কাকে বলে ইসলাম?
লিখেছেনঃ
মাওলানা ইয়াহয়া (রহ)
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
আমরা আগেই জেনেছি যে, কালিমায়ে তাওহীদ হচ্ছে সমগ্র দ্বীনের মূল বুনিয়াদ। বিশ্বাসের সঙ্গে এই কালিমার উচ্চারণ দ্বারা একজন মানুষ শিরক ও কুফুরির অন্ধকার কাঁটাবন থেকে বের হয়ে ঈমানের আলোকিত উদ্যানে প্রবেশ করে এবং মুসলিম উম্মাহর দ্বীনী ও ঈমানী ভাই হয়ে যায়। তখন জন্মসূত্রে প্রজন্ম পরম্পরায় একজন মুসলিম যে সকল সুবিধা ও অধিকার ভোগ করে সেও তা ভোগ করবে এবং সমান মর্যাদার দাবীতেই ভোগ করবে। তদ্রূপ দায়দায়িত্ব বহন করার ক্ষেত্রেও একই কথা। একজন ‘জন্মমুসলিম’ যে সকল দায়দায়িত্ব বহন করে সেও তা বহন করবে এবং সমান মর্যাদার দাবীতে। তার রক্ত আমাদের জন্য তেমনি হারাম যেমন আমাদের পরস্পরের জন্য পরস্পরের রক্ত হারাম। তার ইজ্জত-আবরু তেমনি সুরক্ষিত যেমন আমাদের পরস্পরের ইজ্জত-আবরু পরস্পরের কাছে সুরক্ষিত। আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘লাহূ মা লাকুম ও আলাইহি মা আলাইকুম’।
এমনকি একজন কাফির, যে তার জীবনের সুদীর্ঘ একশ বছর কুফুরির অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিলো, বরং নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি ও সর্বশক্তি দিয়ে সে ইসলামের ক্ষতি সাধনে সচেষ্ট ছিলো। এখন যুদ্ধের ময়দানে তলোয়ারের নীচে হঠাৎ কালিমা উচ্চারণ করে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণ করলো, সেও ঈমানের আলোকিত অঙ্গনে প্রবেশ করে মুমিন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে বলে গণ্য হবে। এমনই শক্তিশালী ও বিপ্লব সৃষ্টিকারী এই কালিমায়ে ঈমান! সুতরাং এই কালিমার হাকীকত সম্পর্কে অবগত হওয়া কত না জরুরি হবে এবং কত না আফসোসের বিষয় হবে একজন মুমিনের এ সম্পর্কে অজ্ঞ ও অনবগত থাকা!
একথা আমাদের জানা থাকা দরকার যে, কালিমায়ে ঈমান নিছক কোন সংবাদ-বাক্য নয়। অর্থাৎ এর মাধ্যমে একজন মানুষ এ বিষয়ে সংবাদ বা খবর দান করে না যে, তার অন্তরে ঈমান রয়েছে। যদি তাই হতো তাহলে তাকে সত্যবাদী যেমন বলা যেতো তেমনি মিথ্যাবাদী বলারও অবকাশ থাকতো। কারণ যে কোন খবর সত্তাগতভাবে সত্য বা মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। অর্থাৎ তার এই খবর যদি তার ভিতরের অবস্থার অনুরূপ হয় তাহলে তো সে সত্যবাদী, কিন্তু যদি এই খবর তার ভিতরের অবস্থার অনুরূপ না হয় তাহলে সে মিথ্যাবাদী। দ্বিতীয়ত খবর বা সংবাদ দ্বারা কখনো কোন দুই পক্ষের মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টি হয় না; সম্পর্ক সৃষ্টি হয় কোন চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার দ্বারা, সুতরাং কালিমায়ে তাওহীদ বা কালিমায়ে ঈমান কোন সংবাদ-বাক্য নয়, বরং এটি হচ্ছে ‘সৃজনবাক্য’। অর্থাৎ আল্লাহকে একটি অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি প্রদানের জন্য বান্দা এই কালিমা উচ্চারণ করে, যার অস্তিত্ব এই কালিমা উচ্চারণের পূর্বে ছিলো না। এ কারণেই যে কোন পরিস্থিতিতে এবং যে কোন অন্তর্নিহিত কারণেই বান্দা এই কালিমা উচ্চারণ করে তা গ্রহণ করা অবধারিত হয়ে যায়। একথা বলে তার কালিমা প্রত্যাখ্যান করার কোন অবকাশ নেই যে, সে তো মিথ্যা বলেছে, কারণ এটা তো খবর বা সংবাদ নয়; তদ্রূপ একথা বলারও অবকাশ নেই যে, সে তো মৃত্যুর ভয়ে কালিমা উচ্চারণ করেছে, কারণ চুক্তি বা অঙ্গীকারের সম্পর্ক হলো তা রক্ষা করা না করার সঙ্গে। অঙ্গীকার করার পর যদি তা রক্ষা না করা হয় তাহলে তার সাজা হবে, আর রক্ষা করলে হবে পুরস্কার।
এজন্যই কালিমাতুল ঈমানকে কালিমাতুল আহ্দও বলা যায়। তো এই কালিমার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহকে কী অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি প্রদান করছে? এই প্রতিশ্রুতি প্রদান করছে যে, মৃত্যু পর্যন্ত সে শুধু আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্ব করবে; আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত ও দাসত্ব করবে না। কারণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহের অস্তিত্বই তো নেই, যে মানুষের ইবাদত ও দাসত্বের হকদার হতে পারে।
সে আরো অঙ্গীকার প্রদান করে যে, আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্ব সে নিজের ইচ্ছামত করবে না, বরং মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকামত করবে। আল্লাহর ইবাদত, দাসত্ব ও আনুগত্য করার ক্ষেত্রে তাঁর পবিত্র জীবনই হবে আদর্শ এবং ইবাদত ও দাসত্বের মাপকাঠি। এজন্যই কালিমায়ে শাহাদাতে বলা হয়, আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, আর স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহম্মদ হলেন আল্লাহর আবদ এবং তাঁর রাসূল। অর্থাৎ আবদিয়াত ও দাসত্ব কাকে বলে এবং তা কীভাবে করতে হয় সেটা তাঁর কাছ থেকেই গ্রহণ করতে হবে, কেননা তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত হয়েছেন আপন জীবন ও কর্ম দ্বারা মানুষকে আবদিয়াত শিক্ষা দান করার জন্য। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-
(হে নবী!) আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো (অর্থাৎ তাঁর ইবাদত ও দাসত্ব করতে চাও) তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, এতে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন (অর্থাৎ তোমাদের ইবাদত ও দাসত্ব গ্রহণ করবেন)।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিটি আদেশ ও নিষেধ সে মান্য করবে, এক্ষেত্রেও সে নিজের বুদ্ধি ও যুক্তির বা অন্য কারো পথনির্দেশের অনুগত হবে না। কারণ আল্লাহর পক্ষ হতে রিসালাত একমাত্র তাঁর জন্য নির্ধারিত, অন্য কারো জন্য নয়। মোটকথা, কালিমার মাধ্যমে আমরা অঙ্গীকার-আবদ্ধ হলাম যে, একমাত্র মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকা অনুসরণের মাধ্যমে আমরা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত ও দাসত্ব করে যাবো। এটাই হলো ঈমানের হাকীকত ও তাৎপর্য এবং এটাই হলো কালিমাতুল ঈমান বা কালিমাতুল আহদ-এর মর্মবাণী। সুতরাং কেউ যদি রিসালাতকে অস্বীকার করে, বা তাতে কাউকে শরীক করে, বা রাসূলের বাণী সুন্নাহকে হুজ্জত ও প্রমাণরূপে গ্রহণ করতে অস্বীকৃত হয় তাহলে অবশ্যই অবশ্যই সে কালিমাতুল ঈমানের মাধ্যমে কৃত প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার ভঙ্গ করলো এবং ঈমানের গণ্ডিী থেকে বের হয়ে গেলো। আল্লাহ প্রত্যেক মুসলমানকে গোমরাহি ও ভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করুন, আমীন।
রিসালাতের ন্যায় মা‘আদ বা আখেরাতের জাযা ও সাজা-এর বিশ্বাসও আল্লাহর প্রতি ঈমানেরই অনিবার্য দাবী। কারণ মা‘আদ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার অনেক গুণ ও ছিফাতের লাযিম বা অনিবার্য ফল। যেমন আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতে আদল ও ন্যায়পরতা, ছিফাতে রাহমানিয়াত এবং ছিফাতে রুবূবিয়াত।
ন্যায়পরতার অনিবার্য দাবী হলো অনুগত ও অবাধ্য বান্দার প্রতি অভিন্ন আচরণ না করা। এটা কীভাবে ইনছাফ ও আদল এবং ন্যায়পরতা ও সুবিচার হতে পারে যে, দুনিয়াতে যারা আল্লাহর আনুগত্য করেছে এবং যারা আনুগত্য করেনি তারা উভয়ে সমান হবে। না, বরং আখেরাতে হাশরের ময়দানে ‘ওয়ামতাযুল ইয়াওমা আইয়ুহাল মুজরিমূন’ (হে অপরাধিগণ আজ তোমরা (নেককারদের থেকে) পৃথক হয়ে যাও)- এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি তার ছিফাতুল আদল-এর প্রকাশ ঘটাবেন।
কোরআনের পরিষ্কার ঘোষণা হলো- ‘আল্লাহ তা‘আলা তিলপরিমাণও যুলুম করবেন না।’ এবং ‘সুতরাং যে তিলপরিমাণ নেক কাজ করবে সে তা দেখতে পাবে, আর যে তিলপরিমাণ মন্দ কাজ করবে সেও তা দেখতে পাবে।’ তো ছিফাতুল আদল-এর লাযিম বা অনিবার্য দাবী হলো মা‘আদ বা মানবের পুনরুত্থান এবং বিচারের অনুষ্ঠান।
তদ্রূপ আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতে রাহমানিয়াতেরও লাযিম বা অনিবার্য দাবী হলো বিচারের মাধ্যমে নেককার ও বদকারদের মাঝে ফায়ছালা করা এবং নেককারকে পুরুস্কৃত করা (এবং বদকারকে শাস্তি প্রদান করা)। একারণেই সূরাতুল ফাতিহায় আর-রহমান ও আর-রাহীম গুণদুটি উল্লেখের পর ‘মালিকি ইয়াওমিদ্-দীন বা বিচারদিবসের মালিক বলা হয়েছে। যেহেতু তিনি রাহমান, রাহীম সেহেতু অবশ্যই তিনি বিচার দিবস অনুষ্ঠিত করবেন এবং পুরস্কার ও তিরস্কারের ব্যবস্থা করবেন। তাই ইরশাদ হয়েছে- দয়া ও রহমতকে তিনি নিজের কর্তব্য বলে স্থির করেছেন। সুতরাং অবশ্যই তিনি বিচারদিবসে তোমাদের সকলকে একত্র করবেন, আর সেদিনের আগমনে কোন সন্দেহ নেই।
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, হাশর-নশর, হিসাব-কিতাব ও জান্নাত-জাহান্নাম হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতে রাহমাতের লাযিম বা অনিবার্য দাবী।
তদ্রূপ মা‘আদ বা বিচারদিবস হচ্ছে ছিফাতে রাবূবিয়াতেরও লাযিম বা অনিবার্য দাবী। কারণ রাবূবিয়াতের দু’টি দিক রয়েছে। প্রতিপালন করতে গিয়ে প্রতিপালনেরই স্বাভাবিক তাকাযা হিসাবে বান্দাকে প্রিয় ও অপ্রিয় বহু অবস্থার সম্মুখীন করা হয়। প্রিয় অবস্থার সময় শোকর করা, আর অপ্রিয় অবস্থায় ছবর করা হচ্ছে বান্দার কর্তব্য। তো যারা আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতে রাবূবিয়াতের তাকাযা পুরা করবে তাদের পুরস্কৃত করা, আর যারা তা পুরা করবে না তাদের সাজা দেয়া, এটাই তো ছিফাতে রাবূবিয়াতের লাযিম বা অনিবার্য দাবী। তাই তো সুরতুল ফাতিহায় প্রথম গুণ হিসাবে রাব্বুল আলামীন উল্লেখিত হয়েছে। অর্থাৎ রাবূবিয়াত ও রাহমানিয়াত, উভয়েরই অনিবার্য দাবী হলো মা‘আদ। সুতরাং মা‘আদ বা বিচারদিবসকে অস্বীকার করার অর্থই হলো আল্লাহ তা‘আলার ছিফাতে আদ্ল, ছিফাতে রাহমানিয়াত ও ছিফাতে রাবূবিয়াতকে নাকচ করা।
মোটকথা, উপরের সুদীর্ঘ ও সুবিশদ আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কাররূপে সাব্যস্ত হয়ে গেলো যে, ঈমান শুধু তাওহীদ ফিয্যাত-এর নাম নয়। ঈমান শুধু আল্লাহর যাত ও সত্তার এককত্বের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান করার নাম নয়, বরং রিসালাত ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস আনয়নও ঈমানের অনিবার্য দাবী। আল্লাহর যাত ও ছিফাতের একত্ব, মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের প্রতি স্বীকৃতি এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস, এই তিনের সমুষ্টি হলো ঈমান। আর গোটা দ্বীন ও শরীয়াত হলো ঈমানের শাখা-প্রশাখা। একারণেই বলা হয়েছে, ঈমান হলো সত্তরের অধিক শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট, যার মধ্যে সর্বোচ্চ হলো শাহাদাতের কালিমা, আর সর্বনিম্ন হলো পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূর করা।
সুতরাং কেউ যদি বলে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ তো মানি এবং মুহম্মদ রাসূলুল্লাহও স্বীকার করি, কিন্তু আখেরাত ও বিচারদিবস এবং মীযান ও জান্নাত-জাহান্নাম স্বীকার করি না; যদি কেউ এরূপ বলে তাহলে তার ঈমান থাকবে না।
অন্যভাবে বলা যায় যে, ঈমান হচ্ছে গোটা দ্বীন ও শরীয়াতের সংক্ষিপ্তরূপ, আর দ্বীন ও শরীয়াত হচ্ছে কালিমায়ে তাওহীদেরই বিশদরূপ। ফলত কালিমায়ে তাওহীদ উচ্চারণ করার অর্থই হলো জীবনের সকল ক্ষেত্রে দ্বীন ও শরীয়াতের আনুগত্য গ্রহণ করা। সুতরাং যারা কালিমায় তো মুমিন, কিন্তু রাজনীতে দ্বীন ও শরীয়াত থেকে মুক্ত রাখতে চায়, কিংবা অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে যারা অন্য ব্যবস্থায় বিশ্বাসী, যাদের রাজনীতি গণতন্ত্রের অধীন, যাদের সমাজনীতি কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্রের অধীন, যাদের অর্থনীতি পুঁজিবাদের অধীন তাদের কর্তব্য নিজেদের ঈমান সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন হওয়া।