হাফেযা ও স্মরণশক্তি। কেউ যেন না ভাবে যে, কোরআন হিফয করার পর অন্য কিছু মুখস্থ করার অবকাশ নেই। না, বরং তাতে আরো বেশী সংরক্ষণশক্তি সৃষ্টি হয়। হিম্মতও এমন; মানুষ যত বেশী কাজে লাগায়, তা তত বেশী শক্তিশালী হতে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা তাতে তত বেশী শক্তি সৃষ্টি করেন।সৌন্দর্যপ্রীতির রোগ ও চিকিৎসাএকব্যক্তি হযরত রহ.কে লিখেছেন- ‘আমার মধ্যে সৌন্দর্যপ্রীতি এত প্রবল যে, মামুলি জিনিসপত্রও অত্যন্ত সুবিন্যস্ত ও সুসজ্জিতভাবে রাখি। আর সুন্দর মুখের প্রতিও সীমাহীন আকর্ষণ রয়েছে।(আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৪৫)হযরত রহ.-এর জওয়াব ছিলো এরূপ- ‘যে অবস্থা আপনি লিখেছেন তার কিছু তো উত্তম।  যেমন উত্তম ও সুন্দর জিনিসের প্রতি আগ্রহ এবং তার যথাযোগ্য কদর করার সহজাত রুচি। তো এর উপর আল্লাহর শোকর আদায় করো।আর কিছু হচ্ছে অসুন্দর ও গর্হিত। যেমন সুন্দর মুখের প্রতি ঝোঁক, যা অবলোকন করা অন্যায় ও গোনাহ। তো এক্ষেত্রে খুব ছবর ও ধৈর্যের পরিচয় দাও এবং তা থেকে নযর নীচে রাখো; যদিও তাতে জান বের হওয়ার মত কষ্ট বোধ হয়। কারণ আল্লাহ তা‘আলাও বড় গায়রতওয়ালা। তিনি খুবই গায়রত বোধ করেন যে, বান্দা এমন কোন জিনিসের দিকে তাকাবে, যা দেখা তিনি হারাম করেছেন। সৌন্দর্যের প্রতি যখন তোমার প্রীতি ও আকর্ষণ রয়েছে তখন চিন্তা করো যে, জামাল ও সৌন্দর্যের কামাল ও পূর্ণতা তো রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার কাছে। সুতরাং তিনিই তো হলেন মাহবূবে আকবার ও শ্রেষ্ঠ প্রেমাস্পদ। তাহলে দুনিয়ার মামূলি সৌন্দর্যের জন্য মাহবূবে আকবারকে নারায করা কেমন গায়রাতের কথা।হারামের প্রতি বৈধতার প্ররোচনা ও তার চিকিৎসাআরেক ব্যক্তি হযরত রহ.কে লিখেছেন- ‘শয়তান এরূপ প্ররোচনা দেয় যে, আল্লাহ তা‘আলা যদি সৌন্দর্যের এই প্রতীমাটির উপর বৈধ অধিকার দান করেন তখন তুমি কী করবে?! তো বৈধতার কল্পনা করে (অর্থাৎ স্ত্রী কল্পনা করে) আনন্দ ভোগ করো। অবৈধ আনন্দের চিন্তা করোই না।(আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৪৫)হযরত রহ.-এর জওয়াব ছিলো এরূপ- ‘খেয়াল ও কল্পনাই হচ্ছে খেয়াল ও কল্পনার চিকিৎসা। অর্থাৎ একটি খেয়াল ও কল্পনাকে তুমি অন্য একটি খেয়াল ও কল্পনা দ্বারা দমন করো। যেমন, এরূপ চিন্তা করো যে, ঐ স্ত্রীলোকটির স্বামী যদি তোমার মনের এসব চিন্তার কথা জানতে পারে তাহলে কেমন লজ্জায় তুমি পড়বে! তুমি কি তাকে বলতে পারবে যে, আমি তো অবৈধ কিছু চিন্তা করছি না, বরং চিন্তা করছি যে, তোমার মৃত্যু হয়েছে, আর তোমার স্ত্রী আমার বৈধ স্ত্রী হয়েছে এবং আমি তাকে উপভোগ করছি! ভেবে দেখো, এসব কুচিন্তা জানাজানি হলে কেমন কেলেঙ্কারি হবে!তো আল্লাহ তা‘আলা তো তোমার সমস্ত গোপন চিন্তার কথাও জানেন। কত না লজ্জা-শরমের কথা যে, তোমাকে তিনি এরূপ চিন্তা করা অবস্থায় দেখছেন! তাছাড়া জাহান্নামের আযাবকে উপস্থিত কল্পনা করে ভীত-সন্ত্রস্ত হও।আরো চিন্তা করো যে, অন্যের স্ত্রী সম্পর্কে আমি যা চিন্তা করছি, যদি আমার স্ত্রী সম্পর্কে কেউ এরূপ চিন্তা করছে বলে আমি জানতে পারি তাহলে আমার কী প্রতিক্রিয়া হবে?! তো সেই মানুষটিরও কি একই প্রতিক্রিয়া হবে না?! আমার যেমন গায়রাত আছে, তারও তো তেমনি গায়রাত আছে!তাছাড়া শয়তানের এ বৈধতা-মূলক ব্যাখ্যা প্ররোচনার মতলব তো এমনই হলো যে, পরনারীর সঙ্গে বাস্তবেই যিনায় লিপ্ত হলো, আর কল্পনা করলো যে, যদি আমি এর উপর বৈধ অধিকার লাভ করি তখন তার সঙ্গে এরূপ করবো! অথচ এটা হারাম হওয়ার বিষয়ে তো কোন সন্দেহ নেই। তো চিন্তার যিনা সম্পর্কেও একই হুকূম। (আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৪৫)দরবারে নববীতে যিনার অনুমতি চাওয়ার ঘটনা!!হযরত হাকীমুল উম্মত জওয়াব লিখতে গিয়ে এই যে বললেন, মানুষ যেন চিন্তা করে; আমার বউ-বেটি ও মা-বোন সম্পর্কে অন্য কেউ যদি একই চিন্তা করে তাহলে আমার ভিতরে গায়রাত জ্বলে ওঠবে কি না? আমি তাকে খুন করে ফেলার চিন্তা করবো কি না? হযরত রহ.-এর এ ভাবনা হাদীছ থেকে আহরিত। মাজমাউয্যা-ওয়াইদের বর্ণনায় এসেছে- ‘এক যুবক (ইসলাম গ্রহণের ইচ্ছায়) নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে হাযির হয়ে আরয করলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার সব হুকুম মাথার উপর। কিন্তু যিনা ছেড়ে দেয়ার ধৈর্য ও ছবর আমার নেই। সুতরাং আমাকে যিনার অনুমতি দিয়ে দিন!’একটু চিন্তা করুন তো, কী গুরুতর কথা! কার কাছে কী আব্দার!!আল্লাহর নবী কিন্তু পূর্ণ সংযমের সঙ্গে তাকে কাছে ডাকলেন এবং কাঁধে হাত রেখে বললেন, আচ্ছা, বলো তো, যার সঙ্গে তুমি যিনা করতে চাও সে তো কারো মা, বা খালা হবে, কারো বোন বা মেয়ে হবে; তো কেউ যদি একই আচরণ তোমার মা-খালার সঙ্গে, তোমার বোন বা মেয়ের সঙ্গে কিংবা তোমার স্ত্রীর সঙ্গে করতে চায়, তুমি কি তা মেনে নেবে? যুবক প্রতিবারই একই উত্তর দিলো, কিছুতেই না ইয়া রাসূলাল্লাহ!তখন আল্লাহর পেয়ারা নবী বললেন, যখন অন্যদের এ আচরণ তুমি বরদাশ্ত করতে রাজি নও, বরং এতে তুমি কষ্ট পাবে বলে মনে করো তাহলে একই আচরণ অন্যদের নারিদের সঙ্গে কীভাবে করতে চাও? তাদের কি এতে কষ্ট হবে না? তারা এটা বরদাশ্ত করতে পারবে?যুবক ছাহাবী বলেন, যখন আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লামের দরবারে হাযির হলাম তখন আমার ভাবনা ছিলো এই যে, ইসলাম গ্রহণের পথে সবচে’ বড় বাধা হচ্ছে যিনা ছেড়ে দেয়া। কিন্তু নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা শুনে আমার দিলে যিনার প্রতি এমনই নাফরাত ও ঘৃণা সৃষ্টি হলো যে, আর কখনো এসবের প্রতি ঝোঁক বা মায়লান আমার অন্তরে আসেনি।নারীর মুখোমুখি হওয়ার বিভিন্ন অনিবার্য ক্ষেত্রএকব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘কিছু ক্ষেত্র এমন রয়েছে যেখানে পুরুষকে নারিসঙ্গের সম্মুখীন হতেই হয়। যেমন মেয়েলি সামগ্রীর দোকাদার, অলঙ্কারবিক্রেতা, হাসপাতালের ডাক্তার ইত্যাদি। এরূপ ক্ষেত্রে বদনযর থেকে বাঁচার উপায় বলে দিলে বড় মেহেরবানি হয়।’তো এধরনের মানুষেরা আসলেই বড় বিপদে ঘিরে থাকে। প্রায় সার্বক্ষণিক নারিসঙ্গ অনিবার্য হওয়ার কারণে বদনযর থেকে তাদের বেঁচে থাকা সহজ নয়। কিন্তু এটাও সত্য যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাকে এমন কোন আদেশ দেননি যা পালন করা বান্দার পক্ষে অসম্ভব।প্রথমে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, কোন নারীর মুখ দেখা নিজস্ব সত্তায় দোষ বা গোনাহ নয়। গোনাহ তো হয় তখন যখন ‘সমস্যা’ দেখা দেয়। কিন্তু যেহেতু সমস্যার সমূহ আশঙ্কা বিদ্যমান রয়েছে সেহেতু আগাম সতর্কতারূপে বলে দেয়া হয়েছে যে, নযরই দিয়ো না। কোরআন, দেখুন না, কী সুন্দর আদেশ করেছে নযর নীচু রাখার! কী দরকার নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলার! তার চেয়ে সহজ ও নিরাপদ হলো নযরই না করা!! তো কাজ বা দায়িত্বের প্রয়োজনে যাদের বারবার নারিসঙ্গের সম্মুখীন হতে হয় তাদের প্রতি পয়লা হুকুম তো হলে নযর নীচে রাখা। কারণ লেনদেনের জন্য সরাসরি মুখের দিকে তাকানো তো জরুরি নয়। বহু মানুষকে আমি নিজে দেখেছি, যারা এরূপ ক্ষেত্রে দায়িত্বও পালন করেন, আবার তাদের নযরও নীচে থাকে।হাঁ, যখন কাজের প্রয়োজনে তাকাতেই হয় তখন নিজেও চেষ্টা করবে ‘দৃষ্টি যেন কলুষিত’ না হয়। তারপর আল্লাহর কাছে খুব কাকুতির সঙ্গে দু‘আ করবে, আয় আল্লাহ, আমার দৃষ্টিকে তুমি কলুষতা থেকে রক্ষা করো। হে আল্লাহ, তুমি আমার হিফাযত করো। আর আল্লাহ না করুন, দৃষ্টি কখনো যদি কলুষিত হয়েই পড়ে তখন সঙ্গে সঙ্গে তাওবা-ইস্তিগফার করে নেবে।হযরত ডাক্তার আব্দুল হাই ছাহেবের মোজাহাদাআমাদের হযরত ডাক্তার আব্দুল হাই ছাহেব রহ. প্রথমে ওকালাত করতেন; তাতে বিভিন্ন দ্বীনী সমস্যা হওয়ার কারণে হযরত থানবী রহ.-এর অনুমতিক্রমে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শুরু করেন। তো স্বাভাবিক কারণেই সেখানে পুরুষ রোগী এবং মহিলা রোগী আসতো।এ বিষয়ে পেরেশান হয়ে তিনি হযরত থানবী রহ.কে পত্র লিখলেন- ‘হযরত, আমি তো আগে ওকালতি করতাম। তাতে অন্যরকমের ফেতনা ছিলো। এখন ডাক্তারি শুরু করেছি; তাতে আরেক প্রকারের ফেতনা। সবসময় নারিরোগীর মুখোমুখি হতে হয়। এখন কী করবো?জওয়াবে হযরত রহ. দু’টি বাক্য লিখলেন যে, আল্লাহর কাছে দু‘আ করে নিজের নেগাহ  ও কলবের হিফাযত করুন; আমিও দু‘আ করছি।হযরত ডাক্তার ছাহেব বলেন, ‘এ পত্র পেয়ে আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করি, আর রোগী দেখায় বসি। সুফল এই হলো যে, কী পেরেশানির ছিলো ঐ দিনগুলো, আর কী নিরাপদ আজকের দিনগুলো!! বলা যায়, এ বিষয়ে আমার দিল যেন পাথর হয়ে গিয়েছে।’তিনি আরো বলেন, ‘নযরের হিফাযত সম্পর্কে চিন্তা করে দেখলাম, শুধু নারিদের ক্ষেত্রে নযর নীচু করা বড় মুশকিল কাজ। তো নারী ও পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই নযর নীচু রেখে কথা বলার অভ্যাস করি না কেন? ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, এখন অনেক সময় খেয়ালই থাকে না, সামনের রোগী নারী না পুরুষ, বুড়ো না জোয়ান!’ ব্যস, আমাদের তো একই পথ ও পন্থা, নযর যেন নীচের দিকে থাকে।হিম্মতের উপর আসে আল্লাহর সাহায্যআসল কথা এই যে, মানুষ যখন এধরনের বিপদে পড়ে যায় তখন বাঁচা বড় কঠিন মনে হয়। তবে আল্লাহ তা‘আলা যখন বান্দাকে এধরনের হালাতে লিপ্ত করেন তখন আসানি ও সহজতাও তিনি পয়দা করে দেন। এটা  হতেই পারে না যে, বান্দাকে তিনি অসহায় ও বে-সাহারা অবস্থায় ছেড়ে দেবেন। বান্দা যদি বাঁচার ইচ্ছা ও প্রতিজ্ঞা করে; আর আল্লাহ তা‘আলার কাছে সাহায্য চায়; সেই সঙ্গে নিজের তরফ থেকে অল্প-বিস্তর হিম্মতেরও পরিচয় দেয় তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে অসহায় ও বে-সাহারা অবস্থায় কিছুতেই ছেড়ে দেবেন না। কোন না কোনভাবে অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন।বান্দা যদি বাঁচার ইচ্ছাই না করে; চিন্তা -ফিকিরই না করে, বরং গাফলতের মধ্যেই পড়ে থাকে। আর শুধু বাহানা-অজুহাত করে যে, বাঁচার তো কোন উপায়ই দেখি না; আমার কাছে তো মনে হয় অসম্ভব এবং সাধ্যের অতীত? এ অবস্থায় আমি কী আর করতে পারি?! এগুলো আসলে এড়িয়ে যাওয়ার এবং নিজেকে ধোকার মধ্যে রাখার বাহানা। এ অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সাহায্যের কোন ওয়াদা নেই। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবার সাহায্য করুন এবং এই বরবাদির গোনাহ থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন, আমীন।وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين চোখের নযর বা দৃষ্টি হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার এমন এক নেয়ামত যার বিনিময় হতে পারে না দুনিয়ার সমস্ত ধনসম্পদ। নযর ও দৃষ্টি যদি না থাকে, জীবন মনে হবে অর্থহীন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য নযর ও দৃষ্টিকে শুধু কল্যাণের ক্ষেত্রে এবং আল্লাহ তা‘আলার অনুমোদিত ক্ষেত্রে ব্যবহার করা; অন্যায় ক্ষেত্রে এবং আল্লাহ তা‘আলা নিষেধ করেছেন এমন ক্ষেত্রে ব্যবহার না করা।মানুষের চোখের দৃষ্টি যদি পবিত্র হয় পৃথিবীর সবকিছু পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর হয়ে যায়। দৃষ্টি যদি হয় অপবিত্র, মানুষ তখন নিজের কাছেই হয়ে পড়ে নোংরা অপবিত্র। 
নযর যদি হয় পাকীযা তাহলে নযর থেকে বিচ্ছুরিত হতে পারে এমন আলো ও নূর যে, একটি নযরেই দূর হয়ে যেতে পারে দুনিয়ার সমস্ত দিলের সমস্ত জুলমাত। এমনই হয়ে থাকে আল্লাহর নেক বান্দাদের নেক নযর। যিন্দেগিভর মোজাহাদা করে এরূপ পাকীযা নযর হাছিল করা দরকার।



শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা