জুমাদাল আখেরা ১৪৩১হিঃ (১৬)

তোমাদের জন্য

আলোর লেখা. লেখার আলো

লিখেছেনঃ ইবনে মিসবাহ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
লেখা হয় কীভাবে? কলম থেকে কাগজের বুকে একটি লেখা আসে কীভাবে? আমারই কাছে ছিলো আমার এ প্রশ্ন অনেক দিন থেকে। প্রশ্ন করেছি কখনো শব্দে, কখনো নিঃশব্দে; কখনো দিনের কোলাহলের মধ্যে ডুবে থেকে, কখনো রাতের নির্জনতায় আত্মনিমগ্ন হয়ে। নিজেরই কাছে জানতে চেয়েছি কী এর জবাব? নিজেকে প্রশ্ন করে নিজেরই কাছে জবাব চাওয়া, এটা অন্য জিনিস। এটা যদি করা যায়, নিজের সঙ্গে অত্যন- অন-রঙ্গতা অর্জন করা যায়। নিজের সঙ্গে যার অন-রঙ্গতা নেই জীবনটা তার কষ্টদায়ক একটা নিঃসঙ্গতা দ্বারা পীড়িত হয়। অনেক কিছু আমার থাকতে পারতো, কিন' অনেক কিছু আমার ছিলো না। সে জন্য অনুতাপের দহনে এখনো আমি দগ্ধ হই। কিন' এই একটি জিনিস আমার ছিলো। নিজের সঙ্গে অন-রঙ্গতা ছিলো, এখনো আছে। পরিমাণ ও গভীরতার কথা বলছি না, শুধু বলছি, ছিলো। নিজের সঙ্গে নিজের অন-রঙ্গতাকে অবলম্বন করেই অনেক না থাকার দারিদ্র্যের মধ্যেও আমি বেঁচে ছিলাম, এখনো বেঁচে আছি। চারপাশে যখন কোলাহল থাকে, আমি অনুভব করি, এ কোলাহল আমার জন্য নয়, আমাকে বিভ্রান- করার জন্য। কোলাহলের মধ্যে থেকেও কোলাহলকে এড়িয়ে আমি নিজের সঙ্গ অর্জন করি। যখন নেমে আসে রাতের নির্জনতা, চারপাশে যখন তৈরী হয় নিদ্রার নিঝুমতা, তখনো অনুভব করি, আমি একা নই। তখনো নিজের সঙ্গ অর্জন করি। নিজের সঙ্গে কথা বলি। নিজেকে প্রশ্ন করি এবং নিজেরই কাছে জবাব চাই। যখন প্রশ্ন করার মত কিছু থাকে না, তখন অন-ত এইটুকু জিজ্ঞাসা করি, কেমন আছো? কী করছো? কী ভাবছো? অনেক দিন থেকেই নিজের কাছে আমার প্রশ্ন ছিলো, লেখার জন্ম হয় কীভাবে? কলম থেকে কাগজের বুকে লেখা নেমে আসে কীভাবে? এ প্রশ্নের জবাব ছিলো না আমার কাছে। তবু আমি অন্যকে জিজ্ঞাসা করিনি; অন্যকারো কাছে জবাব চাইনি। না কিতাবের কাছে, না মানুষের কাছে, এমনকি সবচে’ প্রিয়জনের কাছেও নয়। নিজেকে বলেছি, আমার তাড়াহুড়া নেই। যখন তুমি জবাব খুঁজে পাবে, আমাকে জানিও। *** একদিন হঠাৎ একটি ব্যথা পেলাম। অনেকে অনেকভাবে ব্যথা দেয়, কিন' আমরা ব্যথা পাই না। কারণ ব্যথা পাওয়ার কৌশল আমরা জানি না। মুখে স্নিগ্ধ হাসি ফুটিয়ে ব্যথাটুকু শুষে নিতে হয় নিজের মধ্যে, কাগজ যেভাবে শুষে নেয় পড়ে যাওয়া পানি। আর বলতে হয়, শব্দ করে, কিংবা মনে মনে, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন। তখন মানুষ ব্যথা পায়। কেউ ব্যথা দিলো, তুমি ক্রদ্ধ হলে এবং... তাহলে ব্যথাটা তুমি আর পেলে না। সে ব্যথা দিলো, ব্যথাটা তোমার কাছে এলো, কিন' ব্যথাটা তুমি হারিয়ে ফেললে। এক প্রিয়জন একদিন আমাকে একটি ব্যথা দিলো, আর ব্যথাটি আমি ‘পেলাম’। ব্যথা যেভাবে পেতে হয় সেভাবেই পেলাম। এবং আশ্চর্য! দূরে একটি গাছের ছায়ায় গিয়ে বসলাম। আমি নিজে নই, অন্য কেউ, যাকে আমি দেখি না এবং হয়ত জানি না, আমার হাতে কলম তুলে দিলো, একটুকরো কাগজের বুকে সুন্দর একটি লেখা ফুটে উঠলো, অবাক হয়ে দেখি, কলম থেকে কালি ঝরছে এবং আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে! ব্যথার অশ্রু! নিজের কাছে ঐ যে প্রশ্ন ছিলো, যার জবাব তখন পাইনি, এখন পেলাম। কী সেই জবাব? মানুষ যখন ব্যথা পায়, আর কলমের কালি ও চোখের পানি মিশে যায় তখন লেখা হয়, তখন কলম থেকে কাগজের বুকে লেখা নেমে আসে। আমি যদি কিতাবের কাছে প্রশ্ন করতাম এবং কিতাবের পাতায় জবাব খুঁজতাম, হয়ত কিছু একটা পেতাম, কিন' চোখের পানিতে ধোয়া এমন জবাব! *** একদিন হঠাৎ একটি আনন্দ পেলাম। অনেকে অনেকভাবে আমাদের আনন্দ দেয়, কিন' আমরা আনন্দ পাই না। কারণ আনন্দ পাওয়ার কৌশল আমরা জানি না। আনন্দে উচ্ছ্বসিত ও আত্মহারা না হয়ে সবটুকু উচ্ছ্বাস ও উব্দেলতা শুষে নিতে হয় নিজের মধ্যে কাগজ যেভাবে শুষে নেয় পড়ে যাওয়া পানি। আর বলতে হয়, শব্দ করে, কিংবা মনে মনে আলহামদু লিল্লাহ! জাযাকাল্লাহ! তখন মানুষ আনন্দ পায়। কেউ তোমাকে আনন্দ দিলো, তুমি উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হলে, আর শোকর ও কৃতজ্ঞতার কথা ভুলে গেলে এবং... তাহলে আনন্দটা তুমি আর পেলে না, আনন্দটা তুমি হারিয়ে ফেললে। এক প্রিয়জন একদিন আমাকে একটি আনন্দ দিলো, আর আনন্দটি আমি পেলাম। আনন্দ যেভাবে পেতে হয় সেভাবেই পেলাম। এবং আশ্চর্য! ভিতরে একটি ঢেউ জাগলো। মসজিদের পাশে দিঘীর পাড়ে গিয়ে বসলাম। আমি নিজে নই, অন্য কেউ, যাকে অনুভব করি, কিন' স্পর্শ করতে পারি না, আমার হাতে কলম তুলে দিলো, একটুকরো কাগজের বুকে সুন্দর একটি লেখা ফুটে উঠলো। অবাক হয়ে দেখি, কলম থেকে কালি ঝরছে, এবং আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে! আনন্দের অশ্রু! নিজের কাছে ঐ যে প্রশ্ন ছিলো, যার জবাব তখন পাইনি, এখন পেলাম। কী সেই জবাব? মানুষ যখন আনন্দ পায়, আর কলমের কালি ও চোখের পানি মিশে যায় তখন লেখা হয়, তখন কলম থেকে কাগজের বুকে লেখা নেমে আসে। আমি যদি মানুষের কাছে প্রশ্ন করতাম এবং মুখের ভাষায় জবাব খুঁজতাম, হয়ত কিছু একটা পেতাম, কিন' চোখ থেকে ঝরা শিশিরে ধোয়া এমন জবাব! *** একদিন এক ভিখারিণী মা এসে দাঁড়ালো আমার দুয়ারে। কঙ্কালসার, সে এবং তার কোলের সন-ান। আমি তাকালাম আমার সন-ান এবং তার মায়ের দিকে। কত ভিন্নতা, অথচ কত অভিন্নতা! হৃদয় বিগলিত হলো! মায়ের চোখে খুশির ঝিলিক দেখা দিলো। আমি আকাশের করুণা লাভ করলাম। আকাশ থেকে করুণা ঝরে, তবু আমরা আকাশের করুণা পাই না। কারণ আমরা মনে রাখি না, ‘তুমি যদি তাকে আহার দান করতে, আমাকে সেখানে পেতে।’ ভিখারিণী মায়ের চোখে খুশির ঝিলিক দেখা দিলো এবং আকাশ থেকে করুণা ঝরলো, আমি আকাশের করুণা লাভ করলাম। এবং আশ্চর্য! আত্মার তৃপ্তি ও প্রশানি- নিয়ে লেখার টেবিলে ফিরে এলাম। আমি নিজে নই, অন্য কেউ, যিনি দেখেন, কিন' দেখা দেন না, আমার হাতে কলম তুলে দিলেন, একটুকরো কাগজের বুকে একটি সুন্দর লেখা ফুটে উঠলো। আমার মনে হলো, হাতের কলমটি থেকে যখন কালি ঝরছিলো, আকাশ থেকে তখন করুণার শিশির ঝরছিলো। নিজের কাছে যে প্রশ্নটি আমার জমা ছিলো, নিজের কাছ থেকেই এখন তার জবাব এলো। আকাশ থেকে যখন করুণার শিশির ঝরে এবং তা কলমের কালিতে মিশে যায়, সেই কালিতে তখন শিশিরস্নাৎ একটি পবিত্র লেখার জন্ম হয়। আমি যদি আমার প্রিয়তমের কাছে প্রশ্ন করতাম এবং তার মুখ থেকে জবাব চাইতাম, অবশ্যই সুন্দর কোন জবাব পেতাম, কিন' আকাশের করুণাশিশিরে স্নাত এমন একটি পবিত্র জবাব! *** তুমি যদি লেখা চাও কাগজের কাছে, কলমের কাছে এবং কলমের কালো কালির কাছে, পাবে না। তুমি যদি লেখা চাও, মসি-ষ্কের কাছে, চিন-ার কাছে এবং তোমার জ্ঞানের কাছে, পাবে না। লেখা তুমি পাবে ব্যথা ও আনন্দের অশ্রুজলের কাছে! লেখা তুমি পাবে আকাশ থেকে ঝরা শিশিরের কাছে! তোমাকে জানতে হবে, ব্যথা ও আনন্দ কীভাবে ধারণ করতে হয় এবং আকাশের করুণা-শিশিরে কীভাবে সিক্ত হতে হয়। তোমার কাছে ব্যথা আছে, আনন্দ আছে; চোখের পানি ও অশ্রুবিন্দু আছে এবং আছে আকাশ থেকে ঝরা করুণার শিশির, তারপর হতে পারে, তোমার কলম থেকে কালি ঝরে না। কাগজের বুকে কোন লেখার ছবি উদ্ভাসিত হয় না, তখন বুঝতে হবে, লেখা পাওয়ার শোকরের পর পর্দার আড়াল থেকে কেউ এখন দেখতে চান লেখা না পেয়ে কেমন হয় তোমার ছবর! শোকরে ছবরে তোমার লেখা যখন একাকার হবে, তখনই তোমার কলম থেকে মানুষ পাবে আলোর লেখা এবং লেখার আলো।
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা