আবার আগুন জ্বলে উঠলো! এবার কি তাহলে শুরু হলো নতুন ক্রুশেড!! একবার তো মুখফসকে বলা কথা ফিরিয়ে নেয়া হয়েছিলো, নাইন ইলাভেনের দুর্ঘটনায়, কিংবা পরিকল্পিত ঘটনায়। এবার কী মুখে কিছু না বলে সেই ক্রুশেডই শুরু হলো নীরবে! ধূর্ততার আশ্রয় নিয়ে!!
কলম হাতে নিজেকে এমন অসহায় আর কখনো মনে হয়নি। হাত কাঁপা, কলম নিশ্চল হয়ে যাওয়া, আমার জন্য শাব্দিক অর্থেই যেন সত্য হয়ে দেখা দিলো!
যা হলো, উম্মাহর জন্য ভালো হলো, না মন্দ! উম্মাহ তো ভুলেই গিয়েছিলো, প্রথম কিবলা নামে তাদের ইতিহাসে কিছু ছিলো! অন্তত এভাবে উম্মাহ যদি জ্বলে ওঠে! হোক না দপ করে জ্বলে ওঠা, দপ করে নিভে যাওয়া! তবু যদি জেগে ওঠে, জ্বলে ওঠে! ভালো হতেও পারে এর পরিণাম। হয়ত তখন দুশমন আফসোস করবে, ঘুমিয়ে ছিলো ভালোই ছিলো, কেন আগুন লাগিয়ে জাগাতে গেলাম!! এদিক থেকেও হয়ত ভালো হলো, পর্দা সরে গেলো, মুখোশ খুলে গেলো। সাদা চোখেই এখন ধরা পড়ে গেলো, কে খাদেম ইসলামের! কে খাদেম ইসরাইলের!!
আসলে কি পর্দা সরে গেছে! আসলে কি মুখোশ খুলে গেছে!! না প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বলে নির্ভয়ে নিজেরাই পর্দা সরিয়ে দিয়েছে! নিজেরাই মুখোশ খুলে ফেলেছে!!
এতদিন যাই হোক, এখন তো বিশ্বাস করতেই হবে, আল্লাহ্ ছাড়া এই উম্মাহর কেউ নেই! আল্লাহ ছাড়া এই উম্মাহর কোন উপায় নেই।
এখানে আগুন জ্বলছে! ওখানে ধোঁয়া উঠছে!! এখানে লাশ ভাসে! ওখানে লাশ ডোবে!! এখানে হয় গণহত্যা! ওখানে হয় জাতিগত উচ্ছেদ!! এখানে, ওখানে প্রতিটি জনপদে শুধু খুনের দরিয়া, আর আগুনের তুফান!! চারদিকে শুধু মযলুমানের ফরিয়াদ! শুধু আবরুহারা মাবোনের আর্তনাদ!! সেই যামানা কি এসেই গেলো, ঐ যে বলা হয়েছে ‘ঝাঁপিয়ে পড়বে হিন্দু, নাছারা, ইহুদি সব কাফির-মুশরিক মুসলমানদের উপর, যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত মানুষ খাদ্যের উপর!!’
***
আলআকছা! মসজিদুল-আকছা!! মুসলিম উম্মাহর প্রথম কেবলা!! আমাদের পেয়ারা নবীর মেরাজের স্মৃতিধন্য আল- আকছা!! কত বছর হলো! কত যুগ পার হলো!! আলআকছার মর্যাদা ও গৌরব ধূলিলুণ্ঠিত হয়েছে কত দিন হলো! কত যুগ পার হলো!!
ইহুদির বাচ্চা থিয়োডর হার্জেল কত বড় প্রলোভন দিয়েছিলো ইসলামী খেলাফতের ‘শেষ কাণ্ডারী’ সুলতান আব্দুল হামীদকে! পুরো নৌবহর সাজিয়ে দেয়া হবে!! এখন যেমন অস্ত্র বিক্রির টোপ দেয়া হয়, তলোয়ারের নাচ দেখিয়ে তাক লাগানো হয়, কিন্তু জানতে পর্যন্ত চাওয়া হয় না, এত টাকার অস্ত্র কার বিরুদ্ধে ব্যবহার করবো? কীভাবেই বা ব্যবহার করবো?!
ঋণভারে জর্জরিত খেলাফতের জীবন্মৃত মুহাফিযকে আরো প্রলোভন দেয়া হলো, বৈদেশিক সব ঋণ পরিশোধ করে দেয়া হবে!
শেষবারের মতই গর্জে উঠেছিলেন এই মর্দে মুমিন! হাঁ, শেষবারের মতই। এর পর আর সুযোগ হয়নি গর্জন করার! শুধু চেয়ে চেয়ে দেখেছেন শত্রুর হাতে, বন্ধুর হাতে নিজের ভাগ্যবিপর্যয়!! খেলাফতের মৃত-দেহের উপর ‘দুশমন-শকুনের’ ঝাঁপিয়ে পড়ার উল্লাস!! দেখেছেন আর অশ্রুপাত করেছেন!! অশ্রুপাত করেছেন আর কেঁদেছেন রক্তের কান্না!!
জীবনের শেষ হুঙ্কারটি দিয়েছিলেন ভাগ্যাহত সুলতান এ কথা বলে, ‘আমি তো এ পবিত্র ভূমির একমুঠ বালুও দেবো না তোমাদের। এ ভূমি অর্জন করেছেন আমাদের মহান পূর্বপুরুষ রক্তের মূল্যে, আমি তা বিক্রি করতে পারি না স্বর্ণের মূল্যে। তাছাড়া এ ভূমি তো আমার নয়, মুসলিম উম্মাহর।’
শেষে হতাশার সাগরে ডুবে যাওয়া মানুষের মত অসহায় কণ্ঠে সুলতান বলেছিলেন, ‘এত খরচ করবে কেন?! একটু ছবর করো। আমার মউতের ইন্তিযার করো!! তখন মুফতেই পেয়ে যাবে! বিনামূল্যেই তোমাদের হাতে এসে যাবে ফিলিস্তীন!! এসে যাবে বাইতুল মাকদিস, আল আকছা!!’
শেষ পর্যন্ত তাই বুঝি সত্য হলো!! গায়ের সেই ঝাল এখনো ঝাড়ে পশ্চিমারা এরদোগানের উপর ‘সুলতান এরদোগান’ বলে!
কত খরচ হলো ফিলিস্তীনের ভূমি দখল করার জন্য? কী মূল্য দিতে হলো বাইতুল মাকদিস ও জেরুসালেম হাতিয়ে নিতে? আগে তো মিথ্যে করে হলেও কিছু প্রতিশ্রুতি দেয়া হতো; দিতে হতো! এখন তো তাও দেয়া হলো না! দেয়ার প্রয়োজনই হলো না!! আলখেল্লার ভিতরের মানুষটা পর্যন্ত নিজেই আগে বেড়ে হাত মিলিয়েছে দুশমনের সঙ্গে এবং কোন ডর-ভয় ছাড়া প্রকাশ্যে! বিলকুল খোল্লামখুল্লা!!
সুতরাং হে মুসলমান, যারা ব্যথিত হয়েছো, মাতম করো!! যারা খুশী হয়েছো, উল্লাস করো!! ইসলাম শুধু কাঁদুক! ইসলাম শুধু ফরয়াদ করুক!! আর্তনাদ করুক!!
***
কত বছর আগের ঘটনা! সম্ভবত ১৯৬৯; সেই যে আগুন দিলো ইহুদিবাদী উন্মাদ আলআকছায়, সে আগুন আর নেভেনি কখনো। এখনো জ্বলছে দাউ দাউ করে মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি বুকে, প্রতিটি হৃদয়ে!! এ আগুন জ্বলতেই থাকবে যতদিন না ফিরে আসে আমাদের আলকুদ্স, আলআকছা আমাদের কাছে!! আমরা বিশ্বাস করি, সেই আনন্দের দিন, সেই গর্ব ও গৌরবের দিন ইনশাআল্লাহ্ অবশ্যই আসবে একদিন আমাদের জীবনে!! জানি না কবে! তবে বিশ্বাস করি, একদিন না একদিন ফিরে আসবে ‘হামারা কুদ্স হামারে পাস’।
হয়ত যামানা ইনতিযারে আছে নতুন গাজী ছালাহুদ্দীনের, যার হাতে তাকদীর তুলে দেবে আল-আকছার আযাদীর ঝাণ্ডা!
ইতিহাসের ছালাহুদ্দীন তো দামেস্কে কবরের মাটিতে ফুলের বিছানায়! দাউ দাউ আগুনের ঐ মাটি থেকেই ইনশাআল্লা উঠে আসবে নয়া যামানার ছালাহুদ্দীন!
***
ইহুদি, খৃস্টান ও মুসলিম তিনটি ধর্মের অনুসারীদের কাছেই বাইতুল মাকদিস বা জেরুসালেম নগর পবিত্র বলে বিবেচিত। রোম সা¤্রাজ্যের অধীনে ছিলো বৃহত্তর শাম, যার অংশ ছিলো আজকের ফিলিস্তীন। সেই সুবাদে বাইতুল মাকদিস এবং আলআকছা ছিলো খৃস্টানদের দখলে। বাইতুল মাকদিসের প্রথম বিজয় সূচিত হয় দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর রা.-এর সময় (১৭ হি.)। রোমের পর্যুদস্ত বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণে প্রস্তুত! সেজন্য হতে হবে সন্ধিপত্র। ভালো কথা! তো!
সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করার জন্য আসতে হবে স্বয়ং খলীফাতুল মুসলিমীনকে!! কেন? বিজয়ী সেনাপতির স্বাক্ষর কি যথেষ্ট নয়?!
জেরুসালেমের প্রধান বিশপ সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন, শর্ত আরোপ করে বিজয়ী পক্ষ, পরাজিত পক্ষ নয়। কিন্তু অন্যায় আব্দারও মেনে নিলেন আমাদের মহান খলীফাতুল মুসলিমীন, শুধু আলকুদ্স ও আলআকছার ধর্মীয় মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য! সেই সঙ্গে হয়ত শত্রুর মনরক্ষারও জন্য!! খাদেমকে সঙ্গে নিয়ে শুধ একটা গাধার পিঠে পালাক্রমে সওয়ার হয়ে দীর্ঘ পথ সফর করে তিনি হাজির হলেন বাইতুল মাকদিসে। পরাজিত পক্ষ কি ভাবতে পেরেছিলো, তাদের এমন অদ্ভুত আব্দারও রক্ষিত হতে পারে?!
তারপর চুক্তিপত্র! প্রতিটি শর্ত পরাজিত পক্ষের অনুকূলে! যেন হোদায়বিয়ার অনুসরণ!!
নগরের খৃস্টান অধিবাসিদের জানমাল, গীর্জাসমূহ, হযরত ঈসা আ.-এর ক্রুশবিদ্ধ (কল্পিত) প্রতিকৃতি নিরাপদ থাকবে।
খৃস্টানদের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা বহাল থাকবে। গীর্জা ও উপাসনালয়ের আকার আকৃতিতে কোন পরিবর্তন আনা যাবে না।
***
শতাব্দীর পর শতাব্দী বাইতুল মাকদিস এবং আলআকছা মুসলিম শাসকদের তত্ত্বাবধানে থাকলো। ইহুদি, নাছারা সবাই সেখানে ধর্মপালনের পূর্ণ স্বাধীনতাসহ বসবাস করলো।
তারপর এক উন্মাদ ধর্মজাযকের মাধ্যমে শুরু হলো ইউরোপ জুড়ে ক্রুশেড ও ধর্মযুদ্ধর উন্মাদনা। সাধু পিটার ও তার অনুসারীরা অমুসলিমদের উপর মুসলিমদের যুলুম-অত্যাচারের কল্পিত কাহিনী প্রচার করে পুরো ইউরোপের খৃস্টানসমাজে অবিশ্বাস্য এক ধর্মোন্মাদনা ও যুদ্ধমাদকতা সৃষ্টি করলো। ফলে শুরু হলো বিপুল রক্তক্ষয়ী ক্রুশেড ও তথাকথিত ধর্মযুদ্ধ।
১০৯৬ সালের ১৫ই আগস্ট ইউরোপের সম্মিলিত বাহিনী এশিয়ার পশ্চিম উপকূলে নেমে ফিলিস্তীনের দিকে রোখ করলো। ৪৯২ এর ২২শে শা‘বান (১৫/৭/১০৯৯) রোয শুক্রবার খৃস্টান বাহিনী বাইতুল মাকদিস শহরে ঢুকলো।
তারপর কী হলো? যা হলো তা খৃস্টান ঐতিহাসিকও লজ্জার সঙ্গে বলেছেন, ‘কতলে আম ও ব্যাপক গণহত্যা’! নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ কেউ রক্ষা পায়নি ক্রুসেডারদের হিংশ্রতা থেকে, এমনকি যারা আশ্রয় নিয়েছিলো আলআকছায় এ আশায় যে, হয়ত হারামের লাজ রক্ষা করা হবে। কিন্তু লাজ নিজেও হয়ে গেলো লাশ! তৈরী হলো বিশাল স্তূপ। সত্তর হাজার বনীআদম হলো ক্রুশেড-উন্মাদনার বলী ।
***
দীর্ঘ নব্বই বছরের যিল্লতি ভোগ করার পর, এই উম্মতের দুর্গতির উপর দয়া করে আল্লাহ তা‘লা পাঠালেন মহান গাজী সুলতান ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী রহ.কে। মহাকালের বুকে খুব সংক্ষিপ্ত জীবন নিয়ে তিনি এসেছিলেন উম্মতের জন্য আসমানি রহমতের যেন একপশলা বৃষ্টি হয়ে! তাঁর জীবনের একটাই ছিলো প্রতিজ্ঞা! বাইতুল মাকদিস বিজয় এবং মুসলিম উম্মাহর প্রথম কিবলা আলআকছার পুনরুদ্ধার!!
তিনি বাইতুল মাকদিস অবরোধ করলেন ৫৮৩ এর মধ্যরজবে (১১৮৭/৯/২০)।
পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত খৃস্টান বাহিনী সন্ধির মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করলো। মহান সুলতান পারতেন না, ‘হত্যার বদলে হত্যা’র পথে চলতে! না, পারতেন না! তিনি যে সুলতান ছালাহুদ্দীন!! তিনি বিজয়ী বেশে, বিনয়ী অবয়বে প্রবেশ করলেন পবিত্র বাইতুল মাকদিসে ২৭শে রজব ৫৮৩ (১১৮৭/১০/২)
পরাজিত শত্রুর সঙ্গে তিনি এমন উদার ও মানবিক আচরণ করলেন যে, শত্রুরা অবনত মস্তকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হলো। পরাজিত পক্ষের অধিবাসীরা সমান মানবিক ও ধর্মীয় মর্যাদায় বাইতুল মাকদিসে বসবাসের অধিকার লাভ করলো। যারা শহর ত্যাগ করতে চায় তাদের নিরাপদে শহর ত্যাগের ব্যবস্থা করা হলো। হায়, ইনসানিয়াতের দুশমন তবু শিখলো না, কাকে বলে ইনসান ও ইনসানিয়াত!!
***
মহান গাজী সুলতান ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী রহ. ৫৯৮/১১১২ সালে ইনতিকাল করেন। দামেস্কের পাক যমিনের তাকে দাফন করা হয়।
বহু শতাব্দী পর (১৯২০) বলদর্পী ফরাসী জেনারেল গোরো বিজয়ী বেশে দামেস্কে এলো। বলতে কষ্ট হয়, মহান সুলতানের কবরে আঘাত করে বললো, উঠে এসো ‘স্যালাডীন’, এই যে, আমরা এসে গেছি!
শান্ত হও জেনারেল এবং আশ্বস্ত হও। তোমার ‘লালকার’ ইনশাআল্লাহ্ তাকদীরের দুয়ারে মঞ্জুর হয়েছে। আজ হোক কাল হোক যামানার গাজী ছালাহুদ্দীন অবশ্যই হাজির হবেন সব হিসাব বুঝে নেয়ার জন্য। ইন্তিযার করো হে বদকিসমত, আমরাও করছি ইন্তিযার!!
***
জীবন কখনো থামে না, নিজস্ব গতিতে জীবন সামনের দিকে চলতে থাকে। ইতিহাসের স্রোতেও সদাপ্রবহমান। সেই স্রোতে পার হলো যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী। ‘যামানার সিতাম’ ও সময়ের নিপীড়নে মুসলিম উম্মাহ তখন সেই ‘বুড়ো বাঘ’ জঙ্গলের শেয়ালও যাকে ...।
ভাগ্যাহত খলীফা সুলতান আব্দুল হামীদের ‘আসাদী হুঙ্কারের’ কথা তো আগেই বলা হয়েছে এবং বলা হয়েছে তার মর্মান্তিক...। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) শেষ দিকে আরবদের বিশ্বাস-ভঙ্গের সুবাদে পথ যখন বিলকুল ছাফ তখন বেলফোর ঘোষণার মাত্র একমাস আটদিন পর ১৯১৭ সালের ১০ই ডিসেম্বর বৃটিশবাহিনী বাইতুল মাকদিস দখল করে নেয়। সবকিছু এমন পরিকল্পিতভাবে হলো যেন পর্দায় ছায়াছবির প্রদর্শন। তারা হলেন নায়ক, আরবনেতৃবৃন্দ খলনায়ক, মুসলিম উম্মাহ নীরব দর্শক!
তুর্কী খেলাফতের অধীন অঞ্চলগুলো হালুয়ারুটির মত ভাগবাটোয়ারা করে নিলো বিজয়ী মিত্রশক্তি। তবে ফিলিস্তীন ও জেরুসালেমের প্রতি সবপক্ষের সমান আগ্রহের কথা বলে তা রাখা হলো আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে। পরে ১৯২০ সালে বৃহৎশক্তিবর্গে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে বৃটেন লাভ করে ফিলিস্তীন অঞ্চলের ‘যিম্মাদারি’ বা ম্যন্ডেট।
ফিলিস্তীনে নিযুক্ত প্রথম বৃটিশ কমিশার হলেন ইহুদীবাদী চরম মুসলিমবিদ্বেষী স্যার হার্বার্ট স্যামুয়েল (১৯২০Ñ২৫) তিনি ফিলিস্তীনের পুরো অঞ্চল ‘স্বর্গের দুয়ারের মত’ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বাসকারী ইহুদিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।
বিশ্বইহুদিবাদী সংস্থা দুনিয়াজুড়ে রীতিমত ‘হুলস্থুল’ আন্দোলন শুরু করলো ইহুদিদের ফিলিস্তীন -অভিমুখী অভিবাসনে প্ররোচিত করার জন্য। ফিলিস্তীনে ইহুদিদের জমি খরিদ করার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করা হলো, যেন ‘স্বর্গের টিকেটবণ্টন’! তুর্কী খেলাফতের বুকে খঞ্জর বিদ্ধকারী আরবনেতৃবৃন্দ তখনো ঘুমের ঘোরে! এমনকি ফিলিস্তীনের বেশীর ভাগ জনগণও!!
যখন হুঁশ হলো আরবজনগণের তখন কালে কালে হয়ে গেছে অনেক বেলা। যেখানে ইহুদিদের মালিকানার জমির পরিমাণ ছিলো দুই শতাংশ, তা হয়ে গেছে সাতাত্তর শতাংশ!
শুরু হলো আরব-ইহুদি রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাত। রক্তক্ষয়ী মানে ইহুদি সন্ত্রাসীদের হাতে নিরস্ত্র, তবে প্রতিবাদী ও মারমুখী মুসলিম জনগোষ্ঠীর রক্তক্ষয়। কারণ বৃটেন ততদিনে দখলদার ইহুদিদের পূর্ণ ‘সামরিক প্রশিক্ষণ’ দিয়ে এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্র সরবরাহ করে একটি হিংশ্র সশস্ত্র গোষ্ঠী তৈরী করে ফেলেছে।
এদিকে সঙ্ঘাত-সঙ্ঘর্ষ ভয়াবহ আকার ধারণ করলো, ওদিকে বেলফোর ঘোষণা বাস্তবায়নের সকল আয়োজন সম্পন্ন হলো তখন বৃটেন ঘোষণা দিলো, ১৯৪৮-এর ১৫ই মে ফিলিস্তীনের উপর থেকে সে তার তত্ত্বাবধান-ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। বৃটেন উভয় পক্ষকে আহ্বান জানালো ফিলিস্তীনের শাসনভার নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়ার।
এরপর যা হওয়ার তা হলো এবং খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে হলো। বিজয়ী মিত্রশক্তি, বিশেষ করে বৃটেন তখন কোথায় কী হচ্ছে, চোখে দেখে না, কানে শুনে না!
সঙ্ঘবদ্ধ ইহুদি সন্ত্রাসীদের হাতে নিরস্ত্র অসহায় আরবজনগোষ্ঠী স্রেফ ‘কচুকাটা’ হলো! প্রাণ বাঁচানোর জন্য তারা তখন হাজার বছরের বাস্তুভিটা ছেড়ে পালাতে লাগলো, মিয়ানমারের রাখাইনরাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মত প্রায় একই অবস্থা।
এর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক সভ্যতার পৃথিবীতে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হলো ১৪/৫/৪৭ সন্ধ্যায়। অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের বেশ আগে।
বৃটেন দীর্ঘ ভূমিকা পালন করে তখন কিছুটা বোধহয় ক্লান্ত! নবজাতক রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতিনামক ‘স্তন্যদান’-এর দায়িত্বটা পালন করে আমেরিকা রাষ্ট্রঘোষণার মাত্র ১১ মিনিট পর।
কত দ্রুত আমরা ভুলে যাই সব ইতিহাস! আমারও জানা ছিলো না। এখন সামান্য জেনেছি!
***
আরব মুজাহিদীন, বিশেষ করে আজকের ‘সন্ত্রাসী’ ইখওয়ানুল মুসলিমীনের জানবায মুজাহিদীন বহু জানের নাযরানা পেশ করে, বুকের রক্ত ঢেলে ঢেলে ফিলিস্তীনের পশ্চিমাঞ্চল এবং বাইতুল মাকদিস শহরের প্রাচীন অংশ (পূর্বজেরুসালেম) নিজেদের অধিকারে রাখতে সক্ষম হয়।
কিন্তু হায়, ১৯৬৭/ সাতই জুন আরব-ইসরাইল যুদ্ধে তাও হাত- ছাড়া হয়ে যায়! ইখওয়ানের মুজাহিদীন তখন জিহাদের ময়দান থেকে কারাগারের অন্ধকারে! আরবজাতীয়তাবাদের হিরো ‘জামাল আব্দুল নাছের’, আলী মিয়াঁ যাকে বলেছেন, ‘এই উম্মাহর ফিরআউন’, ইখওয়ানের জানি দুশমন। অবাক হওয়া ছাড়া আর কী করতে পারি, ইখওয়ানও আরব রক্তের অধিকারী, জামাল, সাদাত, মুবারক, সিসি, এদেরও শরীরে নাকি আরবরক্ত প্রবাহিত!!
***
এখন জেরুসালেমের পূর্ব-পশ্চিম উভয় অংশ এবং আমাদের প্রথম কেবলা আলআকছা ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলে। পরিস্থিতি এতদূর গড়িয়েছে যে, ফিলিস্তীনীরা এখন রাজী তাদের ভবিষ্যত রাষ্ট্রের রাজধানীরূপে জেরুসালেমের শুধু পূর্ব অংশকে মেনে নিতে, কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসা সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল চায় পুরো জেরুসালেম হবে তার রাজধানী। জেরুসালেমের একইঞ্চি ভূমিও ইহুদিরা ‘ছাড়তে’ রাজী নয় ঘরের মালিক ফিলিস্তীনিদের জন্য! অথচ তেলআবীব রয়েছে তাদের ‘তৈয়ার’ রাজধানী!
আরববসতি উচ্ছেদ করে করে ধীরে ধীরে নতুন নতুন ইহুদি বসতি তো গড়ে উঠছিলো জেরুসালেমের ভূমিতে। ফিলিস্তীনী মুজাহিদীনের দুর্বল প্রতিরোধও চলছিলো। বৃহৎ শক্তিবর্গও দয়া করে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলো। অন্যদিকে সময়ও গড়িয়ে চলেছিলো চূড়ান্ত পরিণতির দিকে।
জাতিসঙ্ঘ এবং তার মুরুব্বি দেশগুলো মোটামুটি একটা রাখঢাক ও চক্ষু লজ্জার ব্যবস্থা রেখেছিলেন এভাবে যে, আপাতত জেরুসালেমে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা হবে। তারপর আরব-ইহুদি উভয় পক্ষ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিজ নিজ রাষ্ট্রের রাজধানী নির্ধারণের বিষয়টি সমাধান করে নেবে।
এদিকে ১৯৯৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস অদ্ভুত একটা বিল পাশ করে নেয়, আরব ও মুসলিম নেতৃবৃন্দকে প্রায় ঘুমের মধ্যে রেখে (কিংবা বসোনিয়াট্রাজেডির জালে আটকা রেখে)। মার্কিন পেসিডেন্টকে পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে বলা হয়, তিনি মার্কিন স্বার্থের অনুকূল মনে করলে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী বলে স্বীকৃতি দিতে পারেন, নচেৎ ছয়মাসের জন্য বিষয়টি স্থগিত রাখতে পারেন। ছয়মাস পর একই ধারা কার্যকর হবে। এবার বুঝুন, কত হুঁশিয়ার দুশমন, আর কত নির্বোধ আমরা!
প্রতিটি নির্বাচনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ঘোষণা দিতেন, তিনি জয়ী হলে তার দেশের দূতাবাস রাজধানী তেলআবীব থেকে জেরুসালেমে নিয়ে যাবেন। জয়ী হয়ে অবশ্য তারা এই বলে পিছিয়ে আসতেন যে, এটা উপযুক্ত সময় নয়!
কিন্তু হায়, এর মধ্যে এসে গেলো মুসলিম উম্মাহর জন্য ইতিহাসের জঘন্যতম দিন ৬/১২/২০১৭
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বুধবার বাংলাদেশ সময় রাত একটায় (গ্রিনিচ সময় বুধবার সন্ধ্যা ৭টায়) ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারীভাবে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দিচ্ছে এবং মার্কিন দূতাবাস তেল আবীব থেকে জেরুসালেমে সরিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি শুরু হচ্ছে। তিনি হওয়াইট হাউজের ডিপ্লোমেটিক রিসিপশন রুম থেকে এক বিবৃতির মাধ্যমে এ ঘোষণা দেন। পরে এবিষয়ক স্মারকে তিনি স্বাক্ষর করেন।
স্বাক্ষরযুক্ত স্মারকটি তিনি এমন গর্বিত ভঙ্গিতে তুলে ধরেন যেন মুসলিমবিশ্ব তার...!
ঠিক যেমন বুশ যুদ্ধজাহাযের ডেকে যুদ্ধ বিমান থেকে নেমে নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইরাকের যুদ্ধ শেষ!! কিন্তু ইরাকের যুদ্ধ কী শেষ হয়েছে?! খুব সহজে কি শেষ হবে?!
তো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, আসুন আমরা অপেক্ষা করি ইতিহাসের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের! কারা বিজয়ী, কারা পরাজিত!!
আপনিও অপেক্ষা করুন আপনার ইহুদি কন্যা ও জামাতকে নিয়ে, আমরাও অপেক্ষা করি আমাদের ..... কে নিয়ে!! আল্লাহ আমাদের সহায়!
পৃথিবীতে পরাক্রম অনেকেই দেখিয়েছেন এবং বিদায়ও নিয়েছেন। ইসলাম ছিলো, আছে এবং ইনশাআল্লাহ থাকবে। হয়ত আপনি ও আপানার দেশও হয়ে যাবেন মুসলিম! অসম্ভব কী!!