আরাকানিদের বাদ্য-বাজনা ও আনন্দ-উল্লাসের মধ্য দিয়ে বার্মার রাজা বোধপায়া আরাকান বিজয় সম্পন্ন করলেন তারপর অল্পদিনেই স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করলেন।
আধুনিক কূটনীতির যুগ তখনো শুরু হয়নি, তবে প্রাচীনযুগের কূটনীতিও যথেষ্ট কুটিল ছিলো। বোধপায়া আরাকানের সামন্তরাজ হারিকে দেয়া প্রতিশ্রুতি বা তার সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। আরাকানকে তিনি সরাসরি বার্মার সঙ্গে যুক্ত করে নিলেন। অর্থাৎ স্বাধীন সার্বভৌম আরাকানরাজ্য বার্মারাজ্যের অঙ্গরাজ্য হলো। হারি, যিনি স্বপ্ন দেখছিলেন আরাকানের করদরাজা হওয়ার, তাকে নিযুক্ত করা হলো আরাকানের প্রশাসকরূপে। শাসনবিষয়ে তার নিজস্ব কোন ক্ষমতাই ছিলো না। যে কোন বিষয়ে তাকে চেয়ে থাকতে হতো বর্মীরাজের অঙ্গলি-হেলনের দিকে।
এরপর শুরু হলো বর্মীসেনাদের এমন হত্যালুণ্ঠন ও অবাধ শোষণ যে, বছরকয়েকের মধ্যেই সচ্ছল সমৃদ্ধ আরাকান হয়ে পড়ে বিধ্বস্ত ও দেউলিয়া।
রাজা বোধপায়ার নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার চরম প্রকাশ ঘটে একটা চাতুরিপূর্ণ পদক্ষেপের মাধ্যমে।
পরাজিত আরাকানবাহিনীর পালিয়ে যাওয়া সৈনিকদের উদ্দেশ্যে তিনি ‘সাধারণ ক্ষমা’র ঘোষণা প্রচার করেন যে, তারা সেনানিবাসে এসে অস্ত্র সমর্পণ করে নিজ নিজ জনপদে স্বাভাবিক জীবন শুরু করতে পারে।
পলাতক সৈন্যরা দলে দলে সেনানিবাসে প্রবেশ করে অস্ত্র সমর্পণ করলো, আর বিজয়ী বাহিনী তাদের উন্মুক্ত স্থানে জড়ো করে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করলো। এ হতভাগ্য প্রতারিত সৈনিকরা না পারলো স্বাভাবিক জীবন গ্রহণ করতে, না পারলো স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করতে!!
ইতিহাসের পাতায় এমনো প্রমাণ পাওয়া যায়, বার্মার সা¤্রাজ্যবাদী শাসক হাজার হাজার আরাকানী পুরুষ ও যুবককে বিনা অপরাধে হত্যা করেছেন, আর নারিদের বেছে বেছে বার্মায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই হতভাগিনিদের শেষ পরিণতি কী হয়েছে তা কোনদিন জানা যায়নি।
এসময় নির্যাতন ও নিপীড়নে অতিষ্ঠ কয়েক লাখ আরাকানী প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনিশাসিত বংলার চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। ১৭৮৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত আরাকানী শরণার্থিদের আগমন অব্যাহত ছিলো।
একে তো চট্টগ্রাম দীর্ঘকাল আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল ছিলো, সেই সুবাদে উভয় অঞ্চলের মধ্যে ভৌগোলিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে নিকটসম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো, অন্যদিকে চট্টগ্রামে তখন আর যাই হোক আরাকানের তুলনায় সচ্ছলতা ও প্রাচুর্য ছিলো অনেক বেশী। যদিও শোষণ ও লুণ্ঠন এখানেও ছিলো, তবে মাত্রা ও প্রকৃতির দিক থেকে পার্থক্য ছিলো আকাশ-পাতাল। তাই নির্যাতিত আরাকানীরা যেমন আশ্রয়ের আশায় আসছিলো তেমনি চট্টগ্রামের মানুষও উদার মানবিকতার সঙ্গেই তাদের গ্রহণ করেছিলো।
আরাকানিদের উপর বর্মীরাজার নির্যাতনের একটি পদ্ধতি ছিলো বাধ্যতামূলক বেগার শ্রমে নিয়োগ। এটা এমনই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছিলো যে, পুরো আরাকান অঞ্চলে রীতিমত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিলো। সক্ষম পুরুষ ও যুবকদল অনেক সময় জনপদ ও বাড়িঘর ছেড়ে বনে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াতো। এর মধ্যে বিভিন্ন উপলক্ষে শত শত, বরং হাজার হাজার সক্ষম পুরুষ ও যুবককে ধরে ধরে বার্মায় পাঠানো হয়েছে। মেইক্টিলা হ্রদ পুনর্নির্মাণের কাজ ধরে আনা আরাকানিদের বাধ্যতামূলক বেগার শ্রমের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছিলো। এভাবে আরো বহু বৃহৎ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা যায়, যা গড়ে উঠেছিলো আরাকানের বেগার শ্রমিকদের শুধু খুনপাসিনার উপর নয়, বরং তাদের কঙ্কালের উপর। পূর্ববর্তী ইতিহাসে যদি এর উপযুক্ত নযির খুঁজতে হয় তাহলে আমাদের যেতে হবে মিশরের ফাঁরাও যুগে, যখন ‘দাসশ্রমিকদের’ বেগার খাটানো হতো পিরামিড তৈরীর কাজে।
শুরু থেকেই আরাকানীরা যোদ্ধাজাতি নয় এবং বিদ্রোহ-প্রবণতাও তাদের মধ্যে ছিলো না। তবে শোষণ-নির্যাতন ও পাশবিকতা-নৃশংসতা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন একটা নিরীহ জনগোষ্ঠীও রুখে দাঁড়াতে পারে প্রবল পরাক্রমী শক্তির বিরুদ্ধে। আরাকানের পরাধীন জনগোষ্ঠীও তখন সহ্যের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছিলো। বলা যায়, দেয়ালে তাদের পিঠ ঠেকে গিয়েছিলো।
শেষ পর্যন্ত ১৭৯১ খৃস্টাব্দে এক ভয়াবহ বিদ্রোহ সঙ্ঘটিত হলো। পূর্ববর্তী রাজবংশের জনৈক বংশধর ওয়েমার নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হলো। ওয়েমা নিজেকে রাজা ঘোষণা করে ক্ষুদ্র আকারে হলেও একটা বাহিনী গড়ে তোলেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। একদিকে অল্প প্রশিক্ষণের আগোছালো একটা বাহিনী, অন্যদিকে সুপ্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত বিশাল সামরিক বাহিনী। তবে ওয়েমা ও তার বাহিনী ছিলো রীতিমত মরিয়া। তাদের লড়াই ছিলো অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। তাই বহু বর্মী সেনা যুদ্ধে নিহত হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত ওয়েমা পরাজিত হন এবং তার বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হয়। তবে বর্মীরাজ নিজেও হতবুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন তার বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি দেখে। ক্রোধান্ধ রাজা তাতে আরাকানিদের উপর যুলুম-নির্যাতন এবং নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতার পরিমাণ বহু গুণ বাড়িয়ে দেন। বর্ণিত আছে, বিদ্রোহ দমনের পর প্রতিশোধ হিসাবে বার্মার দখলদার বাহিনী দু’লাখেরও বেশী আরাকানীকে হত্যা করে।
ঐ সময়ই (১৭৯৮ খৃ.) ঘটে আরাকানের ইতিহাসে সবচে বড় দেশত্যাগের ঘটনা। আরাকানের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশী অধিবাসী চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করে। যদিও শরণার্থিদের বেশীর ভাগ মুসলিম ছিলো, তবে হিন্দু ও বৌদ্ধজন-গোষ্ঠীও সংখ্যায় কম ছিলো না। আজকের পার্বত্য অঞ্চলের যে বৌদ্ধজনগোষ্ঠী, প্রধানত তারা ঐ সময়েরই শরণার্থী। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার পরো তারা আর বাংলাদেশ ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে যায়নি। এদেশের জনগণও তাদের আপন করে নিয়েছে।
বলাবাহুল্য, এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আগমনে তখন সত্যি সত্যি এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিলো। কোম্পানির প্রশাসন এই বিপুল-সংখ্যক উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে সামাল দিতে রীতিমত দিশেহারা অবস্থায় পড়েছিলো। একপর্যায়ে কোম্পানি প্রশাসন শরণার্থিদের বলপূর্বক ফেরত পাঠানোর চিন্তাভাবনা শুরু করে। কারণ অর্থনৈতিক দায়ভার তো ছিলোই, তার উপর ইংরেজ কোম্পানীর তো কোন ধর্মীয় দায় ছিলো না। এত বড় একটা বোঝা কেন তারা মুফতে মাথায় তুলে নেবে।
ঐ পরিস্থিতিতে জনৈক আরাকানী সরদার যে মর্মস্পর্শী বক্তব্য রেখেছিলেন তা এখনো যে কোন মানুষের অন্তরে সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা কিছুতেই আরাকানে ফিরে যাবো না। যদি তোমরা আমাদের গণহত্যা করতে চাও, আমরা প্রস্তুত। আর যদি জোর করে ফেরত পাঠাতে চাও তাহলে আমরা যাবো এবং পাহাড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নেবো। সেখানে পশুপ্রাণীর নিরাপদ আশ্রয় হলে আমাদেরও হবে।’
শেষ পর্যন্ত কোম্পানি প্রশাসন তাদের চিন্তা থেকে সরে আসে। এদিকে উদ্বাস্তুদের মধ্যে যারা সরদারশ্রেণীর, সীমিত সাধ্যের মধ্যেও তারা আরাকানের অভ্যন্তরে প্রতিশোধমূলক হামলা চালানো শুরু করে, যাকে মোটামুটি গেরিলাতৎপরতা বলা যায়। এতে অবশ্য কোম্পানী প্রশাসনের অনুমোদন ছিলো না। তাই তাদের সমগ্র তৎপরতা ছিলো গোপনীয়তানির্ভর। এজন্য তারা চট্টগ্রামের দক্ষিণ ও পূর্ব-সীমান্তের পাহাড়-জঙ্গলকে নিরাপদ আশ্রয়রূপে ব্যবহার করেছিলো।
সরদারশ্রেণী দ্বারা পরিচালিত গেরিলা হামলায় আরাকানে অবস্থানকারী বর্মী বাহিনী ও বেসামরিক লোকজন যথেষ্ট সংখ্যায় হতাহত হতে থাকে।
***
হারি, যার আমন্ত্রণে রাজা বোধপায়া আরাকান দখলের অভিযানে বের হন এবং যাকে দখলকৃত আরাকানের প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়, তারপর বিদ্রোহের অপরাধে হত্যা করা হয়, তার একমাত্র জীবিত পুত্র সিন পিয়ান ছিলেন প্রচ- রকম স্বাধীনচেতা এবং অনমনীয় মনোবলের অধিকারী। শুরু থেকেই তার প্রতিজ্ঞা ছিলো যুদ্ধের মাধ্যমে আরাকানের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের। তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলে শরণার্থীরূপে বাস করলেও অতি গোপনে সামরিক প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে থাকেন এবং অস্ত্রচালনায় সক্ষম অল্পকিছু উদ্যমী ও স্বাধীনতা-পাগল যুবক এবং সামান্য পরিমাণ অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। তার আশা ছিলো, এক পর্যায়ে তিনি ইংরেজ কোম্পানীর সহায়তা অর্জনে সক্ষম হবেন। তখন যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হবে। ফলে দখলদার বাহিনীকে তিনি আরাকানের ভূমি থেকে চিরতরে উৎখাত করতে সক্ষম হবেন।
১৮১১ খৃস্টাব্দে সিন পিয়ান বাংলা-আরাকান সীমান্তের ‘মুরুসুগিরি’ ভূখ-টি দখল করতে সক্ষম হন। এতে তার ক্ষুদ্র বাহিনীর মনোবল যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ঐ বছরের মে মাসে সিন পিয়ান তিন হাজার রোহিঙ্গা যুবকের বাহিনী নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে আরাকানের গুরুত্বপূর্ণ শহর মংডু দখল করে নেন। সিন পিয়ান তখন উদ্বাস্তু আরাকানী যুবকদের তার নেতৃত্বে পরাধীন আরাকানের জন্য স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগদানের উদাত্ত আহ্বান জানান। সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে বহু রোহিঙ্গা যুবক সিন পিয়ানের বাহিনীতে যোগদান করে। রোহিঙ্গা যুবকদের মধ্যে একে তো স্বাধীনতার চেতনা ছিলো প্রবল, তদুপরি মংডু দখলের ঘটনা তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে জোয়ার সৃষ্টি করে।
সিন পিয়ানের স্বাধীনতাযুদ্ধ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে, যা হয়ত তিনি নিজেও ধারণা করতে পারেননি। মাত্র এক মাসের যুদ্ধতৎপরতায় রাজধানী ¤্রােহং ছাড়া প্রায় পুরো আরাকান তার দখলে চলে আসে।
এর মধ্যে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়ে যায়, যার কারণে যুদ্ধের গতি ঝিমিয়ে আসে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সম্পূর্ণ বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও সিন পিয়ান রাজধানী অবরোধের চিন্তা করেন, যা নিছক অতি উৎসাহের ফল ছাড়া আর কিছু ছিলো না। তাছাড়া কোম্পানি সরকারের প্রতি তার অতিআশাবাদও তাকে সামরিক দিক থেকে এরূপ আত্মঘাতী পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে থাকবে।
একথা অবশ্য সত্য যে, সিন পিয়ান যদি তার ধারণামত বিটিশশক্তির ন্যূনতম পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন তাহলে অবশ্যই তার প্রচেষ্টা সফল হতো। কিন্তু রাজা নরমেখলার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলো মুসলিম বাংলার শাসকগণ যাদের কাছে রাজনৈতিক স্বার্থের চেয়েও বড় বিষয় ছিলো মানবিকতা। আর সিন পিয়ান সাহায্য চেয়েছিলেন বৃটিশবাংলার কাছে, আর বৃটিশ হলো এমন একজাতি যারা কারো সাহায্যে এককদমও আগে বাড়ে না, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থ ছাড়া। যাই হোক, বৃটিশশক্তির সাহায্য লাভের জন্য সিন পিয়ানের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়, যদিও বাহ্যত তাতে বৃটিশদের যথেষ্ট রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা ছিলো। কিন্তু নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে কোম্পানি সরকার ঐ সময় সিন পিয়ানের জন্য বর্মীরাজের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির ঝুঁকি গ্রহণ করতে কিছুতেই প্রস্তুত ছিলো না।
সিন পিয়ান শেষ চেষ্টা হিসাবে কোম্পানিকে এ মর্মে পত্র দেন যে, স্বাধীন আরাকান থেকে কোম্পানিকে তিনি নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করবেন। কিন্তু কোম্পানি তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
এদিকে যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছিলো তাই ঘটলো। সিন পিয়ান অস্ত্র ও গোলাবারুদের তীব্র সঙ্কটে পড়লেন। খাদ্যসঙ্কটও ছিলো প্রবল। এর মধ্যেও সিন পিয়ান যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অপরিনামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন। তার বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত রোহিঙ্গা যুবকদের বেশীর ভাগ যুদ্ধে নিহত হয়।
সিন পিয়ান পরাজিত হয়ে গোপনে চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এছাড়া তার কাছে তখন কোন উপায়ও ছিলো না।
***
সিন পিয়ান এমনই অনমনীয় মনোবলের অধিকারী ছিলেন যে, এমন বিপর্যয়ের পরো তিনি নতুন উদ্যমে যুদ্ধের প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে থাকেন। তিনি তার যাবতীয় তৎপরতা কোম্পানির দৃষ্টির অগোচরে রাখতে সক্ষম হন।
মোটামুটি প্রস্তুতি গ্রহণ করার পর ১৮১২ সালের জুন মাসে তিনি নতুন সংগৃহীত ছয়হাজার রোহিঙ্গাযুবকের একটি দল নিয়ে আরাকানের ভূখ-ে প্রবেশ করেন। দখলদার বর্মী বাহিনী তখন নতুন কোন হামলার জন্য বলা যায়, প্রস্তুত ছিলো না। কারণ সিন পিয়ান এত অল্প সময়ে বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে যুদ্ধের পর্যায়ে চলে আসবেন তা কল্পনা করা সম্ভবও ছিলো না। তাছাড়া তিনি এমনই গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিলেন যে, সিন পিয়ান জীবিত না মৃত, সেটাই বর্মীরাজের জানা ছিলো না।
সিন পিয়ান মামুলি যদ্ধের মাধ্যমে অপ্রস্তুত বর্মী বাহিনীকে পরাজিত করে মংডু ও তার আশপাশের বিরাট এলাকা জয় করে ফেলেন।
এসময় ঘটলো এমনই এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা যা সিন পিয়ানের সব মনোবল ভেঙ্গে চুরমার করে দিলো। কোম্পানি সরকার, যার সাহায্যলাভের আশা সিন পিয়ান শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছাড়েননি, এবার তার পিছন থেকে ছুরি চালায়। অর্থাৎ যে কোনভাবেই হোক শেষ মুহূর্তে কোম্পানি সরকার সিন পিয়ানের যাবতীয় তৎপরতার কথা জেনে যায় এবং অবিলম্বে বার্মীরাজাকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করে।
বর্মীরাজা শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিলো যে, সিন পিয়ানের ‘বিদ্রোহমূলক’ তৎপরতার পিছনে কোম্পানি সরকারের হাত রয়েছে। কোম্পানী সরকার সবরকম প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বর্মীরাজাকে বোঝাতে পারেনি যে, সিন পিয়ানের বিষয়ে তারা কোনভাবেই জড়িত নয়। কোম্পানি এটাকেই মোক্ষম সুযোগ মনে করে নিজের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার। চট্টগ্রামের প্রশাসক মিস্টার পিচেল যে গোয়েন্দা তথ্য প্রেরণ করেন তার আলোকে বর্মী বাহিনী একদল চৌকশ সেনাদলের সাহায্যে সিন পিয়ানের বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। সিন পিয়ান ও তার বাহিনীর জন্য এ পরিস্থিতি ছিলো সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। যুদ্ধ হলো এবং সিন পিয়ানের মুষ্টিমেয় বাহিনী বলতে গেলে নির্মূল হয়ে গেলো। বর্মী বাহিনী সমুদ্র-উপকূলে রক্ষিত নৌকাগুলো আগেই ডুবিয়ে দিয়েছিলো। ফলে যুদ্ধে যারা বেঁচে গিয়েছিলো তারাও বর্মী বাহিনীর হাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হলো। খুব অল্পসংখ্যক সৈন্যসহ সিন পিয়ান চট্টগ্রামে আশ্রয় নেন। তখন তার অবস্থা ছিলো উত্তাল সাগরে মাস্তুলভাঙ্গা ও পালছেঁড়া এক ভঙ্গুর নৌকার মাঝির মত।
***
গ্রীক রূপকথায় বলা হয়, একটি পাখী আছে ফিনিক্স, যাকে জ্বালিয়ে ফেললেও ছাইভষ্ম থেকে আবার জীবিত হয়ে উঠে আসে। রূপকথার সেই কাল্পনিক ফিনিক্সেরই যেন বাস্তব রূপ ছিলেন সিন পিয়ান। বারবার তিনি বিধ্বস্ত অবস্থার ছাইভষ্ম থেকে জ্বলে উঠেছেন; এবারও জ্বলে উঠলেন শেষবারের মত। জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা এবং স্বাধীনতার অন্তহীন পিপাসাই মূলত চরম প্রতিকূলতার মধ্যেও তাকে প্রেরণা যুগিয়েছে। উদ্বাস্তু জীবনের সব দুর্ভোগ সত্ত্বেও তার সম্প্রদায় শেষ পর্যন্ত তাকে সঙ্গ দিয়েছে এবং তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। এটা অবশ্যই তার বিশাল ব্যক্তিত্বের ‘ক্যারিশমাটিক’ দিক। তাই আমরা মনে করি, শেষ পর্যন্ত পরাজিত হলেও অবশ্যই তিনি জাতীয় বীরের মর্যাদা লাভের অধিকারী। সিন পিয়ান শেষবারের মত জ্বলে উঠেন এবং তার বিপর্যস্ত বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। ঐদিকে কোম্পানী সরকার তার মাথার মূল্য ঘোষণা করলো যে, তাকে জীবিত বা মৃত ধরিয়ে দেয়ার নগদ পুরস্কার পাঁচহাজার টাকা, আর তাকে আশ্রয় দিলে কঠোর শাস্তি!
কোম্পানির এরূপ ঘোষণার পরো কেউ পুরস্কারের লোভে তাকে ধরিয়ে দেয়নি, আবার শাস্তির ভয়ে তাকে আশ্রয় দেয়া থেকে পিছিয়ে আসেনি। এটাই জ্বলন্ত প্রমাণ সিন পিয়ানের প্রতি তার সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ ভালোবাসা ও আনুগত্যের ।
সিন পিয়ান এবার কোম্পানি সরকারের পরোয়া না করে সরাসরি কক্সবাজার দখল করে বসেন এবং সেখানে তার প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেন। এটা ছিলো ১৮১২ সালের শেষ দিকের ঘটনা।
কোম্পানি সরকারের জন্য এটা মেনে নেয়া সহজ ছিলো না। বৃটিশবাহিনী কিছু দিন অপেক্ষার পর উপযুক্ত সময়ে কক্সবাজার উদ্ধারের অভিযান শুরু করে। তবে তত দিনে সিন পিয়ান তার ধারণায় প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করে ফেলেছেন আরাকানভূখ-ে অভিযান পরিচালনার জন্য। ১৮১৪ সালের শেষ দিকে তিনি বৃটিশ বাহিনীর প্রচ- চাপের মুখে কক্সবাজারের দখল ছেড়ে দিয়ে আরাকানে মংডু এলাকায় এক ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করেন এবং কিছু ভূখ- অধিকার করে তার অস্থায়ী কেন্দ্র স্থাপন করেন।
বলাবাহুল্য, সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে তার এসব পদক্ষেপ ছিলো নিছক আত্মহত্যার শামিল। তিনি নিজেও যে তা জানতেন না, মনে করার কারণ নেই। কিন্তু আসলে তিনি তখন জয়-পরাজয় এবং জীবন-মৃত্যু থেকে বেপরোয়া হয়ে শুধু বীরের ধর্ম পালন করে যাচ্ছিলেন। দোধারী তলোয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে এতটুকুই তো তিনি করতে পারতেন এবং তা অকুতোভয়ে তিনি করেছেন, আর তার সম্প্রদায়ের অন্তত কিছু যুবক শেষ পর্যন্ত তাকে সঙ্গ ও আনুগত্য দিয়ে গেছে।
***
মংডুর কাছাকাছি এলাকায় কেন্দ্র স্থাপনের পর সিন পিয়ান স্থানীয় আরাকানিদের সাহায্য লাভের চেষ্টা করেন। তাতে কিছুটা সফলও হন। মূলত তাদেরই সহযোগিতায় অল্পসময়ের মধ্যে তিনি মংডু, বুচিডং ও রাথিডং দখল করতে সক্ষম হন। এমনকি কালাদান নদী পর্যন্ত এগিয়ে যান। সেখানে চূড়ান্ত যুদ্ধ হয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই তিনি পরাজিত ও পর্যুদস্ত হন। এরপর তার আর উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ছিলো না।
কোম্পানি তখন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো সিন পিয়ানকে জীবিত বা মৃত পাকড়াও করে বর্মীরাজার হাতে সোপর্দ করার, যাতে বৃটিশ-বার্মা সম্পর্ক চরম অবনতির হাত থেকে রক্ষা পায়। বৃটিশ শক্তির বর্মীরাজাকে এতটা গুরুত্ব দেয়ার কারণ অবশ্য এখনো আমাদের বোধগম্য নয়। এমন একজন বিপ্লবী সামরিক নেতাকে, যিনি জাতীয় পর্যায়ে বিপুল জনপ্রিয়তার অধিকারী, তাকে সাহায্য করলে বৃটিশদের সবদিক থেকেই বরং প্রচুর লাভবান হওয়ার কথা ছিলো। রাজনীতি, কূটনীতি ও সমরনীতির জটিলতা অনুধাবন করা অবশ্য খুব সহজও নয়।
সিন পিয়ানের তখন একমাত্র চিন্তা বৃটিশ গোয়েন্দা-দলের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করা। দীর্ঘ দিন বনে জঙ্গলে আত্মগোপন করে থেকে তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে, মানসিক-ভাবেও তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এভাবে অল্পক’দিন পর ১৮১৫ সালের ২৫শে জানুয়ারী পোলং চরানের পাহাড়ী এলাকায় অত্যন্ত নিঃসঙ্গ অবস্থায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
তার মৃত্যুর পর আরাকানের স্বাধীনতাযুদ্ধের এ মরণপণ সংগ্রামের মূলত অবসান ঘটে। কারণ তার স্থলবর্তী রূপে আর কোন যোগ্য নেতা উঠে আসেনি। তাই বিচ্ছিন্ন কিছু প্রচেষ্টা ১৮২০ সাল পর্যন্ত চলতে থাকলেও সেটা উল্লেখযোগ্য কিছু ছিলো না।
সিন পিয়ান সম্পর্কে শেষ কথা হলো, তিনি ছিলেন এক অযোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান। পিতার কৃত অপরাধের উপযুক্ত প্রায়শ্চিত্তই তিনি করে গিয়েছেন।
***
বৃটিশের কোম্পানি সরকার, বর্মীরাজার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হবে, এ আশঙ্কায় আরাকানের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রচেষ্টায় কোন রকম সহায়তা করা থেকে বিরত ছিলো। তারপরো সম্পর্ক স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকেনি। কারণ কোম্পানি সরকারের প্রতি বর্মীরাজার বদ্ধমূল সন্দেহ ছিলো যে, সিন পিয়ানের বিদ্রোহমূলক তৎপরতার পিছনে বৃটিশের ইন্ধন রয়েছে। কারণ সিন পিয়ান যেভাবে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছেন এবং যে মাত্রায় শক্তি প্রদর্শন করেছেন তা তার একার পক্ষে সম্ভব মনে করা সত্যি কঠিন।
কোম্পানি সরকার অবশ্য শুরু থেকেই বর্মীরাজার সন্দেহ দূর করার জন্য সবরকম চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। এমনকি কোম্পানি সরকারের সঙ্গে সিন পিয়ানের যে পত্রবিনিময়, সে সবের অনুলিপিও বর্মীরাজার দরবারে পেশ করা হয়। কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয়েছে বলে মনে হয় না।
বৃটিশদের অব্যাহত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে ক্যাপ্টেন ক্যানিং (১৮০৩, ০৯, ১১) তিনদফা বার্মায় প্রেরিত হন বৃটিশ প্রতিনিধিদলের নেতারূপে।
বৃটিশদের তোষণনীতির বিপরীতে বর্মীরাজের আচরণ ছিলো বেশ ঔদ্ধত্যপূর্ণ।
ঘটনার ধারাবাহিকতায় বর্মী বাহিনী বারবার চট্টগ্রামে বৃটিশভারতীয় ভূখ-ে হানা দিতে থাকে। অজুহাত হলো, বৃটিশ সীমান্তের ভিতরে উদ্বাস্তুরূপে অবস্থানকারী স্বাধীনতাকামী আরাকানিদের শায়েস্তা করা। ভালো কথা, কিন্তু এজন্য তো বৃটিশকর্তৃপক্ষের আগাম অনুমতি দরকার, অন্তত অবগতি! বর্মীরাজা ঐসব কূটনৈতিক রীতিনীতি রক্ষার প্রয়োজনই বোধ করেননি।
্আসল কথা হলো, বর্মীরাজা বোধপায়া আরাকান দখলের পর সা¤্রাজ্যবাদী চেতনায় পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বর্মী বাহিনী ১৭৮৬ সালে বার্মার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রতিবেশী রাজ্য শ্যাম দখলের পাঁয়তারা করে। এ উদ্দেশ্যে রাজা বোধপায়া দখলকৃত আরাকান থেকে বিপুল অর্থ, সৈন্য, অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের দাবী জানান। বলাবাহুল্য, এটা ছিলো আরাকানের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’। কিন্তু কোন উপায় ছিলো না। আরাকানী সরদারগণ রাজদাবীর অর্ধেক পূরণের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে বাকি অর্ধেক থেকে অব্যাহিত প্রার্থনা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে রাজা বোধপায়া হারির জেষ্ঠ্য পুত্রকে সপরিবারে রাজদরবারে ডেকে এনে হত্যা করেন।
বর্মীরাজ বোধপায়া ১৮১৯ সালে মৃত্যু বরণ করেন। তার জীবদ্দশায় পরস্থিতি অবশ্য নিয়ন্ত্রণের ভিতরেই
ছিলো। অন্তত বৃটিশশক্তির প্রতি তার আচরণ ঔদ্ধত্যের সীমা অতিক্রম করেছে বলে কোম্পানি সরকারের মনে হয়নি। তাছাড়া বৃটিশরা ধারণাই করতে পারেনি যে, কোম্পানির শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে বর্মীরাজ এতটা অজ্ঞ হবেন এবং কোম্পানি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আস্পর্ধা দেখাবেন। তাই মারাঠাশক্তির বিদ্রোহ ও অন্যান্য অভ্যন্তরীণ গোলযোগ স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত আরাকান সীমান্তে সংযমের নীতি অনুসরণ করাই ছিলো কোম্পানি সরকারের নীতি।
১৮১৯ সালে রাজা বোধপায়ার মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র বা‘জীদ সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই তরুণ বর্মীরাজ ক্ষমতার মদে এমনই মত্ত হয়ে পড়েন যে, একদিকে নিজেদের সমরশক্তির উপর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে আক্রান্ত হন, অন্যদিকে বৃটিশের শক্তি ও ক্ষমতা সম্পর্কে আগাগোড়া অবমূল্যায়নের শিকার হন। এ জন্য অবশ্য বৃটিশদের বর্মীতোষণনীতিই বহুলাংশে দায়ী, যদিও এর মূল কারণ ছিলো মারাঠাশক্তির বিদ্রোহসহ বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতি। মূলত একারণেই কোম্পানি সরকার সিন পিয়ানের সাহায্যে এগিয়ে আসতে, বা আরাকান সীমান্তে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনি বলে মনে করা হয়। কিন্তু বর্মীরাজ বিষয়টা সম্যক অনুধাবন করতে পারেননি। তিনি বরং ভেবেছেন, বার্মার সামরিক শক্তিতে বৃটিশরা প্রভাবিত বলেই এমনটি হচ্ছে।
বৃটিশদের সংযম-নীতির কারণে বর্মীরাজের ঔদ্ধত্য এত দূর গড়িয়েছিলো যে, কোম্পানি সরকারের কাছে কয়েকটি দাবী জানিয়ে তিনি একাধিক পত্র প্রেরণ করেন। যথাÑ
০ চট্টগ্রামে আশ্রয়গ্রহণকারী উদ্বাস্তুদের প্রত্যার্পণ।
০ চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও কাশিমবাজার এলাকার রাজস্ব বর্মীরাজার কোষাগারে অর্পণ। (কারণ এসমস্ত অঞ্চল একসময় আরাকানের অধীন ছিলো। সুতরাং এর উপর বার্মার অধিকার সুস্বীকৃত।
একদিকে কোম্পানি সরকারের সংযমী আচরণ, অন্যদিকে বার্মা সরকারের আগ্রাসী আচরণ চলতেই থাকে। একপর্যায়ে ১৮২১ সালে নভেম্বরের শুরুতে আসাম-বাংলাসীমান্তে বর্মীবাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায়। এতে লোকজন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। কোম্পানি এরূপ আগ্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানায়, কিন্তু বর্মী কর্তৃপক্ষ তার পরোয়া না করে আসাম-বাংলাসীমান্তে হামলা ও লুটতরাজ অব্যাহত রাখে।
১৮২৩ সালের শুরুতেই বর্মী বাহিনী আরাকানসীমান্তে সৈন্যসমাবেশ করে। এই প্রথম পাল্টা ব্যবস্থা হিসাবে কোম্পানি সরকার টেকনাফে সমরশক্তির বৃদ্ধি ঘটায়।
এর মধ্যে বর্মী বাহিনী সামরিক অভিযান পরিচালনা করে বিতর্কিত শাহপরীর দ্বীপটি দখল করে নেয়। এসময় শাহপরীর দ্বীপে অবস্থানকারী কোম্পানির সৈন্যদলটি ভয়াবহরূপে হতাহতের শিকার হয়।
বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি যখন ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে তখন বর্মী বাহিনীর পক্ষ হতে সমঝোতামূলক আলোচনার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে কোম্পানির উচ্চপদস্থ নৌকর্মকর্তা একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। কোম্পানির নৌজাহায ‘সোফিয়া’ মংডুতে পৌঁছার পর বর্মী কর্তৃপক্ষ সর্বপ্রকার কূটনৈতিক নিয়মনীতি ভঙ্গ করে জাহাযটি আটক করে এবং কোম্পানির প্রতিনিধিদলকে গ্রেফতার করে লংদুতে পাঠিয়ে দেয়।
এরপর বর্মী বাহিনী চূড়ান্ত ঔদ্ধত্যের পরিচয় দিয়ে চট্টগ্রামে আক্রমণ পরিচালনা করে। অবশ্য এটা বর্মীরাজের অনুমোদনক্রমে হয়েছিলো, নাকি সেনানায়ক মহাবান্দুলার নিজস্ব হঠকারিতা ছিলো তা জানা যায়নি। তবে এ ঘটনায় কোম্পানি সরকারের চূড়ান্ত ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষ ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ হতে ১৮২৪ সালের ৫ই মার্চ বার্মার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবে শুরু হয় প্রথম ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধ। ঘটনাপ্রবাহের আগাগোড়া বিশ্লেষণ একথাই প্রমাণ করে যে, এ যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ণরূপে বার্মাসরকারের আগ্রাসী কর্মকা- ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবই দায়ী।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)