যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪)

সংযোজিত

আমার ছোট্ট বাবা!

লিখেছেনঃ আমাতুল্লাহ তাসনীম, সাফফান

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
আমার ছোট্ট বাবা আফনান! আমি আজ কিছু কথা লিখে রাখবো তোমার জন্য, আমার আব্বুর পুষ্পের পাপড়িতে। তুমি যখন বড় হবে এবং মায়ের ব্যর্থ জীবনের যন্ত্রণা বোঝার সময় সেদিন তুমি এ লেখাগুলো পড়বে এবং নিজের জীবনের মাধ্যমে মায়ের জীবনের সব ব্যর্থতা মুছে দিতে চেষ্টা করবে। তুমি যখন বড় হবে আমি তখন কোথায় থাকবো জানি না, তবে কাগজের এ লেখাগুলো আমারই হৃদয়ের রেখা হয়ে থাকবে তোমার সামনে। তখন তুমি যেন হতে পারো মায়ের স্বপ্নের ফুল! মায়ের সাধনার ফল! তুমি যেন হতে পারো নীরব অশ্রুপাতের ফসল। বাবা! হৃদয়ের গভীরে বহু দিন ধরে লুকিয়ে রেখেছি কিছু কথা এবং কিছু ব্যথা। কাউকে বলিনি; কারণ এগুলো আর কারো জন্য নয়। আজ তোমাকে বলবো, কারণ এগুলো শুধু তোমার জন্য। মায়ের মুখের হাসি এবং চোখের অশ্রু শুধু সন্তানের জন্য। মায়ের বুকে যে হৃদয়, সে হৃদয়ের আনন্দ ও বেদনা শুধু সন্তানের জন্য। এখন তুমি বোঝবে না, তবু লিখে রাখছি; পরে সময় যদি সময় না দেয়! বাবা! একসময় তুমি ছিলে না; আমি একা ছিলাম এবং ছোট ছিলাম। আমার সামনে তখন একটি জীবন ছিলো, সম্ভাবনার আলো ছিলো। সেই আলোকে নিজের মাঝে ধারণ করার অনেক সুযোগ ছিলো। এত সুযোগ, এত সম্ভাবনা আর কোন মেয়ের জীবনে হয়ত ছিলো না। আমার জীবনে অনেক কিছু ছিলো, ছিলো না শুধু এইটুকু বোঝার যোগ্যতা যে, জীবনকে কীভাবে যাপন করতে হয়, সময়কে কীভাবে সাদরে বরণ করতে হয় এবং জ্ঞানের স্বচ্ছ সরোবরে অবগাহন করে, সাহিত্যের উদ্যানে পুষ্পমাল্য রচনা করে নিজেকে কীভাবে সাজিয়ে তুলতে হয়। আমাকে আলোর ভুবনে এবং সাহিত্যের অঙ্গনে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে একজন মানুষ ছিলেন এবং তিনি সবার আগে ছিলেন আমার, তারপর অন্য কারো। তিনি আমাকে দিতে চেয়েছিলেন জ্ঞানের আলো ও সাহিত্যের প্রভা, চিন্তার ঔজ্জ্বল্য ও চেতনার উত্তাপ। কিন্তু আমি- তোমার মা- বুঝতে পারিনি জীবনের আহ্বান এবং সৌভাগ্যের হাতছানি। তখন আমার জীবন এবং জীবনের বৃত্ত এখনকার মত ছিলো না। তখন আমার সঙ্গে ছিলো সময়ের সঙ্গ, বরং সময় তখন আমার কাছে প্রার্থনা করতো আমার সঙ্গ! সময়ের আকুল প্রার্থনায় আমি সাড়া দিতে পারিনি। আমি বুঝতে পারিনি, একদিন সময় যখন আমার সঙ্গ ত্যাগ করবে তখন নিঃসঙ্গতার বেদনা কত কঠিন হবে! বাবা! আমার এ লেখা পড়ে তুমি কি ভাবছো, জীবনকে ঘিরে তোমার মায়ের কোন স্বপ্ন ছিলো না, কিংবা ছিলো না কোন আকাঙ্ক্ষা! তা কিন্তু নয়! আমিও স্বপ্ন দেখেছি এবং জীবনের সুন্দর ছবি এঁকেছি হৃদয়ের পাতায়; আমিও স্বপ্ন দেখেছি, ইলম ও আদব এবং জ্ঞান ও সাহিত্যের জগতে বিচরণ করার এবং কলমের কাফেলায় শামিল হওয়ার, যে কাফেলার রাহবার আমারই বাবা, যাকে তুমি ডাকো ‘নানা’। আমার প্রতিজ্ঞা ছিলো, পৃথিবীকে আমি দেখাবো, একটি মেয়ে-কলম কীভাবে ছাড়িয়ে যেতে পারে বহু পুরুষ-কলমকে। আমার বাবাই আমার ছোট্ট হৃদয়ে অঙ্কুরিত করেছিলেন এই স্বপ্ন-উদ্দীপনা। কিন্তু আমি মগ্ন ছিলাম জীবনের খেলাঘরে! তাই আসতে পারিনি জীবন-সাধনার মন্দিরে! বুঝতে পারিনি, জীবনের সফলতা স্বপ্নের অঙ্গনে নয়, কর্মের প্রাঙ্গনে। একটা কথা কি বাবা! সময় তোমাকে সঙ্গ দিতে চায় সত্য, এবং সময় তোমার সঙ্গ পেতে চায়, তাও সত্য; কিন্তু আরো বড় সত্য হলো, সময় কখনো কারো পথ চেয়ে থেমে থাকে না। সময় ডাক দিয়ে যায় এবং চলে যায়। জীবনের বৃক্ষ থেকে প্রতিদিন একটি করে পাতা ঝরতে থাকে এবং একসময় জীবনবৃক্ষের শাখা পত্রশূন্য হয়ে পড়ে। জীবনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে এবং জীবনের সত্যকে হৃদয়ঙ্গম করতে করতে আমার জীবনবৃক্ষ থেকে অনেকগুলো পাতা ঝরে গেলো। আমি বড় হলাম, শুধু বয়সের পরিসরে; যেখানে বড় হওয়ার কথা ছিলো সেখানে ছোটই রয়ে গেলাম। সময় আমার সঙ্গ ত্যাগ করে, আমাকে নিঃসঙ্গ ফেলে অনেক দূর এগিয়ে গেলো। আমি পড়ে থাকলাম পিছনে, অনেক পিছনে। স্বপ্নের আড়াল থেকে যখন বাস্তবতার কাছে এলাম জীবনের নিঃসঙ্গতা, হৃদয়ের বিষণ্নতা এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনা ছাড়া তখন আর কিছু ছিলো না। তবে কি বাবা! বান্দাকে আল্লাহ ত্যাগ করেন না, কখনো না। জীবনের এই যে এত অপচয় হলো, তারপরো আল্লাহ আমাকে মায়া ও মমতা এবং দয়া ও করুণা থেকে বঞ্চিত করেননি। জীবনের চারপাশে যখন শূন্যতা, আর শূন্যতা; নিঃষঙ্গতা, আর বিষণ্নতা, তখনই তুমি এলে আমার কোলজুড়ে জান্নাতী ফুলের কলি হয়ে! মেয়ে-জীবন মুছে দিয়ে আল্লাহ আমাকে দান করলেন মাতৃজীবন! তোমার চোখের তারায় আমি দেখতে পেলাম আমারই জীবনের নতুন যাত্রার সজীব ছবি। তোমার চোখের পাপড়িতে আমি দেখতে পেলাম আমার হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের রেণু। তোমাকে ঘিরে আমার হৃদয়-উদ্যানে আবার শুরু হলো স্বপ্নের ফুল ফোটা। আমার জীবনে এখন আর কোন স্বপ্ন নেই তুমি ছাড়া, আর কোন আকাঙ্ক্ষা নেই তুমি ছাড়া। তুমিই আমার জীবন, তুমিই আমার প্রাণ। তুমিই আমার আকাশ, তুমিই আমার চাঁদ ও জোসনা। মমতার আঁচল বিছিয়ে এবং বিগলিত হৃদয়ের অশ্রু ঝরিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, জীবনকে তুমি যেন পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করতে পারো চেষ্টায়, সাধনায়, উদ্ভাসে ও আলোকময়তায়। তুমি অনেক বড় হও, আমার স্বপ্নের চেয়ে বড় এবং তোমার সাধনার চেয়ে বড়; অতীতের বড়দের মত বড়। কলবে, কলমে, অশ্রুতে, কালিতে, ভাবে, অনুভবে, চিন্তায়, চেতনায়, উত্তাপে, অনুতাপে, সবকিছুতে তুমি যেন হতে পারো অতীতের ছায়া। বাবা! আমি যেখানেই থাকি, এখানে, কিংবা সেখানে, আমার দু‘আ ও মায়া এবং আমার আঁচলের ছায়া থাকবে তোমার সঙ্গে। তোমার পড়ায়, তোমার লেখায়, তোমার কর্মে ও চিন্তায় এবং তোমার চোখের তারায় আমি বেঁচে থাকতে চাই, আমি পরিপূর্ণ হতে চাই। *** কলমের কালিতে চোখের পানি মিশিয়ে আমি একদিন দাঁড়াতে চেয়েছিলাম আমার আব্বুর পাশে। কিন্তু হায়, দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কী দিতে পারি এখন আমি আমার আব্বুকে! আমি চাই, আমার হয়ে তুমি দিতে চেষ্টা করো তোমার নানাকে স্বপ্নের সফলতার আনন্দ। একদিন তুমি যেন হতে পারো মায়ের মাতৃত্বের অলঙ্কার, বাবার পিতৃত্বের অহঙ্কার। তুমি যেন অর্জন করতে পারো নানার কলমের উত্তরাধিকার! আফনান ও আফীফ, তোমাদের দু’জনের জন্যই আমার হৃদয়ের শিশিরভেজা এ শুভকামনা।
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা