জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮)

বিজ্ঞান বিচিত্রা

বিজ্ঞানের জগতে স্বাগতম

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির কথা যখন বলা হচ্ছে তখন স্বয়ং বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন, মানব-জাতির জন্য বিজ্ঞান কি আশীর্বাদ, না অভিশাপ? প্রযুক্তি আশা, না হতাশা? এখন তো আশঙ্কা হচ্ছে যে, বিশ যে হারে উষ্ণ হয়ে উঠছে তাতে নিকট ভবিষ্যতেই পৃথিবী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে, যদি না বায়ুম-লে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, যা প্রায় অসম্ভব।

একসময় মনে করা হতো, পৃথিবী মহাকাশের কেন্দ্রে অবস্থিত। প্রাচীন বিজ্ঞানীদের এ ভাবনার ভিত্তি ছিলো মানুষ সম্পর্কে তাদের এরূপ ধারণা যে, মহাবিশে মানুষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অর্থাৎ মহাবিশে মানুষ পর্যবেক্ষকের মর্যাদায় আসীন। তাদের এ ধারণা অবশ্য কোরআনে বর্ণিত মানব-জাতির খেলাফত এবং বনী আদমের প্রতি ঐশীক সম্মাননা-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিলো। তবে তারা বুঝতে পারেননি যে, এ জন্য মহাবিশে্র কেন্দ্রে অবস্থান অপরিহার্য নয়, বরং সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান যথেষ্ট।

প্রাচীন বিজ্ঞানীদের মহাবিশ  ছিলো আমাদের মহাবিশে র তুলনায় অনেক ছোট। তাদের ধারণা অনুযায়ী মহাবিশ  বর্তমান সৌরজগতের চেয়ে বড় ছিলো না। এভাবেই চলে এসেছে দীর্ঘকাল।

১৫৪৩ সালে নিকোলাস কোপার্নিকাস দীর্ঘ গবেষণার পর ঘোষণা করলেন পৃথিবী নয় সূর্যই আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্র। তবে কোপার্নিকাসের ধারণায় দু’টি বড় ধরনের ভুল ছিলো। তিনি মনে করতেন, সূর্যের অবস্থান শুধু সৌরজগতের কেন্দ্রে নয়, বরং মহাশূন্যেরও কেন্দ্রে। দ্বিতীয়ত তিনি মনে করতেন নক্ষত্ররা স্থির, গতিশীল নয়। সূর্য ও আকাশের তারাদের নিজস্ব কোন গতি নেই। বিজ্ঞান আজ আমাদের বলছে, সূর্য ও সৌরজগতের অবস্থান মহাবিশের কেন্দ্রে নয়। শুধু তাই নয়, আমাদের এই যে বিশাল ছায়াপথ, এরও অবস্থান মহাবিশের কেন্দ্রে নয়। এমনকি সৌরজগতের অবস্থানও ছায়াপথের কেন্দ্রে নয়, বরং এক পাশের্ ।

মহাজাগতিক নীতি বা কসমোলজিক্যাল প্রিন্সিপ্যাল হচ্ছে জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি বহুল আলোচিত পরিভাষা। এর মূল কথা হলো, মহাবিশ কে যে কোন অবস্থান থেকেই দেখা হোক, বড় স্কেলে অর্থাৎ একটা বিশাল অঞ্চলজুড়ে মহাবিশ^কে একই রকম দেখা যাবে।

বিশাল অঞ্চল জুড়ে মানে কত বিশাল তা ধারণা করাও কঠিন। ‘সেটা হতে পারে লাখ লাখ আলোক-বর্ষ! তো এই ব্যাখ্যা অনুসারে বড় স্কেলে মহাবিশের গঠন মোটামুটি সমরূপ হবে। এখান থেকে আরেকটি কথা বেরিয়ে আসে যে, মহাশূন্যে ছায়াপথগুলোর বিতরণের ঘনত্ব কেমন হবে? এ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, অন্তত মিলিয়ন আলোকবর্ষ জুড়ে ছায়াপথের সংখ্যা একই হবে।

আধুনিক পর্যবেক্ষণ

উপরে যে মহাজাগতিক নীতির যে ব্যাখ্যা দেয়া হলো....

(এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা পরবর্তী...)

মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও প্রসারণ

মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং এর শুরু কীভাবে হলো, এ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের চিন্তাভাবনার যেন শেষ নেই। এ পর্যন্ত এ বিষয়ে বিভিন্ন ধারণা ও মতবাদ জন্ম নিয়েছে, আবার বাতিলও হয়েছে। তবে বিজ্ঞানজগতে সবচে’ আলোচিত ও গ্রহণযোগ্য যে চিন্তা তা এই যে, মহাবিশ্বে যা কিছু আমরা দেখি এবং দেখি না তা একসময় খুব ক্ষুদ্র ও সঙ্কুচিত অবস্থায় ছিলো, ঠিক যেন ক্ষুদ্র একটি বিন্দু! ক্ষুদ্র মানে যতটা ক্ষুদ্র কল্পনা করা সম্ভব। তারপর ঐ বিন্দুটির অভ্যন্তরে ঘটলো রহস্যময় এক মহাবিস্ফোরণ। এই মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছে মহাবিশ^, যার ব্যাপ্তি ও প্রসার সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, বড় বড় বিজ্ঞানীদেরও কল্পনার ঊর্ধ্বে।

একসময় বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিলো, মহাবিশ্ব গতিশীল কিছু নয়, বরং তা স্থির। সৃষ্টি বা উৎপত্তির সময় থেকে চিরকাল এটি একই আকার নিয়ে বিদ্যমান রয়েছে।

কিছুদিনের মধ্যেই বিজ্ঞানীগণ বুঝতে পারলেন, এ পর্যন্ত তারা যা জেনে এসেছেন তা কত বড় ভুল! এখানেই ট্রাজেডি!

বিজ্ঞান আজ যেটাকে সত্য বলে গ্রহণ করে এবং যার উপর ভিত্তি করে বহু অজাচিত সিদ্ধান্ত বিজ্ঞান সগৌরবে প্রচার করে, একসময় দেখা যায়, সেই মূল চিন্তাটাই ছিলো ভুল! বারবার এটা ঘটছে, তবু যেন বিজ্ঞান তার চিন্তাকে সংশোধন করতে চায় না।

বিজ্ঞানীরা পরবর্তী সময়ে অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করলেন নতুন সত্য যে, মহাবিশ্ব স্থির নয়, গতিশীল। সৃষ্টির সময় থেকে এখন পর্যন্ত তা অব্যাহত-ভাবে আকারে আয়তনে প্রসারিত হয়েই চলেছে।

১৯৯৮ সালে জানা গেলো, মহাজাগতিক সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে মহাবিশ্বে প্রসারণ হার তত বৃদ্ধি লাভ করছে। এই আবিষ্কারের পিছনে অবদান রাখার জন্য ২০১১ সালে তিনজন বিজ্ঞানীকে একই সঙ্গে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।

প্রশ্ন হলো, মহাবিশে^র এই যে সৃষ্টি ও প্রসার, এটা কি নিজে নিজেই ঘটছে, না এর পিছনে রয়েছে মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী কোন মহাশক্তির মহাকুদরত?

বিজ্ঞানের এ টু জেড সমগ্র আলোচনা থেকে বোঝা যায়, এটা যেন কোন প্রশ্নই নয়! এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই! সৃষ্টিজগতের একেকটা রহস্য উন্মোচিত হয়, আর বিজ্ঞানীরা অবাক বিস্ময়ে থ খেয়ে যান। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। একবারও তারা সৃষ্টির সূত্র ধরে স্রষ্টার অসীম কুদরতের উপস্থিতি অনুভব করতে চান না। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ্র কী হলো! আমাদের মুসলিম বিজ্ঞানীরাও কি স্রষ্টার  অসীম কুদরতের আলোকে সৃষ্টির বিষয়ে গবেষণা করতে পারেন না। তাদের জন্য কি আলকোরআন হতে পারে না বিজ্ঞানসাধনার জন্য আলোকবর্তিকা!

দেখুন আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে এক উম্মী নবীর উপর যে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে সেই কোরআন কত স্পষ্ট ভাষায় মহাবিশ্বে সম্প্রসারণশীলতা এবং এর পিছনে মহান ¯্রষ্টার মহাকুদরতের উপস্থিতির কথা ঘোষণা করছে-

إنَّـا خَـلَـقْـنَـا السَّـمَـاءَ بِـأَيْـدِ وَّ إِنَّـا لَـمُـوسِـعُـونَ

অবশ্যই আমরা সৃষ্টি করেছি আকাশ/ মহাকাশ/মহাবিশ শক্তি দ্বারা, আর অবশ্যই আমরা (সেটিকে) সম্প্রসারণ করে চলেছি।

প্রামাণ্য যে কোন আরবী অভিধান খুলে দেখুন أوسـع মানে হচ্ছে সম্প্রসারিত করলো, বিস্তৃত করলো। موسـع হচ্ছে তার ইসমুল ফাইল, যা দাওয়াম বা ঘটমানতা বোঝায়।

মহাবিশ্বে আয়তন

এই সেদিন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিলো আমাদের যে ছায়াপথ, যার নাম রাখা হয়েছে মিল্কিওয়ে, তার বাইরে আর কোন ছায়াপথ নেই। এটাই হচ্ছে সমগ্র মহাবিশ্বে। অবশ্য এর বিপরীত মতও ছিলো।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী এডউইন হাবল ১৯২৪ সালে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় নতুন আবিষ্কারের ঘোষণা দিলেন যে, আমাদের ছায়াপথ মহাবিশে^র সবটুকু নয়। এর বাইরেও রয়েছে অসংখ্য ছায়াপথ।

১৯২৫ সালে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির যে সম্মেলন হলো তাতে মাত্র ৩৫ বছর বয়সের এই তরুণ বিজ্ঞানী তার বৈপ্লবিক আবিষ্কারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করলেন একটি পূর্ণাঙ্গ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র আকারে।

মহাবিশে^র সম্প্রসারণ সম্পর্কেও তিনি নতুন আবিষ্কারের কথা জানালেন১৯২৯ সালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণাপত্রে। তিনি বললেন, মহাবিশ^ ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। যে ছায়াপথ যত দূরে সেটি তত দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে।

মহাবিশে^র সম্প্রসারণের গতি

প্রশ্ন হলো, মহাবিশে^র সম্প্রসারণ কী গতিতে হচ্ছে? এবং সম্প্রসারণের গতি কি সবসময় অভিন্ন? খুবই সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, মহা-বিশে^র সম্প্রসারণ অকল্পনীয় গতিতে হচ্ছে, যার পরিমাপ আমাদের পরিচিত ‘একক’ দ্বারা সম্ভব নয়। তদুপরি এই সম্প্রসারণের হার সময়ের সঙ্গে বেড়েই চলেছে।

মহাবিশে^র সম্প্রসারণহার পরিমাপ করার জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ অত্যন্ত জটিল একটি একক নির্ধারণ করেছেন, যার নাম মেগাপারসেক একক। এখানে একটু ব্যাখ্যা দরকার। আলোর গতি তো আমরা জানি, সেকেন্ডে একলাখ ছিয়াশি হাজার মাইল। এই গতিতে আলো একবছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে বলা হয় এক আলোকবর্ষ। কল্পনা করুন এক আলোকবর্ষের দূরত্ব তাহলে কত!

সাধারণভাবে আলোকবর্ষকে মহাকাশীয় দূরত্ব পরিমাপের জন্য এককরূপে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেই বিশাল এককও এখানে অচল। এজন্য নির্ধারণ করা হয়েছে আরো বৃহৎ একক। এক আলোকবর্ষের ৩ দশমিক ২৬ গুণ হলো পারসেক। পক্ষান্তরে মেগাপারসেক হলো পারসেক-এর দশগুণ। কল্পনা করতে গিয়ে যদি মাথা গুলিয়ে যায় দোষ দেয়া যাবে না। তো হিসাব করে বের করা হয়েছে, যে ছায়াপথ আমাদের থেকে ৭৩ মেগাপারসেক (প্রায় ৩৩ লাখ আলোক বর্ষ) দূরে আছে সেটি প্রতি সেকেন্ডে ৭৩ কিলো-মিটার বেগে দূরে সরে যাচ্ছে।

মহাজ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাবান আল্লাহ্ তা‘আলা সমগ্র সৃষ্টিজগতকে তাঁর অসীম কুদরতের নির্দশনরূপে ছড়িয়ে দিয়েছেন, যাতে না দেখেও আমরা তাকে বিশ^াস করি, তাঁর আনুগত্য করি  এবং তাঁর ইবাদত করি। আল্লাহ সত্য বলেছেন, আর তিনি তো মহাসত্যবাদী-

هذا خَـلْـقُ اللهِ فَأَرُونِـى مَـاذا خَـلَـقَ الَّذِينَ مِنْ دُونِـه

এ হলো আল্লাহ্র সৃষ্টি, তো দেখাও দেখি আমাকে, কী সৃষ্টি করেছে তারা, যারা আছে তাঁকে ছাড়া?

 

বিশ্ব বীজ ব্যংক

প্রধানত যুদ্ধের কারণে যে ধ্বংস সাধিত হয় তাতে অনেক কিছুরই বিনাশ ঘটে, তার মধ্যে একটি হলো ফল ও ফসলের অস্তিত্ব লোপ পাওয়া। অর্থাৎ বিভিন্ন জাতের স্থানীয় উদ্ভিদ এমনভাবে বিনষ্ট হয় যে, তার বীজ পর্যন্ত আর পাওয়া যায় না।

একদিকে মানুষ পুরো মানবসভ্যতার ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছে যুদ্ধের উন্মাদনা দ্বারা, অন্যদিকে তারাই আবার বৃক্ষ ও উদ্ভিদের বীজ সংরক্ষণের চেষ্টায় উদ্গ্রীব!

বেশ কিছুদিন হলো, বিশ্ব পর্যায়ে একটি বীজ সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা হয়েছে। তাতে এ পর্যন্ত দশ লাখ জাতের বীজ-নমুনা সংরক্ষণ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে পৃথিবীর বেশীর ভাগ জাতের ফসলের বীজ এখানে রয়েছে।

সম্প্রতি সিরিয়ায় যে যুদ্ধবিপর্যয় তাতে স্থানীয় বীজসংরক্ষণাগারটিও ধ্বংসা হয়ে গিয়েছে। তবে সেখানকার সমস্ত বীজের নমুনা সংরক্ষিত ছিলো ঐ বিশ্ববীজ সংরক্ষণাগারে। তাই এসকল ফসলের জাত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। আধুনিক সভ্যতার যেন শ্লোগান হলো,

 ‘যুদ্ধ করো, ধ্বংসা করো, তবে বীজ সংরক্ষণ করো।’

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা