ইউরোপের একমাত্র মুসলিম অঞ্চল বলকান, তারই একটি অংশ বসোনিয়া ও হার্জেগোভীনা; খুব বেশী দিন তো হয়নি, ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য গণহত্যা ও নির্মম মুসলিম নিধনযজ্ঞের ঘটনা ঘটলো সরা বিশ্বের চোখের সামনে!
তাদের প্রথম অপরাধ তারা মুসলিম, এক আল্লাহতে বিশ্বাসী, আখেরী নবীর উম্মত। দ্বিতীয় অপরাধ, তারাও কয়েকটি অমুসলিম প্রদেশের মত স্বাধীন হতে চেয়েছে সার্বিয়া (সাবেক যুগোস্লাভিয়া) থেকে। সেটা ১৯৯৫ সালের ঘটনা। আমরা যে মর্মান্তিক ঘটনার কথা এখানে বলতে যাচ্ছি তা আরো একবছর পরের ঘটনা। ইউরোপের কতিপয় ‘সেবাসংস্থা
মুসলিম শিশু ও তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত মায়েদের একত্র করেছে বসোনিয়ার রাজধানী সারায়েবু’র ফুটবল স্টেডিয়ামে।
মায়েদের বোঝানো হলো, এখানে সার্ব নরপশুদের হাতে তোমাদের সন্তানেরা নিরাপদ নয়। তাদের আমাদের হাতে অর্পণ করো। আমরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রতিপালন ও শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে তাদের নিরাপদ জীবন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত করবো।
মায়েরা তো চিরকাল মমতার হাতে মজবূর। তারা ভাবলো, এখানে গুলি খেয়ে এবং না খেয়ে মরার চেয়ে তো এটা ভালো! তাই মমতার টানেই বুকের সন্তানদের তারা তুলে দিলো অচেনা সেবাসংস্থাগুলোর হাতে।
বাচ্চাদের বাসে তোলা হলো। মায়েদের বুক খালি হয়ে গেলো। বাস চলতে শুরু করলো। মাঝখানে জানালায় কাঁচের দেয়াল। একদিকে অবুঝ শিশুদের বোবা চাহনি, অন্যদিকে মায়েদের চোখে পানি, আর হৃদয়ে রক্তক্ষণর। একটি বাচ্চা যেন জানালার কাঁচের ওপাশ থেকে মা বলে চিৎকার করে উঠলো, আর এক মা চলন্ত বাসের দিকে দৌড়ে গেলেন, কিন্তু ...!! দ্বিতীয় বাসও প্রস্তুত। এক ‘হিজাবিনী’ মা চাঁদের মত ফুটফুটে শিশুটিকে তুলে দেয়ার আগে, জীবনের শেষ বিদায় জানাবার আগে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শুধু বলতে পারলেন। বাবা, শুধু মনে রেখো, তুমি মুসলিম। তুমি এক আল্লাহর বান্দা এবং আখেরী নবীর উম্মত।
তোমার আম্মুর নাম আয়েশা। ওরা তোমার নাম বদলে দিতে পারে, কিন্তু মনে রেখো, চিরকালের জন্য তোমার নাম মুহম্মাদ আলফাতেহ।
তোমার বাড়ীর ঠিকানা...
বাবা, সবকিছু ভুলে যেয়ো, তোমার মাকেও, কিন্তু তোমার বিশ্বাস ও পরিচয়কে নয়।
সময় নিজের গতিতেই এগিয়ে চলে। সময় নাকি যে কোন যখমের জন্য সর্বোত্তম মলম। কিন্তু মায়েদের দিলের যখম সময়ের মলমও শুকোতে পারেনি। দীর্ঘ পনেরো বছর পার হওয়ার পরেও না।
হঠাৎ একদিন সাদা চুলের পর্দানশীন আয়েশার নামে একটি চিঠি এলো। তিনি কম্পিত হাতে চিঠিখানা নিলেন। পড়ার আগেই তার চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো। অনেক কষ্টে শুধু দেখলেন, শুরুতে লেখা, ‘মা, আমার মা, আমার জান্নাত! আর শেষে লেখা, তোমারই চিরকালে মুহম্মদ আল ফাতিহ! সময়ের গতি থেমে থাকে না, বয়ে যেতেই থাকে, নদীর স্রােতের মত। একে একে পার হয়ে গেলো আরো পাঁচটি বছর।
বসোনিয়ার হতভাগিনী মা আয়েশা তখন বার্ধক্যের ভারে ...! তার দৃষ্টি এখন এমনই ঝাপসা যে, কোন কিছু ভালো করে পড়তে পারেন না। তবু মাঝে মধ্যে কতকটা যেন নিজের মনেই বলে ওঠেন, দয়াময় ওর শেষ চিঠিটা পড়ার আগে যেন আমার দৃষ্টি...!
হাঁ, শেষ চিঠিটাই তিনি পেলেন বুকের মানিকের কাছ থেকে। তাতে লেখা ছিলো-
‘মা, তুমি কি বেঁচে আছো মা! আমার কেন জানি মনে হয়, তুমি ওপারে আমার প্রতীক্ষায় আছো মা! আমারও জীবন প্রদীপ নিভে আসছে মা। আল্লাহর দয়ায় জান্নাতের দুয়ারে আমাদের দেখা হবে মা!
ওরা আমাকে গীর্জার সেবাদাস বানিয়েছে, কিন্তু আল্লাহর দাসত্ব ভুলাতে পারেনি মা! আমি আমার বিশ্বাস রক্ষা করেছি মা!
কিছুদিন আগে গভীয় রাতে গীর্জার নির্জনতায় নামায পড়ছিলাম মা! কীভাবে যেন ওরা দেখে ফেলে! তারপর তো সত্যি সত্যি কেয়ামত নেমে এলো মা!
নির্যাতনের এমন কোন প্রকার ছিলো না মা, যা ঐ হায়েনারা আমার উপর প্রয়োগ করেনি। মারতে মারতে হয়ত মেরেই ফেলতো আমাকে মা!
গীর্জার ফাদার, এত দিন যাকে সবকিছুতে দেখেছি হৃদয়হীন, কীভাবে যেন সেদিন তারও মনে দয়া জেগে ওঠলো। তিনি তাদের অনেক বুঝিয়ে আমাকে উদ্ধার করলেন এবং নিজের দায়িত্বে হাসপাতালে নিয়ে এলেন।
আজ সন্ধ্যায় চুপি চুপি বললেন, আমি বিশ্বাস করি, তোমার ধর্ম সত্য! এজন্যই তোমার অন্তরে এত শক্তি! এটি আর কিছু না, বিশ্বাসের শক্তি!
ধীরে ধীরে আমি শেষ সময়টির দিকেই এগিয়ে চলেছি মা! তাই আমার মনে হয় তুমি আর বেঁচে নেই মা...
এর পর আর কিছু লেখা নেই। এমন চিঠির এমন অসমাপ্তির চেয়ে সুন্দর সমাপ্তি হয়ত আর কিছু হতে পারতো না!
বৃদ্ধা মা চিঠিটা হাতে নিয়েই ‘ইয়া আল্লাহ’ বলে এমন বুকফাটা চিৎকার করলেন, আশেপাশের সবাই জড়ো হয়ে গেলো। তিনি সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন, তবে আর উঠলেন না! তার বুকের মানিক যে ...!!