আমার ফুলের মত ছোট্ট মেয়েটি, এখন তো অনেক বড়, এবং তার বৃন্তে ফুটেছে দু’টি ফুল! যখন সে ছিলো সত্যি সত্যি ছোট্ট একটি মেয়ে, তাকে নিয়ে বেড়াতে যেতাম এক সবুজ মাঠে ভোরের সুন্দর সময়টাতে, যখন সূর্য উঠেনি, অথচ আলো ফুটেছে! জান্নাতের সময়টা নাকি এমনই হবে!
মেয়েটি আমার হাত ধরে হাঁটতো, কচি ঘাসের উপর কচি কচি পা ফেলে। সে তাকাতো চারদিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে, আর আমি তাকাতাম, ভোরের আলোতে উদ্ভাসিত তার মুখটির দিকে, একজন বাবার হৃদয় থেকে ঝির ঝির করে ঝরতে থাকা শিশিরসিক্ত দৃষ্টিতে।
একদিন দেখি, তার মুখম-লে কিসের যেন আকুতি। গভীর কোন চিন্তা যেন তার ছোট্ট হৃদয়টিতে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। কিছু পেতে চায়, অথচ পাওয়ার উপায় খুঁজে পায় না, এমন হলে যেমন হয়, কিছুটা যেন তেমনি। এখনকার মত তখনো মেয়েটি আমার বড় অন্তর্মুখী! শুধু ভাবে, মুখ ফুটে কিছু বলে না। কষ্ট বলো, আনন্দ বলো, স্বপ্ন বলো, আকাক্সক্ষা বলো, সবকিছু সে মনের ভিতরে একান্তভাবে লালন করে। কাউকে কিছু বুঝতে দিতে চায় না।
খুব সন্তর্পণে তার মনের ভিতরে উঁকি দিয়ে মনের কথাটি বুঝে নিতে হয়। আমার কিন্তু ভালো লাগতো ওর এই অন্তর্মুখী প্রকৃতিটি, শুধু নীরবে প্রার্থনা করতাম, আল্লাহর ইচ্ছায় যে মানুষটি আসবে ওর জীবনে সে যেন তার হৃদয়টিকে বুঝতে পারে হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে এবং ঝিরঝির শিশিরে সিক্ত হয়ে। ...
কণ্ঠস্বরকে খুব কোমল করে জিজ্ঞাসা করলাম, কী ভাবছো আম্মু!
কোন উত্তর নেই। একটু পরে কুণ্ঠিত স্বরে বললো, এখানে গাছ লাগালে কেমন হয় আব্বু?!
এটাই ছিলো তাহলে তার ভিতরের ভাবনা, যার হালকা বিষণœ একটা ছায়া পড়েছিলো মুখের আয়নায়! বললাম, আম্মু, এখানে তো লোকেরা গাছ লাগাতে দেবে না; চলো আমরা জান্নাতে গাছ লাগাই!
ছোট্ট মেয়েটির চোখে কী সুন্দর অবাক চাহনি!
বললাম, একবার সুবহানাল্লাহি..... বলো জান্নাতে একটি সবুজ গাছ হয়ে যাবে, যার ছায়া হবে ...!
প্রতিদিন সেই সবুজ মাঠে বেড়াতে গিয়ে মেয়েটি শুধু বলতো, সুবহানাল্লাহ ...
যখন মনে পড়ে, আমার খুব ভালো লাগে!
আজ কেন জানি খুব বেশী মনে পড়ছে, সেই মেয়েটির কথা, আমারই নামে ছিলো যার নাম, নুসাইবা।
সাত বছরের ছোট্ট মাসুম মেয়েটি পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলো। শুনেছি, পানিতে ডুবে মৃত্যুতে নাকি অনেক কষ্ট হয়। সেদিন আমার কী যে কষ্ট হয়েছিলো! কষ্টের কারণে কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিলাম।
আজ আবার মনে পড়ছে মেয়েটির কথা, আর মনের ভিতরে কেমন জানি একটা কষ্ট হচ্ছে!
আমাদের বাড়ীতে এসেছিলো এই তো সেদিন। কী হাসিখুশি মেয়েটি ছিলো! সবার সঙ্গে কী সুন্দর হেসে হেসে কথা বললো! যে দেখতো সেই কাছে নিয়ে আদর করতো। সত্যি বড় আদরকাড়া মেয়ে ছিলো! আমাদের বাড়ীতে বেড়িয়ে গেলো, আর দু’দিন পড়ে পানিতে পড়ে মারা গেলো! ওর আম্মু-আব্বুর তখন কী করুণ অবস্থা! বাবা তো অনেক আহাযারি করলেন। তাতে নাকি বুকটা হালকা হয়ে যায়। কিন্তু মা, তিনি একফোঁটা কাঁদেননি! শুধু মৃত্যুর পর আরো সুন্দর হওয়া মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন একদৃষ্টিতে। যখন কবরে নেয়ার জন্য জানাযা ওঠানো হলো তখন আস্তে করে নিস্তেজ হয়ে গেলেন, আর জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়লেন। জ্ঞান ফিরলো কখন? সবাই যখন ছোট্ট মেয়েটিকে মাটির ঘরে রেখে ফিরে এলো। নুসাইবার আম্মু তখনো কাঁদেননি। একদিকে শুধু তাকিয়ে ছিলেন শূন্য দৃষ্টিতে। মানুষ যখন উদাসমনে এবং দুঃখীমনে একদিকে তাকিয়ে থাকে, অথচ কিছু দেখতে পায় না, সেটাকে বলে উদাস দৃষ্টি, বা শূন্য দৃষ্টি। নুসাইবার আম্মুকে সেদিন মনে হয়েছিলো, উদাসদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দূরের কোন কিছুর দিকে।
পরে যখনই দেখেছি নুসাইবার আম্মুকে, হাসতে দেখিনি! একই রকম উদাসদৃষ্টি! আমাকে দেখলে তিনি কেমন যেন হয়ে পড়েন! নীরবে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আর তখনই তার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। হয়ত আমার নামে মেয়ের কথা আরো বেশী মনে পড়ে, এ কারণে!
আমি অনেক দু‘আ করেছি; এখনো করি, আল্লাহ যেন নুসাইবার আম্মুকে ছবর করার তাওফীক দেন।
কী করছে নুসাইবা এখন? হয়ত জান্নাতী শিশুদের সঙ্গে খেলা করছে!
তাহিয়্যাতুল জান্নাত নুসাইবা, ঢালকানগর, ঢাকা