পশ্চিমা রাজধানীগুলোতে পাশাদের মধ্যে মিদহাত পাশারই ছিলো তখন সবচেয়ে বেশি আদর, কদর ও সমাদর। খেলাফাতের সাংবিধানিক রূপান্তর তথা খলীফার ক্ষমতা খর্ব করার মূল নায়ক হিসেবে সমস্ত পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ছিলো তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের ভাষায় তিনি ছিলেন ‘সংবিধানের পিতা’। মিদহাত পাশাকে দিয়ে খেলাফাতকে সাংবিধানিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে বহুদিনের ষড়যন্ত্রের ফসল ঘরে তুলেছিলো শত্রুরা। ওয়াজিরে আযম হওয়ারও বহু আগে মিদহাত পাশা যখন খেলাফাতের বিভিন্ন প্রদেশে প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তখন থেকেই তাকে তুলে আনার জন্য তার পক্ষে প্রচার প্রচারণায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলো ইহুদিদের ছদ্মবেশী বিশ্বসংগঠন ফ্রিম্যাসন। তাদের বক্তব্য ছিলো, মিদহাত পাশা হলেন খেলাফাতের প্রশাসকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আর খেলাফাতের ভিতরে জনগণের সামনে তাকে হিরো হিসেবে তুলে ধরার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো ফ্রিম্যাসনের অনুগত নব্যতুর্কী লেখক সাংবাদিক। তার স্তুতি প্রশংসায় দিনরাত যেন এক করে ফেলছিলো পুরো সংবাদ-মাধ্যম। তাদের বক্তব্য ছিলো, খলীফা এখন শুধু নামে আছেন, ওয়াযিরে আযম মিদহাত পাশাই দীর্ঘ দিন যাবত খেলাফাতের হাল ধরে আছেন। এই দূর্যোগপূর্ণ সময়ে একমাত্র মিদহাত পাশাই পারবেন খেলাফতকে সংকট থেকে উদ্ধার করতে।
দেশী বিদেশী এই প্রচারণাষড়যন্ত্রের ফলও পাওয়া গেলো। বিপুল সংখ্যক মানুষ তাকেই ভাবতে শুরু করলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে। তাদের দৃষ্টিতে মিদহাত পাশা ও নব্যতুর্কিরাই খেলাফাতের আসল শুভাকাক্সক্ষী আর খলীফা হলেন পথের প্রতিবন্ধক। এভাবে যুগে যুগে নিজেদের হাতের পুতুলকে কতবার যে ‘ওরা’ আমাদের ‘হিরো’ বানিয়েছে। আর শত্রুর ক্রীড়নককে ত্রানকর্তা ভেবে একই গর্ত থেকে কতবার যে দংশিত হয়েছে উম্মাহ্ তার কোন ইয়ত্তা নেই। নিকট অতীতে তুরস্কের অভিশাপ কামাল পাশা এবং মিসরের নব্য ফেরআউন জামাল আবদুন নাছেররা এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রায় রাতেই মিদহাত পাশার আস্তানায় বসতো নব্যতুর্র্কিদে -র মদের আসর। সেখানে খেলাফাত ও খলীফার বিরুদ্ধে বোনা চক্রান্তের ‘বিষজাল’। কিন্তু সম্পর্কে জনসাধারণ ছিলো বেখবর। শত্রুর কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়া মিদহাত পাশা এবং তার দোসরদের ক্ষমতার লালসা সম্পর্কে তারা ছিলো সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তবে সব খবরই পৌঁছতো তরুণ খলীফা আব্দুল হামীদের কাছে। তাদের নীল নকশা আর কূটকৌশল সম্পর্কে খলীফা কিছু মাত্র বেখবর ছিলেন না। হিংস্র হায়েনার ঘেরাওয়ের মাঝে মেষ শাবকের যে অবস্থা, পাশাদের ঘেরাওয়ের মধ্যে তার চেয়েও অসহায় অবস্থায় মসনদে আরোহণ করেছিলেন খলীফা অবদুল হামীদ। কিন্তু নীরব দর্শক হয়ে খেলাফাতের পতন দেখে যাওয়ার মানুষ তো ছিলেন না তিনি।
দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রজ্ঞাবান তরুণ খলীফা প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা হলো খেলাফাতের আনাচে কানাচে কখন কী হচ্ছে, সময়মত সঠিক তথ্যটি পাওয়ার জন্য একটি ব্যক্তিগত গোয়েন্দাবাহিনী গঠন। ইতিহাসে যার য়ালদিয গোয়েন্দাসংস্থা হিসেবে সুপরিচিত। এ সংস্থা সরাসরি শুধু তাঁর কাছেই ‘রিপোর্ট’ করবে। রহিমাকাল্লাহু ইয়া আবদাল হামীদ! সত্যিই অবাক হতে হয় তরুণ খলীফার প্রজ্ঞা এবং চিন্তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা দেখে। ঘরে ও বাইরে শত্রুর মোকাবেলায় কিছু করতে পারুন বা না পারুন, শত্রুর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বেখবর যেন থাকতে না হয়। শত্রুর কাছে পরাস্ত হই কিন্তু প্রতারিত যেন না হই, এটাই ছিলো খেলাফাতে উছমানীয়ার মাজলূম খালীফা সুলতান আবদুল হামীদের সারা জীবনের মূলনীতি।
খলীফা যখন যুবরাজ ছিলেন তখন থেকেই এ বিষয়ে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড যদিও তিনি সযত্নে এড়িয়ে চলেছেন কিন্তু তার ‘কান’ পূর্ণ সজাগ ছিলো, বরং সবার দৃষ্টির আড়ালে থাকার কারণে খোঁজখবর রাখা তাঁর জন্য আরো সহজ হয়েছিলো। এ কাজে তিনি তাঁর বিশ্বস্ত ব্যাক্তিগত চিকিৎসক মাফরূনিকে ব্যবহার করতেন। এটা ছিলো তাঁর বুদ্ধিমত্তার আরেকটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর ফল হয়েছিলো এই যে, দায়িত্ব গ্রহণের প্রাক্কালে যুবরাজের কাছে ঘন ঘন চিকিৎসকের আগমন দেখে বৃটিশ রাষ্ট্রদূত তার রাজধানীতে বার্তা পঠিয়েছিলেন যে, ভাবী সুলতান সম্ভবত দূরারোগ্য কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত সুতরাং ‘নো টেনশন’।
অল্প ক’জনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করা অতিক্ষুদ্র এই বাহিনী মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে এতটা শক্তি অর্জন করেছিলো যে তৎকালীন পরাশক্তি রুশ-বৃটিশ গোয়েন্দা-বাহিনীর সঙ্গেও তারা সমানভাবে টক্কর দিচ্ছিলো এবং বহুক্ষেত্রে বুদ্ধির খেলায় তাদের নাজেহাল করে ছাড়ছিলো। এমনকি ইস্তাম্বুলস্থ রুশ দূতাবাসেও খলীফা ‘কান’ স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন। রুশরাজধানী থেকে রাষ্ট্রদূতের কাছে প্রেরিত বার্তা প্রায় একই সময় পৌঁছে যেত খলীফারও কানে। বুদ্ধির লড়াইয়ে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে ব্যর্থ হয়ে খলীফার এ অনন্য গোয়েন্দা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রোপাগাণ্ডা শুরু করলো ভিতরের ও বাইরের শত্রুদল। জনসাধারণের মধ্যে ভীতি ছড়ানোর জন্য নাকি তিনি এই বাহিনী ব্যবহার করছেন। এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা সম্পর্কে অন্ধকারে থাকার কারণে শত্রু আরো বেশী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো তাঁর ওপর। এটাকে তারা তাঁর স্বৈরাচারী আচরণ বলে প্রাচার চালাতে লাগলো। কী করণীয় ছিলো তাহলে খলীফা আবদুল হামীদের? তাদের গিলোটিনে নীরবে মাথা পেতে দেয়া! পরবর্তীসময়ে বারবার প্রমাণিত হয়েছে, কী অসামান্য পদক্ষেপ ছিলো এটি খলীফা আবদুল হামীদের। নব্যতুর্কি/নব্য উছমানীদের বড় বড় বহু ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছিলো এই গোয়েন্দা সংস্থার নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা। পড়ো পড়ো খেলাফাতকে আরো তিনটি দশক বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছিলো খলীফা আবদুল হামীদের হাতে গড়া এই গোয়েন্দসংস্থা। এর মাধ্যমেই পাশাদের, বিশেষ করে মিদহাত পাশার সব কর্মকাণ্ডের সংবাদ তিনি পেয়ে যেতেন। প্রায় প্রতি রাতেই ওয়াযিরে আযমের আস্তানায় নব্যতুর্কিদের মদের আসরেও যখন খলীফার ‘কান’ পৌঁছে গেলো তখন খলীফা ও খেলাফাতের বিরুদ্ধে তাদের এমন এমন বক্তব্য ও পরিকল্পনা খলীফার গোচরে এলো যার একটিই যথেষ্ট ছিলো মিদহাত পাশাকে দশবার মৃত্যুদণ্ড দেয়ার জন্য। কিন্তু তার সাজানো জনপ্রিয়তা এবং পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষ -কতার কারণে তার বিষয়ে কিছু বলার এবং করার আগে অনেক ভাবতে হতো খলীফাকে। তাই সব জেনে বুঝেও আপন চাচা খলীফা আবদুল আযীযের রক্তে হাত রঞ্জিত করা খুনী মিদহাত পাশাকে সয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছিলেন খলীফা আবদুল হামীদ।
তবে মুহূর্তের জন্যও খুনীর পরিচয় ও ভূমিকার কথা ভুলেননি তিনি। অপেক্ষা ছিলো শুধু উপযুক্ত সময়ের। কিন্তু জবাবদিহিতাবিহীন এ অবস্থা দিন দিন আরো যেন বেপরোয়া করে তুলছিলো পাশাদের। খেলাফাত-কে আগ্রাসী শত্রুর মুখে ঠেলে দিয়েই তারা ক্ষান্ত ছিলো না, বরং ভিতর থেকেও খেলাফাতের কোমর ভেঙ্গে দেয়ার জন্য শত চক্রান্তের জাল তারা বিছিয়ে চলেছিলো। ওয়াযিরে আযম হওয়ার কিছুদিন পরের ঘটনা। নব্যতুর্কিদের নীলনকশা সামনে রেখে খেলাফাতের মুসলিমসংখ্যা-গরিষ্ঠ কয়েকটি অঞ্চলে অমুসলিম প্রশাসক নিয়োগের জন্য খলীফার উপর চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করলেন মিদহাত পাশা। শুধু তাই নয়, সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইহুদি খৃস্টানদের ভর্তির অনুমোদনের জন্যও আয়োজন শুরু করলেন তিনি। উছমানী সেনাবাহিনীর ভবিষ্যতনেতৃত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মহাগুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইহুদি নাছারাদের প্রবেশাধিকারের কী অর্থ তা বোঝার জন্য কি খেলাফাতের ওয়াযিরে আযম হওয়ার প্রয়োজন আছে? আবারও বলতে হয় সেই কথা যে, মূর্খতা নয়, এগুলো ছিলো খেলাফাতের ঘরের শত্রু মিদহাত পাশার ধূর্ততা। কিন্তু খলীফার অপরাধ! মিদহাত পাশার এ চক্রান্তমূলক সিদ্ধান্ত তিনি অনুমোদন করতে রাজি হলেন না। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মিদহাত পাশা খলীফার কাছে চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ এক বার্তা পাঠালেন, আমাদের ক্বানূনী আসাসী ঘোষণার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে প্রাসাদের (খলীফার) স্বৈরাচারের অবসান ঘটানো। ‘মহামান্য!’ আপনাকে অবশ্যই আপনার ক্ষমতার সীমারেখা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। ইয়া আল্লাহ্! রহিমাল্লাহু আবদাল হামীদ! মিদহাত পাশার বহু ঔদ্ধত্যের মধ্যেও এটি ছিলো শীর্ষে। এ ঘটনার কথা উল্লেখ করে খলীফা আবদুল হামীদ লিখেছেন , ‘এ ঘটনার পর আমি নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারলাম যে, সবই যদি ছেড়ে দিতে থাকি এবং সংশোধন হবে, আশায় কালক্ষেপণ করতে থাকি তাহলে আমার পক্ষে আর কোন কাজ করাই সম্ভব হবে না। তারপরও বিভিন্ন হিকমত ও কৌশল চিন্তা করে খলীফা নীরব থাকলেন...থাকতে বাধ্য হলেন।
কিন্তু এরই মধ্যে গোয়েন্দাসূত্রে এমন একটি সংবাদ পৌঁছলো খলীফার কাছে যা আক্ষরিক অর্থেই খলীফার পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিলো। খলীফা সংবাদ পেলেন, মিদহাত পাশা ও তার দোসররা খেলাফাতের সেনাবাহিনীর বাইরে আলাদা একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলছে! আর উদ্দেশ্য কত ‘নেক’ হতে পারে তা বোঝার জন্য মিদহাত পাশার নামই তো যথেষ্ট। পরিস্থিতির ভয়াবহতা একটু শুধু কল্পনা করুন! সুদূর-প্রসারী ষড়যন্ত্রকে সামনে রেখে অনেক আগে থেকেই গোপনে নিজের বিশ্বস্ত লোকদের নিয়ে আলাদা সশস্ত্র বাহিনী কিংবা পড়ুন গুণ্ডা বাহিনী গড়ে তুলছিলেন মিদহাত পাশা তথা নব্যতুর্কিরা। যার নাম দেয়া হয়েছিলো ‘জাইশুল উম্মাহ’ বা জাতীয় বাহিনী। রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ তো অনেক আগেই তাদের প্রায় হস্তগত হয়েছিলো। তারপরও এ বাহিনীটি তারা গড়ে তুলছিলো তাদের ভয়ঙ্কর দুরভিসন্ধি সামনে রেখে। এ বাহিনী ছিলো সম্পূর্ণই মিদহাত পাশার ব্যক্তির প্রতি অনুগত। রাষ্ট্রিয় বাহিনীর সঙ্গে তাদের কোনই সম্পর্ক ছিলো না অর্থাৎ রষ্ট্রের অর্থে প্রতিপালিত হলেও তারা ছিলো রাষ্ট্রের যে কোন নিয়ন্ত্রণের সম্পূর্ণ বাইরে। কল্পনা করা যায়.....! কল্পনা করা যায় কী ঔদ্ধত্যপূর্ণ এবং বিশ্বাস- ঘাতকতাপূর্ণ পদক্ষেপ ছিলো এটা।
ইস্তাম্বুলসম্মেলন প্রত্যাখ্যান তরা তথা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর সিদ্ধান্তে খলীফাকে রাজী করানোর জন্য এই গুণ্ডা বাহিনী দিয়েই দিনের পর দিন ক্বাসরে খেলাফাতের ফটকের সামনে মিছিল সমাবেশ এবং যুদ্ধ যুদ্ধ শ্লোগানের আয়োজন করতেন মিদহাত পাশা। আর খলীফাকে বোঝাতেস, ‘জ্যনতা ইয়ে চাহতা হ্যায়’। নির্বোধদের জানা ছিলো না যে, খলীফা জানতা হ্যায় ইয়ে জ্যনতা কৌন হ্যায়! এখানেই শেষ নয়! অবগত হওয়ার পর খলীফা আবদুল হামীদ যখন তাকে বললেন এ বাহিনীকে যেন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আওতায় নিয়ে আসা হয় তখন তার উত্তর ছিলো স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান। খলীফা এবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন যে মিদহাত পাশার অপরাধের পাত্র পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। এরপর আর মুহূর্ত বিলম্ব করা মানে শত্রুকে চূড়ান্ত সর্বনাশের সুযোগ করে দেয়া। যে কোন কিছু ঘটে যাওয়ার আশংকা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর উপর ভরসা করে মজলূম খলীফা আবদুল হামীদ এবার খেলাফাতদেহের ‘বিষফোঁড়া’টা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ্)