রবিউল আওয়াল ১৪৩২হিঃ (১৯)

তোমাদের জন্য

তিনি নেই, তবে তিনি থাকবেন

লিখেছেনঃ মাওলানা আব্দুল মালিক

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

হিদায়াতের কত বাতি ছিলো, যারা কোরআন-সুন্নাহর আলো জ্বেলে রেখেছিলোআরদুল ওয়াহি থেকে বহু দূরের এই দেশ সেই আলোতেই তো আলোকিত ছিলো! চারদিকে নূর ও নূরানিয়াত ছিলোতাদের ছোহবতেই তো মানুষের দিলের জাহান আবাদ ছিলো! নূর ও নূরানিয়াতে পূর্ণ ছিলো! কিন্তু তাকদীরের ফায়ছালা! আজালের ঝাপটা আসে, একটি করে বাতি নিভে যায়, আর অন্ধকার আরো ঘনীভূত হয়

তেমনি একটি নিভে যাওয়া বাতির কথা লিখতে বসেছি আজএই তো দুদিন আগেও ঘোর অন্ধকারে এবাতি আমাদের আলো দিয়ে যাচ্ছিলো, আমরা পথ দেখতে পাচ্ছিলাম, হঠাৎ নিভে গেলো ঘোর অন্ধকারে আমাদের  দিশেহারা করে! তিনি আলো লাভ করেছিলেন আগের বাতি থেকে, আগামী দিনর বাতিগুলো এই নিভে যাওয়া বাতি থেকে কতটা আলো লাভ করেছে তা তো সময় থেকেই জানা যাবেআমি এখানে শুধু বাতি থেকে বাতির আলো গ্রহণের ধারাটুকু উল্লেখ করতে চাই   

পাকভারত উপমহাদেশে ইলম ও হিদায়াতের অঙ্গনে এই নিকট অতীতেও অসংখ্য বাতি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল আলো দান করছিলোঅনেক আলোর মাঝেও যে বাতির আলোটি ছিলো বিশেষভাবে প্রোজ্জ্বল ছিলো তিনি হলেন ফাকীহুন্-নাফস হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী রহ, (১২৪৪-১৩২৩ হিঃ) 

এই প্রদীপ্ত প্রোজ্জ্বল বাতির আলো থেকে আলো গ্রহণ করেছেন এবং বিভিন্ন জনপদে অন্ধকার মানুষের মাঝে আলো বিতরণ করেছেন কত বাতি, কত প্রদীপ, তার হিসাব আছে শুধু মহাকালের কাছে 

আমাদের সৌভাগ্য এই যে, এ অঞ্চলেও ছিলো কয়েকটি প্রদীপ্ত বাতিতাদেরই একজন চট্টগ্রামের গৌরব হযরত মাওলানা যমীরুদ্দীন ছাহেব রহ. ( ১২৯৬ - ১৩৫৯ হি.)তিনি ছিলেন বহুমুখী আত্মিক ও বাহ্যিক গুণের এক বিরল ব্যক্তিতাঁর আলোক-সান্নিধ্য থেকে আলো লাভকারী অনেক বাতির বিশিষ্ট একটি হলেন হযরত হযরত মাওলানা মুফতী আযীযুল হক ছাহেব রহ. (১৩৩ -১৩৮০ হি.) বস্ত্তত জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিনয়, ধর্ম- ভীরুতা, রুচি ও বুদ্ধির বিশুদ্ধতা, ইত্যাদি যাবতীয় গুণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন যুগের অনন্য পুরুষআবার বাতি থেকে অনেক বাতি আলো লাভ করলোতবে সবার মাঝে সবচে প্রোজ্জ্বল হলেন হযরত মাওলানা সুলতান আহমদ নানুপুরী রহ. (মৃ ১৪১৮ হিঃ)এ মহান আধ্যাত্মিক পুরুষের ফানাইয়্যাত ও আত্মবিলীনতা, তাঁর জাযব ও আকর্ষকতা এবং তাঁর কালবানিয়াতের জামাল ও সৌন্দর্য কোন্ সুউচ্চ স্তরের ছিলো তা যারা অনুধাবন করেছেন তাদের অনেকে এখনো বেঁচে আছেন

এই মহান সাধকপুরুষ তাঁর প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান জামিয়া ওবায়দিয়া নানুপুর-এর দায়িত্বভার অর্পণ এবং সুলূক ও  আধ্যাত্মিকতার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য যে ভাগ্যবান ব্যক্তিটিকে নির্বাচিত করেছিলেন তিনি হলেন আমাদের প্রিয় মুরুবিব হযরত মাওলানা যামীরুদ্দীন (পীর ছাহেব নানুপুর, রহ)তিনি ছিলেন এক নীরব সাধকমহান পূর্ববর্তীর কাছ থেকে প্রাপ্ত মহান দায়িত্বের প্রতি পূর্ণ আত্মনিবেদিত অবস্থায় এ ক্ষণস্থায়ী জীবন তিনি অতিবাহিত করেছেনইলমের পিপাসুদের মধ্যে নবুয়তের মীরাছ বণ্টন করেছেন; যাদের মধ্যে পিপাসা ছিলো না তাদের মধ্যে পিপাসা সৃষ্টি করেছেন এবং পিপাসার জল সরবরাহ করেছেন; উত্তপ্ত হৃদয় দ্বারা বহু হৃদয় উত্তপ্ত করেছেন, আর যারা জানতো না কীভাবে কাঁদতে হয়, নিজের কান্না দিয়ে তাদের তিনি কান্নার সৌন্দর্য শিখিয়েছেন; অসংখ্য মানুষের হৃদয় ও আত্মাকে ঈমান ও মারিফাত এবং বিশ্বাস ও অন্তর্জ্ঞানের আলোতে আলোকিত করেছেনএভাবেই পার হয়েছে তাঁর জীবনের সকাল-সন্ধ্যা এবং যিন্দেগির ছুবহ-শাম

বাতির আলো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল হয়ে দূর থেকে আরো বিস্তার লাভ করে চলেছিলো; ঠিক তখন আবার তাকদীর নাযিল হলো, আজলের ঝাঁপটায় এ বাতিটিও নিভে গেলোএই নিভে যাওয়া তো আমাদের দিক থেকেতাঁর দিক থেকে হলে বলবো, মাওলার ডাকে লাববাইক বলে, দুই ঠোঁটে সারা জীবনের আল্লাহু, আল্লাহু যিকিরের সজীবতা নিয়ে মাওলার কাছে চলে গেলেনআমাদের জন্য হলো- إنا لله و إنا إليه رجعون 

 আর তাঁর জন্য হলো- ارجعي إلى ربك راضية مرضية (মৃত্যুর তারিখ, পয়লা রাবিঃ আউয়াল ১৩৩২ হি. ৫ই ফেব্রম্নয়ারি ২০১২ খৃ. রোয শনিবার দিবাগত রাত প্রায় এগারটার)

ইনতিকালের রাতে এশার পরে তিনি তালিবানে ইলমের উদ্দেশ্যে বয়ান করেছেন, এমন আদনা কামও করবে না, যার কারণে মন্দ মউত হতে পারে, আবার এমন আদনা কামও তরক করবে না যারা দ্বারা উত্তম মউত নছীব হতে পারে

বয়ান ও দুআর পর কামরায় এসে রাতের উপস্থিত খাবার গ্রহণ করলেন এবং কিছুক্ষণ পর রাতের শয্যাগ্রহণ করলেনহঠাৎ অস্থিরতা অনুভূত হলোনিজেই অযু-তাহারাত হাছিল করলেনযিকরুল্লাহ জারি ছিলো, জারি থাকলোএম্বুলেন্স আনতে নিষেধ করে বললেন, দরকার নেই এর পর দশ মিনিটেরও কম সময়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন এবং পৌঁছে গেলেন রাহিমাহুল্লাহু রাহমাতান ওয়াসিআতান

প্রায় প্রত্যেক দুআতে তিনি মন্দ মউত থেকে পানাহ চাইতেন, আর তা এমনই কবুল হলো যে, বড় ঈর্ষণীয় মৃত্যু সবাই দেখতে পেলো, যা দেখতে পাওয়াও বড় সৌভাগ্যের(চাঁদ-হিসাবে) তাঁর জীবনের পরিধি ছিয়াত্তুর বছরের বেশী নয়, কিন্তু মাশাআল্লাহ কর্মে ও কীর্তিতে এবং দানে ও অবদানে তা ছিলো সুসমৃদ্ধ ও প্রাচুর্যপূর্ণ; যেমন  তালিম-তারবিয়াতে, তেমনি ওয়ায ও ইরশাদে, আর তেমনি মুনাজাতে ইবাদতে

যদিও আল্লাহর বান্দাদের ইছলাহ ও সংশোধন এবং তাদের কল্যাণসাধন ছিলো তাঁর জীবনের প্রধান চিন্তা, তবে আউলিয়ায়ে সালাফের মত তাঁরও আত্মার প্রশান্তি ছিলো দুআ-মুনাজাত এবং শেষরাতের আহাযারি ও রোনাযারিবস্ত্তত এটা ছিলো স্বভাব ও আত্মার চাহিদা, তার রূহের গিযা ও দিলের খোরাকতবে ইছলাহে খালক-এর দায়িত্ব সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ সজাগ ও সদাপ্রস্ত্ততদিলে উম্মতের দরদ ছিলো বে-পানাহকেউ যখন দেখে না তখন কাঁদতেন, আর যখন কাউকে কাছে পেতেন মায়া দিয়ে, দরদ দিয়ে বলতেন, এই পথে চলো, ঐ পথে চলো নাএকটা অস্থিরতা ছিলো দিন-রাত, বান্দা কীভাবে মাওলার সঙ্গে জুড়ে যায়, কীভাবে নবীওয়ালা যিন্দেগি হাছিল হয়ে যায়, আর আখেরাতে খোশনছীব হয়ে যায়!

শেষ সময়ে এ অস্থিরতায় বে-চায়ন ছিলেন যে, তরুণ আলিমগণ কীভাবে নিজেরা আহলেদিল হবেন, তারপর  তালিবানের জন্য সাচ্চা রাহনুমা ও পথপ্রদর্শক হবেনতিনি বলতেন, এখন আসল দুর্ভিক্ষ হচ্ছে কলব-রূহের উপর মেহনতকারী মানুষেরতাই তোমরা খালওয়াত ও নির্জনতা গ্রহণ করো এবং নিজেদের তৈয়ার করোছদর ছাহেব, হাফেজ্জি হুযূর, পীরজ্বি হুযূর, তাঁদের নমূনা যিন্দা করোতাঁদের মেহনতের সিলসিলা জারি রাখো

যিকির ও দুআর প্রাচুর্য এবং ইনাবাত ও আত্মনিবেদন, এগুলোই ছিলো তাঁর পরিচয়-বৈশিষ্ট্যমুনাজাতের নিবিষ্টতা ও নিমগ্নতা ছিলো তাঁর সমকালে তুলনাহীনরোনাযারি ও আহাযারি ছিলো এমন যে, নির্জীব হৃদয়ও যেন সজীব এবং মুরদা দিলও যেন যিন্দা হয়ে ওঠেসালিকীনের তাযকিয়া ও তারবিয়াত দুআ-যিকির দ্বারা শুরু করাকেই তিনি উপকারী মনে করতেনএটা শুধু এবং শুধু আল্লাহর তাআলার ফযল ও করম যে, কয়েকবার কিছু সময় এ অধম লেখকের সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর মজলিসে মারিফাত-এর কাছাকাছি উঁকিঝুঁকি করারসেই মজলিসের খায়র ও কল্যাণ যদি এখানে তুলে ধরতে যাই, বড় এক লেখা হয়ে যাবে, যা নিকটতম কোন সুযোগে করার নিয়ত আছে ইনশাআল্লাহএখন তো শুধু উদ্দেশ্যে হলো হযরত মরহূম, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সম্পর্কীদের জন্য দুআর আবেদন জানানোহাদীছ শরীফে এসেছে-

আদমের বেটা যখন মারা যায়, তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে যদি ছাদাকা-জারিয়া রেখে যায়, বা এমন ইলম রেখে যায় যা দ্বারা উপকার হয়, কিংবা নেক সন্তান রেখে যায়,  যে তার জন্য দুআ করে (সেগুলো বন্ধ হয় না)

আলহামদু লিল্লাহ উপরোক্ত তিন পথেই আমলের সিলসিলা জারি থাকার ব্যবস্থা হযরত মরহূম করে গিয়েছেন, যা ইনশাআল্লাহ তা-কিয়ামাত অব্যাহত থাকবে

দুনিয়াতে কেউ থাকার জন্য আসে না, যাওয়ার জন্যই আসেএখানে আগমন আসলে নির্গমনেরই প্রারম্ভতবে করো নির্গমন হয় কোন প্রস্ত্ততি ছাড়া, কারো হয় অর্ধপ্রস্ত্ততির উপর, কারো প্রস্ত্ততি সীমাবদ্ধ শুধু নিজের পর্যন্ত, আর আল্লাহর ভাগ্যবান বান্দারা তো মাশাআল্লাহ এমনই প্রস্ত্ততি গ্রহণ করেন যে, আল্লাহর ইচ্ছায়, শত শত নয়, হাযারো, লাখো বান্দার নাজাত ও বুলন্দ দারাজাত-এর জন্যও যথেষ্ট হয়শুধু তাই নয়, তাঁরা তাঁদের পিছনে এত বিপুল কর্ম ও কীর্তি রেখে যান যে, মৃত্যুর পরো তাদের ফায়য ও ফায়যান জারি থাকেতাঁরাই হলেন মরণেও অমরআমাদের হযরত মরহূম হলেন সেই রকম একজন অমর (ইনশাআল্লাহ)তাঁর জড়-অস্তিত্ব তো এখন আর নেই, কিন্তু কর্মে ও কীর্তিতে এবং জাগতিক ও আধ্যাত্মিক ছাদাকাতে জারিয়ার মাধ্যমে তিনি জীবন্ত থাকবেন, কিয়ামত পর্যন্ত মানুষ তাঁর দ্বারা উপকৃত হতে থাকবে এবং তাঁর আমলনামা ওযনদার হতে থাকবে, আল্লাহর রহমতের ভরসায় একথা বলা যায়উম্মতের দরদে, মৃত্যুর চিন্তায় আরামের ঘুম জীবনে তার নছীব হয়নিহে আল্লাহ, কবরে তা-কেয়ামত সেই আরামের ঘুম যেন তাঁর নছীব হয়, আমীন

اللهم لا تحرمنا أجره, و لا تفتنا بعده, و أكرم نزله و وسع مدخله, آمين يا رب العلمين واللهم لا تحرمنا أجره, و لا تفتنا بعده, و أكرم نزله و وسع مدخله, آمين يا رب العلمين و

 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা