কংগ্রেস ও বিজেপি
পার্থক্য কোথায়?
ভারতের মুসলিম নেতৃত্ব, শেখ আব্দুল্লাহ্ থেকে শুরু করে সমস্ত সেকুলার নেতা, এমনকি ধর্মীয় নেতৃত্বও বাদ যান না, মাওলানা আযাদ থেকে শুরু করে, সেদিনের মাওলানা আস‘আদ মাদানী পর্যন্ত সবাই হিন্দু নেতৃত্বকে দু’ভাগে ভাগ করে নিজেদের নীতি ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছেন। তাদের ধারণায় কংগ্রেসনেতৃত্ব জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনায় যথেষ্ট আন্তরিক এবং তাদের হাতে মুসলিম স্বার্থ যথেষ্ট নিরাপদ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী মুসলিম নেতৃত্ব যেমন কংগ্রেসের প্রতি অনুগত থেকেছে তেমনি, ধর্মীয় নেতৃত্ব অখ-ভারতের চেতনায় কংগ্রেসের ‘সহযোগী’ হয়েছেন। কারো নিয়তের সততায় আমাদের কোন প্রশ্ন নেই। আমাদের প্রশ্ন হলো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা নিয়ে। বিভাগপূর্ব হিন্দুরাজনীতির পূরো চিত্রই আমাদের সামনে ছিলো, হিন্দু-চরিত্র বোঝার জন্য যা যথেষ্ট হতে পারতো। পরবর্তী রাজনীতিও সামনে ছিলো, বন্দেমাতরম থেকে শুরু করে বাবরী ভাঙ্গা পর্যন্ত। ভারতবর্ষের আলেমগণ যদি কোনভাগে পাকিস্তানের দাবীতে অটুট ঐকবদ্ধ বাই‘আতে আবদ্ধ হতে পারতেন তাহলে আমাদের দরকষাকষি হতো অন্যরকম। পাকিস্তানের আয়তন হতো বর্তমানের তিনগুণ। অবিভক্ত বাংলা ও পাঞ্জাব হতো আমাদের। ...
কিংবা যদি আলেমসমাজ ও মুসলিম জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে পারতো অখ- ভারতের দাবীতে তাহলেও আমাদের দরকষাকষি হতো অন্যরকম। কয়েকটি প্রদেশ হতো আমাদের। আমরা প্রাদেশিক সেনাবাহিনীর দাবী করতে পারতাম, যা জাতীয় প্রয়োজনে কেন্দ্রের ডাকে সাড়া দেবে। ...
প্রয়োজন ছিলো শুধু একজন সিদ্ধান্তদাতা মুরুব্বির তত্ত্বাবধানে একত্র হওয়া। নিজ নিজ চিন্তা পেশ করা। তারপর মুরুব্বির ফায়ছালা আকড়ে ধরে কাজ করে যাওয়া। কারণ ইখতিলাফ দ্বারা তো আমরা কিছু পাইনি, শুধু হারিয়েছি। পক্ষান্তরে ক্ষুদ্র জাতি ইহুদি শুধু একতার মাধ্যমে এবং সুপ্রিম কমান্ডের অনুগত থাকার কারণে এতকিছু অর্জন করেছে, করতে পেরেছে।
যাক, প্রসঙ্গ থেকে দূরে চলে এসেছি। আমি বলতে চাচ্ছি, ভারতে আজ হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করেছে। কিন্তু ছলে বলে কৌশলে কাশ্মীরকে ভারতের অঙ্গীভূত করার লক্ষ্যে শুরু থেকেই কাজ করেছে হিন্দুনেতৃত্ব। বিশেষ মর্যাদার নামে শুধু আইওয়াস করা হয়েছে। আমাদের পরিভাষায় যার নাম ‘তিফলতাসাল্লি’ বা শিশুতোষ সান্ত¡না।
এক্ষেত্রে শুধু দু’টি বক্তব্যই আমাদের সামনে পুরো বিষয়টা স্পষ্ট করে তোলবে। বিজেপির বর্তমান যে পদক্ষেপ, ধরুন কখনো যদি কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে, আমার বিশ্বাস, কাশ্মীর আগের অবস্থায় যাওয়ার সুযোগ আর পাবে না; বাবরী মসজিদও...।
একারণেই দেখা যায়, উদারপন্থী বা জাতীয়তাবাদী হিন্দু
নেতাদের নিন্দাবক্তব্য যথেষ্ট দায়সারা গোছের। কতকটা যেন এই, কাশ্মীরের জনগণের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়া হয়নি কেন? সাংবিধাধিনক বাধ্যবাধকতা পূর্ণ অনুসরণ করা হয়নি কেন? বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের দিকটি বিবেচনায় আনা হয়নি কেন? ইত্যাদি। দেখুন রাহুলগান্ধি ও তার বোন কী বলছেন! এক টুইট বার্তায় রাহুল বলেছেন, একতরফাভাবে জম্মু-কাশ্মীরকে ছিন্ন করে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কারাবন্দী করে এবং আমাদের সংবিধান লঙ্ঘন করে জাতীয় সংহতিকে বাড়ানো যায় না। এদেশটি তার লোকেরা তৈরী করেছে, এটি জমির কোন প্লট নয়। কার্যনির্বাহী ক্ষমতার এই অপব্যবহারে আমাদের জাতীয় সুরক্ষার জন্য মারাত্মক প্রভাব রয়েছে।
রাহুলের বোন, ভারতীয় কংগ্রেসের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক প্রিয়াঙ্কা বলেছেন, অসাংবিধানিক পথে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। জম্মু-কাশ্মীরে যখন ৩৭০ অনুচ্ছেদ বহাল করা হয়েছিলো তখন বেশ কিছু নিয়মও তৈরী হয়েছিলো। ঐ নিয়মগুলোর তোয়াক্কা না করেই মোদি সরকার ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ করে দিয়েছে। কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতীয় কংগ্রেস সবার মতামতের সমান গুরুত্ব দিয়েছে। সবার মতামত নিয়েই আলোচনা করেছে। অথচ মোদি সরকার একতরফাভাবে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে।
এবার দেখুন, সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতী কী বলছেন! বরখাস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিই কাশ্মীরে বিজেপির সঙ্গে যুক্তসরকার গঠন করেছিলেন। তিনি তার টুইটবার্তায় বলেন, আজকের দিনটি ভারতীয় গণতন্ত্রের অন্ধকারতম দিন হিসাবে চিহ্নিত হবে। ৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করে ভারতের সঙ্গে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত আজ কাশ্মীরের জন্য বিপর্যয়কর প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের ৩৭০ অনুচ্ছেদ একতরফাভাবে বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ, অসাংবিধানিক, যা ভারতকে জম্মু-কাশ্মীরে পুরোপুরি দখল-দার শক্তিতে পরিণত করবে।
উল্লেখ্য, শেখ আব্দুল্লাহ্কে এটা বোঝানোর জন্যই মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, সুদূর কাশ্মীর ছুটে গিয়েছিলেন, যার জবাবে শেখ বলেছিলেন, ‘এখনই আপনি কাশ্মীর ত্যাগ করুন। কাশ্মীর সম্পর্কে আপনার চেয়ে আমি ভালো জানি!’ একজন মুসলিম জাতীয় নেতাকে একজন স্থানীয় মুসলিম নেতা এভাবেই সেদিন অসম্মানিত করেছিলেন!
হায়াদারাবাদের আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সর্ব-ভারতীয় ইত্তেহাদুল মুসলিমীন মজলিসের প্রধান মুসলিম সম্প্রদায়ের নির্ভীক কণ্ঠস্বর আসাদুদ্দীন ওয়াইসি বলেছেন, ভারত কাশ্মীরের ভূমি চায়, কাশ্মীরীদের চায় না। তবে মনে রাখা দরকার, কেউ পৃথিবীতে চিরদিন বেঁচে থাকে না এবং কারো ক্ষমতাই চিরস্থায়ী নয়।
নিজের সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমাকে দেশদ্রোহী সাব্বস্ত করা হবে। তারপর গুলি করে মেরে ফেলা হবে...!’
এই দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমি যে বার্তাটি গ্রহণ করতে চাই তা হলো। কাশ্মীর, বাবরী মসজিদ ও মুসলিম স্বার্থ, এ বিষয়ে হিন্দু নেতৃত্বের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যা কিছু পার্থক্য তা হলো কর্মপন্থা ও কর্মকৌশলে।
দ্বিতীয়ত ভারতবান্ধব মুসলিম নেতৃবৃন্দের বর্তমান প্রতিক্রিয়া যদি সত্যি বোধোদয় থেকে হয়ে থাকে, নিছক ক্ষমতার বঞ্চনাজনিত ক্ষোভ থেকে নয় তাহলে তাদের কর্তব্য হবে, চিরকালের জন্য ঐকবদ্ধ থাকার শপথ গ্রহণ করা এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী মুজাহিদীনকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাহায্য করে যাওয়া।
আমরা বিশ্বাস করি, ঈমান ও বিশ্বাসকে অবলম্বন করে যদি ভারতের মুসলিমসম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তাহলে জয় ও সফলতা তাদের সুনিশ্চিত। কারণ ইনশাআল্লাহ্ গাযওয়া-হিন্দের ভবিষ্যদ্বাণী সমাগত! *