যীকা‘দা ১৪৩৯ হিঃ (৩/৫)

টেকনাফ/তেতুলিয়া

বিশ্বকাপ এবং চায়ের কাপ!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

চায়ের কাপে ঝড় তোলা’ একটি বহুলপ্রচলিত প্রবচন, যা আমাদের জাতীয় মানসিকতা ও সামাজিক প্রবণতার বাস্তব প্রতিবিম্ব। প্রবচনটির মর্মার্থ হলো, প্রয়োজনীয় কাজ সিকায় তুলে তুমুল উৎসাহে অর্থহীন বিষয়ে বাদানুবাদ ও তর্ক বিতর্কে লিপ্ত হওয়া।

সম্প্রতি বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে উপরোক্ত প্রবচনটি যেন আবার নতুন জীবন লাভ করেছে। অর্থাৎ দেশের শহরে বন্দরে, গ্রামে গঞ্জে, পথে ঘাটে আনাচা-কানাচে, এমনকি অফিসে আদালতে সবাই সবকাজ ফেলে বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনার পর্যায়ে মাতামাতি শুরু করেছে। বলা যায়, চায়ের কাপে এখন আর ঝড় নয়,

রীতিমত সাইক্লোন ও সুনামি বয়ে যায়। তর্ক ও বাদানুবাদের পরিণতিতে হাতাহাতি ও মারামারির পর্যায় পার হয়ে এখন খুনাখুনি পর্যন্ত গড়িয়েছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশ। আরো লজ্জার বিষয় এই যে, তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলো পর্যন্ত ‘ফুটবলডেঙ্গু’ থেকে মুক্ত নয়। পুরো একমাস যেন লেখাপড়া গোল্লায় চলে যায়। ক্লাস বর্জন

করে খেলা দেখার দাবীতে মিছিল পর্যন্ত হয়। কর্তৃপক্ষকে বাধ্য হয়ে ‘ছাত্রদের গণদাবী’র সামনে মাথা নোয়াতে হয়। পরীক্ষা পিছাতে হয়, আর কর্তৃপক্ষীয় ব্যবস্থায় খেলা দেখার ‘ইন্তিযাম’ করতে হয়।

জাতি হিসাবে আমাদের অবস্থান কতটা নীচে এবং সামাজিক অবক্ষয় কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, বিশ্বকাপ যেন তারই একটা ব্যারোমিটাররূপে চারবছর পরপর আমাদের সামনে উপস্থিত হয়।

আন্তর্জাতিক মিডিয়ার একজন পরিচিত ব্যক্তিত্ব আমাদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল হচ্ছে ফুটবল খেলোয়াড়ের দেশ, আর ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ হচ্ছে ফুটবলবিশেষজ্ঞের দেশ।

কতটা শ্লেষ ও অবজ্ঞা এ মন্তব্যে প্রচ্ছন্ন রয়েছে তা বোঝার জন্য খুব বেশী বুদ্ধির কি প্রয়োজন আছে?! বাস্তবতাও তো এটাই। একদিকে স্কুলপড়–য়া ছাত্র থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যদিকে কর্মক্ষেত্রে আইনজীবী, আমলা-সচীব থেকে শুরু করে চতুর্থশ্রেণীর কর্মচারী পর্যন্ত প্রত্যেকেই বিশেষজ্ঞমন্তব্য করে চলেছে, যাকে বলে, চায়ের কাপে রীতিমত ঝড় তুলে। তাতে কোন্ খেলোয়াড়ের কী দোষ, কী গুণ, কোন্ দলের কোচ কবে কী ভুল করেছেন, সবই উঠে আসছে।

বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের কিছু অর্জন যদি বলা যায়, তা হলো ‘জার্সি তৈরীর দর্জিগিরি’ এবং সেই সুবাদে কিছু মজুরিপ্রাপ্তি। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের পোশাককারখানাগুলো বিশ্বকাপ উপলক্ষে এবার বিপুল পরিমাণ জ্যাকেট, টুপি, টিশর্ট, মোজা গেঞ্জি ইত্যাদি তৈরী করেছে। খবরে আরো প্রকাশ, বিশ্বকাপ উপলক্ষে বিশ্বের কোটি কোটি ক্রীড়াপাগল ফুটবল সমর্থকের জন্য বাংলাদেশ এককোটিরও উপরে পোশাক সরবরাহ করার ফরমায়েশ লাভ করেছে। ফলে গত তিনমাসে নিটপণ্যের রফতানি-আদেশ বেড়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশ।

এমনকি ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জার্সিও সরবরাহ করেছে বাংলাদেশের পোশাক-কারখানা। ঐ সব জার্সির গায়ে লেখা আছে, ‘মেড-ইন বাংলাদেশ’। আমাদের একটি জাতীয় দৈনিক তো বেশ গর্ব করে লিখেছে, ‘জার্সির মাধ্যমে লুইজ ফেলিপ্পে, স্কলারির দল এবার জানবে বাংলাদেশে নাম’। হীনমন্যতা আর কাকে বলে!

আর মজুরি! ডেইলি টেলিগ্রাফ জানায়, বাংলাদেশী পোশাকশ্রমিকের পারিশ্রমিক প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ২১ পেন্স, সেহিসাবে পুরো মাসের মজুরি মাত্র ৪৭ ইউরো। অথচ প্রতিটি জার্সি বিক্রি হয় ১৬০ ইউরোতে!

আজ সময়ের দাবী হচ্ছে সমাজের সর্বস্তরে আত্মচেতনা তৈরীর লক্ষ্যে কাজ করা, অন্তত যাদের কিছুটা বিবেক ও মর্যাদাবোধ এখনো অবশিষ্ট রয়েছে।

অন্তত মাদারেসের তালিবানে ইলমকে তো যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করতেই হবে। এই সাদা-শুভ্র পোশাকই তো জাতির আশাভরসার অর্থাৎ রাতের আঁধারকে ভোরের আলোর মতই তুলে ধরার মত কুশলী তারা। আর এ জন্য যে আবরণটি তারা ব্যবহার করে তা ভোরের আলোর চেয়েও যেন উজ্জ্বল! ইসলামী সংবাদপত্রের জগতে যারা কাজ করে তাদের কর্তব্য প্রথম আলোর এ কর্মকৌশলটি আত্মস্থ করা এবং সত্যের সেবায় এটিকে সুন্দরভাবে ব্যবহার করা।                                                                                                   

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা