আল কুদসসংখ্যা (৩/২)

আল কুদসসংখ্যা (বিশেষ).

জ্যারড কুশনার, কে তিনি? / বিন সালমানের উত্থান, অতপর?

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

জ্যারড কুশনার, কে তিনি?

জ্যারড কুশনার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর কন্যাপতী, এটা হতে পারে বত্রিশবছর বয়সী মানুষটির শুধু সামাজিক পরিচয়। তিনি ট্রাম্পের প্রধান উপদেষ্টা, এটাও তার প্রশাসনিক পরিচয়মাত্র। এ দু’টো ছাড়া তার ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের যতটুকু পরিচয় জানা সম্ভব তা জেনে রাখাই ভালো। কারণ ঘটনাপ্রবাহের আলোকে তাকেই মনে করা হচ্ছে বর্তমান জেরুসালেমট্রাজেডির প্রকাশ্য পরিকল্পনাকারী।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রেসিডেন্টকর্তৃক জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা এবং মার্কিন দূতাবাস সেখানে সরিয়ে নেয়ার ঘোষণায় মুসলিমবিশ্ব যেখানে উত্তাল, সেখানে সৌদী আরব যাকে বলে একেবারেই নীরব, যা খুবই অবিশ্বাস্য বিষয়। এর জন্য যাকে একমাত্র দায়ী মনে করা হচ্ছে তিনি আর কেউ নন, এই মাত্র বত্রিশ বছর বয়সের যুবক জ্যারড কুশনার। এমনকি মনে করা হয়, সউদী রাজপরিবারে ক্ষমতার যা কিছু তোলপাড় হলো, যা কিছু উত্থান-পতন হলো তাতে বিন সালমানের সফলতা ও স্থায়িত্বের পিছনে জ্যারড কুশনারের নীরব ভূমিকাই ক্রিয়াশীল। মূলত তার দৃঢ় সমর্থনের কারণেই রাজপরিবারের বড় বড় প্রভাবশালী সদস্য আজ আলো থেকে অন্ধকারে ছিটকে পড়েছেন। সউদী রাজপরিবারের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিন সালমান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিঃশর্ত সমর্থন লাভ করেছেন এই কুশনারের মাধ্যমেই।

ট্রাম্পপ্রশাসনের মধ্যপ্রাচ্যনীতি আবর্তিত হচ্ছে এককভাবে কুশনারকে কেন্দ্র করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসনের তাতে তেমন কোন ভূমিকা নেই। এমনকি স্বয়ং প্রেসিডেন্টও যদি চান, কুশনারের পরামর্শের বাইরে কিছু করতে পারবেন বলে মনে করা হয় না। অর্থাৎ কুশনারও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন পর্দার আড়ালে অবস্থানকারী কারো দ্বারা। হয়ত মূলচাবি তারই হাতে। এবিষয়ে শুধু আন্দাযই করা যায়, নিশ্চিতরূপে কিছু বলার সুযোগ নেই।

আমেরিকার একটি বিখ্যাত ও বিত্তশালী পরিবারের সন্তান কুশনার অত্যন্ত মৌলবাদী ইহুদি। ট্রাম্পকন্যা ইভাঙ্কা ইহুদি ধর্মগ্রহণ করার পরই শুধু তাকে তিনি বিবাহ করেছেন। ইসরাইলের সঙ্গেও তার সম্পর্ক আগাগোড়া ধর্মীয় ও আত্মিক। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইহুদি ধর্মজাযক হিরশি জারখী নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, কুশনারের কাছে ইসরাইল রাজনীতির বিষয় নয়; ইসরাইল হচ্ছে তার ধর্ম, তার জীবন এবং তার মরণ। প্রখর মেধার অধিকারী কুশনার ছাত্রজীবনেই পারিবারিক ব্যবসায় জড়িত হন এবং ২০০৬ সালে মাত্র পঁচিশবছর বয়সে তিনি ১০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে নিউইয়র্ক অবজার্ভার পত্রিকার মালিকানা অর্জন করেন। এর দ্বারাই বোঝা যায়, তার গন্তব্য আসলে কত দূর। কুশনারের একটি সেবামূলক পারিবারিক ফাউন্ডেশন রয়েছে, যার বার্ষিক ব্যয় দুই মিলিয়ন ডলারের বেশী। এর মাধ্যমে মূলত ইহুদিদের সেবা করা হয়।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সঙ্গে বহু আগে থেকেই কুশনারের পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো। স্কুল জীবনে নেতানিয়াহু কুশনারের বাড়ীতে রাত যাপন করতেন। বস্তুত ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী আজ যে মহাসুযোগ পেয়েছেন ইহুদিবাদী কর্মকা-কে এগিয়ে নেয়ার জন্য তা কুশনারের প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হতো না। *

 

বিন সালমানের উত্থান, অতপর?

১৯৮৫ সালে জন্মগ্রহণকারী বিন সালমান হচ্ছেন বর্তমানে সউদী আরবের ক্রাউন পিন্স। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী প্রতিরক্ষামন্ত্রী। জ্যারড কুশনার ও  বিনসালমানের পরিচয়ের সূত্র সম্পর্কে যথেষ্ট জল্পনা কল্পনা চলছে। তবে প্রায় সমস্ত পর্যালোচক একমত যে, পারস্পরিক প্রয়োজনই তাদের কাছে এনেছে। অর্থাৎ রাজপরিবারে তার ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো সমর্থন প্রয়োজন ছিলো। পক্ষান্তরে কুশনারের প্রয়োজন ছিলো তার মধ্যপ্রাচ্যনীতি বাস্তবায়নের জন্য একজন কমবয়সী, কমবুদ্ধির সহযোগী বা মিত্রের।

লেখাপড়ায় তিনি  গড়পড়তা পর্যায়ের, অন্তত কুশনার থেকে অনেক পিছনে। কিং সউদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনবিষয়ে সনদ লাভ করেছেন।

কুশনার অত্যন্ত ধীর স্থীর এবং প্রত্যয়ী। তিনি যে কাজ শুরু করেন তা শেষ করেন এবং সফলতার সঙ্গে করেন। পক্ষান্তরে এ পর্যন্ত প্রায় সব বিষয়ে দেখা গেছে তিনি হুটহাট কাজ করেন। তার সিদ্ধান্তগুলো হয় ত্বরিত ও তাৎক্ষণিক এবং সফলতা নেই বললেই চলে। তিনি বলা যায়, ক্ষমতার শীর্ষে উঠে এসেছেন অনেকটা ঝড়ের গতিতে। আর পর্যবেক্ষকদের মতে সেটা সম্ভব হয়েছে মূলত মার্কিন সমর্থনের কারণে। দীর্ঘ দিনের একটি ধর্মপন্থী, রক্ষণশীল দেশ ও সমাজকে তিনি উদার ও খোলামেলা সংস্কৃতির উপর তুলে আনতে চান; এক্ষেত্রেও বলা যায়, তিনি তাড়াহুড়া করছেন, শিকড় থেকে ধীর পর্যায়ে শুরু করেননি এবং জনমত গঠনের চিন্তাই করেননি। এছাড়া তিনি তেলনির্ভরতা কমিয়ে আনার যে অর্থনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন তাতেও রয়েছে অদূরদর্শিতার ছাপ। পর্যালোচকদের যথেষ্ট আশঙ্কা তার এ পদক্ষেপের সফলতা নিয়ে। এর বড় কারণ, তিনি অর্থনৈতিক সংস্কার এবং যুদ্ধ একসঙ্গে শুরু করেছেন। তাছাড়া বিনিয়োগ আকর্ষণের অজুহাতে তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতির অবাধ অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছেন, যা তার জন্য আত্মঘাতী হতে পারে।

তিনি ইয়ামেনে কোন সফলতা অর্জন করতে পারেননি, বরং তার দেশ জাতিসঙ্ঘের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে। তার ইরানী প্রভাব রোধ করার যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে হয়। কাতারের বিরুদ্ধে যে অবরোধ, তা নিশ্চিতভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। তাতে তার আনাড়ীপনা স্পষ্টরূপে ধরা পড়েছে। এটা তিনি করেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট তথা কুশনারের পরামর্শে। কিন্তু পরে ট্রাম্প অবরোধের সমালোচনা শুরু করেন। এখন বিন সালমান এমনভাবে আটকা পড়েছেন যে, না অবরোধ তুলতে পারছেন, না অব্যাহত রাখতে পারছেন। পক্ষান্তরে এখন তিনি কুশনারের প্ররোচনায় এক নতুন পরীক্ষায় নিজেকে নিক্ষেপ করেছেন। হয়ত কুশনার এবং নেতানিয়াহু মিলে তাকে নতুন একটি অনিশ্চিত যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, অর্থাৎ সৌদী আরবকে সামনে রেখে ইরানের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ, যাতে সফল হলে পুরো ফল যাবে ইহুদি বাক্সে, আর ব্যর্থ হলো পুরো দায় চাপবে বিন সালমানের একার ঘাড়ে।

মোটকথা, বিন সালমানের ঝড়োগতির উত্থান তো আমরা দেখলাম, এখন দেখার বাকি তার পরিণতি! কোন হিসাবই বলে না যে, তিনি বেশী দূর যাবেন। তার  সময় খুব সামান্যই মনে হয়। কিন্তু নিজের সঙ্গে দেশটাকে তিনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, যে দেশকে মক্কা-মদীনার সম্পর্কের কারণে পুরা মুসলিমবিশ্ব মনে করে তাদের প্রাণকেন্দ্র! এমন দেশটা তিনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?!

 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা