আগেই বোঝা গিয়েছিলো,
কী হতে চলেছে কাশ্মীরে!
৪/৮/১৯ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক
কাশ্মীরে তখন রাষ্ট্রপতির শাসন চলছে। এর মধ্যে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে জুম্মু-কাশ্মীরের গভর্নর সত্যপাল মালিক কাশ্মীরী জনগণকে ‘আশ^স্ত’ করে বলেছিলেন, কাশ্মীরপ্রশ্নে সংবিধানের কোন পরিবর্তন করার পরিকল্পনা ভারত সরকারের নেই।
উল্লেখ্য, ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং এর আওতাভুক্ত ধারা ৩৫এ জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণকে আলাদা একটি সুরক্ষা দান করেছে। এই অনুচ্ছেদ ও ধারায় কাশ্মীরের স্থায়ী অধিবাসীদের সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বহিরাগতদের, অর্থাৎ ভারতের অন্যকোন প্রদেশের কোন ব্যক্তির এখানে জমি ও সম্পদ ক্রয়ের বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আরেকটি বিশেষ সুবিধা হলো, কোন অকাশ্মীরী কাশ্মীরে চাকুরিতে নিযুক্ত হতে পারবে না। এ সাংবিধানিক সুবিধা কাশ্মীরকে দিতে ভারত বাধ্য হয়েছিলো, কাশ্মীরভুক্তির পথ সুগম করার জন্য। কাশ্মীরের বৈরী জনগোষ্ঠীকে আশ^স্ত করার প্রয়োজন ছিলো যে, ভবিষ্যতে কখনো কাশ্মীরের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পরিবর্তন আনার ইচ্ছে বা পরিকল্পনা ভারতের নেই। ...
***
কাশ্মীরের পরিস্থিতি তখন এমন এক পর্যায়ে চলে এসেছিলো যে, গভর্নর সত্য মালিকের আশসে কাশ্মীরের জনগণ ভারতপন্থী বা ভারতবিরোধী কোন পক্ষই তাতে আস্থা স্থাপন করতে পারেনি। প্রশাসনের বিভিন্ন গতিবিধি ও বক্তব্য থেকে কাশ্মীরের জনগণ ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলো যে, গুরুতর কিছু একটা ঘটতে চলেছে। জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল দিলবাগ সিং গত সপ্তাহে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন যে, উত্তর কাশ্মীরে সেনাসংখ্যায় ঘাটতি রয়েছে। সে কারণে রাজ্যে অতিরিক্ত সেনা দরকার।
এর আগে বলা হয়েছিলো, কাশ্মীরে সন্ত্রাসদমন বাহিনীর শক্তি বাড়াতে ১০০ কোম্পানি সেখানে নতুন করে মোতায়েন করতে হবে। ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার অজিত দোভাল কাশ্মীর সফর করে আসার পরপর ঐ সিদ্ধান্তনেয়া হয়। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহষ্পতিবার সকাল থেকেই রাজ্যে সৈন্যদের আগমন শুরু হয়ে গিয়েছে, যাদেরকে সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানে মোতায়েন করা হচ্ছে।
সাউথ এশিয়ান মনিটর জানায়, অধিকৃত কাশ্মীরে দশহাজার আধা সামরিক সেনা পাঠানোর পর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে আরো পঁচিশহাজার সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পর্যবেক্ষক মহল এটাবে যুদ্ধকালীন সামরিক গতিবিধি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
মূলত এই সেনাসংখ্যা বাড়ানোর বক্তব্য ও পদক্ষেপ থেকেই কাশ্মীরে বিভিন্ন জল্পনা ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা শুরু হয়। কারণ আগে থেকেই কাশ্মীরে বিপুলসংখ্যক সেনা মোতায়েন রয়েছে। এমন নতুন কোন পরিস্থিতি তো সৃষ্টি হয়নি যাতে সেনাসংখ্যা বৃদ্ধির আশু প্রয়োজন দেখা দেবে।
এদিকে আরেকটা বিষয়ও পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। হঠাৎ করে বিখ্যাত অমরনাথ তীর্থ যাত্রা আপাতত চৌঠা আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। কারণ হিসাবে ‘প্রতিকূল আবহাওয়া’ সামনে আনা হয়েছে। অথচ আবহাওয়া দফতরের পক্ষ হতে বড় ধরনের কোন প্রতিকূল আবহাওয়ার কথা বলা হয়নি। সূত্র জানিয়েছে, তীর্থযাত্রীদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সৈন্যদের অন্যত্র মোতায়েনের প্রয়োজনেই মূলত এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এখান থেকেই যাদের কিছুটা রাজনৈতিক বুঝজ্ঞান রয়েছে তারা ধরে নিয়েছে যে, সম্ভাব্য কোন আইনশৃঙ্খলাপরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আগাম প্রস্তুতি হিসাবে উপরোক্ত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
পরিস্থিতি আরো স্পষ্ট হয়ে যায় যখন পয়লা আগস্ট কেন্দ্রীয় সরকার সশস্ত্র পুলিশবাহিনীর আরো ২৮হাজার সদস্যকে জম্মু ও কাশ্মীরে পাঠিয়ে দেয়।
এর মধ্যে বোমাবিস্ফোরণ ঘটান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে জানান, ভারতের সশস্ত্রবাহিনী কাশ্মীরের নিরস্ত্র জনতার উপর গুচ্ছবোমা নিক্ষেপ করছে, যা আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ। কারণ এর মারাত্মক প্রভাব রয়েছে, যা ব্যাপক প্রাণহানির কারণ হতে পারে।
ইমরান খান তার বিবৃতিতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে বলেন, অধিকৃত কাশ্মীরের জনগণের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের অবসান ঘটানোর সময় এসে গিয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক (বরখাস্তকৃত) মুখ্যমন্ত্রী ও পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতীর বক্তব্যে আসন্ন ঝড়ের সমস্ত আলামত বেশ পরিষ্কার হয়ে যায়। তিনি মোদির উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন রাখেন, বাইরে থেকে আগত পর্যটক ও অন্যান্য লোকজনকে কাশ্মীর থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে, আবার সেনাসংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, এসবের অর্থ কী? কেন্দ্রীয় সরকারকে আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, ৩৭০ অনুচ্ছেদ ও ৩৫এ ধারায় কোন গরমিল করার অপচেষ্টা হলে পরিণতি মোটেই ভালো হবে না।
মূলত মুফতীর এ ‘ফতোয়া’ থেকেই কাশ্মীরের মুসলিম জনতা বুঝে নিয়েছে আগামী কয়েক-দিনের মধ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে।
কিন্তু কয়েকদিন নয়, পরের দিন ৫ই আগস্টই এসে যায় সেই কালো দিন। সংবিধান থেকে রহিত হয়ে যায় ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং এর অধীন ৩৫এ ধারা। বাকি ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যতই বলবে। আমরা শুধু কামনা করি আল্লাহ্ যেন কাশ্মীরকে... *
মোদির উদ্দেশ্যে মেহবূবা মুফতি
কোথায় গেলো ইনসানিয়াত, জমহূরিয়াত
কাশ্মীরিয়াত!
ভারত-অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি সবসময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি ইনসানিয়াত, জমহূরিয়াত ও কাশ্মীরিয়াতের নীতি অনুসরণ করবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, কোথায় গেল আপনার ইনসানিয়াত, জমহূরিয়াত ও কাশ্মীরিয়াত? শিশু, যুবক ও নারীবৃদ্ধকে নির্বিচারে গুলি করা, মা-বোনকে ধর্ষণ করা, এটাই কি ইনসানিয়াত? সামান্য প্রতিবাদও সহ্য না করা, এটাই কি জমহূরিয়াত? কাশ্মীরকে যেভাবে বৃহৎ কারাগারে পরিণত করা হয়েছে, এটাই কি আপনার তথাকথিত কাশ্মীরিয়াত?
বেচারা মেহবুবা মুফতি, তিনি নিজেও জানেন, কোন জবাব পাওয়া যাবে না। তবু সান্ত¡না, তিনি প্রশ্ন করতে পেরেছেন! আগামীদিন হয়ত ...
বিলম্বিত বোধোদয় কী কাজে আসে? পাকিস্তানে যোগ না দেয়া কি ভুল ছিলো? মেহবুবা মুফতি
শাব্দিক অর্থেই কাশ্মীরের পরিস্থিতি এখন বিস্ফোরনোন্মুখ। জম্মু-কাশ্মীর এতদিন সংবিধানের যে ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং এর আওতাধীন ৩৫এ ধারার আলোকে কিছু বিশেষ মর্যাদা ও সুবিধা ভোগ করে এসেছে ঐ অনুচ্ছেদ ও ধারা সংবিধান থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। ফলে জম্মু ও কাশ্মীর এখন ভারতের অন্য যে কোন রাজ্যের সমান কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর যে, কাশ্মীরের নেতা ও জনতা এখন আচমকা আঘাতে সম্বিতহারা। কাশ্মীরের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি তীব্র ভাষায় তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, জনগণ এখনো চিন্তা করছে যে, পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে তারা ভুল করেছেন।
ভারত সরকারের নেয়া এ সিদ্ধান্তকে তিনি গণতন্ত্রের জন্য কালোদিবস বলে মন্তব্য করেছেন। ইন্ডিয়া টু ডে-এর কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ৫ই আগস্ট গণতন্ত্রের জন্য কালো দিবস কারণ এই দিন জনগণকে দেয়া অধিকার চোরের মত কেড়ে নেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ভারত এত বড় একটি দেশ, তারপরো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছোট একটি রাজ্যের ভয়ে সে ভীত। রাজ্যের জনগণকে দমন করার জন্য পুরো দেশকে কারাগারে পরিণত করেছে বিজেপি সরকার। কাশ্মীরী জনগণের সঙ্গে ভারত প্রতারণা করেছে মন্তব্য করেমেহবুবা বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ ভারতে বিশাস করি, কিন্তু তারা আমাদের এ বিশাস ভেঙ্গে দিয়েছে। জনগণ এখনো চিন্তা করছে যে, তারা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে ভুল করেছে।
আমার সরকারকে ভেঙ্গে দিয়েই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছে, একথা স্মরণ করে মুফতি মেহবুবা বলেন, বিজেপি সরকার যদি মনে করে, তাদের নীতি কার্যকর ও সফল তাহলে কেন তারা রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করবে? স্পষ্ট বোঝা যায়, সরকার আশা হারিয়ে ফেলেছে।
মেহবুবা আরো বলেন, যে সকল কাশ্মীরী এতদিন ভারতকে সমর্থন করেছে তাদের উপরো চরম যুলুম নির্যাতন নেমে এসেছে। তারা এখন কারাগারে বা গৃহে বন্দী। মেহেবুবা চরম হতাশার সুরে বলেন, সরকার এতদিন স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে যা করার করেছে, এবার তারা ‘মূলধারার’ ভারতবান্ধব নেতাদের সঙ্গে এবং রাজনৈতিক দলগেুলোর সঙ্গেও একই কৌশল অবলম্বন করছে।
মুফতি মেহবুবার মেয়ে ইলতিজা মুফতি ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, কাশ্মীরীদের আজ জানোয়ারের মত খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। সর্বপ্রকার মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে তারা আজ বঞ্চিত।
ইলতিজা মুফতি আরো বলেন, অখ- ভারতের উপর আমাদের গর্ব ছিলো; এটাই কি সেই ভারত যেখানে জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়ে উল্লাস করা হয়?!
***
মাহবূবা মুফতিকে ধন্যবাদ যে, তার বাপদাদা না হোক, তিনি অন্তত সত্যকে স্বীকার করে নিয়েছেন। আজ তার বোধোদয় হয়েছে যে, দ্বিজাতিতত্ত্ব সত্য, তবে অনেক বেশী মূল্য দিয়ে তাকে এ সত্য উপলব্ধি করতে হয়েছে।
তিনি আরো বড় তাৎপর্যপূর্ণ একটি সত্য বলেছেন, ‘কাটা পড়া গাছ কুঠারের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করেনি। কারণ কুঠারের গোড়ায় তো গাছেরই ডাল ছিলো।’
আমরা কামনা করি, এটা যেন তার প্রকৃত বোধোদয় হয়, নিছক রাজনৈতিক কৌশল নয়।
মেহবুবা মুফতির পরিচয়
মেহবূবা মুফতির পিতা মুফতি সাঈদ ১২ জানুয়ারী ১৯৩৬ কাশ্মীরের এক জায়গীরদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৭ই জানুয়ারি ২০১৬ আশিবছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি থেকে আইনের ডিগ্রি লাভ করে তিনি কাশ্মীরের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে কাশ্মীরকংগ্রেসের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। রাজনৈতিক নির্বাসনের সময় তিনি দিল্লীতে ছিলেন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করে জনতাদলের সরকারে প্রথম মুসলিম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। কাশ্মীরে ফিরে তিনি দল গঠন করার মাত্র তিন বছরের মাথায় দোসরা নভেম্বর ২০০২ সালে মুখ্যমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হন। কাশ্মীরের ভারত -ভুক্তির ক্ষেত্রে শেখ আব্দুল্লাহ্র সঙ্গে তারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। *