ভুলে যাওয়া ইতিহাস
জানতে হবে আবার
উছমানী সালতানাতের মযলূম খলীফা
সুলতান আব্দুল হামীদ রহ.
৬
ইস্তাম্বুলসম্মেলনে পেশকৃত পশ্চিমাদের দাবিদাওয়া আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাখ্যানের লক্ষ্যে মিদহাত পাশা রাষ্ট্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে যে জরুরী বৈঠকের আয়োজন করেছিলেন তার একদিন আগে সালিসবুরি বিশেষ বার্তা পাঠালেন ওয়াযিরে আযমের উদ্দেশ্যে। ‘ভূমিদখলে’র প্রতিযোগিতায় রাশিয়ার আগে বেড়ে যাওয়া রোধ করতে শেষ চেষ্টা হিসেবে মিদহাত পাশাকে তিনি লিখলেন, ‘জনাব! উছমানী রাষ্ট্রের জীবন-মৃত্যু এখন আপনার হাতে। কারণ, ইস্তাম্বুল-সম্মেলনের প্রস্তাবসমূহ গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান সম্পূর্ণই আপনার উপর নির্ভর করছে। আপনার উপর অর্পিত দায়িত্বের গুরুত্ব সম্পর্কে আশা করি আপনি অবগত আছেন এবং যে কোন সিদ্ধান্ত আপনি বেশ ভেবেচিন্তেই গ্রহণ করবেন’।
খুবই স্বাভাবিক যে, সালিসবুরির এই সদোপদেশ ছিলো মূলত তার দেশের স্বার্থ বিবেচনায়, ঘটনার অনিবার্যতায় যা উছমানী খেলাফাতের প্রতি তার আনুকূল্য বলে ভ্রম হচ্ছিলো। তবে হ্যাঁ ভেবেচিন্তেই প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন মিদহাত পাশা ও তার অনুচরেরা। তাদের প্রতিটি হঠকারিতা ছিল সুপরিকল্পিত এবং প্রতিটি কাজের পরিণতি সম্পর্কে তারা ছিলেন পূর্ণ অবগত। আর যদি বলা হয়, এটা ছিল তাদের অজ্ঞতা তাহলে তো প্রশ্ন হবে, খেলাফাতের ‘সর্বোচ্চ’ পদের অধিকারী ব্যক্তির জন্য এ অজ্ঞতা কত বড় অপরাধ? ইতিহাস অবশ্য সুস্পষ্ট-ভাবেই আমাদের সামনে তুলে ধরেছে মিদহাত পাশাদের বিশ্বাস ঘাতকতা ও ক্ষমতালিপ্সার কথা। ধ্বংস ও বরবাদির যে সর্বনাশা পথ নির্বাচন করেছিলেন মিদহাত পাশা তা থেকে তাকে বিরত রাখার মত কেউ তখন ছিল না । যদিও মিদহাত পাশার প্রতি খলীফার বিন্দুমাত্র আস্থা ছিলো না, কিন্তু তারপরো তিনি ‘ওয়াযিরে আযম’ মিদহাত পাশাকে এই জরুরী অধিবেশন আহ্বানের অনুমতি দিয়েছিলেন এ চিন্তা থেকে যে, খেলাফাতের দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা একত্র হয়ে সবদিক আলোচনা করবেন এবং গভীর চিন্তাভাবনার সঙ্গে ইস্তাম্বুলসম্মেলনের প্রস্তাব- সমূহের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করবেন। আর সামান্যতম বিচার-বুদ্ধি যার আছে সে-ই বুঝবে যে, পশ্চিমাদের দাবিদাওয়া, যত অপমানজনকই হোক, প্রত্যাখ্যান করে খেলাফাতকে রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে ঠেলে দেয়ার মত নির্বুদ্ধিতা আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু ইহুদিমগজ দ্বারা পরিচালিত ধূর্ত মিদহাতের পরিকল্পনাই ছিলো অন্যরকম। ‘বিশিষ্ট ব্যক্তি’ নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্ব এমনভাবেই তিনি সাজালেন যাতে তার পছন্দের সিদ্ধান্তটাই অধিবেশনে গৃহীত হয়।
১৮৭৭ খৃস্টাব্দের ১৮ই জানুয়ারী মোতাবেক ৩রা মুর্হারম ১২৯৪ হিজরীতে ষাটজন ইহুদি-খৃস্টান এবং ১৮০ জন ‘মুসলিম’কে নিয়ে মিদহাত পাশার সভাপতিত্বে শুরু হল খেলাফাতের ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তিদের জরুরী অধিবেশন। খলীফার মতামত উপেক্ষা করে খেলাফাতের ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে বসা এই নির্বোধদের সিদ্ধান্ত কি হবে তা তো জানাই ছিল। তবে মিদহাত এবং তার অনুচরদের হঠকারিতার কথা ইতিহাসের পাতায় চিরকালের জন্য লিপিবদ্ধ রাখতে সত্যিই এর প্রয়োজন ছিল। মুক্ত চিন্তা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আর গণতন্ত্রের নামে খেলাফাতে উছমানিয়ার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্করতম ষড়যন্ত্র সঙ্ঘটিত হলো মিদহাত পাশার সভাপতিতে¦ অনুষ্ঠিত ঐ অধিবেশনে। যারা সম্মেলনের সমর্থক এবং রাশিয়ার সঙ্গ যুদ্ধের বিরোধী তাদের দেশদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিয়ে অধিবেশনের উদ্বোধনী বক্তব্য শুরু করলেন মিদহাত পাশা। তারপর ইস্তাম্বুলসম্মেলনে অংশগ্রহণকারী ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোকে, বিশেষ করে রাশিয়াকে এমন ভাষায় আক্রমণ করলেন যার পর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সমাধানের আর কোন দরজাই খোলা থাকে না। তারা বেমালুম ভুলে গেলেন যে, সদ্যদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়া তরুণ সুলতান ও খলীফার মতামতের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তাঁকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে বলকান অঞ্চলে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার যে হঠকারী সিদ্ধান্ত সেটাই শত্রুকে আজ এই সম্মেলনের এবং তাতে এই দাবিদাওয়া নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। অতীতের ভুল থেকে সামান্য শিক্ষা গ্রহণ না করে খেলাফাতকে তারা ঠেলে দিতে থাকলেন আরো বড় বিপর্যয়ের দিকে। নিজের মত করে সবার সামনে বর্তমান পরিস্থিতি এবং করণীয় তুলে ধরে মিদহাত পাশা সবার মতামত জানতে চাইলেন। প্রথমে দাঁড়ালেন মুসলিম প্রতিনিধিগণ। সম্মেলনের দাবীদাওয়া প্রত্যাখ্যান করে একের পর এক জ্বালাময়ী বক্তব্য দিয়ে গেলেন আচমকা ভীষণ আত্মসম্মানবোধ জেগে ওঠা খেলাফাতের নেতৃস্থানীয় সব পাশা।
মিদহাত পাশার পর বক্তব্য দিতে দাঁড়ালেন তারই অনুগত অনুচর সাবেক ওয়াযিরে আযম রশদী পাশা, খলীফা আবদুল আযীযের ক্ষমতাচ্যুতি ও হত্যাকা-ণ্ডের ষড়যন্ত্রে যিনি ছিলেন মিদহাত পাশার বিশ্বস্ত সহযোগী। তার বক্তব্য শেষ হলো এভাবে, ‘সামান্য আত্মসম্মানবোধ যদি আমাদের থেকে থাকে তাহলে এখন একটি পথই খোলা আছে। সম্মেলনের অপমানজনক সমস্ত দাবিদাওয়া আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি।’
কী নির্মম উপহাস! শত্রুর কাছে নিজেদের বিক্রি করে দেয়ার সময় কোথায় থাকে এদের আত্মমর্যাদা? হায়রে নির্বোধ! আত্মমর্যাদাবোধের মহাসাগরে কয়েক ফোঁটা বিবেচনাবোধও যদি থাকতো! এ বিষয়টা উল্লেখ করে মজলূম খলীফা সুলতান আবদুল হামীদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন ‘কোন দেশের শীর্ষব্যক্তিবর্গ যখন এরূপ নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয় তখন বুঝতে বাকি থাকে না, কী দুর্গতি অপেক্ষা করছে তাদের সামনে।’
এরপর ইহুদি-খৃস্টানদের পালা। গ্রিক অর্থোডেক্স চার্চের প্রতিনিধির বক্তব্য দেখুন ‘মুসলিম-অমুসলিম আমরা সকল ‘উছমানী’ একই দেশের সন্তান এবং পরস্পর ভাই। ইস্তাম্বুল-সম্মেলনের প্রস্তাবসমূহ মেনে নেয়া আমাদের সবার জন্যই চরম লজ্জাজনক ও আত্মঘাতী। সুতরাং কিছুতেই তা মেনে নেয়া যায় না ।...’
‘দেশ ও জাতির স্বার্থে আমরা আমাদের মুসলিম ভাইদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়তে প্রস্তুত।’
এমনই আরো কিছু আবেগসর্বস্ব কথা বলে বিপুল করতালির মধ্যে তার বক্তব্য শেষ হলো। অথচ তলে তলে পূর্ণোদ্যমে অব্যাহত ছিলো খেলাফাতের বিরুদ্ধে তাদের কূটচক্রান্ত। খেলাফাতের দুধ কলায় পোষা ইহুদিখৃস্টান- চক্রই ছিলো দুশমনের সকল ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের আসল ক্রীড়নক। অপরাধ অবশ্য আমাদেরই। ‘আল কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহিদাহ’ এ সতর্কবাণীর পরও আমরা তাদের বুকে টেনে নিই! তাক্বদীরের কী গর্দিশ! খেলাফাতের বুকের উপর বসে ইহুদি-নাছারাচক্র আজ নির্ধারণ করছে খেলাফাতে ইসলামিয়ার করণীয়!
এরপর দাঁড়ালেন আর্মেনীয় খৃস্টানদের প্রতিনিধি এনভিয়া যিয়ান। গ্রিক প্রতিনিধির মত তিনিও আবেগসর্বস্ব বাগাড়ম্বর চালিয়ে গেলেন। তার বক্তব্যের খোলাছা ছিল ‘খেলাফাতের ‘খেদমতে’ আর্মেনীয়রা অতীতে যেমন নিবেদিত ছিলো ভবিষ্যতেও তেমনি যে কোন আত্মত্যাগের জন্য তারা সদাপ্রস্তুত ।...’
ইনি হলেন সেই ব্যক্তি, রাশিয়ার প্রত্যক্ষ মদদে খেলাফাতের বিরুদ্ধে আর্মেনীয়বিদ্রোহে যার ছিল অগ্রণী ভূমিকা।
এভাবে খেলাফাতের বুকের উপর বসে খেলাফাতের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেল ‘আস্তিনের সাপগুলো’, খলীফা আব্দুল হামীদ ছিলেন যার অসহায় দর্শক। অধিবেশনের সমাপ্তিপর্বে মিদহাত পাশা সবাইকে ইস্তাম্বুল-সম্মেলনের প্রস্তাবসমূহের পক্ষে/ বিপক্ষে রায় (ভোট) দেয়ার আহ্বান জানালেন। যারা প্রত্যাখ্যানকারী তারা বসা থাকবেন, আর সমর্থকরা দাঁড়িয়ে তাদের অবস্থানের জানান দেবেন।
উপস্থিত ২৪০ জন ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তির মধ্যে কারো মনে যদি সত্য ও ন্যায়ের উপলব্ধি থেকেও থাকে দাঁড়িয়ে তা প্রকাশ করার মত সাহসী কেউ সেখানে ছিলো না। কিছু সময়ের নীরবতার পর বুরসাপ্রতিনিধি আবেদীন আফেন্দি চিৎকার করে বললেন, হে পাশা এক শতাব্দীও যদি আপনি অপেক্ষা করেন আমাদের একজনও দাঁড়াবে না। মুহুর্মুহু করতালিতে ফেটে পড়লো অধিবেশনস্থল। ‘গৃহীত সিদ্ধান্ত’ লিপিবদ্ধ করা হলো। তাতে স্বাক্ষর করার সময় কিছু প্রতিনিধিকে অতিউৎসাহে একাধিকবারও স্বাক্ষর করতে দেখা গেল। হায়! তাদের যদি জানা থাকতো, এটা আসলে খেলাফাতের মৃত্যুপরোয়ানায় স্বাক্ষরেরই শামিল। খেলাফাতের বুকের উপর বসে প্রকাশ্য দিনের আলোতে এভাবেই সঙ্ঘটিত হলো খেলাফাতের বিরূদ্ধে নিকৃষ্টতম ষড়যন্ত্র। খেলাফাতকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতে শুধু এই অধিবেশনের আয়োজন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল না পাশাদের অপতৎপরতা, বরং নব্যতুর্কী/নব্য উছমানিদের নিয়ন্ত্রণাধীন পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন
বক্তব্য বিবৃতি ও ব্যাপক প্রাচার-প্রচারণার মাধ্যমে সাধারণ জনতাকেও উত্তেজিত করার চেষ্টায় তারা কোমরবেঁধে নামলো। সেই সঙ্গে ছিলো রাজধানীজুড়ে ব্যাপক মিছিল সমাবেশ। ‘যুদ্ধ চাই, যুদ্ধ চাই’ শ্লোগান মুখে তুলে দিয়ে শাহী প্রাসাদের কাছেও ‘জনতাকে’ নিয়ে যাওয়া হলো। প্রজ্ঞা ও বিবেক-সম্পন্ন কিছু মানুষ তাদের বোঝানোর চেষ্টা তো করেছিলেন, কিন্তু দুশমনের ইশারায় যারা উঠবস করছে তাদের কথা তো বাদ, এমনকি সস্তা আবেগের শিকারদায়িত্বশীল মানুষেরাও তাদেরকে বুযদিল-গাদ্দার তুহমত দিলো। দেশ ও জাতির ‘নেতৃত্ব’ শত্রুর কাছে বিকিয়ে যাওয়া এবং জাতির শিক্ষা-সংস্কৃতি ও চিন্তা-চেতনার গতিপ্রকৃতি দুশমন ও তাদের ক্রীড়নকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া, এটা তো এখন শতধাবিভক্ত এই উম্মাহ্র জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু তখন যা ঘটে চলেছিলো উম্মাহ্র হাজার বছরের ইতিহাসে তা ছিলো অভূতপূর্ব। সংবাদমাধ্যম ও পত্রপত্রিকা, প্রায় পুরোটাই ছিলো নব্যতুর্র্কিদের নিয়ন্ত্রণে। সামরিক ও বেসামরিক গুরুত্বপূর্ণ সব পদই ছিল তাদের দখলে। গণহারে মগজধোলাইয়ের জন্য সর্বশক্তি নিয়োজিত ছিলো। তবে আফসোস, এমন লোকের সংখ্যা ছিল প্রচুর যারা খেলাফাতের শাহরগে ছুরি চালাচ্ছিলো খেলাফাতের কল্যাণ ভেবেই। পক্ষান্তরে বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বিচ্যুতি তো শুরু হয়েছিল বহু আগেই, যখন সামগ্রিক অর্থে ‘পশ্চিম’কে উন্নতি ও অগ্রগতির মানদ- নির্ধারণ করে তার অবাধ প্রবাহের জন্য আমরাই ‘খাল কেটেছিলাম’।
অধিবেশনের সিদ্ধান্ত খলীফাকে‘অবহিত’ করার জন্য মিদহাত পাশার দুই অনুচর দামাদ মাহমূদ জালাল পাশা ও ‘সারে আসকার’ রদীফ পাশা তাঁর সামনে হাজির হলেন। খলীফাকে তারা বোঝাতে চাইলেন যে, জনসাধারণ তো প্রবলভাবে ইস্তাম্বুলসম্মেলনকে প্রত্যাখ্যান এবং যুদ্ধকে সমর্থন করছেই সামরিক বাহিনীও যুদ্ধের জন্য পূর্ণ প্রস্তুত। অন্যকোন সিদ্ধান্ত তারা কিছুতেই মেনে নেবে না। তারা আরো যুক্ত করলো, ‘যুদ্ধ শুরু হলে অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে ইংল্যান্ড নিজ নিজ স্বার্থেই খেলাফাতের পাশে থাকবে।’ মিদহাত পাশারা যখন সমস্বরে এ গীত গাইছিলেন যে, যুদ্ধ শুরু হলে নিশ্চিতভাবেই বৃটিশ ও ফরাসিরা
আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে, ঠিক তখন গোপন দূতের মাধ্যমে বৃটিশ দূতাবাস থেকে লর্ড সালিসবুরির বার্তা এসে পৌঁছলো খলীফার কাছে। তার সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিলো, ‘যুদ্ধই যদি হয় আপনাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তাহলে নিশ্চিত জেনে রাখুন, রাশিয়ার বিপক্ষে আমাদের সামান্যতম সাহায্যও আপনারা পাবেন না’ ।
আল্লাহপ্রদত্ত প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার আলোকে খলীফার সামনে ‘করণীয়’ পরিষ্কার থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধোন্মাদদের বাঁধা দেয়ার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। তদুপরি বাতাসে এ কথাও ছড়িয়ে দেয়া হলো যে, খলীফা যদি ‘জনদাবী’ সত্ত্বেও যুদ্ধঘোষণায় রাজী না হন তাহলে তার মসনদচ্যুতি অনিবার্য। সেক্ষেত্রে ‘মানসিক ভারসাম্যহীনতা’র কারণে মসনদ থেকে অপসারিত সাবেক সুলতান মুরাদকেই আবার ফিরিয়ে আনা হবে।
শেষপর্যন্ত তারসানাসম্মেলনের প্রস্তাবসমূহ প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হলেন খলীফা আব্দুল হামীদ। খলীফার স্বাক্ষরিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হলো পশ্চিমাদের। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ যে অবশ্যম্ভাবী সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহ থাকলো না। যুদ্ধ নয়, বরং খেলাফাতের উপর রাশিয়ার ‘নগ্ন আগ্রসন’ এটাই ছিলো বাস্তবসম্মত শব্দ। কারণ যুদ্ধ তো দূরের কথা, শুধু টিকে থাকার জন্যই তখন ধুঁকতে হচ্ছে সেদিনের প্রবল প্রতাপে তিন মহাদেশ শাসনকারী খেলাফাতে উছমানিয়াকে। খলীফা আব্দুল হামীদ তো দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলেন কী ঘটতে চলেছে! অল্পসময়েই খেলাফাতের বিশাল ভূখ- গ্রাস করে নেবে রুশ ভল্লুক তারপর যুদ্ধ থামাতে রাশিয়ার সাথে আরো বিপর্যয়কর চুক্তিতে যেতে বাধ্য হবেন তিনি। কিন্তু খলীফাকে ঘিরে রাখা পাশারা তখন হয়ে পড়েছিলেন কিংবা সেজে বসেছিলেন ‘অন্ধ’! ইস্তাম্বুলসম্মেলনের আলোচকরাতো আগেই বিদায় নিয়েছিলেন এবার খেলাফাতের চূড়ান্ত ‘প্রত্যাখ্যানসিদ্ধান্ত’ জানামাত্র ইস্তাম্বুলে নিযুক্ত বিভিন্ন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরাও নিম্নপদস্থদের হাতে দূতাবাসের দায়িত্ব দিয়ে বিদায় নিলেন রাজধানী থেকে। আগ্রাসনের পথে আর কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলো না খেলাফাতের শতাব্দীর শত্রু রাশিয়ার সামনে। আগ্রাসী রুশভল্লুকের হিংস্রের থাবার সামনে এভাবেই ‘লোভনীয় টুকরো’ হয়ে ‘স্বেচ্ছায়’ যেন ধরা দিলো খেলাফাতে উছমানীয়া। ইতিহাস সাক্ষী, মিদহাত পাশার এই নির্বুদ্ধিতা ও হঠকারিতা খেলাফাতের জন্য কত বড় বিপর্যয় ডেকে এনেছিলো। অথচ তার চেয়ে বয়সে অনেক নবীন, কিন্তু প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় বহুগুণ যোগ্য খলীফা আবদুল হামীদ এ বিষয়ে তাকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন বারবার, কিন্তু হায়... !
কোন বিষয়ে খেলাফাতের ওয়াজিরে আযমের যদি কোন ভিন্নমত বা পরামর্শ থাকে তাহলে খলীফার সামনে সেটা পেশ করা অবশ্যই কর্তব্য, কিন্তু খলীফার আদেশ বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যখন এসে যাবে তখন সেটার সঠিক বাস্তবায়নই তো হলো তার পবিত্র দায়িত্ব। কিন্তু চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নব্যতুর্কিদের পরম আস্থাভাজন মিদহাত পাশা তখন পৌঁছে গিয়েছেন ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরে। তিনিই ছিলেন তখন সর্বেসর্বা। তার ‘পরামর্শের’ সামনে খলীফা ছিলেন অসহায়।
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ যখন অনিবার্য হয়ে পড়লো তখন পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার করে সেনাবাহিনীর সার্বিক অবস্থা এবং যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে আলোচনার জন্য ওয়াজিরে আযম মিদহাত পাশা এবং ‘সারে আসকার’ রদীফ পাশাকে নিয়ে বসলেন মাজবূর খলীফা আবদুল হামীদ। সব প্রশ্নের জবাবে খলীফাকে তারা ‘পূর্ণ আশ^স্ত’ করলেন যে, উছমানী বাহিনীর দুই লাখ তাজাদম
নওজোয়ান, দুশমনের যে কোন আগ্রাসন মোকাবেলার জন্য পূণপ্রস্তুত। কিন্তু এরই মধ্যে পূর্ব রণাঙ্গণে ককেশাস অঞ্চলে উছমানী বাহিনীর বিখ্যাত সিপাহসালার আহমাদ মুখতার পাশা খলীফার কাছে জরুরী বার্তা পাঠালেন যে, লক্ষাধিক রুশসেনার মোকাবেলায় তার অধীনে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত মাত্র ত্রিশ হাজার সেনা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে লড়াই শুরু করা আত্মহত্যারই শামিল। একটু কল্পনা করুন, খলীফা আবদুল হামীদের মনের অবস্থা তখন কী হয়েছিলো? বার্তা পাওয়ামাত্র দুই পাশাকে তিনি দ্রত ডেকে পাঠালেন। কিন্তু সিপাহসালারের বার্তা দেখার পর ওয়াযিরে আযমের পদে সমাসীন ব্যক্তিটি যে দৃশ্যের অবতারণা করলেন তা বর্ণনা করার মত কোন শব্দ নেই। সামান্যতম অনুতাপ প্রকাশ না করে, চরম দায়িত্বহীনতার সঙ্গে মিদহাত পাশা বললেন, এ সম্পর্কে নিশ্চিত কোন তথ্য তার কাছে নেই। এর দায় ও দায়িত্ব সারে আসকারের। আগুনঝরা বক্তৃতায় কেল্লাফতে করা মিদহাত পাশার এই ছিল আসল অবস্থা রাশিয়ার মত পরাশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের পূর্বমুহূর্তে। আর সব বাদ, শুধু এতটুকুই কি যথেষ্ট ছিলো না পাশা ও তার অনুচরদের চরম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জন্য!? কিন্তু ...।
পাশাদের চরম বিশৃঙ্খল এ অবস্থার কথা উল্লেখ করে খলীফা আবদুল হামীদ তার রোজনামচায় লিখেছেন ‘পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর, একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দায়মুক্ত হতে চাওয়া এমন একটি দলকে সাথে নিয়ে যুদ্ধে জড়ানো, পাগলামি ছাড়া একে আর কি বলা যায়? নিজ বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা সম্পর্কে অজ্ঞ এক ওয়াযিরে আযম দ্বারা আর যাই হোক যুদ্ধে কিছু অর্জন করা তো অসম্ভব! তারপরো নিজেকে সংযত রেখে আমি তার ‘পাত্রটি’ পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা করলাম। কারণ, জনতা তখন মিদহাত পাশায় ‘মন্ত্রমুগ্ধ’। তারা অধীর হয়ে ছিলো তার ‘কারিশমা’ দেখার জন্য। এ অবস্থায় তাকে সরানোর চেষ্টা নির্ঘাত বিপরীত ফল বয়ে আনবে।’
খলীফার সঙ্গে আচরণে, এমনকি মৌখিক সৌজন্যটুকু রক্ষার প্রয়োজনও বোধ করত না পাশাচক্র। খেলাফাতের অর্থবিভাগের দায়িত্বশীল ব্যক্তির প্রতি কোন কারণে ক্ষীপ্ত হয়ে মিদহাত পাশা খলীফার কাছে দাবি জানালেন অবিলম্বে তাকে বরখাস্ত করার। যোগ্যতা ও সততার সুনাম ছিলো ঐ ‘অর্থকর্মকর্তার। তাই অন্য সময়ের মত ওয়াযিরে আযমের কথায় সায় না দিয়ে কারণ ও প্রমাণ জানতে চাইলেন খলীফা। তাতে পাশার ক্রোধ যেন আরো বেড়ে গেল। কথিত ব্যক্তির বিরুদ্ধে খেলাফাতের আর্থিক ক্ষতির এক খোঁড়া অভিযোগ উত্থাপন করা হলো। আর প্রামাণ হিসেবে যা বলা হলো তাতে অভিযোগের অসারতাই আরো প্রকাশ পেলো। তাই খলীফা তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন। এক পর্যায়ে চরম ঔদ্ধত্যের সঙ্গে খলীফার সামনে থেকে উঠে গিয়ে মিদহাত পাশা বলতে লাগলেন। যাকেই অর্থবিভাগের দায়িত্ব দেয়া হবে ‘বেতনে’র জন্য তাকে খলীফার কাছেই পাঠিয়ে দেয়া হবে। ওয়াযিরে আযমের সঙ্গে তার কোন ‘লেনা-দেনা’ থাকবে না। পাশাদের এসব ‘আচরণ’ তুলে ধরে খলীফা আব্দুল হামীদ তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন ‘যে ইংল্যান্ড, আর ফ্রান্সের তারা এত গুণমুগ্ধ সেখানে বাদশাহর সঙ্গে কারো এরূপ আচরণ কি কল্পনাও করা যায়? তারপরো আমি ধৈর্য রক্ষা করে চললাম।’ ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত এ সব ঘটনা সামনে রেখেও যারা স্বৈরশাসনের অপবাদ দিতে চায় মাজলূম খলীফা আবদুল হামীদের উপর সত্যি ‘বাহবা’ দিতে হয় তাদের। জ্ঞানপাপ শব্দটিও যেন যথেষ্ট নয় তাদের জন্য। * মুহাম্মাদ বিন মিছবাহ
(চলবে ইনশাআল্লাহ্)