জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮)

তোমাদের পাতা

বানানের জলসা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

বানানের  জলসা 

এমনিতে নাকে তেল, বা তেলে নাক না দিলে সভাপতি হুযূরের ঘুমটা তেমন আয়েসের হয় না। তবে কিনা এখন হলো শীতকাল! তার উপর আজ দু’দিন ধরে বেজায় ওস/ কুয়াসা পড়ছে। বারোটার আগে, সূর্য যে মুখ দেখাবে, তার উপায় নেই। ঘুমের সঙ্গে যাদের মুহব্বত নেই তাদেরও এমন সময় ঝিমুনি ধরে। আর সভাপতি হুযুরের তো ...!

তো আজ জলসার শুরুতেই সভাপতি হুযূর চোখের পাতা দু’টো অর্ধেক খোলা রেখে খুব কোমল কণ্ঠে বললেন, ‘আমি ঘুমুচ্ছি না, তোমরা জেগে থাকার চেষ্টা কররররর।

বেচারা হুযূরের বাচ্চা, কথাটা কিনা শেষও করতে পারলেন না, তার আগেই নাকের বাঁশী বাজতে শুরু করলো ‘রররররর’।র্

আফীফা (খাঁটি মূর্ধন্যষওয়ালা বিমর্ষ কণ্ঠে) জলসার তাহলে কী হবে গো?!

আফিয়া (সবাইকে সান্তনা দিয়ে, তবে কিনা  ¦ ছাড়া সান্তনা!) চিন্তা করো না। হুযূরের তন্দ্রায় নিদ্রায় কলিম মুন্সী ভরসা। বানানটা হুযূরের কাছ থেকে তিনি ভালোই শিখেছেন, হ্রস্ব উকার দীর্ঘ উকারে কিছুটা দুর্বলতা এই যা!

ছুফিয়া (হতাশার সুরে) ঃ কিন্তু কলিম মুন্সীরও তো দেখা নেই!

আফিয়া (আবারও   ¦ ছাড়া সান্তনা দিয়ে) ঃ চুপচাপ বসে থাকো। একটু দেরী হলেও কলিমচাচা ঠিকই এসে যাবেন।

আফিয়া ঃ এই ফাঁকে আমরা নিজেদের বানানজ্ঞানটা একটু ঝালিয়ে নিতে পারি।

আদীবা (মেয়েদের মধ্যে বয়সে বড়, বুদ্ধিতেও, তাই সকলে তাকে মান্য করে) ঃ আফিয়া, তোমার সান্ত¡নায়  ¦ নেই কেন?

আফিয়া (কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে) ঃ হুযূর নিদ্রিত আছেন তো, কিছু টের পাবেন না!

(এর মধ্যে সভাপতি হুযূরের নাসিকা -ধ্বনিতে পরিবর্তন, ‘বববববব...’

আদীবা ঃ হুযূরকে তোমরা চিনতে পারোনি। এই দেখো, নিদ্রার মধ্যেও তোমার ছোট্ট  ¦ ধরে ফেলেছেন!

আফিয়া (অবাক হয়ে) আমাদের হুযূর বড় কামেল তো! ঠিক যেন  মিনি আব্বা হুযূর!!

আফিয়া (আদীবাকে সম্বোধন করে) ঃ আয়েসে কোন স বড় আপু?

আদীবা ঃ আয়েস হলো পায়েসের খালাতো বোন। দু’টোতেই দন্ত্য-স।

ছুফিয়া (সবার ছোট, শব্দের অর্থ ঠিকমত বুঝতে পারে না) ঃ ওস

মানে কী, আর কুয়াসা মানে?

আদীবা ঃ খুব সোজা! ওস মানে কুয়াসা, আর কুয়াসা মানে ওস!  দু’টোতেই দন্ত্য-স! অনেকে ভুল করে মূর্ধন্য ষ দেয়।

সভাপতি হুযূরের নাকের বাঁশি তৃতীয় স্তরে উঠেছে ‘শঁশঁশঁশঁশঁশঁশঁশঁ’।

আফীফা ঃ শোনো শোনো, হুযূর মনে হয় বাঁশীর বানান বলে দিচ্ছেন!

আদীবা (অবাক হয়ে) ঃ তাই তো! চন্দ্রবিন্দু, আর তালব্য-শ!! চন্দ্রবিন্দুটা অবশ্য বয়ের উপরে।

বশির (জানো তো মেয়েরা, বাঁশের বাঁশী, আর নাকের বাঁশী দু’টোতেই আছে চন্দ্রবিন্দু!)

আফিয়া (বশীরের খালাতো বোন, মুখ বাঁকিয়ে, ঠিক চন্দ্রবিন্দুর মত করে) ঃ উঁহ! তোমাদের ছেলেদের কাছে শিখতে হবে নাকি!

ঝগড়া প্রায় বেঁধেই যাচ্ছিলো, এর মধ্যে কলিম মুন্সী দরজায় এসে হাজির। হাতে লম্বা একটা কাগজের বাক্স।

কলিম মুন্সীকে বেশ মনমরা মনে হচ্ছে।

আতিকটা আবার বড় দুষ্ট ছেলে। তাই চন্দ্রবিন্দুসহ ফোঁড়ন কেটে বললো ঃ কী কলিম মুন্সী! আজ বুঝি চাচীর হাতে কানমলা জুটেছে!

কলিম মুন্সী তো একেবারে কী বেগুনে যেন বলে! হাঁ, তেলে বেগুনে জ¦লে উঠলো। এমন জ¦লে ওঠা যে, ছোট্ট  ¦ টা পর্যন্ত বাদ গেলো না!

মেয়েরা তো মা-জননী, তাই মায়ার আঁচলটা যেন বিছিয়ে দিলো।

আফীফা (মেয়েদের পক্ষ হতে) ঃ ওদের কথায় তুমি কিছু মনে করো না কলিম চাচা! এই নাও, আমাদের চাটাইয়ের ঐ কোণটায় আরাম করে বসো।

মেয়েদের মায়াভরা কথায় কলিম মুন্সীর রাগটা অবশ্য পড়ে গেলো, তবে কিনা তেলে বেগুনে বলে কথা! তাই আতিককে জব্দ করার একটা ফন্দি আঁটলো।

কলিম মুন্সী ঃ এই ছেলে, চটপট দাঁড়াও এবং ঝটপট উত্তর দাও, আটা, চন্দ্রবিন্দু আছে না নেই?

আতীক (একটুও না ভড়কে) ঃ গমের আটা হলে চন্দ্রবিন্দু নেই। ফন্দি আঁটা হলে চন্দ্রবিন্দু ছাড়া উপায় নেই।

কলিম মুন্সী (ভিতরে ভিতরে দমে গেলেও, রাগের ভাবটা বজায় রেখে) ঃ ইঁচড়ে পাকা ছেলে, বললেই হলো! আমি যখন রেগে থাকি, সব আটাতেই তখন চন্দ্রবিন্দুথাকে! আমি হলাম সভাপতি হুযূরের খাদেম, চন্দ্র ও বিন্দু দু’টোই আমার কথায় ওঠে এবং বসে।

আদীবা ঃ ওদের কথা বাদ দাও, কলিম চাচা! তোমাকে চিনবে, সে যোগ্যতা কি ওদের আছে! তার চেয়ে বলো তো, বাক্সটার মধে কী এনেছো?

কলিম মুন্সী (মেয়েদের উদ্দেশ্যে একটা বিগলিত হাসি উপহার দিয়ে) ঃ বলছি গো মা-জননী বলছি। তার আগে একটা কথা!

ছেলেরা মেয়েরা একসঙ্গে ঃ কী কথা! কী কথা!

কলিম মুন্সী ঃ ভূতের বাচ্চাটা যে আরশোলা হয়ে গেলো তা তো তোমরা জানো! এখন কথা হলো, গত জলসার পর অভিধানে আরশোলা খুঁজেছো কে কে?

ছেলেরা প্রায় সবাই হাত তুললো, অনেকটা যেন বীরদর্পে।

আফীফা (মেয়েদের পক্ষ হতে) ঃ আসলে হয়েছে কী! আরশোলাটা যদি লোগাতের পাতা থেকে জেগে ওঠে, এই ভয়ে না...!

কথাটা শেষ না হতেই ছেলের দল হুহু করে হেসে উঠলো।

কলিম মুন্সী (যদিও তার নিজেরও হাসি পেয়েছে, ছেলেদের প্রতি রাগী চোখে তাকিয়ে) ঃ এই চুপ, চুপ! সভাপতি হুযূরের নিদ্রাভঙ্গ হলে উপায় আছে!

আদীবা (ছেলেদের প্রতি একেবারে চন্দ্রবিন্দুসহ মুখ বাঁকিয়ে) ঃ কলিম চাচা, লোগাত না দেখেও আমরা বলতে পারি, আরশোলাটার জন্ম হয়েছে তালব্য-শ দিয়ে। ছেলেরা অবশ্য শ ও স-এ তালগোল পাকিয়ে ফেলে। এবার বলো তোমার বাক্সের কথা।

কলিম মুন্সী ঃ হাঁ, শোনো! ভূতের বাচ্চাটা তো হয়ে গেলো আরশোলা, আমার তাতে আপত্তি ছিলো না। কিন্তু ভূতের বাচ্চা ভূত একদিন বলে কী, আমি ছবি আঁকবো!

আমার তো মেজাজ গেলো বিগড়ে। আহা, যেন ভূতের বাড়ীর আব্দার! বেটা জানিস, আঁকতে চন্দ্রবিন্দু লাগে?!

ভূতের বাচ্চা আরশোলা (একগাল হেসে) ঃ চটেন কেন চাচা, চন্দ্রবিন্দু তো ভূতের রাজ্যে খুবই জনপ্রিয়, মানে ‘ভূতপ্রিয়’!

আমি তো অবাক। আমার অবাক হওয়া দেখে আরশোলাটা যেন বেশ মজা পেলো। তাই মজা করে বললো ঃ কেন গল্পে পড়োনি চাচা, মানুষের ঘাড় মটকে দেয়ার আগে ভূতেরা বলে, ‘হাঁউ মাঁউ মাঁনুষেঁর গঁন্ধ পাঁউ’!

আদীবা ঃ তা কিসের ছবি আঁকলো তোমার ভূত আরশোলা?

কলিম মুন্সী (হতাশার ভাব প্রকাশ করে) ঃ এখানেই তো হলো সমস্যা!

ছেলেরা মেয়েরা একসঙ্গে ঃ কী সমস্যা?

কলিম মুন্সী ঃ ভূতের বাচ্চা ভূত বলে কিনা, ছেলেদের ছবি আঁকবে মাথায় বড় বড় চুল দিয়ে, আর মেয়েদের ছবি আঁকবে মাথা মুড়িয়ে!

মেয়েরা ঃ র্ম র্ম!

ছেলেরা ঃ দূর হ! দূর হ!

কলিম মুন্সী ঃ কিন্তু আমি কী করি, ভূতের বাচ্চা তো মরেও না, দূরও হয় না। শেষে আমি একটা বুদ্ধি বের করলাম। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে বললাম, ভূতের বাচ্চা কত্তো ভালো! তুমি না বানানজলসার ছেলেদের বন্ধু! মেয়দের বন্ধু! বন্ধু হয়ে বন্ধুদের মনে কষ্ট দেবে! তার চেয়ে এক কাজ করো, সবুজ মাঠের ছবি আঁকো। ছেলেরাও খুশী হবে, মেয়েরাও হবে না অখুশী।

ভূতের বাচ্চা আসলে খারাপ না, তোমাদের মত না। বুঝিয়ে বললে বেশ বোঝে।

আতিক ও আফিয়া ঃ তা সবুজ মাঠের ছবি আঁকলো তোমার ভূতের বাচ্চা?

কলিম মুন্সী ঃ আঁকলো মানে! জব্বর আঁকা আঁকলো! তবে...

ছেলেরা মেয়েরা একসঙ্গে ঃ তবে!

কলিম মুন্সী ঃ সবুজ মাঠের মধ্যে আবার  ঘোড়া এঁকেছে পাজিটা!

ছেলেরা মেয়েরা (সভাপতি হুযূরের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে) ঃ ঘোড়া-গাধা যাই হোক, হুযূর তো ঘুমিয়ে আছেন! ছবিটা আমাদের দেখতেই হবে কলিম চাচা!

কলিম মুন্সী কিছুটা যেন নিমরাজি হয়ে বাক্সটা খুলতে শুরু করলো। ছেলে বলো, মেয়ে বলো, সবার চোখে মুখে তখন অদ্ভুত কৌতূহল! কিন্তু কোথায় কী! না ঘাস না ঘোড়া! সেরেফ একখান সাদা কাগজ!

কলিম মুন্সীরও তখন আক্কেল গুড়–ম! ঘটনা কী! নিজের চোখে দেখলাম ছবিটা! শেষে আমতা আমতা করে ঃ ঘোড়াটা মনে হয় ঘাস খেয়ে সাবাড় করে ফেলেছে!

সবার তখন একই প্রশ্ন। তা না হয় হলো, কিন্তু ঘোড়া কোথায়

কলিম মুন্সী (কাচুমাচু হয়ে) ঃ ঘাস খাওয়া যখন শেষ, তখন কি আর বসে থাকে!

কেউ টের পায়নি, সভাপতি হুযূর কখন জেগে উঠেছেন। টের পেলো যখন কলিম মুন্সী কানটানা খেয়ে ‘উহ করে উঠলো।

সভাপতি হুযূর (কানের টান আরো দীর্ঘ করে) ঃ ঘাস নেই, ঘোড়া নেই, তাহলে তুমি আছো কেন! আমার ছেলেমেয়েদের বোকা বানাতে! ভাগো উল্লু কা পাট্ঠা!

(মাদরাসাতুল মাদীনাহর ষষ্ঠ বর্ষের ছাত্র ফায়সালের লেখা অবলম্বনে। তোমাকে অন্তরের অন্তঃস্তল থেকে জাযাকাল্লাহু খায়রান)

 

 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা