কীভাবে শোকর আদায় করবো আমি এই নেয়ামতের, এ অমূল্য সম্পদের! কীভাবে, কোন্ ভাষায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো এ সৌভাগ্যের, এ অনন্য গৌরবের! এত অবুঝ নির্বোধ একটি মেয়ের এমন চাঁদ-কপাল! কত দয়াবান আমার খালিক, আমার আল্লাহ!
এত গোনাহগার, নাফরমান বান্দীর এমন ‘খোশজাবীন’! কত মেহেরবান আমার মালিক, আমার আল্লাহ!
দিনের পর দিন আমি ছিলাম গাফিল-উদাসীন, তবু মাওলা আমার মাফ করেছেন, আর দান করেছেন। কত ক্ষমাশীল, কত দানশীল আমার আল্লাহ!
তাঁর যদি দয়া না হতো, ক্ষমা না হতো, আমার কী উপায় হতো! কে আমাকে ছায়া দিতো, মায়া দিতো!
কীভাবে তোমার শোকর আদায় করবো হে আল্লাহ! কোন্ ভাষায় তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো হে আল্লাহ! আমার তো জানা নেই ভাষা ও অলঙ্কার তোমাকে শায়ানে শান কৃতজ্ঞতা নিবেদন করার। আমার অজ্ঞতা ও ক্ষুদ্রতা তুমি ক্ষমা করো হে আল্লাহ এবং কবুল করো আমার সিজদায়ে শোকর।
বান্দার শোকর ছাড়া হয় না আল্লাহর শোকর। তাই মাওলার শোকর আদায় করার পর আমি আদায় করবো আমার বাবার শোকর। কারণ গাফলাতের এই যিন্দেগিতে আল্লাহর কাছ থেকে আমার যা কিছু পাওয়া, তা শুধু বাবার ত্যাগ ও কোরবানির ওছিলায় পাওয়া। সকাল-সন্ধ্যা আমার ছিলো শুধু খেলাধূলা, আর অবহেলা। আমি পড়বো না, বাবা তবু কিতাব মেলে ধরতেন; আমি লিখবো না, তবু তিনি কলম এগিয়ে দিতেন। এত ধৈর্য বাবাদের! কষ্ট হতো আববুর, অনেক কষ্ট হতো, তবু তার মুখের হাসিটি থাকতো অম্লান। বেদনা ও বিষণ্ণতার ছায়া থাকতো শুধু চোখের তারায়। অভাগিনী মেয়ে কী দিতে পারে তোমাকে আববু! জাযাকাল্লাহ! জাযাকাল্লাহ!!
***
আমার জীবনে আজ পরম সৌভাগ্যের দিন। বাইতুল্লাহর ছায়ায় বসে আজ আববু আমার দরসে হাদীছের শুভ উদ্বোধন করেছেন। আলহামদু লিল্লাহ! ছুম্মা আলহামদু লিল্লাহ! আববু বললেন, মা! যত পারো এ পবিত্র উদ্যান থেকে অাঁচল ভরে ফুল তুলে নাও; যত পারো তুলে নাও। এ বাগানে ফুল কখনো ফুরায় না; এবাগানে ফুল শুধু ফোটে; এবাগানের ফুল কখনো ঝরে না।
প্রথম হাদীছটি পড়া হলো; আমি পড়লাম, আববু শুনলেন, তারপর বললেন, আবার পড়ো, বারবার পড়ো; পড়ো, আর হৃদয়ে তার আলো গ্রহণ করো। আমি পড়লাম পুলকিত হয়ে, শিহরিত হয়ে এবং রোমাঞ্চিত হয়ে। বারবার পড়লাম কম্পিত কণ্ঠে এবং স্পন্দিত হৃদয়ে। আমার সামনে যেন উন্মোচিত হলো এক নতুন ‘উফুকে নূর’ ও আলোর দিগন্ত। এ নূরের রৌশনি, এ আলোর উজ্জ্বলতা কখনো শেষ হবে না এবং নিষ্প্রভ হবে না। কিংবা আমার সামনে যেন এক মহাসাগর যার নেই কোন দেশ ও তলদেশ। হায়, এত দিন কোথায় পড়ে ছিলাম আমি! কিসের ঘোরে, কোন্ অাঁধারে!
আববু বললেন, এবার পড়ো আমার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে। আমি পড়লাম এবং এই প্রথম উপলব্ধি করলাম, কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠের মিলনে কী হয়! দূর অতীতের কণ্ঠস্বরের মধুরতা অর্জিত হয়, আর কলবের সঙ্গে কলবের সংযোগে দূর অতীতের ‘কলবানিয়াত’ হাছিল হয়। হায়, এ রহস্য কোথায় লুকিয়ে ছিলো এত দিন! আরো কত রহস্য উন্মোচিত হবে প্রতিদিন!
‘এই মেয়ে’ শোনো! এত দিন তুমি যা-ই ছিলে, আজ তোমার সৌভাগ্যে আমার ঈর্ষা হয়! জানি না, কে তুমি! কে আমি! তবু তোমার প্রতি আমার ঈর্ষা হয়!
তিনটি হাদীছ পড়া হলো আজ। জীবনের চলার পথে প্রথম হাদীছটি কত মূল্যবান পাথেয়-
اغتنم خمسا قبل خمس
اغتنم خمسا قبل خمس : حياتك قبل موتك, و صحتك قبل سقمك, و فراغك قبل شغلك, و شبابك قبل هرمك, و غناك قبل فقرك غناك قبل فقرك
সুবহানাল্লাহ! এর চেয়ে মূল্যবান উপদেশ কী হতে পারে জীবনের জন্য! হায়াতের পর মউত অবশ্যই আসবে। আর মউত যখন এসে যাবে, হায়াত আর ফিরে আসবে না। দুনিয়ার সকল মাল-দওলতের বিনিময়েও হায়াতের সামান্য একটি অংশও আর ফিরে পাওয়া যাবে না। সুতরাং মউত আসার আগে আগে হায়াতকে কাজে লাগাও। হায়াতের অপচয় করো না।
স্বাস্থ্য ও সুস্থতা আল্লাহর পক্ষ হতে বিরাট নেয়ামত। কত বড় নেয়ামত তা মানুষ বুঝতে পারে অসুস্থ হলে। অসুস্থ মানুষ, আর মৃত মানুষে খুব বেশী পার্থক্য নেই। সুতরাং অসুস্থতা এসে পড়ার আগে সুস্থ অবস্থতায় যত পারো নেক কাজ ও ভালো কাজ করো।
মানুষের জীবনে একটা সময় থাকে যখন সে খুব অবসর থাকে। কিন্তু সে বুঝতেও পারে না, ধীরে ধীরে তার ব্যস্ততা কত বেড়ে যাচ্ছে। তখন ইচ্ছে থাকলেও আর কাজ করা যায় না। সুতরাং অবসর দিনগুলোতে যত পারো কাজ করো।
জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হলো যৌবনকাল। শক্তিতে শাহসে, উদ্যমে ও মনোবলে যৌবনের কোন তুলনা নেই। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তার যৌবনকাল অযথা নষ্ট করে ফেলে, তারপর বার্ধক্যের রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে ‘লাচার’ হয়ে পড়ে। তখন ইচ্ছে থাকলেও ইবাদত করা সম্ভব হয় না।
সচ্ছলতা ও প্রাচুর্য খুব ক্ষণস্থায়ী। আজ আছে, কাল নেই। আজকের আমীর যে কোন মুহূর্তে হয়ে যেতে পারে কালকের ফকীর। সুতরাং তোমার সম্পদ সঞ্চিত না করে শরীয়তের আদেশ মত আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করো।
এভাবে একে একে তিনটি হাদীছ পড়া হলো; যেন মহাসাগরের তলদেশ থেকে তিনটি মুক্তা তুলে আনা হলো! আরো আছে কত অজস্র মুক্তা! জীবন তোমার শেষ হয়ে যাবে হে ডুবুরী, এ সগারের মুক্তা তুলে আনা শেষ হবে না।
ইলমে নববীর এই যে মহাসাগর, তা পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন দেখছে আজ ক্ষুদ্র, তুচছ, অক্ষম ও দুর্বল সামান্য একটি মেয়ে! কীভাবে পাড়ি দেবে! সময়ের কিশতি যে অনেক ছোট! তাতে যে অনেক ফুটো! হে আল্লাহ, বান্দী তোমার অভাগিনী, তাকে তোমার রহমতের কিশতিতে তুলে নাও।
ভুল করেছি, অনেক ভুল করেছি। ক্ষুদ্র জীবনের সামান্য কিছু সময়ের বিপুল অপচয় করেছি। ‘ফারাগাকা কাবলা শুগলিকা’-এর সতর্কবাণী ভুলে গিয়েছি, ভুলে গিয়ে ‘শুগল’-এর চোরাবালিতে আটকা পড়েছি। এখন আমি উদ্ধার পেতে চাই হে আল্লাহ! আর তোমার রহমত ছাড়া আমার উদ্ধারের কোন উপায় নেই হে আল্লাহ! দাসীর উপর তোমার করুণার শিশির ঝরবে না হে আল্লাহ! বান্দীর উপর তোমার রহমতের শবনম পড়বে না হে আল্লাহ! কবে! কবে!!
কানে কানে কে যেন বলে, ‘আলা ইন্না নাছরাল্লাহি কারীব’।
আমি আশা করি হে আল্লাহ! আমি বিশ্বাস করি হে আল্লাহ! দাসীর ডাকে তুমি সাড়া দেবে। বান্দীর ফারয়াদ তুমি শোনবে। তুমি যে বলেছো, লা-তাকনাতূ! ঘুম ছিলো, গাফলাত ছিলো, তুমি তা দূর করেছো! খেলাধূলা ও হেলা-অবহেলা ছিলো, তুমি উদ্দীপনা দান করেছো। ভীতি ও ভীরুতা ছিলো, তুমি বল ও মনোবল দান করেছো। না চেয়ে এত কিছু পেয়েছি তোমার দয়ায়, এখন হাত পেতে পাবো না! আমি আশা করেছি, তুমি নিরাশ করো না হে আল্লাহ! জীবন-বৃক্ষে যে ক’টি সবুজ পাতা আছে হে আল্লাহ, তা যেন শুকিয়ে না যায়!
হে আল্লাহ! আমাকে এবং পুষ্পের সকল বন্ধুকে কোরআন ও সুন্নাহর আলোকিত পথে অবিচল থেকে চলার তাওফীক দান করো, আমীন।
পুষ্পের প্রিয় ভাই ও বোন! তোমরা দু‘আ করো আমার জন্য, আমি দু‘আ করি তোমাদের জন্য। তারপর এসো আমরা সবাই দু‘আ করি আববুর জন্য। (আমি লিখতে পারতাম, ‘পুষ্পের সম্পাদকের জন্য’, এমনকি লিখতে পারতাম, ‘সম্পাদক ভাইয়ার জন্য’, তবে সে লেখা হতো, মস্তিষ্কের, অথচ আমার এ লেখা হৃদয়ের। হৃদয়ের লেখায় মস্তিষ্কের শব্দ, আর মস্তিষ্কের লেখায় হৃদয়ের শব্দ ব্যবহার করা সঙ্গত নয়। সুযোগ পেয়ে দেখো, একটু সম্পাদনার ‘মশক’ করে নিলাম।)
একটা কথা তোমাদের আমি বিশ্বাস করতে বলবো; যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকে দেখে আসছি, আমার আববু যতটুকু আমাদের জন্য, ঠিক ততটুকু তোমাদেরও জন্য! দিনের ব্যস্ততায়, রাতের সাধনায় আমরা শুধু দেখি তাকে কখনো দূর থেকে, কখনো নিকট থেকে, আর তিনি নিমগ্ন থাকেন ঘরে ঘরে যত প্রদীপ আছে তার আলো উজ্জ্বল করার জন্য। আববু আমার আল্লাহর রহমতের ছায়া সবার জন্য। আর এখন এ যুগের প্রখর রোদে রহমতের একটু ছায়ার আমাদের বড় প্রয়োজন।