রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭)

বিজ্ঞান বিচিত্রা

বৃ ষ্টি র বি জ্ঞা ন

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

বৃষ্টির সৌন্দর্য সত্যি অতুলনীয়; বৃষ্টিতে ভেজার অভিজ্ঞতাও বড় উপভোগ্য। বৃষ্টির একটানা রিমঝিম সুর, আর টিনের চালের বৃষ্টি পড়ার...! সব মিলিয়ে পুরো বৃষ্টিটাই যেন কী এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি নিয়ে আসে! কত কবি বৃষ্টির কবিতা লিখে, কত শিল্পী বৃষ্টির ছবি এঁকে অমর হয়েছেন!

আমি আজ তোমাদের বৃষ্টি নিয়ে লেখা কবির কবিতা শোনাবো না! এমনকি বৃষ্টি নিয়ে আঁকা শিল্পীর কোন ছবিও দেখাবার ইচ্ছে আমার নেই। আজ আমি তোমাদের শোনাবো বৃষ্টির বিজ্ঞান-কথা। কীভাবে আকাশে মেঘের রাজ্যে বৃষ্টি তৈরী হয়, তারপর পৃথিবীর বুকে বৃষ্টি নেমে আসে! যাতে তোমরা বুঝতে পারো, বৃষ্টিও আমাদের আল্লাহর অসীম কুদরতের কত বড় নিদর্শন! আল্লাহ নিজেও বলেছেন কোরআনে যে, বৃষ্টি তাঁর

কুদরতের নিশান। তিনিই আসমান হতে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। বৃষ্টি দ্বারা ভূমি সবুজ সজীব হয় এবং ভূমি প্রাণ লাভ করে। বৃষ্টির কারণেই আল্লাহর হুকুমে মাটি থেকে ফল ও ফসল হয়। বৃষ্টি না হলে ভূমি মৃত ও নিষ্ফলা হয়ে যায়।

সূর্যের তাপে সাগর-মহা সাগর থেকে প্রতিনিয়ত বিপুল পরিমাণ পানি বাষ্প আকারে বাতাসে মিশতে থাকে। খাল-বিল, নদী-নালা সম্পর্কেও একই কথা। এমনকি গাছের পাতার মাধ্যমেও জলীয় কণা বাতাসে মেশে। কীভাবে? শিকড়ের সাহায্যে গাছ মাটি থেকে পানি সংগ্রহ করে। কারণ পানি ছাড়া গাছ বাঁচতে পারে না। তো মাটি থেকে পাওয়া পানি প্রয়োজন পরিমাণ রেখে বাকিটা গাছ তার পাতার সাহায্যে বাতাসে ছেড়ে দেয়।

বাতাস এক অবস্থানে থাকে না, বরং দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করে। জলীয় বষ্প ধারণকারী বাতাস সাধারণ বাতাসের চেয়ে কিছুটা ভারী হবে, এটাই স্বাভাবিক। আর ভারী বাতাস থাকে বায়ুম-লের নীচের দিকে, পৃথিবীপৃষ্ঠের কাছাকাছি। উপরের দিকে থাকে জলীয় বাষ্পহীন হালকা বাতাস। ভারসাম্য না থাকার কারণে উভয় বাতাস তাদের স্থান পরিবর্তন করতে থাকে। অর্থাৎ ভারী বাতাস উপরে ওঠবে, আর হালকা বাতাস নীচে নামবে। এভাবে বাতাসের মধ্যে একটা ‘পরিচলন গতি’ সৃষ্টি হয়।

বাষ্পমিশ্রিত বাতাস সিক্ত ও আর্দ্র অবস্থায় যখন বায়ুম-লের উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন তা ‘চাপস্বল্পতা’-র সম্মুখীন হয়। যত উপরে যাবে, চাপস্বল্পতা তত বাড়বে। একসময় স্বল্প চাপের এলাকায় গিয়ে অধিক চাপসম্পন্ন ভারী বাতাস দ্রুত প্রসারিত হয়ে যায়।

এভাবে বাষ্পমিশ্রিত ভারী ও আর্দ্র বাতাস উপরে এসে প্রসারিত হয়ে শীতলতা অর্জন করে। ফলে জলীয় কণা বা বাষ্পও শীতল হয়ে পড়ে। বাষ্প তখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা বা বরফকণা হয়ে বাতাসে ভাসতে থাকে। এরাই হলো ভাসমান মেঘ।

জলকণা বা বরফকণাগুলো নীচে পড়ে যায় না কেন?

কারণ কণাগুলো এতই ক্ষুদ্র যে, বাতাস অনায়াসেই তা বহন করতে পারে। নীচে বৃষ্টি হয়ে নামার জন্য প্রয়োজন কণাগুলোর ঘনীভবন। তরল অবস্থা থেকে পানি যে প্রক্রিয়ায় বায়বীয় অবস্থায় রূপান্তরিত হয় সেটাকে বলা হয় বাষ্পীভবন, পক্ষান্তরে যে প্রক্রিয়ায় ঠিক বিপরীত অবস্থা হয়, অর্থাৎ বাষ্প পানিতে পরিণত হয় সেটাকে বলা হয় ঘনীভবন।

ঘনীভবনের জন্য আবার প্রয়োজন একটা অনুঘটকের। আর সেটা হচ্ছে বায়ুম-লে বিদ্যমান অসংখ্য ধূলিকাণা। বায়ুলম-ল যদি ধূলিকণা থেকে মুক্ত শতভাগ পরিষ্কার হতো তাহলে কখনই জলীয় বাষ্পগুলো ঘনীভবনের মাধ্যমে বৃষ্টি হয়ে ঝরতো না।

তাহলে বোঝা গেলো তুচ্ছ বালুকণাই হচ্ছে বৃষ্টির মূল অনুঘটক। পানি থেকে বাষ্প, বাষ্প থেকে পানি, এই যে একটা চক্র, যা না হলে জীবন ও প্রাণ ধারণ করা সম্ভব হতো না, তা কিন্তু নির্ভর করে বায়ুম-লে বিদ্যমান এই তুচ্ছ ধূলিকণার উপর। এই ধূলিকণা না হলে পানিচক্র কখনো পূর্ণতা লাভ করতো না, বরং পানি শুধু বাষ্প হয়ে উপরে উঠতো, পানি হয়ে আবার নেমে আসা সম্ভব হতো না।

বায়ুম-লে অতি প্রয়োজনীয় এই ধূলিকণা আসে কোত্থেকে?

ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে যখন বাতাস বয়ে যায় তখন প্রচুর ধূলিকণা উড়িয়ে নিয়ে যায়। সেগুলো বায়ূম-লে গিয়ে জমা হয়। যানবাহন ও কলকারখানার ধোঁয়া এগুলোও বায়ুম-লে গিয়ে জমা হয়। এভাবে সমুদ্র থেকে লবণ-কণাও বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়, যা বায়ুম-লে গিয়ে জমা হয়। এভাবেই বায়ুম-লে ধূলিকণার বিশাল একটা ভা-ার গড়ে ওঠে।

বায়ুম-লে বিদ্যমান ধূলিকণাগুলোর পানির প্রতি সহজাত আকর্ষণ রয়েছে। তাই খুব সহজেই ধূলিকণা ও জলকণার মিশ্রণ ঘটে এবং ঘনীভবন সম্পন্ন হয়।

জলকণাগুলোর ঘনীভবনের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত বড় ও ভারী জলকণা তৈরী হয়, যা বাতাস আর ধরে রাখতে পারে না, বরং পৃথিবীর অভিকর্ষণের টানে নীচে নেমে আসে। এটাই হলো বৃষ্টি।

এখানে একটা জিনিস বোঝার আছে। ঘনীভবনের মাধ্যমে যা সৃষ্টি হয় সেটা আসলে তরল পানি নয়, বরং বরফ। তো বরফ যখন ভারী হয়ে বেগ ধারণ করে নীচে নামতে শুরু করে তখন বাতাসের সঙ্গে তার ঘর্ষণ ঘটে। ঘর্ষণের ফলে তাপ সৃষ্টি হয়। সেই তাপে বরফ গলে যায়, আর আমরা পাই তরল বৃষ্টি।

যদি বাতাসের চাপ কম থাকে, তাহলে তাহলে সংঘর্ষটা হবে সামান্য এবং তাপ সৃষ্টি হবে অল্প। ফলে বরফ গলিত হওয়ার সুযোগ পাবে কম। একারণেই তরল বৃষ্টি না হয়ে শিলাবৃষ্টির ঘটনা ঘটে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

বাষ্প হয় কীভাবে?

বিজ্ঞান আমাদের বলে, বস্তুমাত্রই অণু-পরমাণু দ্বারা গঠিত। আর বস্তুর ভিতরের অণু-পরামাণুগুলো সদা চলমান, কিংবা কম্পনশীল। কঠিন পদার্থের ক্ষেত্রে কম্পনশীল, আর বায়বীয় ও তরল পদার্থের ক্ষেত্রে চলনশীল।

বস্তু ও পদার্থ হিসাবে পানিও অসংখ্য অণু-পরমাণু দ্বারা গঠিত। আর তরল পদার্থরূপে অণু-পরমাণুগুলো সদা চলনশীল। তো পানির যে সমস্ত অণু-পরমাণু উপরের স্তরে থাকে সেগুলো নীচের স্তরের তুলনায় বেশী গতি ও শক্তি লাভ করে। কারণ সূর্যের তাপ পানির উপরের স্তরই বেশী পরিমাণে শোষণ করতে পারে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলীয় কণাগুলো ছোটাছুটি করে পানি থেকে বের হয়ে বায়ুম-লে প্রবেশ করে।

পানি অবশ্য তার সহজাত আকর্ষণধর্ম দ্বারা কণাগুলো ধরে রাখতে চায়, কণাগুলোর গতি ও শক্তি যখন পানির নিজস্ব আকর্ষণশক্তির চেয়ে বেশী হয় তখন কণাগুলো সেই আকর্ষণশক্তি অতিক্রম করে বায়ুম-লে উঠে আসে।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা