গীবত নফসের ভয়ঙ্কর বিমারি আসুন বাঁচার চেষ্টা করি!
হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ তাক্বী উছমানী দা.
জিহ্বা থেকে নির্গত একটি বাক্য, এমনকি একটি শব্দ হতে পারে দু’জন মানুষের মধ্যে, দু’টি পরিবারের মধ্যে, এমনকি দু’টি দেশের মধ্যে যুদ্ধের কারণ। এর বহু নযির আছে আমাদের সমাজে, আমাদের দেশে, আমাদের এই পৃথিবীতে।
একই ভাবে জিহ্বা দ্বারা উচ্চারিত একটি বাক্য, এমনকি একটি শব্দ হতে পারে দুই শত্রুর মধ্যে, দু’টি বিবাদমান পরিবারের মধ্যে, এমনকি দু’টি শত্রুদেশের মধ্যে সন্ধি, সমঝোতা, শান্তি ও মৈত্রির কারণ। এরও বহু নযির রয়েছে আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে, আমাদের এই পৃথিবীতে।
الحمد لله رب العالمين والعاقبة للمتقين؛ والصلاة والسلام على رسوله الكريم؛ وعلى آله وأصحابه أجمعين؛ أما بعد
হযরত হাকীমুল উম্মত থানবী রহ. গীবত থেকে বাঁচার উপায়রূপে একটি বুনিয়াদি কথা বলেছেন-
‘চিন্তা ছাড়া কিছুতেই যেন কোন কথা না বলা হয়। যদিও কখনো কখনো চিন্তা করে কথা বলার বিষয়টি মনেই থাকবে না, তবে খেয়াল রাখার চেষ্টা করতে থাকলে বেশীর ভাগ সময় মনে থাকবে যে, চিন্তা করে যেন কথা বলি। এর পরে ইনশাআল্লাহ আর গাফলত ঘটবে না। তো যে কোন কথা বলার আগে এটা চিন্তা করা কর্তব্য যে, এর দ্বারা গোনাহ তো হবে না? ইনশাআল্লাহ্ এই চেষ্টা দ্বারাই অনেক দূর সংশোধন হয়ে যাবে।’ (আনফাসে ঈসা-১৪৯ পৃ.)
অর্থাৎ চিন্তা ছাড়া কথা বলার যে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, তা দূর করো। যখনই কিছু বলবে চিন্তা করে বলবে যে, মুখ থেকে যে শব্দ বের করতে চাই সেটা যেন আমাকে গোনাহর মধ্যে এবং আল্লাহ্র নাফরমানির মধ্যে লিপ্ত না করে ফেলে? হাদীছের মযমূন রয়েছে- যদি বলতে চাও, উত্তম কিছু বলো, আর না হয় নীরব থাকো।’
ইমাম শাফেয়ী রহ., তাঁর কাছে যারা আসতো, এ মযমূনের উপর খুব জোর দিয়ে তাদের উপদেশ দিতেন।
ফযূল কথা, বেহুদা কথা, যা জাহান্নামের আযাবের কারণ হবে, বলে বেড়ানোর চেয়ে চুপ থাকা তো হাজার গুণ ভালো।
যা জাহান্নামে উপুড় করে নিক্ষেপ করে!
হাদীছ শরীফে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
هَـلْ يَـكُـبُّ الـنـاسَ فِـى الـنَّـارِ إلَّا حَـصـائِـدُ أَلْـسِـنَـتِـهِـمْ؟
যে জিনিস মানুষকে উপুড় করে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করে তা তাদের মুখের (লাগামছাড়া) কথাই তো!
এই মহাফিতনা থেকে আল্লাহ্ পানাহ্ দান করুন। যবান এমন এক যন্ত্র যা আল্লাহ্ তা‘আলা দয়া করে মানুষকে দান করেছেন। জন্ম থেকেই এটা চলছে এবং মৃত্যু পর্যন্ত চলতেই থাকবে। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মত, তেল-জ¦ালানীর কোন খরচ নেই, কোন মেহনত কসরত নেই। কোন কিছু বলার ইচ্ছা হলো, ব্যস যবানের মাধ্যমে বাইরে এসে গেলো!
এত বড় এবং এত মূল্যবান নেয়ামতের কদর শুধু এজন্য আমাদের হয় না যে, কোন মেহনত ছাড়া, সাধনা ছাড়া এটা আমরা পেয়ে গিয়েছি এবং শৈশব থেকে এটা আমাদের সঙ্গে থেকে কাজ করে যাচ্ছে, না কোন খরচ, না কোন কষ্ট। ব্যস, শুধু এজন্য এর কদর হয় না।
যবানের কদর করা উচিৎ
মুখের মধ্যে বিদ্যমান, এই ছোট্ট একটুকরা গোশতের কদর ও কীমত কত তা ঐ লোকদের জিজ্ঞাসা করুন, কোন কারণে যাদের বাকশক্তি রহিত হয়ে গিয়েছে, যারা নির্বাকতার আযাব-যন্ত্রণার শিকার। আমাদের মত তারাও কথা বলতে চায়, বিবিবাচ্চার সঙ্গে, মা-বাবার সঙ্গে, ভাই-বোন ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে, কিন্তু বলতে পারে না। মুখের অভিব্যক্তি থেকেই বোঝা যায়, কী এক অস্থিরতায় ভিতরে ছটফট করছে যে, মনের কথা কীভাবে বলতে পারি! ভিতরের ভাব ও ভাবনা কীভাবে আপনজনদের বোঝাতে পারি!!
তখন বুঝে আসে, এই যবান ও তার বাকশক্তির কী মূল্য। আল্লাহ্ না করুন, আমাদের কারো যদি শুধু দুই মিনিটের জন্য বাকশক্তি বন্ধ হয়ে যায়, আর যদি তাকে বলা হয়, বাকশক্তি যদি ফিরে পেতে চাও তাহলে এর জন্য তোমাকে মূল্য দিতে হবে, তখন তো সাধ্যের ভিতরে, এমনকি সাধ্যের বাইরেও সবকিছু খরচ করতে তৈয়ার হয়ে যাবে। অথচ সেই মুফতে পাওয়া যবান কেঁচির মাত চালিয়েই যাচ্ছি, ভালো মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ ও হারাম-হালালের কোন চিন্তাই করছি না। এমনকি এ কথাও ভাবছি না যে, আখেরাতে এ জন্য আমাকে কী পরিণতি ভোগ করতে হবে?
দু’টি মহান শব্দ
আমাদের কাছে শরী‘আতের দাবী এই যে, এত বড় নেয়ামত, এত বড় উপকারী যন্ত্র যখন বিনামূল্যে, বিনা মেহনতে পেয়েছো, তো এটাকে উত্তম কাজে, কল্যাণের পথে এবং ছাওয়াবের ক্ষেত্রে ব্যবহার করো। অন্যায় কাজে এবং হারামের ক্ষেত্র থেকে এটাকে বাঁচিয়ে রাখো।
মানুষ যদি এর দ্বারা উপকার ও ফায়দা হাছিল করতে চায় তাহলে এর উপকার ও ফায়দাও বে-ইন্তিহা, বে-শুমার; এর কল্যাণ ও ছাওয়াবও বিরাট। হাদীছ শরীফে এসেছে, মুখে একবার যদি শুধু سـبـحان الله বা الـحـمـد لله বলে তাহলে আখেরাতে আমল ওজন করার যে পাল্লা বা মীযান রয়েছে তা অর্ধেক ভরে যায়। এ হাদীছ তো খুবই মশহূর, আমরা সবাই জানি-
كَـلِـمَـتـانِ حَـبِــيـبَــتـانِ إلى الرَّحْـمـنِ، خَـفِـيـفَـتـانِ عَلى اللِّسانِ، ثَـقِـيـلَـتـانِ فِـى الْـمِـيـزانِ، سُـبْـحـانَ اللهِ وَبِـحَـمْـدِه، سُـبـْحـانَ اللهِ الْعَـظـيـمْ
দু’টি শব্দ যা দয়াময়ের কাছে খুবই প্রিয়, মুখে যার উচ্চারণ খুবই সহজ, কিন্তু মীযানে খুবই ওজনদার, সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী, সুবহানাল্লাহিল আযীম।
চিন্তা করুন, কত সহজে, কত কম সময়ে, বরং একমুহূর্তে উচ্চারণ করা যায়, ইচ্ছা হলো, আর বলা হয়ে গেলো, আর আমলনামায় জমা হয়ে গেলো! অথচ আল্লাহ্র সামনে যেদিন তা পেশ করা হবে এবং আমলের মীযানে মাপা হবে, পাল্লায় তোলা হবে তখন তা খুব ভারী হবে। কত ভারী হবে তা শুধু আল্লাহ্ জানেন। আসুন একবার উচ্চারণ করি, দিল দিয়ে, খুলূছের সঙ্গে-
سُـبْـحـانَ الله وَبِـحَـمْـدِه، سُـبْـحـانَ الله العَـظِـيـمْ
এখন বিশ^াস করুন, আল্লাহ্ খুশী হয়েছেন এবং ইনশাআল্লাহ্ মীযানে তা খুব ভারী ও ওজনদার হবে।
মোটকথা, মানুষ যদি যবানকে ঠিক মত ব্যবহার করতে থাকে তাহলে জান্নাতে সে নেয়ামতের স্তূপ তৈরী করতে পারে, বলতে গেলে বিনা মেহনতে। যদি সে উঠতে বসতে চলতে ফিরতে যবানকে আল্লাহ্র যিকির দ্বারা তরুতাজা রাখে।
হাদীছ শরীফে এসেছে, এক ছাহাবী নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, সবচে’ উত্তম আমল কোন্টি? উত্তরে তিনি বললেন, সবচে’ উত্তম আমল এই যে, তোমার যবান ও জিহ্বা যেন আল্লাহ্র যিকির দ্বারা সজীব থাকে।
‘সজীব থাকা’ এটা অব্যাহত থাকা বোঝায়। অর্থাৎ উঠতে বসতে, চলতে ফিরতে যদি আল্লাহ্র যিকির করতে থাকো তাহলে একদিকে তো তোমার যবান নাফরমানির কথা উচ্চারণ করার আযাব থেকে বেঁচে যাবে, অন্যদিকে তোমার আমলনামা সমৃদ্ধ হতে থাকবে, নেকি ও ছাওয়াবের স্তূপ জমা হতে থাকবে। আল্লাহ্ তোমার প্রতি খুশী হতে থাকবেন।
যবান ইসলামে দাখেল হওয়ার মাধ্যম
এই যবান ও জিহ্বাই তো মানুষকে কুফুরের অন্ধকার থেকে ঈমানের আলোর মধ্যে নিয়ে আসে। সত্তর বছরের কাফের, আল্লাহ্ তাকে ঈমানের তাওফীক দিলেন, আর সে জিহ্বা দ্বারা একবার, শুধু একবার তাওহীদের কালিমা উচ্চারণ করলো-
أَشْهَدُ أَن لَّا إلهَ إلَّا الله وَ أَشْهَدُ أَنَّ مُـحَـمَّـدًا عَـبْـدَه وَ رَسُـولُـه
ব্যস, সত্তর বছরের কাফির জাহান্নাম থেকে নাজাত পেয়ে জান্নাতের অধিকারী হয়ে গেলো। সাত তবক জাহান্নাম থেকে বের হয়ে জান্নাতুল ফেরদাউসের আ‘লা মাকামে পৌঁছে গেলো!
কিসের কল্যাণে? কিসের বরকতে? হাঁ, শুধু এই ছোট্ট যবানের বরকতে! আল্লাহ্ তা‘আলা এই যবানের মধ্যে এমনই আছর রেখেছেন যে, কাফির-মুশরিকের সারা জীবনের কুফুর-শিরক, ফাসিক-ফাজিরের সারা জীবনের ফিসক-ফুজূর ও পাপাচার মুহূর্তের মধ্যে ধুয়ে মুছে পাকছাফ হয়ে যায়। সারা জীবন তার কেটেছে শিরক ও কুফরির মধ্যে, পাপাচার ও বদআমলের মধ্যে, জীবনের শেষ সময়ে এসে আল্লাহ তাকে ঈমানের তাওফীক দান করলেন, সে কালিমা উচ্চারণ করলো, পাপাচার থেকে তাওবা করলো, আর তখনই তার ইন্তিকাল হয়ে গেলো। এখন কী হলো? কালিমা পড়ার আগে, তাওবা করার একটু আগে যদি তার মৃত্যু হয়ে যেতো, সোজা জাহান্নামে চলে যেতো। কিন্তু কালিমা উচ্চারণ করছে, আর মারা গিয়েছে, ব্যস, সোজা জান্নাতে চলে গেলো! একটা কালিমা, কালিমার শুধু একবারের উচ্চারণ তাকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে পৌঁছে দিলো!
যবানের ক্ষতিও সর্বনাশা
তো মানুষ যদি ইচ্ছা করে, এই যবান ও জিহ্বার মাধ্যমে আখেরাতের পুঁজি জমা করতে পারে, তিলাওয়াতের মাধ্যমে, যিকির, তাসবীহ্, হামদ ও ছানা দ্বারা, ছবর ও শোকর দ্বারা, মুসলমান ভাইয়ের দিল খোশ করা দ্বারা। হাঁ, মুখ থেকে এমন কোন শব্দ বের করা যার দ্বারা কোন মুসলমানের দিল খোশ হয়ে যায়, হাদীছ শরীফের বয়ান মতে এটাও বান্দার পক্ষ হতে ছাদাকা বলে গণ্য হবে, যাকে বলে মুফতের ছাদাকা! বিনা খরচের ছাদাকা!
আবার যবান ও জিহ্বাকে যদি অন্যায় কাজে ব্যবহার করা হয় তাহলে এর নোকছান ও ক্ষতিও বিরাট। এ হাদীছ তো আগেই বলা হয়েছে যে, যবান ও জিহ্বার ‘ফসল’ই মানুষকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। যবান মিথ্যা বলছে, গীবত করছে, মানুষের দিলে কষ্ট দিচ্ছে, অশ্লীল কথা ও ফুহশকালামি হচ্ছে,এগুলো সবই মানুষকে জাহান্নামের আগুনে উপুড় করে নিক্ষেপ করবে।
সুতরাং নাজাতের রাস্তা এটাই যে, খুব ভেবে চিন্তে যাবান ও জিহ্বা ব্যবহার করো। এ জন্য হযরত হাকীমুল উম্মত রহ. বলেছেন, যখনই কিছু বলতে চাও, বলার আগে চিন্তা করে নাও যে, এই শব্দ, এই কথা জান্নাতের দিকে নিয়ে যাবে, নাকি জাহান্নামের দিকে?
যবান সম্পর্কে ইমাম শাফে‘ঈ রহ. এর আমল
হযরত ইমাম শাফে‘ঈ রহ. সম্পর্কে লেখা হয়েছে যে, কোন ব্যক্তি যদি কোন বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করতো, কখনো কখনো এমনও হতো যে, কোন উত্তর না দিয়ে দীর্ঘ সময় তিনি নীরব থাকতেন।
কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসা করতো, হযরত, এত সময় হয়ে গেলো, আপনি কিছুই বলছেন না! তখন তিনি বলতেন, আমি বোঝার চেষ্টা করছি যে, এ বিষয়ে নীরব থাকা উত্তম, না কথা বলা।
ব্যস, এটাই নাজাতের পথ, এটাই নিরাপদ থাকার উপায় যে, ‘আগে ওজন করো, পরে উচ্চারণ করো’। মুখ থেকে যে কথাই বের করবে, আগে চিন্তা করে নাও, এর দ্বারা তোমার উপকার হবে, না ক্ষতি?
যবানের হিফাজত, জান্নাতের যামানত
এক হাদীছ শরীফে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
مَـن يَّـضْـمَـنْ لِـي مـا بَــيْـنَ لِـحْـيَــيْـهِ وَمـا بَــيْـنَ رِجْـلَـيْـهِ أَضْـمَـنْ لَهُ الْـجَـنَّـةَ
দুই উরুর মাঝে এবং দুই চোয়ালের মাঝে যা আছে তার বিষয়ে যে আমাকে নিশ্চয়তা দেবে, আমি তাকে জান্নাতের বিষয়ে নিশ্চয়তা দেবো।
যবানে নবুয়তের, দেখুন কী শালীন প্রকাশ! দুই উরুর মাঝে যা আছে, অর্থাৎ লজ্জাস্থান, দুই চোয়ালের মাঝে যা আছে, অর্থাৎ জিহ্বা, কেউ যদি নিশ্চয়তা দেয় যে, এ দু’টি অঙ্গ সে ভুল স্থানে ভুলভাবে ব্যবহার করবে না, আল্লাহর পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিচ্ছেন। জান্নাতে যাওয়ার পথে যেন তার আর কোন বাধা নেই!
এখানে যবানের আলোচনা হচ্ছে। তাই শুধু যবান সম্পর্কে বলছি। খুব সাবধান মেরে ভাই! এমন যেন না হয় যে, মুফতের যন্ত্র পেয়েছি, ব্যস, সকাল থেকে সন্ধ্যা কেঁচির মত চলতে থাকলো। যা মনে আসছে, মুখে আসছে বলতেই থাকলো। কোন চিন্তা নেই, ভাবনা নেই। এ অবস্থা কিন্তু কোন ভাবেই ঠিক নয়। বরং আগে চিন্তা করো যে, উপকার হবে, না ক্ষতি, তারপর উচ্চারণ করো।
ফযুল ও বেহুদা কথার এক ঘটনা
দিল্লীতে হযরত মির্যা মাযহার জানে জানাঁ রহ. বড় উচ্চস্তরের অলী বুযুর্গ ছিলেন। খুব নাযুক তবিয়ত ও সংবেদশীল রুচির অধিকারী ছিলেন। এ সম্পর্কে বহু ঘটনা মশহূর আছে।
একবার বলখ থেকে দু’জন তালিবে ইলম এলো। উদ্দেশ্য হযরতের হাতে বাই‘আত হওয়া এবং ইছলাহ ও আত্মসংশোধনের মুজাহাদা করা। বলখ হচ্ছে আফগানিস্তানের প্রসিদ্ধ শহর। তো সেখান থেকে বহু দূরের পথ অতিক্রম করে তারা হযরত জানে জানাঁ-এর মসজিদে উপস্থিত হলো। নামাযের সময় আসন্ন ছিলো। তাই তারা হাউযের পারে বসে অযু করতে লাগলো। অযু করার সময় তাদের মধ্যে কথা হলো যে, এই হাউযটি বড়, না আমাদের বলখের মসজিদের হাউযটি বড়? হযরত জানে জানাঁ ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় তাদের তর্ক শুনতে পেলেন।
নামায থেকে ফারেগ হয়ে যখন তালিবে ইলম দু’জন হযরতের খিদমতে হাযির হয়ে আরয করলেন, আমরা সুদূর বলখ থেকে এসেছি আপনার হাতে বাই‘আত হওয়ার নিয়তে।
তখন তিনি ধীরে ধীরে বললেন, বাই‘আত হতে তো এসেছেন, কিন্ত ু ফায়ছালায় কি পৌঁছতে পেরেছেন, এই হাউয বড়, না বলখের হাউয? এখন তো তারা শরমিন্দা, খামোশ!
তখন হযরত বললেন, ‘বাই‘আত তোমরা পরে হয়ো। এখন বলখে যাও। ওখানকার হাউয মেপে আসো, তারপর এই হাউয মেপে ফায়ছালা করো, কোনটা বড়?’
একেই বলে ইছলাহ ও তারবিয়াত! এভাবে সম্পন্ন হয় নফসের ইছলাহ ও স্বভাবের সংশোধন।
প্রথম কথা হলো, তারা তো তাহকীক ও নির্ভুল তথ্য না জেনেই তর্কে লিপ্ত হয়েছে। তাতে বোঝা যায়, স্বাভাবের মধ্যে সতর্কতা ও দায়িত্ববোধ নেই। দ্বিতীয় কথা হলো, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বেহুদা ও বেকার কথা বলার অভ্যাস শিকড় গেড়ে আছে। যদি ফায়ছালা হয়েও যায়, কোনটা বড়, কোনটি ছোট, তাতে কী ফায়দা, দুনিয়ার বা আখেরাতের? সুতরাং যাও বলখ, মেপে আসো হাউয। এছাড়া বাই‘আত হবে না।
এলাজ ও চিকিৎসার ফায়দা
আগের যুগে এভাবেই নফসের এলাজ ও চিকিৎসা করা হতো। বড় কঠিন ও তিক্ত এলাজ, ঠিক আছে, তবে আশা করা যায়, সারা জীবনের জন্য এই একটি চিকিৎসা যথেষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। হয়ত এরপর আর কখনো তাদের মুখ থেকে বেহুদা কথা এবং বেলা তাহকীক কথা বের হয়নি।
হাঁ, এভাবেই সংশোধনের এলাজ ও চিকিৎসা হতো। এমন না যে, যিকির তাসবীহ বলে দেয়া হলো। একদিকে তাসবীহ জপছে, অন্যদিকে বেহুদা কথাও চলছে, আর কামেল বুযুর্গ হয়ে যাচ্ছে। না, বরং এমন কঠিন ঘষামাজা করা হতো, তারপর গিয়ে ইছলাহ ও সংশোধন হতো, আর যামানার সেরা বুযুর্গ পয়দা হতো।
কঠিন এলাজের হিকমত
হযরত থানবী রহ. এ ঘটনা শুনিয়ে বলেছেন, কারো দিলে এরূপ ধারণা আসতে পারে যে, বেচারা তালিবে ইলম দু’জন বেশীর চেয়ে বেশী একটা ভুল কাজই তো করেছে! ভুল কাজের স্বভাবই যদি না থাকবে, আগে থেকেই যদি যবান কাবুতে থাকবে, চিন্তাভাবনা সঠিক খাতে চলবে তাহলে শায়খের কাছে আসার প্রয়োজনই কেন হবে! ইছলাহের জরুরতই বা কেন হবে? সুতরাং বুঝে আসে না, এতটুকু ভুলের জন্য বাই‘আত করে নিতে অস্বীকৃতি কেন? আগে বাই‘আত করে নিতেন, তারপর মুনাসিব এলাজ শুরু করতেন!
প্রশ্ন উত্থাপন করে হযরত নিজেই জওয়াব দিলেন যে, এখানে দু’টি বিষয়। প্রথমত বা‘আত না করা দ্বারা একথা বুঝিয়ে দেয়া উদ্দেশ্য ছিলো যে, কিছু বিষয় এমনো রয়েছে যা মুরীদ ও সালিকের মধ্যে আগেই থাকা উচিত। আগে থেকেই এ সম্পর্কে চিন্তা-ফিকির ও সতর্কতা থাকা উচিত। শায়খের তারবিয়াত ও ইছলাহ দ্বারা তখনই কাক্সিক্ষত ফায়দা হয় যখন মুরীদ ও সালিক আগে থেকেই মৌলিক বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখে। শায়খ শুধু সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর সংশোধন করবেন। মৌলিক বিষয়েই যদি গাফলত থেকে যায় তখন বাই‘আতের আগেই ঐ গাফলাতের ধোলাই হয়ে যাওয়া উচিত, যাতে বাইআত ও ইছলাহের ফায়দা দ্রুত হয়।
ব্যক্তি ভিন্ন, এলাজও ভিন্ন
দ্বিতীয় কথা এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলাই শায়খের দিলে ইলকা করে দেন যে, কোন মুরীদের সঙ্গে কী মু‘আমালা করতে হবে। প্রত্যেক ব্যক্তির ইছলাহ ও সংশোধন এবং এলাজ ও তারবিয়াতের জন্য রয়েছে আলাদা পথ ও পন্থা। কাউকে তো বেত লাগাতে হয়, কাউকে শুধু তিরস্কার করলেই হয়ে যায়, আর কারো ক্ষেত্রে শুধু শাসনের দৃষ্টি নিক্ষেপ দ্বারা হয়ে যায। কারো ইছলাহ হয় পেয়ার ও আদর সোহাগ দ্বারা এবং পিঠচাপড়ানো ও শাবাশি দ্বারা।
এখন আল্লাহ্ তা‘আলা শায়খের দিলে এ কথা ঢেলে দেন যে, কার জন্য কোন্ তরীকা উপকারী হবে। যারা বোঝে না, যাদের অন্তর্দৃষ্টি নেই তাদের কাছে মনে হতে পারে যে, শায়খ তো কিছু বাড়াবাড়ি করছেন! তারা বুঝতে পারে না যে, আল্লাহ্ তা‘লা তার ইছলাহ ও সংশোধন এর মধ্যেই রেখেছেন।
আমার আব্বাজানের তরীকা
মুরীদান ও সালিকীনের তারবিয়াতের ক্ষেত্রে আমার আব্বাজানের তরীকা ও কর্মপন্থায় এ বিষয়টা বারবার দেখার মধ্যে এসেছে। অথচ স্বভাবের দিক থেকে তিনি অত্যন্ত নরম ও কোমল ছিলেন। ক্রোধ ও গোছ্-ছা তো ছিলো না বললেই হয়। প্রত্যেকের সঙ্গেই তিনি কোমল, বিন¤্র ও বিনীত আচরণ করতেন। কিন্তু এমনও হতো যে, হঠাৎ কারো সামান্য ত্রুটির উপর ভীষণ অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ প্রকাশ করতেন। এখন স্থুল দৃষ্টির কারো মনে হতে পারে যে, সামান্য ও তুচ্ছ কারণে তিনি লোকটির সঙ্গে কঠোরতা করছেন। কিন্তু আসল ঘটনা এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নেক বান্দাদের দিলে এ কথা ঢেলে দেন যে, কার সঙ্গে কখন কী আচরণ করতে হবে।
এই যে দেখুন, এখানে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। একবার একজন শিক্ষিত, অভিজাত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি আব্বাজানের সঙ্গে দেখা করার জন্য এলেন এবং কোন ভূমিকা ছাড়া, অনুমতি ছাড়া কথা বলা শুরু করে দিলেন।
এক দু’টি কথা মাত্র বলেছেন, ব্যস, আব্বাজান তাকে এমন ‘ডাট’ লাগালেন যে, আমিও হয়রান! কারণ আজ পর্যন্ত কখনো কারো সঙ্গে এরূপ শক্ত আচরণ তিনি করেননি। এমনকি তিনি বললেন, যাও, এখান থেকে বেরিয়ে যাও। শুধু যে বললেন, তা না, দফতর থেকে বের করেই দিলেন। আজ পর্যন্ত কখনো আমি এরূপ দৃশ্য দেখিনি। মনে মনে তখন ভাবলাম, ইয়া আল্লাহ্, এ লোকের তো ‘কাম হয়েছে’! কারণ আধুনিক শিক্ষিত মানুষ, সম্মান পেয়েই তো অভ্যস্ত। এমন ডাট খেয়ে তো বীতশ্রদ্ধ হয়ে সম্পর্কই ছিন্ন করে ফেলবে, আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কিন্তু ঘটনা এই যে, ঐ ব্যক্তি নিজে আমাকে বলেছেন, হযরত মুফতী ছাহেবের ঐ দিনের ‘ডাট’ আমার যিন্দেগির ধারাই বদলে দিয়েছে। আমার উপর তার কঠোরতার এমন সুপ্রভাব পড়েছে যে, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতেই পরিবর্তন এসে গিয়েছে।
মোটকথা, আল্লাহ্ তা‘আলাই তাঁর নেক বান্দাদের দিলে ইলকা করেন যে, কার সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে। সুতরাং কোন আল্লাহ্ওয়ালার আচরণ ও কর্মতরীকা সম্পর্কে ইশকাল বা অপত্তি করো না যে, কাউকে ধমক, তিরস্কার; কাউকে আদর-পুরস্কার, এটা কেন? কারণ আসল দাতা এবং দানের প্রকৃত উৎস তো স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা। শায়খ তো শুধু মাধ্যম ও উছীলা। তিনি যার সঙ্গে যেমন ইছলাহী ও তারবিয়াতি মু‘আমালা করেন, আল্লাহ্র পক্ষ হতে ইশারাপ্রাপ্ত হয়েই করেন।
তো ঐ যে দুই তালিবে ইলম, তাদের সঙ্গে হযরত মিরযা মাযহার জানে জানাঁ রহ. এর ঐ কঠোর আচরণ, সে সম্পর্কেও একই কথা। যা তিনি করেছেন, আল্লাহর পক্ষ হতে ইশারাপ্রাপ্ত হয়েই করেছেন যে, শুরুতেই যদি শক্ত ‘ঝটকা’ লাগে, সারা জীবনের জন্য তাতে কাজ হয়ে যাবে।
আগে চিন্তা, পরে কথা
হযরত মিরযা জানেজানাঁ রহ. এর ঘটনার মূল বার্তা তো এটাই যে, যবানের ব্যবহারে সংযম ও সতর্কতা খুব জরুরি। তো এই সতর্কতা অবলম্বনের তরীকাই বাতলে দিয়েছেন হযরত হাকীমুল উম্মত যে, প্রত্যেক কথার আগে চিন্তা করে নাও যে, আমি যা বলতে চাই তা ঠিক আছে কি না? তাতে সীমালঙ্ঘন হচ্ছে কি না? তাতে মিথ্যার মিশ্রণ আছে কি না? অসতর্কতা ও অসংযম আছে কি না? কারো মনে কষ্টদেয়ার কোন দিক আছে কি না?
এখনকার সমাজে বহু ফাসাদ ও ঝগড়াবিবাদ শুধু এ কারণেই হয় যে, চিন্তা না করেই যা মনে এলো বলে দিলো। সত্যমিথ্যার তাহকীক ও অনুসন্ধান পর্যন্ত করলো না, যা শুনলো তাই ‘উগরে’ দিলো। কারো মনে কষ্ট হবে কি না,অযথা কারো সম্মানের হানি হবে কি না, কোন পরোয়া নেই। ব্যস, কোন একটা বেফাঁস কথার কারণে পুরো পরিবারে, পুরো খান্দানে ফাসাদ শুরু হয়ে গেলো। সুতরাং খুব সতর্কতার সঙ্গে জিহ্বা চালাও। বিশেষ করে শোনা কথা বলার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করো। আগে চিন্তা করো, কী বলা হয়েছে, কীভাবে বলা হয়েছে এবং কী উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে? এখন যদি কারো কাছে তা বলতে হয়, ঐ সব বিষয় রক্ষা করেই বলতে পারো। নিজের পক্ষ হতে বিন্দুমাত্র বাড়িয়ো না; না শব্দ, না ভাব ও অভিব্যক্তি।
দেখুন, হযরত হাকীমুল উম্মতের ব্যবস্থাপত্রটি কত প্রজ্ঞাপূর্ণ! যেহেতু অভ্যাস শিকড় গেড়ে আছে যবান চালানোর! হরদম চলতেই থাকে, থামার নামই নেয় না। সুতরাং এ ফিতনা থেকে বাঁচার জন্য দীর্ঘ মশক ও অনুশীলন এবং লাগাতার মেহনত ও মুজাহাদার প্রয়োজন। যে কোন কাজ, যত কঠিনই হোক এভাবেই হয়। সুতরাং আল্লাহ্র উপর ভরসা করে মশক ও মেহনত শুরু করে দাও। প্রথম দিকে হয়ত চিন্তা করার কথা মনেও থাকবে না। কিন্তু সামান্য চেষ্টা মেহনত দ্বারাই দেখবে, ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিকে যদি চিন্তা করার কথা ভুলে যাও তাহলে যখনই মনে পড়বে তখন অনুতাপ করো এবং চিন্তা করো, বারবার এটা করো। এভাবে একসময় চিন্তা করার অভ্যাস তৈরী হয়ে যাবে। তখনস্বতঃস্ফূর্তভাবেই চিন্তা আসতে থাকবে, চিন্তার জন্য আলাদা চেষ্টা মেহনত করতে হবে না। বরং তখন তো এমন হবে যে, যবান থেকে যে কথাই বের হবে সঠিকই বের হবে। গীবত থেকে, মিথ্যাকথন থেকে এবং ‘দিলদুখানো’ থেকে বেঁচে থাকার এটাই একমাত্র পথ, একমাত্র উপায়।
গীবতের পক্ষে নফসের বাহানা ও তার জবাব
জনৈক ব্যক্তি হযরত থানবী রহ.কে পত্রযোগে নিজের অবস্থা জানালেন যে, আমার নফস আমাকে এ বাহানা শেখায়, লোকেরাও তো তোমার গীবত করে। কিয়ামতে যখন পাকড়াও হবে তখন যে আজর-ছাওয়াব তোমার গীবতকারীদের থেকে পাবে তা তাদের দিয়ে দেবে. যাদের তুমি গীবত করেছো। এভাবে সমান সমান হয়ে যাবে। (আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৫০)
এই বাহানা বা গলদ ব্যাখ্যার সূত্র এই যে, হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কারো গীবত করে তার আজর-ছাওয়াব গীবতকৃতকে দিয়ে দেয়া হবে।
তো এখন নফস এ ওয়াসওয়াসা দেয় যে, যারা তোমার গীবত করে তাদের আজর তুমি পাবে, আর তুমি যাদের গীবত করবে তারা তোমার আজর পাবে। সুতরাং মু‘আমালা তো সমান সমান হয়ে গেলো, বেশী চিন্তিত হওয়ার তো কিছু নেই।
এর জবাবে হযরত হাকীমুল উম্মত লিখেছেন-
‘প্রথমে তো এর কোন নিশ্চয়তা নেই যে, অন্যদের থেকে যে আজর তুমি পাবে তা থেকেই তোমার দেনা পরিশোধ করা হবে। এমনো তো হতে পারে যে, অন্যদের থেকে পাওয়া আজর তোমার কাছেই থাকলো। আর তোমার দেনা তোমার নিজের আমল থেকে পরিশোধ করা হলো, আর নাজাতের জন্য অন্যের আমলকে যথেষ্ট মনে করা হলো না।
দ্বিতীয়ত এটা বাদ দিলেও সমতার তো কোন প্রমাণ নেই যে, তোমার যা পাওনা সেটা তোমার কাছে যা পাওনা তা পরিশোধের জন্য যথেষ্ট হবে। এমনো তো হতে পারে যে, অন্যদের থেকে পাওয়া আজর পরিমাণে কম হলো, আর তোমার কাছে পাওনা আজর পরিমাণে বেশী হলো! তখন কী হবে?!
অর্থাৎ এত কঠিন ও গুরুতর বিষয়ে এত হালকা হিসাবের উপর ভরসা করা ঠিক নয়। কারণ হিসাব আটকে গেলে তখন কিছুই করার থাকবে না। দুনিয়াতে তো কোন না কোন ভাবে পুষিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা থাকে, কিন্তু আখেরাতে তো শুধু ইয়া নফসি, ইয়া নফসী অবস্থা। তাই সমান সমান কাটাকাটি হয়ে যাবে এই মিথ্যা বাহানার ভরসায় গীবতে লিপ্ত হওয়া কিছুতেই বুদ্ধির কাজ নয়।
এগুলো আসলেই শয়তানের ওয়াসওয়াসা এবং নফসের ধোকা। মানুষকে বরবাদির কাজে লিপ্ত করার জন্য শয়তান ও নফস বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা দিলের মধ্যে দেয় যে, এমন করো, এভাবে করো, সমাধান হয়ে যাবে।
আল্লাহ্ বাঁচিয়ে রাখুন, আখেরাতে যখন আজর ও ছাওয়াবের মু‘আমালা হবে, আর নিজের এত কষ্টের কামাই করা আজর অন্যের কাছে চলে যাবে তখন বুঝে আসবে যে, কত ধোকার মধ্যে ছিলো, কত বড় সর্বনাশের ওয়াসওয়াসা ছিলো? এত এত নেক আমল, এত এত নামায, রোযা; রামাযানের দান ছাদাকা ও ইতিকাফ, রাতের পর রাত জেগে আদায় করা নফল, তাহাজ্জুদ! কিন্তু সেখানে গিয়ে জানা গেলো যে, সব আমল, সব আজর অন্যের ভাগে চলে যাচ্ছে! তখন যে আফসোস ও অনুতাপ হবে তার কোন সমাধান নেই, ক্ষতিপূরণেরও কোন উপায় নেই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাযত করুন, আমীন।
হিম্মত করো এবং স্মরণে রাখো
সামনে হযরত হাকীমুল উম্মত রহ. বলেন, ‘গীবত একটা স্বেচ্ছাধীন কাজ। সুতরাং তার চিকিৎসার পন্থা হলো হিম্মত করে তা ত্যাগ করা এবং পরিণামের কথা স্মরণে রাখা। তবে সহায়ক পন্থা এই যে, যখন একবার গীবত হয়ে যাবে শাস্তিরূপে একবেলা উপবাস করবে। (আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৫০)
অর্থাৎ প্রথম কথা তো হলো, গীবত সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছাধীন একটা কাজ। মানুষ যখন ইচ্ছা করে তখনই গীতবত হয়, যখন ইচ্ছা করে না তখন গীবত হয় না। গীবত যদি মানুষের ইচ্ছা ও এখতিয়ারের অধীন না হতো তাহলে গীবত করা হারাম হতো না। আল্লাহ্ তা‘আলা এমন কোন কাজ হারাম করেননি যা থেকে বেঁচে থাকা মানুষের সাধ্যের ভিতরে নেই। সুতরাং বোঝা যায়, গীবত থেকে বেঁচে থাকা মানুষের ইচ্ছা, এখতিয়ার ও সাধ্যের মধ্যে রয়েছে। তবে কিনা বেঁচে থাকার জন্য কিছুটা হিম্মত, সাহস ও মনোবলের প্রয়োজন। হিম্মত করো যে, এ গোনাহ আমি কিছুতেই করবো না। আমার যবান ও জিহ্বাকে আমি অন্যায় কথা উচ্চারণে ব্যবহার করবো না। তারপর সবসময় একথা স্মরণে রাখো যে, এটা কত বড় অপরাধ, কত জঘন্য গোনাহ যে, এর পরিণামে নিজের নেক আমল অন্যের দখলে চলে যায়, আরো চিন্তা করো যে, এটাকে আল্লাহ তা‘আলা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন।
তারপর সহায়ক চিকিৎসারূপে হযরত বলেন, গোনাহ থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে শাস্তিব্যবস্থা খুবই সহায়ক হয়ে থাকে। মানুষ যদি সিদ্ধান্ত নেয় যে, আগামীতে যদি গীবত হয় তাহলে নিজেকে আমি এই শাস্তি দেবো।
হযরত রহ. বলতেন, শাস্তিটা এত সাধারণ ও মামুলি যেন না হয় যে দিলের মধ্যে তার কোন পরোয়াই হলো না। যেমন আমার আব্বাজান রহ. ঘটনা শোনাতেন যে, যখন আলীগড় কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো তখন আইন ছিলো, প্রত্যেক ছাত্রকে অবশ্যই নামায পড়তে হবে। এমনকি নামায না পড়লে নামাযপ্রতি দুই আনা জরিমানা নির্ধারিত ছিলো। তো ছাত্ররা খুশিমনে সারা মাসের জরিমানা জমা করে দিতো। কারণ জরিমানার পরিমাণ ছিলো তুচ্ছ।
তো জরিমানা এমন হওয়া উচিত যা আদায় করতে কিছুটা কষ্ট হয়। আবার এত কঠিনও যেন না হয় যে, বরদাশতের বাইরে চলে যায়, তখন আমলও করবে না, জরিমানাও দেবে না, ইছলাহ বা চিকিৎসাও হবে না। মোটকথা জরিমানা নির্ধারণের সময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে।
শাস্তিরূপে অনাহারপ্রসঙ্গ
গীবতের শাস্তির ক্ষেত্রে হাকীমুল উম্মত রহ. উদাহরণ ও মিছাল হিসাবে শুধু অনাহারের কথা বলেছেন। আসল ঘটনা এই যে, কারো ক্ষেত্রে মালের জরিমানা কঠিন মনে হয়। সুতরাং সে এরূপ সিদ্ধান্ত করবে যে, যখনই গীবত হবে, আমি এই পরিমাণ মাল ছাদাকা করে দেবো। পক্ষান্তরে যার কাছে মাল কোন বিষয় না, বরং ক্ষুধার্ত থাকাটা কঠিন সে নিজের জন্য মালের পরিবর্তে অনাহারের শাস্তি নির্ধারণ করবে। আসলে হাকীমুল উম্মত এটা এমন মানুষের জন্যই নির্ধারণ করেছেন যাদের কাছে মালের পরিবর্তে জানের কষ্ট বেশী কঠিন।
তো যদি সঠিক জরিমানা নির্ধারণ করা যায়, যা নফসের উপর কঠিন, তারপর যদি ঠিকমত তা প্রয়োগ করা হয় তাহলে আশা করা যায়, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই গীবতের বিমারি দূর হয়ে যাবে।
অন্যের দোষ প্রকাশ করার হুকুম
জনৈক ব্যক্তি হযরত হাকীমুল উম্মত রহ. কে জিজ্ঞাসা করলো-
‘যারা কবীরা গোনাহে লিপ্ত তাদের দোষ এবং গোনাহ প্রকাশ করে দেয়া গীবত হবে কি না? নফস তো সর্বদা এই তাবিল-ব্যাখ্যার আশ্রয় নিতে চায় যে, এমন লোকের দোষ যদি মানুষের সামনে প্রকাশ না করা হয় তাহলে মানুষ ধোকায় পড়বে। অথচ ধোকায় পড়া থেকে মুসলমানদের রক্ষা করা জরুরি।
(আনফাসে ঈসা, পৃ. ১৫০)
অর্থাৎ কোন ব্যক্তি সম্পর্কে আমার জানা আছে যে, সে এই এই গোনাহে লিপ্ত, অথচ মানুষের জানা নেই। তো মানুষ যেন ধোকায় পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, এই নিয়তে তার গীবত করবো কি করবো না।
আসলে ইনি সুলূক ও ইছলাহের পথে নবাগত ছিলেন। মাত্র নিজের ইছলাহ গ্রহণ করা শুরু করেছিলেন। শুরুতেই তার মনে এ প্রশ্ন এসেছিলো। তাই হযরত তার অবস্থা বিবেচনা করে জওয়াব দিয়েছেন যে, এ প্রশ্ন পরিপক্ব সালিকের জন্য উপযোগী। যারা নবীন, নতুন ও মুবতাদি তাদের তো জায়েয গীবতও করা উচিত নয়।
কারণ এখন অন্যের বিষয় নিয়ে তার ভাবার সময় না। এখন তো তার আসল কাজ হলো, বরং একমাত্র কাজ হলো নিজের ইছলাহের ফিকির করা। সুতরাং যেসব ক্ষেত্রে মানুষের দোষ প্রকাশ করা জায়েয, সেই জায়েয ক্ষেত্র থেকেও তাকে বিরত থাকতে হবে।
এ বিষয়টিকেই হযরত মাওলানা ইয়াকূব নানুতবী রহ. মিছাল দিয়ে বুঝিয়েছেন যে, একটা কাগজ একদিকে মোড়ানো আছে। তাকে যদি এখন সোজা করতে চাও তাহলে স্বাভাবিক চেষ্টায় সোজা হবে না, বরং এটাকে সোজা করার তরীকা এই যে, উল্টো দিকেও মুড়তে হবে। কিছুক্ষণ ঐভাবে রাখলে তখন সোজা হবে। মানুষের নফসও একদিকে মোড়ানো অবস্থায় আছে। না জায়েয গীবতে সে অভ্যস্ত হয়ে আছে। এই অভ্যাস থেকে ফিরিয়ে নফসকে সোজা পথে আনতে হলে তাকে উল্টো দিকে মুড়ে দিতে হবে। অর্থাৎ শুরুতে জায়েয গীবত থেকেও তাকে বিরত রাখতে হবে। তাহলেই গীবতে অভ্যস্ত নফস সোজা হবে। পরবর্তী সময়ে শুধু জায়েয গীবতই তার দ্বারা প্রকাশ পাবে, যা আসলে গীবত নয়, বরং দায়িত্ব পালন। না জায়েয গীবত তখন তার দ্বারা আর হবেই না, যা বরবাদির কারণ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফীক দান করুন, আমীন।
وآخر دعوانا أن الـحمد لله رب العـالـمـيـن
তরজমা-
আমাতুল্লাহ তাসনীম সাফফানা