১-৬-৩১ হিঃ
বিকেল থেকে বৃষ্টি ছিলো। সন্ধ্যার পরে আর বৃষ্টি নেই। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেজা ফুলের মিষ্টি সুবাস যেন আমাকে অভিনন্দন জানালো। সবুজ লতাগাছটির পাশে বসলাম। আকাশে এখন একটুকরো মেঘ নেই। অসংখ্যা তারা জ্বলজ্বল করছে। আমার চারপাশে যেন কিছু তারা নেমে এসেছে। জীবন্ত তারা, জ্বলছে আর নিভছে! রাতের কত রকম সৌন্দর্য দেখেছি, কিন্তু আজকের সৌন্দর্য অন্যরকম।
বিশাল প্রকৃতির খুব সামান্যটুকুই আমি কাছে পাই। একফালি আকাশ, একটুকরো মেঘ, কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি, অল্পক’টি তারা, কিছু জোনাকি, কয়েকটি গাছ, সবুজ পাতা, ফুলের সুবাস।
মনটা বিষণ্ণ ছিলো। আমার ছোট্ট প্রকৃতি আজ এই অন্ধকারেও সান্ত্বনার কোমল পরশে আমাকে স্ণিগ্ধ করলো। জীবনের পূর্ণিমাকে ভালোবাসবো, কিন্তু জীবনের অমাবশ্যাকে ভয় করবো কেন?! সেখানেই তো আছে ...!
২-৬-৩১ হিঃ
দু’দিন হলো আম্মু কাছে নেই। কবে দেখবো, কবে কাছে পাবো আম্মুকে?! কতটুকুই বা দূরে এখন আম্মু, তাতেই এত কষ্ট!
আম্মুর কি মনে পড়ছে আমাকে? ছি! এ আমি কী ভাবছি! মায়ের মনে পড়বে না সন্তানের কথা! সন্তানের ভালোবাসা যেখানে গিয়ে শেষ, মায়ের মমতা তো সেখান থেকে শুরু! পুরো একটি ঝর্ণাধারা নেমে আসে পর্বতের গভীর উৎস থেকে, কিন্তু একফোঁটা জল কি উঠে যেতে পারে পর্বতের কাছে! তবু তো সন্তান বোঝে না, বুঝতে চায় না।
৩-৬-৩১ হিঃ
পুষ্প এসেছে গত রাতে। ‘তোমাকে’ পড়লাম। খুব সাধারণ একটি শব্দ ছোট্ট একটি লেখার শিরোনাম হয়ে এত অর্থপূর্ণ হতে পারে! এত ছোট্ট লেখা এমন সুন্দর হতে পারে! এমন বিপুল ভালো লাগা কীভাবে বোঝাতে হয়! এমন আলোঝলমল লেখা ও তার লেখকের প্রতি কীভাবে অভিনন্দন জানাতে হয়! কলমের শব্দ কি পারে বুকের স্পন্দনের অনুবাদ করতে!
আমাদের সৌভাগ্য, এমন লেখা একজন আলিমের কলম থেকে পেয়েছি। এখনো সুযোগ আছে অন্য কিছু পড়ার! অন্য কিছু থেকে সাহিত্য শেখার! এমন দুর্ভাগা কেউ যদি থাকে, তার জন্য আমার একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস!
৪-৬-৩১ হিঃ
আমাদের এখানে অল্পক’টি গাছ, সামান্য কিছু সবুজ পাতা, কিন্তু পাখীর অভাব নেই। আমি যেন পাখীর রাজ্যে বাস করি! কত রকমের পাখী; আসে, বসে, আবার উড়ে যায়!
‘তিনি’ লিখেছেন, ‘পাখীদের কলতান প্রকৃতির নির্জনতাকে আরো নিবিড়তা দান করে, আর মানুষের কোলাহল প্রকৃতির নির্জনতাকে ক্ষুণ্ণ করে, ছিন্ন করে।’ এমন বাস্তব সত্য এত সুন্দর করে সবাই কি লিখতে পারে?!
যখনই পাখিদের কলতান শুনি, আমার মনে পড়ে ‘তাঁর’ এই কথাটি।
আজ দুপুরে নাম না জানা একটি পাখী জানালায় এসে বসলো। ভারি লোভ হলো, পাখীটির গায়ে আলতো করে হাত বুলাই। কাছে না যেতেই পাখিটি ডানা মেলে উড়াল দিলো। পাখী- পুরুষ হোক, বা নারী- ডানা মেলে উড়াল দেয়, উড়াল দিতে পারে। মানুষের সমাজে পুরুষ ও নারী একরকম হয় না কেন? স্বাধীনতা যদি হয় একটি পাখী তাহলে তার একটি ডানা ভাঙ্গা কেন? কেউ যদি বলে, এটা স্রষ্টার বিধান, আমি বলবো ...! থাক, নাই বা বললাম যা বলতে চাই।
৫-৬-৩১ হিঃ
আজ সারা দিন একটি শব্দের বানান খুঁজেছি। সন্ধ্যার পর আমার উস্তাযের কাছ থেকে সঠিক বানানটি জানতে পারলাম। সঠিক বানান অনেকেই বলে দিতে পারবে, কিন্তু এমন করে! শব্দের বানানের গায়ে এত রস! এত মধু! বাতাসের যে তালব্যশ হতে পারে, কে কবে ভেবেছে! আল্লাহ আপনাকে আরো দান করুন, জ্ঞান ও প্রাণ!
৬-৬-৩১ হিঃ
পুষ্পের প্রতিটি সংখ্যার প্রতিটি লেখাই তো ভালো! তবে এ সংখ্যার ‘আলোর লেখা, লেখার আলো’ অন্যরকম ভালো; যেন একটি ‘আলোকগুচ্ছ’! সত্যি, আমরা কেউ জানি না, ব্যথা কীভাবে পেতে হয় এবং কীভাবে ব্যথা থেকে কিছু অর্জন করতে হয়। তাই ব্যথা পেলে আমাদের এত কষ্ট হয়।
৭-৬-৩১ হিঃ
কিছু কষ্ট আছে, বলা যায় না, বুকের ভিতরে নীরবে শুধু লালন করতে হয়। মানুষ কীভাবে মানুষকে এত কষ্ট দেয়! কষ্টকে যে বরণ করে সে তো কিছু অর্জন করে, কিন্তু যে কষ্ট দেয়! আমার হুযূর বলেছেন, ‘তোমার ছবর হচ্ছে প্রতিপক্ষের জন্য বিষাক্ত তীর, যা আসমানে জমা হয় এবং যথাসময়ে তা নিক্ষিপ্ত হয়! আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন, আমীন।
৮-৬-৩১ হিঃ
আজ সারা দিন আমার সঙ্গে ছিলো শুধু তিনটি শব্দ; কষ্ট, কান্না ও প্রার্থনা।
৯-৬-৩১ হিঃ
একজন ভালো মানুষ আমার ভাইয়ের ডায়রীর কয়েকটি পাতা পড়ে সুন্দর একটি মন্তব্য করলো, আমার জন্য এবং আমার ভাইয়ের জন্য আমার প্রার্থনা, ডায়রীর পাতাগুলো যত সুন্দর, জীবনের পাতাগুলো যেন হয় আরো সুন্দর।
১০- ৬-৩১ হিঃ
আমরা এখন এত ব্যস্ত কেন, এবং শুধু নিজেকে নিয়ে? অন্যের জন্য আমাদের জীবনে কোন সময় নেই কেন? আমাদের জীবন কেন হয় না মোমের মত, যা সবাইকে দান করে আলো? আমি যদি ব্যস্ত হতে পারি অন্যের প্রয়োজনের জন্য, তাহলেই তো গায়বের শক্তি নিয়োজিত হবে আমার প্রয়োজনের জন্য!
১১-৬-৩১ হিঃ
একটি মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে আজ আবার মনে হলো, নারী নিজেই নিজেকে অপদস্থ করছে। তিক্ত হলেও এটাই সত্য। আমরা ভুলে গেছি, কোথায় আমাদের মর্যাদা! মুসলমান হয়ত আমাদের প্রাপ্য মর্যাদাটুকু আমাদের দেয়নি, কিন্তু ইসলাম তো আমাদের অনেক মর্যাদা দিয়েছে! আমাদের যারা পর্দার বাইরে নিতে চায়, কেন চায়, মর্যাদা দিতে?!
পুরুষ যত শক্তি, প্রতাপ ও প্রতিপত্তির অধিকারী হোক, তার জান্নাত কিন্তু একজন ‘দুর্বল’ নারীর পায়ের নীচে!
১২-৬-৩১ হিঃ
যারা কাজ করে এবং কাজ করে না, সময় কারো জন্যই বসে থাকে না। একজনের সময় জ্বলে জ্বলে জীবনকে আলোকিত করে, একজনের সময় গলে গলে জীবনকে ..! হে আল্লাহ, আমার জীবন যেন হয় ...!
১৩-৬-৩১ হিঃ
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কি রোযনামচা লেখা যায়! বোধহয় লেখা যায়। আমার দু’একবারের অভিজ্ঞতা তো তাই বলে!
১৪-৬-৩১ হিঃ
সন্ধ্যার কিছু পর বাসায় এসে পৌঁছলাম। গাড়ী থেকে নেমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায়। ঝিরঝির বাতাসে দেহ-মন জুড়িয়ে গেলো। পথের সব ক্লান্তি যে শরীর থেকে ঝরে গেলো। আজ পূর্ণিমা। চাঁদের জোসনায় পৃথিবীটা বড় সুন্দর ছিলো। বহু দিনের স্বপ্ন ছিলো, পূর্ণিমার রাতে কৃষ্ণচূড়ার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমার ছোট্ট পৃথিবীটাকে দেখবো। সে স্বপ্ন আজ সত্য হলো। শুকরান লাকা ইয়া রাবিব!
১৫-৬-৩১ হিঃ
আজ সারা দিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। সময়গুলো কীভাবে যে চলে গেলো, বুঝতেই পারিনি। এখন অনেক অসুস্থ বোধ করছি। অনেক কিছু লেখার ছিলো, হয়ত কিছুই লেখা হবে না। হয়ত এই না লেখা কথাগুলোই জীবনের আসল সম্পদ।
১৬-৬-৩১ হিঃ
সারা দিন বৃষ্টি হয়েছে। একটু আগে বারান্দায় গিয়েছিলাম। দেখি, মেঘের কোলে চাঁদ হাসছে! বড় সুন্দর দৃশ্য! দৃশের চেয়ে অদৃশ্যের সৌন্দর্য যে কত বেশী তা জানার সাধ্য আমাদের নেই।
১৬-৬-৩১ হিঃ
ফজরের পর থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি যে আকাশের কান্না এটা কি শুধু কবিকল্পনা! আকাশ এত কাঁদছে কেন আজ?! আকাশের কান্নায় পৃথিবীর সব আবর্জনা ভেসে যায়। পৃথিবীটা বড় সুন্দর হয়। মাটি নরম হয়, ভূমি সজীব হয়। তাই বৃষ্টি আমার ভালো লাগে এবং ভালো লাগে মানুষের কান্না। মানুষ যখন কাঁদে তখন তার মনের মাটি নরম হয় এবং হৃদয়ের ভূমি সজীব হয়। পাপের আবর্জনা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। চোখের পানি মুছে দিতে পারে জীবনের ভুল এবং নিভিয়ে দিতে পারে জাহান্নামের আগুন।
১৮-৬-৩১ হিঃ
একটি দুঃখ পেলাম আজ। আসলে এটাই জীবন। সুখই জীবনের সবটুকু নয়। এত দিন দুঃখ পেলে কষ্ট হতো, এখন দুঃখের মাঝেও আমি সুখী হতে পারি। কারণ ...!
দিনের পর রাত, রাতের পর দিন, এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম। আর ‘অন্ধকার যত ঘনীভূত হয়, বুঝতে হবে নতুন ভোরের নতুন সূর্যোদয়ের সময় ঘনিয়ে এসেছে।’
১৯-৬-৩১ হিঃ
আজ সারা দিন শুধু পুষ্প পড়েছি। পুষ্প এত সুন্দর কেন?! যদি তাঁকে এ প্রশ্ন করি, তিনি বলবেন, ‘যে যত সুন্দর চোখ দিয়ে পড়ে, পুষ্প তার কাছে তত সুন্দর লাগে।’
আমার ইচ্ছে হয়, একবার প্রশ্ন করে দেখি, আমার ধারণা সত্যি কি না, কিন্তু লজ্জা করে।
কবে আমি পারবো পুষ্পের মত করে লিখতে!
আমার সৌভাগ্য, বাংলাভাষায় আমার যা কিছু সম্বল তা আমার হুযূরের লেখা। এছাড়া আর কিছু আমি পড়িনি, পড়তে চাইও না।
২০-৬-৩১ হিঃ
নারী-অধিকার, ঠিক আছে, কিন্তু নারীর সমানাধিকার, এ শেস্নাগান প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে এটা নারিনির্যাতনের নতুন সংস্করণ। যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট।
২১-৬-৩১ হিঃ
আজ রোযনামচা লেখা হবে না। কারণ পিছনের কিছু লেখার পরিচর্যা করতে হবে। আমার হুযূরের ভাষায়, লেখাকে পরিচর্যা করতে হয়, মা যেমন সন্তানের পরিচর্যা করেন।
২২-৬-৩১ হিঃ
পৃথিবীতে আমি অনেক সুখী। আমার কিছু নেই, তবু আমি পরিপূর্ণ। কারণ আমি পেয়েছি পিপাসার স্বাদ ও তৃষ্ণার তৃপ্তি।
২৩-৬-৩১ হিঃ
আমরা শুধু চাই, আপনজনদের হৃদয়ে আমাদের জন্য ভালোবাসার ফুল ফুটুক; তাদের দৃষ্টি থেকে মমতার ফুল ঝরুক। হয়ত সঙ্গত চাওয়া, কিন্তু জলসিঞ্চনে আমরা খুব কৃপণ।
২৪-৬-৩১ হিঃ
আববু আমার একটি লেখা নিয়ে গেলেন হুযূরের কাছে। আমাকেও সঙ্গে নিলেন। ভাবছি লেখাটা তো আববুই দেবেন। কিন্তু আববু ভুলে গেলেন, তখন আমি নিজেই লেখাটা তাঁর হাতে দিতে গেলাম, এমন সময় ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। সব আনন্দ কোথায় হারিয়ে গেলো। বাস্তবেও এমন হয়নি তো আজ! খোঁজ নিয়ে শুনি, সত্যি সত্যি আববু হুযূরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন এবং আমার লেখা নিয়ে গেছেন!
২৫-৬-৩১ হিঃ
নারকেলগাছের নীচের দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। কৃষ্ণচূড়ার চূড়ায় লাল সূর্যটি ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। দূর থেকে দৃশ্যটি মনে হচ্ছে কোন শিল্পীর হাতে আঁকা
সূর্য অস্ত গেলো। দিগন্তের লালিমা দেখে মনে হলো, এই লালিমা বিষণ্ণতার নয়, প্রফুল্লতার। কারণ সূর্য তো আরো পশ্চিমে যাবে!
২৯-৬-৩১ হিঃ
জীবনের সবকিছু লিখে রাখা কি সঙ্গত! সে বললো, তোমাকে একটি ব্যথা দিতে চাই। আমি বললাম, কেন তুমি আমার ব্যথার কারণ হতে চাও? তাছাড়া মেয়েদের কি এতো আয়োজন করে ব্যথা দিতে হয়! মেয়েরা তো ব্যথা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে থাকে! বেদনা দিয়েই তো তাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় শুরু হয় এবং শেষ হয়! যদি পারো, একটু সুখ দেয়ার চেষ্টা করো, অন্তত ব্যথা দেয়ার আয়োজন করো না। মেয়েদের হৃদয়ে তো ব্যথা সবসময়ই আছে। সে ব্যথা কখনো ঝরে কাগজের পাতায় কলমের কালি হয়ে, কখনো ঝরে চুলার পাড়ে শুধু চোখের পানি হয়ে।