আমি পাখী, আমার দু’টি ডানা আছে। মনের আনন্দে আমি নীল আকাশে মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উড়ে বেড়াই। আমার কোন সীমানা নেই, কোন ভূগোল নেই। ইচ্ছে হলেই আমি উড়ে যেতে পারি দেশ থেকে দেশান্তরে, এমনকি মহাদেশ থেকে মহাদেশে। মানুষের তো ডানা নেই। তাই তারা উড়তে পারে না। সীমানা ও সীমান্তের বেড়াজালে তারা আবদ্ধ। ইচ্ছে হলেই তারা পাড়ি দিতে পারে না দেশ থেকে দেশে, মহাদেশ থেকে মহাদেশে। হয়ত এ জন্যই পাখীদের প্রতি মানুষের এত বিদ্বেষ। পাখীরা কখনো মানুষের কোন ক্ষতি করেনি। যখন যদ্দুর পেরেছে মানুষের উপকারই করেছে। পাখীরাই তো মানুষের হৃদয়ে, আকাশে ডানা মেলে ওড়ার স্বপ্ন সৃষ্টি করেছে। পাখীদের কাছ থেকেই তো মানুষ উড়োজাহায তৈরীর প্রযুক্তি অর্জন করেছে। মানুষের তো কর্তব্য ছিলো আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া। কিন্তু মানুষ বড় অকৃতজ্ঞ! পাখীরা কখনো মানুষ শিকার করে না; মানুষই পাখী শিকার করে।
মানুষ বলতে পারে, আমরা তাদের মাঠের ফসল খেয়ে ফেলি। কিন্তু সেটা তো আমাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে! তাছাড়া পরিমাণে তা কত সামান্য!! মানুষ কিন্তু আমাদে শিকার করে প্রয়োজনের তাগিদে নয়, নিছক শখের বশে!!
***
এবার বলি আমার নিজের কষ্টের কথা। আমি যখন ছোট্ট ছানা তখন একনিষ্ঠুর শিকারী একসঙ্গে আমার মা-বাবাকে শিকার করে নিয়ে গেলো। বেশ উঁচু ডালে ছিলো আমাদের বাসা। মা-বাবা বাসার বাইরে একসঙ্গে একটা ডালে বসে নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প করছিলো। হঠাৎ বন্দুকহাতে এক শিকারী এসে হাজির! কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা বিকট আওয়ায হলো, আর মা-বাবা দু’জনই ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মাটিতে পড়ে গেলো! আমরা বাসায় ছিলাম তিন ভাইবোন। চোখের সামনেই দেখতে পেলাম মা-বাবার আহত হওয়ার এবং রক্তঝরার দৃশ্য!
আমরা তিনভাইবোন সেদিন এতীম হয়ে গেলাম। মানুষের তো বুঝতে পারার কথা, এতীম হওয়ার কষ্ট কেমন! তারপরো কীভাবে মানুষ পাখী-ছানাদের এভাবে এতীম করতে পারে!
***
আরেকদিনের ঘটনা! আমি তখন বড় হয়েছি। মা হয়েছি। আমাকে অনেক দূর উড়ে, অনেক দূর ঘুরে ছানাদের জন্য খাবার সংগ্রহ করতে হয়। মা হওয়ার এ বড় মধুর যন্ত্রণা! ভোরের আলো ফুটলো ছানা-গুলোকে আদর করলাম। ওরা শুধু কিচিরমিচির কাঁদছিলো, মানবশিশু যেভাবে কাঁদে ক্ষুধা পেলে। আমি খুব অস্থির হলাম, মায়েরা ক্ষুধার্ত সন্তানের কান্নায় অস্থির না হয়ে পারে না। আমি ছানাগুলোকে সান্ত¦না দিয়ে বললাম, সোনামণিরা, একটু ছবর করো। এই উড়াল দিয়ে যাবো, আর খাবার নিয়ে আসবো। ছানাগুলোকে বাসায় রেখে অস্থির মনে বের হলাম। উড়তে উড়তে কত দূরে যে গেলাম, হিসাব ছিলো না। একজায়গায় পেয়ে গেলাম ছানাগুলোর উপযুক্ত খাবার। খাবার ঠোঁটে করে, শুরু করলাম ফিরতি উড়াল। আর তখন...
কোন নিষ্ঠুর শিকারীর শখ হলো উড়ন্ত পাখী শিকার করার! গুলিটা মনে হয় ডানার মধ্যেই লাগলো। ঝাপটি খেয়ে খেয়ে অনেক দূরে গিয়ে পড়লাম। তাই গুরুতর আহত হয়েও শিকারীর হাত থেকে বেঁচে গেলাম। হায়রে মানুষ! হায়রে মানুষের নিষ্ঠুরতা!!
ছানাগুলোর কথা মনে পড়লো। শরীরের ব্যথা ছাপিয়ে মনের অস্থিরতা যেন আমাকে অবশ করে ফেললো। ছানাগুলো নিশ্চয় অস্থির হয়ে পড়েছে খাবারের জন্য! আশ্চর্যরকম একটা কান্না যেন ভিতরে গুমরে উঠলো!
কিন্ত আমাকে এখন বাঁচার চিন্তা করতে হবে। নিজেকে সুস্থ করার চেষ্টা করতে হবে। অন্তত আমার ছানাগুলো যেন মা-হারা না হয় সে জন্য। মা হারানোর কষ্টটা আমার এখনো মনে আছে। মনে পড়লে এখনো সেই শৈশবের ব্যথাটা চিনচিন করে ওঠে। না, আমার সন্তান মা-হারা হতে পারে না, কিছুতেই না! আমার সন্তানের জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে, বাঁচার চেষ্টা করতে হবে।
প্রথমে দরকার একটা নিরাপদ আশ্রয়। মানুষের আনাগোনা থেকে দূরে একটা বিশাল প্রান্তরে ফসলের মাঠে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বের করলাম। মানুষ যত নিষ্ঠুরই হোক, মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহ, তিনি পাখিদেরও ¯্রষ্টা। পাখীর প্রতিও তাঁর দয়া মায়া কম নয়। হয়ত মানুষের প্রতি দয়া-মায়ার চেয়ে একটু বেশী। এ সত্যটা আগে কখনো এমন করে অনুভব করিনি। আজ এ অসহায় অবস্থায় মনে হলো, আল্লাহ নিজে আমার শুশ্রƒষা করছেন। তিন দিনের মাথায় ওড়ার মত সুস্থ হলাম।
ছানাগুলোর জন্য আবার কিছু খাবার যোগাড় করলাম। উড়ে উড়ে সন্ধ্যার কিছু আগে বাসায় এসে পৌঁছলাম। সারাটা পথ শুধু এ আশঙ্কায় অস্থির ছিলাম, ফিরে গিয়ে কী দেখবো? আমার ছানাগুলো বেঁচে আছে তো?! নিরাপদে আছে তো?!
কিন্তু সেখানে আমার জন্য এমন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য অপেক্ষা করছিলো যা কল্পনা করতেও ছোট্ট পাখীর হৃদপি-টা টিপ টিপ করে ওঠে। দু’টি ছানা হয়ত ক্ষুধায় ছটফট করতে করতে মগডালের বাসা থেকে নীচে পড়ে গেছে। এখনো পড়ে আছে তাদের মৃতদেহদু’টো। একটা কাক ঠোকরাচ্ছে। মনে হলো প্রতিটা ঠোকর আমার বুকে বিঁধছে। অসহায়ের মত দেখে থাকা ছাড়া আমার তখন কিছুই করার ছিলো না।
বাসায় তখনো যে ছানাটি ছিলো, নড়াচড়া করতে পারছে না। চিঁচিঁ আওয়ায বের হচ্ছে শুধু ঠোঁট থেকে। মনে সামান্য হলেও সান্ত¦না এলো, একটা ছানা এখনো বেঁচে আছে। যদি ওর ঠোঁটে খাবার তুলে দিতে পারি, বাঁচতে পারে।
***
সেই ছানাটি যখন উড়তে শিখলো, বাসা ছেড়ে, আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। এতে অবশ্য অস্বাভাবিকতা কিছুৃ নেই। পাখীর সমাজে এটাই প্রকৃতির বিধান। মানুষের সন্তানই তো মা-বাবাকে ছেড়ে চলে যায় নিজের সুখের সন্ধানে। অথচ মানুষের জন্য আল্লাহর বিধান হলো ‘তাদের জন্য তুমি দয়ার ডানা বিছিয়ে দাও ...!
মানুষ যদি বুঝতে চায়, তাহলে এখানেও রয়েছে শিক্ষা। মা-বাবার প্রতি দয়ার কথা বলতে গিয়ে আল্লাহ পাখীর ডানার কথা উল্লেখ করেছেন। তাহলে পাখীর প্রতিও সদয় হওয়া কি মানুষের কর্তব্য নয়?
আমার ভাষা যদি আজকের মানুষ বুঝতো যেমন বুঝতেন আল্লাহর নবী হযরত সোলায়মান তাহলে আমি জানতে চাইতাম
‘মানুষের সমাজে এমন ভালো মানুষ কি নেই, যারা মানুষকে মানবতা শেখাতে পারে! যারা নিষ্ঠুর শিকারিদের ফিরিয়ে রাখতে পারে পাখীশিকারের নিষ্ঠুরতা থেকে! *
কোরআন শরীফে দেখো আল্লাহ কত সুন্দর করে বলেছেন, ‘তারা কী তাকিয়ে দেখে না পক্ষীদলের দিকে, যখন তা তাদের উপর (আকাশে) সারিবদ্ধভাবে উড়ে যায়, কখনো ডানা মেলে, কখনো ডানা গুটিয়ে। আকাশে ভাসমান অবস্থায় কেউ তাদের ধরে রাখতে পারে না, রহমান ছাড়া।’
ওড়ার জন্য প্রয়োজন হালকা শরীর এবং ডানার মাধ্যমে বাতাসের উপর ভর করার শক্তি। পাখীর শরীরকে আল্লাহ তা‘লা খুব হালকা করে বানিয়েছেন। পাখীর গোশত পশুর গোশতের চেয়ে ওজনে কম, আবার হাড়গুলোর ভিতরটা ফাঁপা! ডানাগুলো বিভিন্ন মাপের পালক দ্বারা এমনভাবে সজ্জিত যে, এর সাহায্যে পাখী সহজেই বাতাসে ভাসমান থাকতে পারে। পাখীর এ উড্ডয়নকৌশল চিন্তা করেই মানুষ বিমানের নকশা ও প্রযুক্তি অর্জন করেছে। একারণেই বিমান দেখতে ঠিক পাখীর মত।
লেখা থেকে লেখার জন্ম!
প্রিয় আহমদ মূসা!
তোমাকে দেখিনি কখনো, তবে তোমার লেখা দেখে অন্তরে তোমার প্রতি একটি কোমল অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে। তোমার পাঠানো লেখাটি থেকে দেখো, কী সুন্দর একটি লেখা তৈরী হয়েছে ‘একটি পাখীর আত্মকথা’ নামে! তোমার লেখাটি না হলে এ লেখা কিছুতেই তৈরী হতো না। এ জন্য তোমার কলমের কাছে আমার কলম ঋণী। লিখতে থাকো এবং লেখা পাঠাতে থাকো। এভাবে একদিন তুমি বড় লেখক হতে পারবে ইনশাআল্লাহ। এই লেখাটির জন্য তুমি এবার পুষ্পের অতিথি সম্পাদক। তোমার লেখাটি এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো
মানুষ কত কষ্টে জীবন যাপন করে। কিন্তু পাখী মনের আনন্দে দিক দিগন্তে ঘুরে বেড়ায়। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে উড়ে বেড়ায় ডানা মেলে। সকালে বের হয় নীড় থেকে, আবার সন্ধ্যায় নীড়ে ফিরে যায়। কিন্তু তার জীবন তো আর একার নয়। সেও ভাবে, আমারও জীবন আছে। অন্যকে বাঁচাতেও আমারই লাগবে। সেও জানে, বাঁচানোর মালিক আমি নই। বাঁচানোর মালিক একজন আছে। কখন যে মৃত্যু আসে জানা নেই। পরিবার পরিজন তো শুধু আমারই আছে। অন্যসব পাখীরই আছে। ভিন্ন কোন জাতির নেই, বিষয়টি এমনও নয়। কিন্তু তারপরো আমাদেরকে কেন গুলাই দিয়ে মারে ‘ওরা’?! আমরা কি তাদেরকে কিছু করেছি?! কোন ক্ষতি করেছি?! ক্ষতি যদি করেই থাকি করলে কী ক্ষতি এমন করেছি, একটু বলুক না আমাদেরকে! আমরা আর কোন ক্ষতি করবো না। আহা, ওরা কেন ক্ষতি করছে আমাদের এমনভাবে?! পাখীর যদি কথা বলার শক্তি থাকতো তাহলে অবশ্যই মামলা দায়ের করতো। কিন্তু কোরআন আমাদেরকে বলছে, তারা তাসবীহ পাঠ করে, কিন্তু তোমরা (মানবজাতি) তাদের তাসবীহ বুঝবে না, অনুধাবন করতে পারো না। আসলেই তাই হচ্ছে। যাই হোক সকাল যায়, সন্ধ্যা আসে। প্রতিদিনের মত পাখীও তার নীড়ে ফিরে যায় কিচির মিচির আওয়াযে। সকালে আবার পরদিন বের হবে এই আশায়। একদিন হলো কী! পাখিটি সকালে বের হলো। পাখীটিকে সুন্দর ভেবে আর সহ্য হলো না। গুলাইটা দিয়ে দিলো এক ব্যথা। ব্যথা পেয়ে উড়ন্ত পাখীটি এক দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিলো। উড়ছে না। উড়তে পারছে না ব্যথার কারণে। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মাটিতে পড়ে গেলো। মুহুর্তেই জীবনটা কেমন হয়ে গেলো। সবকিছু তছনছ হয়ে গেলো পাখীটার। জীবনটা কঠিন দূর্বিষহ হয়ে উঠলো। একটু আগে ছিলো সতেজ ও জীবন্ত। আর এখন হয়ে পড়লো নিস্তেজ ও নির্জীব। পাখীটাকে দেখে বড় মায়া হলো। দেখে মনে হলো, বেচারার জানটা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ঠিক আছে, আল্লাহর উপর ভরসা করে কাছে গেলাম। দেখে বড় সুন্দর মনে হলো। দিলে মায়ার বাধন আরো বেড়ে গেলো। গায়ের রংটা দেখতে লাগলাম, আর ¯্রষ্টার সৌন্দর্য অবলোকন করতে লাগলাম। আলতো করে গায়ে হাত বুলালাম। দু’হাতে উঠিয়ে নিলাম তাকে, যেন কোলে তুলে নিলাম। তারপর তার স্বাধীনতা হনন করলাম। যে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই সেবাশুশ্রƒষা দিয়ে যেতে লাগলো। দানা-পানি, খাবার দাবার সবই দেয়া হলো। যেন এক্কেবারে সোনায় সোহাগা, আলালের ঘরের দুলাল। (বলতে পারতাম মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশী। কিন্তু বলিনি।) কতজন কত কিছু দিলো! কলা দিলো, মুড়ি দিলো, ভাত দিলো, পানি দিলো। খাবে না তো খাবে নাই। যতো সব জ্বালাযন্ত্রণা শুরু হলো। অবস্থা দেখে মনে হলো, বেশীক্ষণ আটকে রাখা ঠিক হবে না। আবার যদি খাবার না খায় তাহলে তো বেশী দিন বাঁচবে না। সুস্থও হয়ে ওঠবে না। চিন্তায় আল্লাহ দান করলেন যে, তুমি শুধু বান্দা, চেষ্টা করে দেখতে পারো। আমিই সুস্থতা ফিরিয়ে আনবো। চিন্তায় এটাও এলো যে, খাঁচায় আটকে রেখে দিলেও তো ফায়দা নেই। বরং পেরেশানি শুধু বেড়েই চলছে। তাকে ছেড়ে দেই, হতে পারে আল্লাহ তাকে সুস্থ করে দেবেন, কিংবা সে নিজেই এর ব্যবস্থা করে নেবে। এই ভেবে পাখীটাকে খাঁচা থেকে বের করে দু’হাতে মুঠ করে উপরের দিকে মেলে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে পাখীটি ফুড়–ত করে উড়ে যেয়ে গাছের ডালে যেয়ে বসলো। এরপর খুশী মন নিয়ে নীড়ে ফিরে গেলো। এই দেখে আমার মনটি আনন্দে ভরে উঠলো। ভিতর থেকে নিজের অজান্তেই শোকরিয়া বেরিয়ে এলো।
সম্পাদক ঃ সামনের কোন সংখ্যায় সম্ভব হলে তোমার লেখটি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করার ইচ্ছে আছে। আপাতত লাল অংশটি সম্পর্কে তুমি এবং সবাই চিন্তা করে দেখো, কিছু বুঝতে পারো কি না!