এ মুহূর্তে মুসলিমবিশ্বের সবচে’ কঠিন যন্ত্রণা ও মর্মপীড়ার কারণ হলো জেরুসালেমট্রাজেডি, যা নগ্ন হয়ে সামনে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানীরূপে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিষয়টির বিভিন্নমুখী আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হচ্ছে।
নীচে আমরা তার কিছু নমুনা পুষ্পের পাঠকবর্গের জন্য তুলে ধরছি। তবে প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয়া জরুরি মনে করি। আজ এ আলোচনা মনে হবে বড় অদ্ভূত যে, ইসরাইল নামক ইহুদি রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব সকল বিচারেই ছিলো অবৈধ। কোন আরবরাষ্ট্র কোন মুসলিমরাষ্ট্র এমনকি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও একদু’টি ব্যতিক্রম ছাড়া ইসরাইলের অস্তিত্বকেই স্বীকার করতো না। পুরো ইসলামী বিশ্বে যে শব্দটি ইসরাইল সম্পর্কে ব্যবহৃত হতো তা ছিলো, ‘অবৈধ, মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া, আর বৃটেন-আমেরিকার জারজ সন্তান।’ সময়ের নির্মমতায় আজ ইসরাইল একটা জলজ্যান্ত বাস্তবতা। ইসরাইলকে প্রথম স্বীকৃতিদানকারী দেশটি হচ্ছে মিশর এবং প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত। তিনি এ অপরাধের মাশুল আদায় করেছেন আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়ে! বেচারা!! এখন তো সউদী আরবকে বলা হয় ইসরাইলের ঘনিষ্ট মিত্র! বেচারা!!
তো এ তিক্ত সত্যটি অন্তরে জাগরূক রেখে আসুন প্রিয় পাঠক, আমরা সামনের আলোচনায় অগ্রসর হই।
আল্লাহ আমাদের সঠিক পাথেয় গ্রহণ করে সঠিকপথে চলার তাওফীক দান করুন, আমীন।
ফিলিস্তীন ও ইসরাইল উভয় রাষ্ট্রই জেরুসালেমকে নিজ নিজ রাজধানী ও পবিত্র নগরী মনে করে।
জেরুসালেম ফিলিস্তীনের ভূখ- হলেও বর্তমানে তা ইসরাইলের দখলে। সুতরাং সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন ছিলো সমঝোতাচুক্তির। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল-আরবযুদ্ধের পর থেকেই নগরটির মর্যাদা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। যুদ্ধের আগে জেরুসালেমকে নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক এলাকা ঘোষণা করেছিলো জাতিসঙ্ঘ। কিন্তু আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তের কোন তোয়াক্কা না করে ইসরাইল যুদ্ধের মাধ্যমে নগরের পশ্চিম অর্ধেক দখল করে নেয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করে নেয় বাকি অর্ধেক। সে চায়, যে কোন মূল্যে পুরো জেরুসালেম তার দখলে থাকবে। বেশীর ভাগ মানুষের প্রত্যাশা ছিলো, একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পশ্চিম জেরুসালেম ইসরাইলকে এবং পূর্বজেরুসালেম ফিলিস্তীনীদের দেয়া হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবসময় জেরুসালেমকে একটি বিতর্কিত এলাকা হিসাবে দেখেছে এবং এর সমাধানের জন্য ইসরাইল ও ফিলিস্তীনের জনগণকে তাগিদ দিয়েছে। দেশটি নিজেকে সবসময় এই সঙ্কটের মধ্যস্থতা-কারী হিসাবে উপস্থাপন করতো। সেই ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করেছেন ট্রাম্প।
১৯৮০ সালে ইসরাইল জেরুসালেমকে তাদের চিরন্তন রাজধানী হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। তখনই মূলত পূর্বজেরুসালেমের উপর নিজের দখলকে সে আনুষ্ঠানিক রূপ দান করে। ট্রাম্প এই অযৌক্তি দাবীকে প্রত্যাখ্যান এবং ফিলিস্তীনীদের ন্যায্য দাবীকে গ্রহণ করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র শুধু যে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে তাই নয়, সে তার নিরপেক্ষ অবস্থানও হারিয়েছে চিরতরে, যা মধ্যস্থতা-কারীর জন্য খুবই জরুরি।
বস্তুত নিরপেক্ষতার নীতি ও অবস্থান চরমভাবে বিতর্কিত হয়েছে গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে। এটি আরো প্রকট হয়েছে খৃস্টধর্মীয় বিষয়গুলো রাজনৈতিকভাবে সুরাহা করার কারণে। (যেমন ইহুদিদেরকে যিশুর রক্তের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়া, যা কারো এখতিয়ারের বাইরে। Ñঅনুবাদক)
এই বিতর্ক আরো নগ্ন হয়েছে নির্বাচনের সময়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী অঙ্গীকার করেছেন তেলআবীব থেকে দূতাবাস জেরুসালেমে স্থানান্তরের। তবে নির্বাচিত কোন প্রেসিডেন্ট তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করার দিকে অগ্রসর হননি, বরং তা ‘পরবর্তী সময়ের জন্য স্থগিত’ এই নীতি অনুসরণ করেছেন, ছয়মাস পর পর উত্থাপিত বিলের উপর স্বাক্ষর করার মাধ্যমে। উদ্দেশ্য ছিলো শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা এবং মধ্যস্থতাকারীর নিরপেক্ষতা রক্ষা করা। ট্রাম্প কোন রাকঢাক ছাড়াই সরাসরি ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিলেন।
ট্রাম্পের ঘোষণার পর থেকে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ, যা সংহিসতার রূপ গ্রহণ করছে। এ পর্যন্ত বেশ কিছু বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে। ফিলিস্তীনীদের মরণপণ শপথ, বিনা যুদ্ধে ইসরাইলকে এক ইঞ্চি ভূমিও দখল করতে দেবো না।
সমগ্র আরববিশ্ব (এবং মুসিলম-বিশ্ব, পশ্চিমারা এ অভিন্নতা ও একাত্মতা বুঝতে পারে না, বা বুঝতে চায় নাÑঅনুবাদক)
সম্পর্কে বলা যায়, এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র কোন জনপ্রিয় ও বিশ্বস্ত বন্ধু নয়। (বলা হয়, আমেরিকা যার বন্ধু, তার ধ্বংসের জন্য কোন শত্রুর প্রয়োজন নেই-অনুবাদক)
আরবরা (এবং বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম) এখনো বিশ্বাস করে (এবং তা সত্য) যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ মিথ্যা অজুহাতে ইরাকে মানুষ হত্যা করেছে। ফলে ফিলিস্তীনের বিরুদ্ধে এই মার্কিন-ইসরাইলী ষড়যন্ত্রের পর আরব শাসকদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা বজায় রাখা কঠিন হবে (এতদিন তারা যা করেছেন জনমতের বিরুদ্ধে গিয়েই করেছেন নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তা করে। তবে এখন সত্যি তা কঠিন হবে-অনুবাদক)
ফিলিস্তীনের বিষয়টি গুরুত্ব না দিলেও নিজ দেশের নাগরিকদের ক্ষোভের বিষয়টি অবশ্যই তাদের চিন্তার কারণ হবে। তবে এর অর্থ এ নয় যে, আরববিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, তবে তারা অনেক বেশী সাবধানী হবে সহযোগিতার বিষয়ে।
সম্পাদকীয় মন্তব্য -
পশ্চিমাদের কান্না আরব ও ফিলিস্তীনী জনগণের প্রতি কৃত অবিচারের কারণে নয় এবং নয় মানবতার প্রতি দরদের কারণে, বরং মার্কিন স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার কারণে এবং আরবজনগণের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের আরববন্ধুদের বিপাকে ফেলে দেয়ার কারণে।
কতটা বিপাকে পড়েছে, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ সউদী আরব।
৬৪ বন্ধুদেশকে সম্বর্ধনা যুক্তরাষ্ট্রের
আবারো প্রকাশ পেলো আমেরিকার দেউলিয়াত্ব! খবরে প্রকাশ, জেরুসালেম ইস্যুতে যারা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ছিলো, বা নিরপেক্ষ ছিলো, এমনকি অন্তত ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত ছিলো ঐ দেশগুলো ‘বন্ধু’ মর্যাদা দিয়ে দেশগুলোর প্রতিনিধিদের সম্বর্ধনা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র! পক্ষে ছিলো মাত্র নয়টি দেশ, তাই পক্ষ বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এ ব্যবস্থা।
সউদী আরব অবশ্য কোন ক্যাটাগরিতেই পড়েনি। কারণ যে কোন কারণেই হোক, সউদী ভোট ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে।
মুসলিম বিশ্বের এখন শুধু কর্তব্য ধৈর্যের সঙ্গে সামনের দিকে পথ চলা এবং ঐক্যবদ্ধ থেকে জিহাদ ফী সাবীলি-ল্লাহর পথে অবিচল থাকা।
দশ দেশে ইসরাইলের ধর্ণা
জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানীরূপে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে বেছে বেছে দশটি দেশের দুয়ারে কূটনৈতিক ধর্ণা দিতে শুরু করেছে ইসরাইল। ছলে বলে কৌশলে, হুমকি ও প্রলোভনে দরিদ্র ও দুর্বল দশটি দেশের সমর্থন আদায়ের জন্য ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। উল্লেখ্য, জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে আমেরিকা ও ইসরাইল জেরুসালেম-সম্পর্কিত ভোটাভুটিতে প্রচ- ধাক্কা খাওয়ার পর এটা হলো ইসরাইলের নতুন কৌশল।
মুসলিম বিশ্বকেও এর মোকাবেলায় কূটনৈতিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। আমাদের কর্তব্য সাধ্যমত চেষ্টা করা, সাহায্য তো আল্লাহর পক্ষ হতে, ইনশাআল্লাহ।