মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬)

বিজ্ঞান বিচিত্রা

অমর চিকিৎসাবিজ্ঞানী ই ব নে সী না

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

পাশ্চাত্যের প-িৎসমাজে ‘এভিসিনা’ এই বিকৃত নামে পরিচিত ইবনে সীনা ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মহান মুসলিম চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তাকে মনে করা হয় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীদের একজন। তাঁর পুরো নাম আবু আলী আল-হোসাইন আব্দুল্লাহ ইবনে সীনা। তবে ইবনে সীনা নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ৯৮০ খৃস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের কোন এক দিন। তাঁর জন্মস্থান তখনকার মানচিত্রে মাওয়ারাউন্-নহর নামের অঞ্চলের শহর বোখারারনিকটবর্তী ‘আফসানা’ গ্রামে। এটি বর্তমান উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল। ইবনে সীনা মাত্র দশবছর বয়সে পবিত্র কোরআন সম্পূর্ণ মুখস্থ করে সবাইকে অবাক করে দেন। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে তিনি সে যুগে প্রচলিত প্রায় সমস্ত শাস্ত্রে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করে ফেলেন। জ্ঞানজগতের বড় বড় দিকপাল তাঁর মেধা, প্রতিভা ও পা-িত্যে মুগ্ধ হন।গণিত, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব ও চিকিৎসাবিজ্ঞান ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয়। এর মধ্যে চিকিৎসাই ছিলো তাঁর গবেষণা ও সাধনার মূল ক্ষেত্র।ইবনে সীনা চিকিৎসাশাস্ত্রের সমস্ত কিতাব সংগ্রহ করে অধ্যয়ন শুরু করেন। বহু দিনরাত এমন অতিবাহিত হয়েছে যাতে তিনি মুহূর্তের জন্যও ঘুমোননি।যখন জটিল কোন সমস্যার সম্মুখীন হতেন, মসজিদে গিয়ে নফল নামাযের মধ্যে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে এভাবে দু‘আ করতেন, ‘হে আল্লাহ, আমার জন্য জ্ঞানের দুয়ার খুলে দাও।’দু‘আ-মুনাজাতের পর ঘরে এসে যখন কিতাব খুলে বসতেন, সমস্ত জটিল বিষয় তার কাছে পানির মত পরিষ্কার হয়ে যেতো। বিশেষ করে যখন অধ্যয়ন-অবস্থায় ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেন তখন সংশ্লিষ্ট জটিল সমস্যার সহজ সমাধান তাঁর মানসপটে স্বপ্নের মতই ভেসে উঠতো, আর ঘুম থেকে উঠে তিনি প্রাপ্ত সমাধান লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। জ্ঞান সাধনায় যারা মেধা ও প্রতিভার পরিবর্তে আল্লাহর রহমত ও মদদের উপর ভরসা করে, এভাবেই গায়ব থেকে আল্লাহ তাদের সাহায্য করেন।এসময় বোখারার শাসক নূহ বিন মানছূর জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে শাব্দিক অর্থেই শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। দেশ-বিদেশের সকল চিকিৎসক যখন ব্যর্থ তখন ইবনে সীনার ডাক পড়ে। আর তাঁর চিকিৎসায় বিস্ময়করভাবে তিনি আরোগ্য লাভ করেন। শাসক নূহ বিন মানছূর ইবনে সীনাকে পুরস্কৃত করতে চাইলে ইবনে সীনা বললেন, আমি কিছু চাই না, শুধু শাহী কুতুবখানায় স্বাধীনভাবে অধ্যয়নের সুযোগ চাই।বিশাল শাহী কুতুবখানায় দাখেল হয়ে ইবনে সীনা হতবাক হয়ে গেলেন। সেখানে এমন সব কিতাবের সন্ধান তিনি পেলেন যার দেখা আগে পরে কখনো পাননি। বস্তুত এটি ছিলো সে যুগের সবচে’ সমৃদ্ধ কুতুবখানা। ইবনে সীন প্রথমে সমস্ত কিতাবের নতুন করে তালিকা ও বিশদ বিবরণ তৈরী করলেন। তারপর তালিকা অনুযায়ী কিতাব অধ্যয়ন শুরু করলেন। এসময় তাঁর দিন-রাতের হুঁশ ছিলে না। পানাহার ও আরাম-বিশ্রাম কিছুরই খেয়াল ছিলো না। শুধু বই পড়া, আর ওয়াক্ত-মত নামায পড়া, এই ছিলো তাঁর দিন-রাতের মাশগালা। এভাবে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তিনি পুরো গ্রন্থাগার আত্মস্থ করতে সক্ষম হন।মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ‘আলমাজমূ‘আ’ নামে বিশ্বকোষ রচনা করেন, যা জ্ঞানীদের সমাজে তাকে বিশেষ মর্যাদায় অভিষিক্ত করে। তবে চিকিৎসা-শাস্ত্রের উপর তাঁর লেখা ‘আলাকানূন ফিত্-তিব্ব’ গ্রন্থটিই তাঁকে জগৎ-জোড়া খ্যাতি এনে দেয়। আঠারো শতকের শেষ পর্যন্ত (প্রায় সাতশ’ বছর) ইবনে সীনার আলকানূন-ই ছিলো ইউরোপে চিকিৎসাশাস্ত্রের আকরগ্রন্থ। তাঁকে মনে করা হয় আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যতম পথিকৃৎ। অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজসহ ইউরোপের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইবনে সীনার আলকানূন ও অন্যান্য গ্রন্থ ছিলো জরুরি পাঠ্যের অন্তর্ভুক্ত। বিশেষ করে শল্যচিকিৎসার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিলো কালজয়ী। শরীর-তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর উপস্থাপিত তথ্যগুলোই বহুযুগ পর্যন্ত অনুসরণ করা হতো। তবে এটা সত্য যে, পাশ্চাত্য তাঁর জ্ঞান দ্বারা যতটা উপকৃত হয়েছে ততটা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার মত উদারতা তারা দেখাতে পারেনি।অতি অল্প সময়ে ইবনে সীনা সমসাময়িকদের তো বটেই, এমনকি আপন শিক্ষকদেরও ছাড়িয়ে যান। ইউক্লিডের জ্যামিতির কয়েকটি সম্পাদ্য তিনি শিক্ষক আন্-নাতেলীর সাহায্যে সম্পন্ন করেন। বাকিগুলো শিক্ষকের সাহায্য ছাড়া নিজেই সম্পন্ন করেন। নির্ভুল সমাধান দেখে শিক্ষক চমৎকৃত হন এবং অনুধাবন করেন যে, এখন তাঁকে শেখাবার মত কোন জ্ঞান তাঁর কাছে নেই। টলেমির ১৩ খ-ের গ্রন্থ ‘আলমাজেস্ট’-এর অধ্যয়ন যখন শুরু হলো তখন শিক্ষক বলে দিলেন, তুমি নিজেই সমাধানের চেষ্টা করো এবং ফল আমাকে দেখাও।এসময় তিনি এরিস্টটলের দর্শন আত্মস্থ করেন এবং তাতে বেশ কিছু সংশোধনী আনেন, যা তাঁর খ্যাতি ও সুখ্যাতি আরো ছড়িয়ে দেয়। তখন থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জ্ঞানপিপাসু তরুণ শিক্ষার্থীরা তাঁর কাছে ছুটে আসতে থাকে, আর তিনি রীতিমত শিক্ষকরূপে সর্বমহলে অখ- শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেন।সে যুগের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে তাঁর জীবন যথেষ্ট বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জীবনের শেষ দিকে তিনি পারস্যের শহর ইস্পাহানে চলে যান এবং সেখানে তাঁর জীবনের বাকি দিনগুলো অতিবাহিত হয়। ১০৩৭ খৃস্টাব্দে ১০ই ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।আল্লাহ তাঁকে রহম করুন। *


ইবনে সীনার জীবনে বিপর্যয়ের সূচনা হয় বোখারার সুলতানের শাহী কুতুবখানায় অগ্নিসংযোগের রহস্যজনক ঘটনা থেকে। তাঁর প্রতি যারা ঈর্ষাপরায়ণ ছিলো তাঁরা সুলতানের কান ভারী করে যে, গ্রন্থাগারের সব কিতাব আত্মস্থ করার পর ইবনে সীনা ইচ্ছা করেই গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দিয়েছেন, যাতে আর কেউ গ্রন্থাগার থেকে উপকৃত হতে না পারে। সুলতানও তা বিশ্বাস করে ইবনে সীনাকে কঠিন সাজা দিতে মনস্থ করেন। ইবনে সীনা বোখারা ত্যাগ করে খাওয়ারেযম চলে যান। সেখানকার ‘জ্ঞানী-সেবক’ সুলতান ইবনে সীনাকে সাদরে বরণ করেন এবং রাজচিকিৎসক নিযুক্ত করেন।গজনীর সুলতান মাহমূদ ইবনে সীনার জ্ঞানখ্যাতি সম্পর্কে অবগত হয়ে খাওয়ারেযমের সুলতানকে লিখলেন, ইবনে সীনাকে অবিলম্বে তার দরবারে পাঠানো হোক। সুলতান মাহমূদের এ দাবী সুলতানে খাওয়ারেযমের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। কিন্তু প্রবল আত্মমর্যাদার অধিকারী ইবনে সীনা ঘৃণার সঙ্গে সুলতানের ‘আদেশ’ মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং আত্মগোপন করে হামাদান চলে যান। সেখানে তাঁকে সসম্মানে প্রধান ওযীরের পদে বরণ করা হয়। কিন্তু সেখানেও তিনি রাজপুরুষদের ঈর্ষার শিকার হন। শেষ পর্যন্ত তিনি ইস্পাহানে গিয়ে স্থিত হন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।ইবনে সীনার জীবনে বিপর্যয়ের সূচনা হয় বোখারার সুলতানের শাহী কুতুবখানায় অগ্নিসংযোগের রহস্যজনক ঘটনা থেকে। তাঁর প্রতি যারা ঈর্ষাপরায়ণ ছিলো তাঁরা সুলতানের কান ভারী করে যে, গ্রন্থাগারের সব কিতাব আত্মস্থ করার পর ইবনে সীনা ইচ্ছা করেই গ্রন্থাগার জ্বালিয়ে দিয়েছেন, যাতে আর কেউ গ্রন্থাগার থেকে উপকৃত হতে না পারে। সুলতানও তা বিশ্বাস করে ইবনে সীনাকে কঠিন সাজা দিতে মনস্থ করেন। ইবনে সীনা বোখারা ত্যাগ করে খাওয়ারেযম চলে যান। সেখানকার ‘জ্ঞানী-সেবক’ সুলতান ইবনে সীনাকে সাদরে বরণ করেন এবং রাজচিকিৎসক নিযুক্ত করেন।গজনীর সুলতান মাহমূদ ইবনে সীনার জ্ঞানখ্যাতি সম্পর্কে অবগত হয়ে খাওয়ারেযমের সুলতানকে লিখলেন, ইবনে সীনাকে অবিলম্বে তার দরবারে পাঠানো হোক। সুলতান মাহমূদের এ দাবী সুলতানে খাওয়ারেযমের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। কিন্তু প্রবল আত্মমর্যাদার অধিকারী ইবনে সীনা ঘৃণার সঙ্গে সুলতানের ‘আদেশ’ মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং আত্মগোপন করে হামাদান চলে যান। সেখানে তাঁকে সসম্মানে প্রধান ওযীরের পদে বরণ করা হয়। কিন্তু সেখানেও তিনি রাজপুরুষদের ঈর্ষার শিকার হন। শেষ পর্যন্ত তিনি ইস্পাহানে গিয়ে স্থিত হন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।


শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা