শব্দদূষণ, শুনলে আমাদের মনে পড়ে শহরের কোলাহল, বাজারের হৈচৈ এবং গাড়ীঘোড়ার শোরশব্দের কথা; আরো মনে পড়ে মাইকের ‘শব্দযন্ত্রণা’র কথা। এগুলো অবশ্যই শব্দদূষণ, যা আমাদের জীবনকে অসহনীয় করে তুলেছে। এ প্রসঙ্গে ইসলামী ওয়াযমাহফিলের কথাও আসে। মাইকে পুরো এলাকা কাঁপিয়ে ওয়ায নছীহতের নামে এবং ইসলামী অনুষ্ঠানের নামে যা করা হয় তা শব্দদূষণ ছাড়া আর কিছু নয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটা ‘ঈযায়ে মুসলিম’-এর অন্তর্ভুক্ত; অর্থাৎ মানুষের কষ্টের কারণ হওয়া, যা পরিষ্কার কবীরা গোনাহ।
তবে আমি আজ অন্যরকম কিছু শব্দদূষণের কথা আলোচনা করবো, যা মানুষের কষ্টের কারণ হয়, সুতরাং সেগুলো পরিহার করাও আমাদের অবশ্যকর্তব্য।
১। সম্প্রতি এক দ্বীনী ভাইয়ের বাড়ীতে একটি মজমা ছিলো। পাকিস্তান থেকে আগত সর্বজনামান্য আলিমে দ্বীন হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেবের যিয়ারাতের উদ্দেশ্যে সকলে উপস্থিত হয়েছেন। সুতরাং বোঝাই যায়, সেটা কাদের মজলিস ছিলো। আমি অধমও একই উদ্দেশ্যে হাযির হয়েছিলাম। শরীফ মেযবান হালকা খাবার পরিবেশনের মাধ্যমে হাযিরানে মজলিসের ইকরাম করলেন। আর -ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন- মজলিসজুড়ে চামচ-পেয়ালার এমন ভরপুর আওয়ায শুরু হলো যে, সে বড় বিশ্রী অবস্থা। আমার তখন বড় লজ্জা লাগছিলো। আমরা যদি একটু সতর্ক হতাম তাহলে আরো কম শব্দ করে, বরং তেমন কোন শব্দ না করে আহারপর্ব সমাধা করতে পারতাম। তখন বোঝা যেতো যে, এটা হচ্ছে আহলে ইলমের ‘বা-ওয়াকার মজলিস’। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত এক আরব সাহিত্যিকের একটি বাক্য মনে পড়ে গেলো-
العظيم عظيم في كل شيء, حتى في أكله و شربه و حتى في سروره و بكائه
বড়রা সবকিছুতেই বড়, পানাহারে, এমনকি হাসি-কান্নায়ও।
মনে পড়ে মাদসারতুল মাদীনায় মাদানী মানযিলে আদীব হুযূরের মজলিসের কথা। একভাই চা তৈরী করছিলেন, চামচ নেড়ে চিনি মেশানোর সময় আওয়ায হচ্ছিলো। হুযূর মৃদু হেসে বললেন, ভেবেছিলাম, ইনি চা তৈরী করতে জানেন! এর পর হুযূর দেখালেন কীভাবে চা তৈরী করতে হয় প্রায় শব্দ না করে। তিনি আরো বললেন, খাবারের টেবিলে ইংরেজরা ছুরি, চামচ, কাঁটা চামচ ব্যবহার করে, কিন্তু খুব কম শব্দ হয়। এটা আসলে ইসলামী আদাব।
শব্দদূষণের আরো গর্হিত রূপ হলো খাওয়ার সময় মুখ থেকে চপচপ বিশ্রী আওয়ায বের হওয়া। মুখ বন্ধ করে খাবার চিবুলে এটা হয় না, যা দস্তরখানে অন্যদের কষ্টের ও রুচিনষ্টের কারণ হয়।
বাইতুল মুকার্রামের সাবেক খতীব হযরত মাওলানা ওবায়দুল হক (রহ) এক দস্তরখানে বলেছিলেন, খাওয়ার সময় ‘ফুরুত ফুরুত’ আওয়ায খুব খারাপ লাগে।
আমাদের দেশের আরেকজন বড় আলেম (চাটখিল, নোয়াখালি) মাওলানা নূরুল ইসলাম (রহ) বলতেন, ‘আমরা অনেকেই দুধ, চা, ডাল ও শুরুয়া খেতে (পান করতে) জানি না। আল্লাহ মাফ করুন, মনে হয় ষাঁড়গরুর মাড়পানি খাওয়ার আওয়ায।’
মাওলানা আবুল কালাম আযাদ নিজে বলেছেন, ছোটকালে একবার খেতে সময় তার আওয়া হচ্ছিলো, তখন আববা তাকে বলেছিলেন, মানুষের মত খাও, আওয়ায করে তো কুকুর খায়। (বীস বড়ে মুসলমান)
শুনেছি, মাদরাসাতুল মাদীনার দস্তরখানে নিঃশব্দ পানাহারের তালীম দেয়া হয়। একবার নিজের চোখে দেখার ইচ্ছা আছে।
আসলে যাবতীয় ইসলামী আদাব শৈশব থেকেই শিক্ষা দিতে হয়। আমাদের মহান পূর্ববর্তীগণ এ বিষয়ে খুব সতর্ক ও যত্নবান ছিলেন, কিন্তু বর্তমানে আমরা আদাবে যিন্দেগি সম্পর্কে খুব উদাসীন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন, আমীন।