কাশ্মীরসংখ্যা

কচি ও কাঁচা

একটি ছোট্ট ঘটনা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

একটি ছোট্ট ঘটনা

কাশ্মীরের এক ছোট্ট ছেলের একটি ছোট্ট ঘটনা। সারা পৃথিবীতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। পৃথিবীতে এখন খুব কম মানুষের বুকে কোমল হৃদয় আছে। যাদের বুকেকোমল হৃদয় আছে তাদের সবার চোখে পানি এসেছে এই ঘটনা পড়ে। এমনকি ঐ হিন্দু সিপাহীটারও চোখ দু’টো ভিজে উঠেছিলো, যাকে নিয়ে ঘটনা! কী সেই ঘটনা!

ছেলেটির নাম নাহিদ; সাতবছর বয়স। শহরের বাড়ী থেকে একটু দূরে তার স্কুল। প্রতিদিন স্কুলে যায়, আসে। আসা-যাওয়ার পথে একটা সিপাহীকে সে প্রতিদিন দেখতে পায়।

মায়ের কাছে শুনেছে, ভারতীয় সৈন্যরা তার বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। হঠাৎ তার কী মনে হলো, মাকে বললো, মা, আমাকে দু’টো কেক বানিয়ে দিয়ো।

মা অবাক হলেন! ছেলে তো কখনো কিছু আব্দার করে না। আব্দার করবে কী, ওকে তো জোর করেও খাওয়ানো যায় না! শুধু পড়ালেখা। তারপর চুপ করে বসে থাকা। ...

আজ হঠাৎ ছেলের মধ্যে এরূপ আশ্চর্য পরিবর্তন!

যাক, মা খুশী হলেন! যা হোক, ছেলে আজ কিছু একটা আব্দার করেছে। মা বড় যত্ন করে কেক তৈরী করে দিলেন তবে তার এত ব্যস্ততা ছিলো যে, একটু কাছে বসে আদর করে কেকদু’টো খাওয়াবেন, সে অবসর হলো না। অনেক সময় মা সন্তানের জন্যই সন্তানের কাছে বসার অবসর করে উঠতে পারেন না। তবে নাহিদ এত ভালো ছেলে যে, মায়ের মনের কথাগুলো যেমন বুঝতে পারে, তেমনি মায়ের মনের কষ্টগুলোও বুঝতে পারে।

সেদিন কিন্তু নাহিদ এমনিতেও খুশী হলো, মা বসতে পারেননি বলে। নইলে তাকেই বলতে হতো। মা, তুমি যাও; আমি খেয়ে নেবোখন!

পরের দিন স্কুলে যাওয়ার পথে সিপাহীটাকে দেখতে পেলো নাহিদ।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে সিপাহীটার দিকে এগিয়ে গেলো। একটুও ভয় পেলো না! সিপাহীটাও অবাক! কাশ্মীরী বাচ্চা তো সিপাহী থেকে দূরেই থাকে!

নাহিদ কাগজে মোড়ানো কেকদু’টো পকেট থেকে বের করে সিপাহীটার সামনে এগিয়ে ধরে কাকুতির সঙ্গে বললো, সিপাহীজী, দেখো তোমার জন্য কত মজাদার কেক এনেছি, প্লিজ আমার আব্বুকে ছেড়ে দাও! ....

স্থানকাল ভুলে সিপাহীটা নাহিদকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, বেটা, কেক তুমি নিয়ে যাও। আমি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবো, তোমার পিতা যেন...

 

আমার মনে পড়ে এবং ভালো লাগে!

এখন তোমাদের শৈশবে যেমন কাশ্মীরে আগুন জ্বলছে। এখন তোমাদের শৈশবে যেমন কাশ্মীরে রক্ত ঝরছে! আমরা যখন শিশু ছিলাম, ঠিক তোমাদের মত, তখন আমাদের শৈশবেও কাশ্মীরে আগুন জ্বলতো এবং রক্ত ঝরতো।

এখন যেমন সারা কাশ্মীরজুড়ে হিন্দুস্তানী ফৌজের হায়েনাদের দাপাদাপি, আর গোলাগুলি, তখনো ওরা সারা কাশ্মীরজুড়ে দাপাদাপি করতো, আর যাকে সামনে পেতো তারই দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরতো। ইচ্ছে হলে ওখানেই গুলি করে মেরে ফেলতো, আবার ইচ্ছে হলে হাতদু’টো পিছমোড়া করে বেঁধে নিয়ে যেতো!

এখন যেমন তখনো তেমন ওরা গুলি করে মানুষ শিকার করতো, যেমন শিকারী পাখী শিকার করে।

কাশ্মীরের মুসলমানদের উপর হিন্দু হায়েনাদের যুলুম নির্যাতনের কাহিনী তো আজকের নয়! শুধু কি তোমাদের জন্মের আগে! না, আমাদেরও জন্মের আগে! ধরো, কম করে হলেও একশ বছর হবে কাশ্মীরে মুসলিমানের উপর হিন্দুদের যুলুম নির্যাতনের কাহিনী।

তো আমি যখন শিশু ছিলাম, আমার শৈশবের একটি কাহিনী বলি। কাহিনীটি হলো ঝিলাম নদীর পাড়ে ছোট্ট একটি বস্তির মধ্যে। সেই বস্তিতে ছিলো ছোট্ট ফুটফুটে একটি শিশু, ছেলে শিশু, নাম শাব্বীর।

কাশ্মীরের শিশুরা নাকি এমনিতেই সুন্দর, যেন শিশির ধোয়া গোলাবের পাপড়ি! তার মধ্যে আবার ঐ শিশুটি ছিলো আরো সুন্দর! এমন সুন্দর শিশু কাশ্মীরেও নাকি বড় একটা দেখা যায় না। বয়স কত হবে, আট কি নয়। একদিন তাদের বস্তিতে হিন্দু ফৌজ হানা দিলো। ঘরে ঘরে তল্লাশির নামে চললো যুলুম-নির্যাতন। শাব্বিরের বাবা ছিলেন অসুস্থ। মা মাত্র ক’দিন হলো, দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

হিন্দু হায়েনারা তার বাবাকে বিছানার মধ্যেই গুলি করে মেরে ফেললো। শাব্বীরের চোখের সামনেই ছটফট করতে করতে বাবা শহীদ হলেন। হায়েনারা যেন উল্লাসে ফেটে পড়লো। শাব্বীর পাথরের মত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। তার যেন নড়বার শক্তিও হারিয়ে গিয়েছিলো। ...

হঠাৎ তার নযর গেলো দেয়ালে ঝুলানো বাবার পুরোনো বন্দুকটার দিকে। নিজের অজান্তেই সে ছুটে গেলো বন্দুকটার দিকে। হায়েনারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই একে একে গুলি করে ওদের ঠাণ্ডা করে দিলো; তারপর ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো!

তারপরের কাহিনী কারো জানা নেই...

আজ এতদিন পর, এই বুড়ো বয়সেও সেই বাহাদুর ছেলেটির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, আর ভালো লাগে!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা