এখানে আমি জাম‘ঈয়্যা শার‘ঈয়্যা ও এর মহান প্রতিষ্ঠাতা শায়খ মাহমূদ খাত্তাব সুবাকী রহ. সম্পর্কে কিছু পরিচিতিমূলক কথা বলে রাখা ভালো মনে করছি। শায়খের জন্ম ১২৭৪ হিজরীতে মানুফিয়্যা জেলার সুবাক গ্রামে। শুরুতে তাঁর প্রতিপালন হয়েছিলো সাধারণ কৃষক-পরিবারের সন্তানের মত। বাবার বকরি চরাতেন, আর বাগানের দেখভাল করতেন। অন্য দশটা কৃষকসন্তানের মত তাঁরও লেখাপড়ার কোন সুযোগই ঘটেনি।
যুবকবয়সে তিনি শায়খ আহমদ বিন মুহাম্মাদ জাবাল সুবাকীর খিদমতে হাযির হন এবং যিকিরসহ আধ্যাত্মিক সাধনায় মশগুল হন। ইবাদাত ও রিয়াযাত-মুজাহাদার মাধ্যমে একসময় তিনি আধ্যাত্মিক উৎকর্ষের ঐ স্তরে উপনীত হন যে, শায়খ তাঁর উপর মুরীদানের সংশোধন এবং সালিকীনের তারবিয়াতের তত্ত্বাবধানের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন এবং ইজাযাত প্রদান করেন।
একসময় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দিলে ইলমের প্রতি মুহব্বত ও শাওক প্রক্ষেপণ করলেন। বয়স বিশের কোটা পার হওয়ার পরো তিনি ইলম থেকে দূরেই ছিলেন। প্রথমে তিনি হস্তাক্ষর ও লেখা শিখলেন। তারপর আযহারে গিয়ে শিক্ষার্থী হলেন। আল্লাহর ইচ্ছায় অতি অল্প সময়ে তিনি ইলমের ঐ স্তরে উপনীত হলেন যে, আযহারের প্রাথমিক ছাত্রদের দরস দেয়া শুরু করলেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ফাতাওয়া আইম্মাতিল মুসলিমীন-এ নিজে লিখেছেন যে, আযহারে তাঁর এ বিশাল অর্জন সম্পন্ন হয়েছিলো মাত্র একবছরের মধ্যে!
আযহারে অধ্যয়নকালে তিনি পল্লী অঞ্চলে গিয়ে কৃষক পরিবারের শিশুদের শিক্ষা ও তারবিয়াতের স্বেচ্ছাদায়িত্ব পালন করতেন। এভাবে যুগপৎ তিনি ছিলেন আযহারের শিক্ষার্থী এবং পল্লীগ্রামের শিক্ষক। পল্লী-অঞ্চলে তিনি ওয়াজ-নছীহত ও ইরশাদ-উপদেশের মাধ্যমে সমাজসংস্কারের ব্রতও গ্রহণ করেছিলেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এবং শাদী-গমির অনুষ্ঠানে যে সকল শরীয়তবিরোধী কাজকর্ম হতো সেগুলো বন্ধ করার তিনি জোরালো প্রচেষ্টা শুরু করেছিলেন।
এমনকি খোদ আযহার-এলাকার বিভিন্ন মসজিদে এবং সমাজের নানা স্তরে যে সকল বিদ‘আত শিকড় গেড়ে বসেছিলো সেগুলোর মূলোৎপাটনেও তিনি অনমনীয় ভূমিকা পালন করেছেন। ভ্রান্ত সিলসিলার পীর মাশায়েখদের সংশোধনের বিষয়েও তিনি মনোযোগী ছিলেন। এসব বিষয়ে তাঁর প্রয়াসপদ্ধতি ছিলো সুসঙ্গত এবং হিকমত ও প্রজ্ঞাপূর্ণ।
যথাসময়ে তিনি আযহার থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে তারকা নম্বর পেয়ে আলিম-সনদ অর্জন করেন এবং নিয়মিত দরস দেয়ার কাজে নিয়োজিত হন। সেই সঙ্গে যাবতীয় কুসংস্কার ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে মুখে ও কলমে জিহাদ চালিয়ে যান।
১৩৩৫ হিজরীতে তিনি সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে দ্বীনী চেতনা জাগ্রত করার মহান উদ্দেশ্যে এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন, যার সংক্ষিপ্ত নাম হলো জাম‘ঈয়্যাতুশ-শার‘ঈয়্যা।
এই সংস্থার প্রধান কাজ ছিলো বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়াইয, মুবাল্লিগ ও সংস্কারক প্রেরণ করা, সুন্নাহ-অনুসারী মসজিদ কায়েম করা এবং (অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার উদ্দেশ্যে) জাতীয় হস্তশিল্পগুলোকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করানো।
তাঁর ইখলাছ ও আত্মনিবেদন, সাধনা ও মুজাহাদা এবং ত্যাগ ও কোরবানির লক্ষণীয় প্রভাব ও সুফল মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রকাশ পেয়েছিলো, যা এখন বিশুদ্ধ আকীদা, তাওহীদের প্রতি দৃঢ়তা, শিরক ও বিদ‘আতের প্রতি প্রবল ঘৃণা এবং ইসলামী সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি নিষ্ঠার আকারে সুস্পষ্টরূপে দেখা যায়।
মুখে শরীয়তসম্মত দাড়ি এবং মাথায় পাগড়ি দ্বারা এই সংস্থার অনুসারিদের আলাদারূপে চেনা যায়, যা মিশরে একসময় বিরল ও অপরিচিত হয়ে পড়েছিলো। এমনকি ওলামাসমাজ ও দ্বীনদার শ্রেণীতেও দাড়ির উপর আমল প্রায় উঠে গিয়েছিলো।
১৩৩৫ হিজরীতে শায়খের ইন্তিকাল হয়। তাঁর পরে তাঁর সুযোগ্য পুত্র শায়খ আমীন মাহমূদ খাত্তাব দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
যখনই আমি এই জামাতের লোকদের সঙ্গে মিলিত হই, আমার দিলে ওলামায়ে দেওবন্দ এবং তাঁদের অনুসারিদের স্মৃতি সজীব হয়ে ওঠে। উভয় জামাতের মধ্যে আকীদার বিশুদ্ধতা, সুন্নাতের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রেম, দ্বীনের আদাব ও রীতি-নীতি এবং শরীয়তের মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে বড় অভিন্নতা ও একাত্মতা পাওয়া যায়। ‘যাত ও ছিফাত’ সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন। শেষ বিষয়টি ছাড়া জাম‘ঈয়্যা শার‘ঈয়্যা ও আহলে নজদ উভয়কে একই পথের অনুসারী বলা যায়।
কোন আন্দোলনের জীবন্ততার পূর্বশর্ত
যুগে যুগে বিভিন্ন আন্দোলন ন্যায় ও কল্যাণের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে, আবার শেষও হয়েছে। কোনটা হয়েছে ক্ষণস্থায়ী, কোনটা দীর্ঘস্থায়ী। কেন এমন হয়? এর কারণ হলো, যে কোন আন্দোলন জীবন্ত থাকার জন্য অপরিহার্য শর্ত হলো সমৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখা, সেই সঙ্গে সময়ের গতিপ্রকৃতি ও সমাজ-শিরার স্পন্দন অনুধাবন করা। যে আন্দোলন ও বিপ্লব এটা করতে পারে, যামানার শত ঝড়ঝাপটার মুখেও তা টিকে থাকে; আর না হয়, খুব দ্রুতই তার প্রাণশক্তি শেষ হয়ে যায়।
আমি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে এ সত্য উপলব্ধি করেছি যে, এই সব জনপদ যেখানে পাশ্চাত্য সভ্যতার সামনে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে সেখানে দ্বীনী যিন্দেগীর উপর অবিচল থাকার বিচারে এই দল ও জামা‘আত তার অনুসারিদের নিয়ে বেশ উত্তম ও আশাব্যঞ্জক অবস্থানেই রয়েছে। এখনো তারা ঐ সকল গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং আদর্শ ও ঐতিহ্য বুকে লালন করে রেখেছে যা তারা আপন ইমাম ও রাহবার -এর কাছ থেকে উত্তরাধিকার-রূপে পেয়েছে।
কিন্তু কঠিন একটা প্রশ্ন হলো, ভবিষ্যতেও কি এই জামা‘আত তার গতি ও অগ্রগতি এবং সমাজের উপর প্রভাব ও প্রতাপ বহাল রাখতে সক্ষম হবে? সময় ও সমাজকে একই ভাবে সঙ্গ দিতে এবং প্রয়োজনে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?
এটা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে এর উপর যে, জামা‘আত তার প্রয়াস প্রচেষ্টা এবং তার দাওয়াত ও পায়গাম নতুন সময় ও সমাজ এবং নতুন প্রজন্মের কাছে যুগের ভাষায়, যুগের উপযোগী কৌশল ও পদ্ধতিতে উপস্থাপন করতে পারে কি না!
অভিজ্ঞতায় বারবার দেখা গিয়েছে, বহু দল, জামা‘আত ও আন্দোলন এমনও ছিলো যার ভিত্তি রেখেছেন আল্লাহর কোন মুখলিছ বান্দা, যিনি ছিলেন সমাজের বুকে অত্যন্ত প্রভাবক ব্যক্তিত্বের অধিকারী, যার চিন্তা ছিলো সঠিক ও বিশুদ্ধ, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর স্থানে যারা এসেছে তারা প্রয়োজনীয় সৃজন-শীলতার পরিচয় দিতে পারেনি; নতুন পন্থা ও কৌশল উদ্ভাবন করতে এবং নতুন পথের জন্য নতুন পাথেয় সরবরাহ করতে পারেনি; সময় ও সমাজের দাবী, চাহিদা ও প্রবণতার সঙ্গে দাওয়াত ও পায়গামের সঙ্গতি রক্ষা করতে পারেনি এবং অধিক কার্যকর ও ফলপ্রসূ পথ ও পন্থা গ্রহণ করতে পারেনি। ফলে ঐ দল ও আন্দোলন ধীরে ধীরে সময় ও সমাজের উপর তার প্রভাব ও প্রতাপ হারিয়ে ফেলে এবং ব্যর্থ ও নির্জীব অবস্থায় পড়ে থাকে।
এই মুবারক জামাতকে আল্লাহ তা‘আলা এরূপ মন্দ পরিণতি থেকে হেফাযত করুন, স্থায়িত্ব দান করুন এবং সময়ের গতির সঙ্গে গতিশীল রাখুন, আমীন।
***
জুমার পর কিছু সময় আমরা শায়খ-এর সান্নিধ্যে থাকলাম। সাদা-কালো দাড়ি, চেহারায় যুহদ ও নির্মোহতার নূরানিয়াত সুস্পষ্ট। ভাবগম্ভীরতার সঙ্গে তাঁর রসজ্ঞতা ও প্রাণবন্ততা আমার খুব ভালো লেগেছে।
***
শায়খের মজলিস থেকে বের হওয়ার পর মুহাম্মদ আহমদ উছমান ও আলহাজ্ব আলী আমাদের বিদায় জানালেন। আমরা ভাই মাহমূদ কিন্দীলের সঙ্গে তাঁর বাসস্থানে গেলাম এবং দুপুরের অনাড়ম্বর, তবে আন্তরিকতাসমৃদ্ধ দস্তরখানে শরীক হলাম। সেখানে এশা পর্যন্ত তার উষ্ণ সঙ্গ লাভ করে নিজেদের অবস্থানস্থলে ফিরে এলাম।
***
বন্ধুদের মাধ্যমে খবর পেলাম (ইখাওয়ানের উদ্যমী ও কর্মপ্রাণ নেতা, ইখওয়ানের প্রাণপুরুষ ও প্রতিষ্ঠাতা শায়খ হাসানুল বান্নার জামাতা) উস্তায সা‘ঈদ রামাযান বর্তমানে কায়রো অবস্থান করছেন। বন্ধুদের মাধ্যমেই গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে তাঁর দাওয়াতি যোগাযোগ ও দ্বীনী কর্মোদ্যম সম্পর্কে অবহিত হলাম। সেই সঙ্গে ইখওয়ানের নেতা-কর্মিদের সঙ্গে ওঠা-বসার মাধ্যমে তাদের উদ্যম ও মনোবল সজীব রাখার ক্ষেত্রে তাঁর নিরন্তর প্রয়াস-প্রচেষ্টার বিষয়ও জানা হলো। তাঁকে দেখার এবং তাঁর সঙ্গে দেখা করার আমার খুব আগ্রহ ছিলো। কারণ বিভিন্ন ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং বিভিন্ন ইসলামী ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের সঙ্গ অর্জন করাই ছিলো আমার এ সফরের সবচে’ বড় কল্যাণ ও সার্থকতা।
আরবজাহানের অবক্ষয় ও উত্তরণ
হিজাযে অবস্থানকালে আরব-জাহানকে আমি খুব নিকট থেকে পর্যবেক্ষণ করেছি। আরবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়, বিভিন্ন সরকারের যুলুম-সিতাম, অন্যায়-অবিচার, অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কেও আমার জানা ছিলো। সর্বোপরি ধর্মবিমুখতা, ধর্মবিদ্বেষ এবং জড়বাদী চিন্তা-চেতনা ও প্রবণতার প্রাবল্য সম্পর্কেও আমি সম্যক অবগত ছিলাম। এমন নেতা ও রাষ্ট্রনেতা আমার দেখার মধ্যে ছিলো যারা জাতীয় সম্পদ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। রাজনৈতিক দলগুলো আম জনতার সঙ্গে এবং সমাজ-জীবনের সঙ্গে যেন একধরনের ‘কানামাছি’ খেলে চলেছে। তদুপরি নিজেদের হীন স্বার্থে মানুষে মানুষে এবং শ্রেণীতে শ্রেণীতে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে রেখেছে। যাদের দিল ইসলামের প্রতি ছাফ নয় এবং যাদের অন্তর ইসলামের জীবন-বিধানের প্রতি আশ্বস্ত নয়, শাসকবর্গ তাদেরকে সুকৌশলে ইসলামপ্রিয় শক্তির বিরুদ্ধে উস্কে দিচ্ছিলো।
আমি আমার চিন্তা-গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে, অবক্ষয় ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া এই নাযুক পরিস্থিতি থেকে আরবজাহান ও মুসলিম বিশ্বকে এমন কোন শক্তিশালী গণআন্দোলনই বাঁচাতে পারে যার ভিত্তি-বুনিয়াদ হবে ঈমান ও তাকওয়া, ইখলাছ, লিল্লাহিয়াত ও আত্মনিবেদন এবং একমাত্র আল্লাহর যমীনে আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার মেহনত মুজাহাদার উপর; এই পচনশীল নষ্ট সমাজকে যাবতীয় সর্বগ্রাসী ব্যাধি থেকে মুক্ত করে ইসলামী জীবন-বিধানের বাস্তবায়নের পথে নিয়ে যাওয়াই হবে যার প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে, পানি মাথার উপর দিয়ে চলে গিয়েছে এবং ব্যক্তিগত প্রয়াস-প্রচেষ্টা, দ্বীনী ওয়ায-বয়ান ও হিতোপদেশ দ্বারা সুরাহা করা যাবে, অবস্থা এর চেয়ে অনেক বেশী সঙ্গীন হয়ে পড়েছে। বইপত্র ও বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা দ্বারা, কিংবা অলস ও ধীরগামী কোন জামা‘আত ও সংগঠন দ্বারা হালাতের সংশোধন কিছুতেই সম্ভব ছিলো না।
যে সায়লাব থামাতে পারে সব সায়লাব
এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, কোন ঢল বা সায়লাবকে রোধ করার জন্য তার চেয়ে শক্তিশালী ও প্রবল কোন ঢল ও সায়লাবের প্রয়োজন।
কোন স্রোতের ধারা ও প্রবাহকে তার চেয়ে প্রবল কোন স্রোতই অন্যদিকে ফেরাতে পারে।
হেজাযে যে সকল লেখক-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে এবং ইখওয়ানের যে সকল বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তারা আমাকে এ ধারণা ও প্রত্যয় দান করেছেন যে, ইখওয়ানুল মুসলিমীনই শুধু পারে এই স্বপ্ন ও প্রত্যাশা পূর্ণ করতে। কারণ ইখওয়ান ইতিমধ্যেই জাতীয় জীবনে বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এই জামা‘আতের মধ্যে ঈমান ও আমলের শক্তি এবং ইশক ও মুহাব্বাতের জাযবা শুরু থেকেই অত্যন্ত প্রবল। ইখওয়ানের অনুসারিদের মধ্যে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, ধৈর্য ও সহনশীলতা, উচ্চ সাহস ও মনোবল এবং শৃঙ্খলা ও নীতিনিষ্ঠা ঈর্ষণীয় পর্যায়ে রয়েছে। সর্বোপরি তারা দ্বীনের জাযবা ও উদ্দীপনায় উজ্জীবিত এবং ঈমানের শাণিত অস্ত্র দ্বারা সুসজ্জিত। আল্লাহর যদি মঞ্জুর হয় তাহলে ইখওয়ানের পক্ষে অবশ্যই সম্ভব দেশ ও সমাজের অভিমুখ ধর্মহীনতা থেকে দ্বীনের দিকে পরিবর্তন করা এবং ইসলামের প্রতি উপহাস-বিদ্রুপের প্রবণতাকে ইসলামের প্রতি আস্থা ও গর্ববোধের প্রবণতায় বদল করা।
ইখওয়ান সেভাবেই অগ্রসর হচ্ছিলো সুসংহত পদক্ষেপের সঙ্গে, কিন্তু ...! জীবনে কতবার যে বলতে হলো, ‘হায়, যদি এমন হতো!!’
ঘটনাপ্রবাহের পরিণতিতে ইখওয়ানের উপর কী প্রলয়ঙ্করী ঝড় ও তা-ব বয়ে গেছে তা তো এখন সবারই জানা।
নাকরাশীর হত্যাকাণ্ডের অজুহাতে ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ মুরশিদুল আম শায়খ হাসানুলবান্না মর্মান্তিকভাবে শহীদ হলেন। এর মাধ্যমে শুরু হয়ে গেলো ঈমান ও ছবর এবং বিশ্বাস ও ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা। একপর্যায়ে ইখওয়ানের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টির অপচেষ্টাও হলো জোরদারভাবে। জুলুম-নির্যাতন ও নিপীড়নের চূড়ান্ত করা হলো। শেষপর্যন্ত তাদের দেশছাড়া করা হলো। এভাবে সমস্ত আশা ও প্রত্যাশার উপর যেন গরম পানি ঢেলে দেয়া হলো।
বস্তুত এটা ছিলো আরবজাহান ও মুসলিম বিশ্বের অত্যন্ত মর্মন্তুদ ট্রাজেডি। তবে শোকর ও গর্বের বিষয় যে, এত কিছুর পরো ইখওয়ানকে নির্মূল করা এবং মাটি ও মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি। ইখওয়ান আবার জেগে উঠেছে; নতুন প্রাণ ও সজীবতা নিয়ে আবার সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করেছে। তাদের সাময়িকী, লিটারেচার ও সাহিত্যসম্ভার আবার প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
***
আমি হিজায থেকে (ইখওয়ানের মুরশিদুল আম) উস্তায ছালেহ আছমাবীকে পত্রযোগে আমার মিশরসফরের পরিকল্পনা এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছিলাম। কিন্তু মিশরে আসার পর কয়েকদিন পর্যন্ত ইখওয়ানের কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে দেখাই হলো না এবং এমন কারো খোঁজও পেলাম না যিনি আমাকে উস্তায ছালেহ আছমাবী পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন।
সাঈদ রামাযানের কায়রোয় উপস্থিতির কথা জানতে পেরে আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য যোগাযোগ করলাম এবং আমার আকাক্সক্ষার কথা জানালাম। উত্তরে তার সালামের সঙ্গে এ বার্তা এলো যে, তিনি নিজেই সাক্ষাতের জন্য আসতে আগ্রহী।
শনিবার রাতে তিনি এলেন। সঙ্গে ছিলো ইখওয়ানের কতিপয় উদ্যমী ছাত্র-যুবক। আমাদের সাক্ষাৎ ছিলো দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর দুই বন্ধুর মিলনের মত। অন্তরে আবেগ ও জাযবার ঢেউ ছিলো; চোখে ছিলো অশ্রুর আভাস। মুখমণ্ডলে ছিলো আনন্দের উদ্ভাস।
কথাপ্রসঙ্গে সাঈদ রামাযান জানালেন, বন্ধুবর মাওলানা মুহাম্মাদ নাযেম নাদাবী তাঁর কাছে আমার আলোচনা করেছেন এবং আমার রচিত কিছু পুস্তিকা তাকে দিয়েছেন। এভাবে আগে থেকেই তিনি আমার প্রতি অন্তরঙ্গ ছিলেন।
লিখতে আনন্দ হচ্ছে যে, সাঈদ রামাযান আমার পাশে বসে সুহৃদ বন্ধু ও হামদর্দ ভাইয়ের মত কথা বলছিলেন। তাঁর মধ্যে বিন্দুমাত্র এরূপ প্রবণতা ছিলো না যে, প্রথম সাক্ষাতে নিজের ব্যক্তিত্ব, প্রতিভা ও যোগ্যতার প্রদর্শন ঘটাবেন, কিংবা সামান্য সময়ের মধ্যে নিজের কর্ম ও কীর্তির ফিরিস্তি তুলে ধরবেন। এ দুর্বলতা বহু নেতা ও নেতৃত্ব- লিপ্সু ব্যক্তির চরিত্রেই দেখা যায়। সাঈদ রামাযান তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন।
তাঁর পরিমিত হস্তসঞ্চালন, সংযমপূর্ণ শরীরী ভাষা এবং মুখম-লে বিভিন্ন অভিব্যক্তির রেখা-উদ্ভাস দেখে মুগ্ধই হলাম। মজলিসের সবার প্রতি তাঁর সমান মনোযোগ ও প্রাণবন্ত আলাপচারিতা সত্যি প্রশংসনীয় ছিলো। প্রখর মেধা ও হৃদয়-সজীবতার ‘সঙ্গ’ দেখে আমি অভিভূতই হলাম।
কিছুক্ষণ আলোচনার পর প্রসঙ্গ চলে গেলো বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও মুসলিম ব্যক্তিত্বের অবস্থা পর্যালোচনার দিকে। সেখান থেকে শুরু হলো মুসলিম জনপদে হৃদয় ও বুদ্ধির দ্বন্দ্ব এবং হৃদয়ের উপর বুদ্ধির প্রাধান্য বিস্তারের দুঃখজনক প্রসঙ্গ। জরুরি আরো কিছু বিষয়ে মতবিনিময় হলো।
শেষে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলেন যে, আগামীকাল তিনি উস্তায ছালেহ আছমাবীর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করবেন এবং বাদ যোহর এ বিষয়ে আমাকে জানাবেন।
কিছুক্ষণ পর সৈয়দ আলী আকবর এলেন। রাতে তিনি এখানেই থাকবেন এবং ভোরে বিমানে দামেস্ক রওয়ানা হবেন।
শনিবার/১৯-৩-১৩৭০ হি./২৭-১-১৯৫১ খৃ.
শায়খ হামিদ আলফাকী-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ
জনাব হোসনী ছকর এলেন। সামানপত্র নিয়ে তারই গাড়ীতে করে আমাদের নতুন অবস্থান-স্থলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সেটা ছিলো মুসকী সড়কে মুদ্রাবিনিময় কেন্দ্রের কাছে। অল্প সময়ে বেশ স্বচ্ছন্দেই পৌঁছে গেলাম।
যোহরের পর আমরা শায়খ মুহাম্মাদ হামিদ আলফাকী-এর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে কাউলাতুল আবেদীন সড়কে অবস্থিত আনছারুছ্-ছুন্নাতিল মুহাম্মাদিয়্যা সংস্থার দফতরে পৌঁছলাম।
আমাদের দেখে স্যুট-বুট পরিহিত, কেতাদুরস্ত ও সপ্রতিভ এক যুবক এগিয়ে এলেন এবং নিজের পরিচয় দিলেন সংস্থার ‘তত্ত্বাবধায়ক’ বলে। আব্দুল ওয়াহ্যাব আলবান্না নামের এ যুবক জানালেন, শায়খ আছরের পর আসবেন।
আমরা তার হাতে আমাদের পরিচয়-বেতাকা (ভিজিটিং কার্ড) দিয়ে শায়খের অপেক্ষায় থাকলাম। তিনি যথাসময়ে এলেন এবং পরম সৌজন্য ও উষ্ণতার সঙ্গে মিলিত হলেন। দেখা করতে বিলম্ব করেছি বলে অনুযোগও করলেন। আমি সৌজন্য রক্ষা করে সঙ্গত জবাব দিলাম।
মাযা খাছিরাল আলামু... পসঙ্গে বললেন, আমি আপনার কিতাব সংগ্রহ করে গভীর মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করেছি। মন চাচ্ছিলো, কিতাবের উপর একটি পর্যালোচনা লিখি। পরে একথা ভেবে বিরত হলাম যে, এজন্য অত্যন্ত শক্তিশালী কলমের প্রয়োজন। এদিকে আমি হলাম লেখার চেয়ে বক্তা হিসাবে ভালো।
আমি বললাম, জনাব, আপনি লিখলে বরং আমার বেশী ভালো লাগতো।
হৃদ্যতার পরিবেশে আরো কিছু কথা হলো। শেষে আমি তাঁকে এ কয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের আকাক্সক্ষার কথা জানালাম; জামে আযহারের প্রধান শায়খ আব্দুল মাজীদ সালীম, প্রসিদ্ধ লেখক-গবেষক শায়খ আহমদ শাকের এবং ঐ সময় মিশরে অবস্থানকারী শায়খ মুহাম্মাদ ইবরাহীম (আলেশায়খ)।
তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললেন, আপনার সেবায় আমি প্রস্তুত। কিছুক্ষণ পর তিনি আমাদের নিয়ে আনছারুছ্-ছুন্নাহর প্রেসে গেলেন। এদিক থেকে মিশরের দ্বীনী সংস্থাগুলো হিন্দুস্তান থেকে বেশ এগিয়ে। নিজস্ব ছাপাখানা থেকে হিন্দুস্তানের দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো অনেক দূরে। আনছারের ছাপাখানা যথেষ্ট উন্নতমানের। সেখানকার ব্যস্ততা ও ব্যতিব্যস্ততা ছিলো দেখার মত।
শায়খে আযহারের সঙ্গে সাক্ষাৎ
মাগরিবের পর আমরা শায়খে আযহারের বাসভবনে গেলাম। মনে হলো, আমরা বড় কোন হুকূমতের বড় কোন আমলা-উযিরের বাসভবনে এসেছি! উস্তায হামিদ বেশ বেতাকাল্লুফির সঙ্গে শায়খের গৃহে প্রবেশ করলেন। মনে হলো, শায়খের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট জানাশোনা ও হৃদ্যতা রয়েছে। হয়ত এজন্যই সাক্ষাতের জন্য সময় ও পূর্বঅনুমতি নেয়ার প্রয়োজন হয়নি।
শায়খের মজলিসে তখন আযহারের বড় বড় শিক্ষক এবং সরকারের পদস্থ লোকজন ছিলেন। আযহারের রেজিস্টারার শায়খ আব্দুল-লতীফ দরাজও ছিলেন।
এর মধ্যেও শায়খ উঠে এসে আমাদের স্বাগত জানালেন। শায়খ মুহাম্মাদ হামিদ শায়খে আযহারের সামনে আমাকে নাদওয়ার পরিচয়ে পেশ করলেন।
আমি আরয করলাম, আপনাকে আমি ওলামায়ে হিন্দের পক্ষ হতে সালাম পেশ করতে চাই। আযহারকে তারা বড়ই কদর-মর্যাদা ও মূল্যায়নের দৃষ্টিতে দেখে থাকেন।
শায়খ বড় অভিজাতভাবে এর জবাব দিলেন। আমি তাঁকে মাযা খাসিরাল আলামু... কিতাবটি হাদিয়া দিলাম। তিনি শুকরিয়ার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। তারপর বিভিন্ন বিষয়ে বহু বৈদগ্ধ্যপূর্ণ কথা বললেন।
হিন্দুস্তানের দ্বীনী তা‘লীম ও শিক্ষাব্যবস্থা এবং আহলে ইলমের তারবিয়াতের ক্ষেত্রে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা উঠলো। আমি অত্যন্ত আস্থা ও প্রত্যয়ের সঙ্গে আমার বক্তব্য তুলে ধরলাম, যার সারমর্ম ছিলো এইÑ
হিন্দুস্তানের দ্বীনী তা‘লীম ও শিক্ষাব্যবস্থার চালচিত্র ও প্রকৃতি ঐ সকল দেশ থেকে অনেক ভিন্ন যেখানে দ্বীনী শিক্ষা ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান সরকারী সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত।
আমাদের দ্বীনী প্রতিষ্ঠানগুলোর যাবতীয় ব্যয়ভার সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ বহন করে থাকে। ফলে তা সরকারী নিয়ন্ত্রণ ও খবরদারি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে নিজেদের কর্মকা- পরিচালনা করতে পারে। সেখানে যারা তা‘লীম ও শিক্ষাদানে নিয়োজিত, বেতন-ভাতা ও জাগতিক সুযোগ-সুবিধার চেয়ে তাদের লক্ষ্য থাকে আখেরাতের আজর-ছাওয়াব ও প্রতিদানের প্রতি। সেখানে তারাই দ্বীনী শিক্ষার অভিলাষী হয় যারা সরকারী চাকুরি ও সুযোগ-সুবিধার কথা ভুলেও চিন্তা করে না, বরং অর্থনৈতিক ভবিষ্যত ও সচ্ছলতার জীবনকে শুরুতেই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
এ জিনিসটাই হিন্দুস্তানের আলেমদের স্বাধীনচেতনা, সাহস ও মনোবল যোগায় এবং সমস্ত প্রতিকূলতার মুকাবেলা করে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করার প্রেরণা দান করে।
শায়খ আমার বক্তব্য পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে শুনে বললেন, আগের যুগে আযহারও এমনই ছিলো।
আমি বললাম, আসলে সেটাই ছিলো আযহারের সোনালী যুগ।
তারপর আমি দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামার পরিচয় তুলে ধরে বললাম, এটি হিন্দের বড় বড় কয়েকটি দ্বীনী মাদরাসার অন্যতম। তাছাড়া নাদওয়াতুল উলামা হচ্ছে মুসলিমানে হিন্দের বড় সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্র।
এসময় শায়খ হামিদ আলফাকী আলোচনায় যোগ দিয়ে দারুল উলূমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এবং নাদওয়ার তত্ত্বাবধায়করূপে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে হযরত মাওলানা সৈয়দ সোলায়মান নাদাবী ছাহেবের নাম নিলেন। সম্ভবত সৈয়দ ছাহেবের সঙ্গে হিজাযে তাঁর দেখা হয়েছিলো। আমি বললাম, নাদওয়ার বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক হচ্ছেন আপনাদের আযহারেরই ছাত্র মাওলানা ইমরান খান নাদাবী আযহারী।
মজলিসের হাযিরীন আগ্রহের সঙ্গে মুসলিমানে হিন্দের দ্বীনী হালাত, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক অবস্থা জানতে চেয়ে নিজেদের থেকেই বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন। আমি যথাসম্ভব সন্তোষজনক উত্তর দিলাম। একটা কথা খুব জোরালোভাবেই বললাম যে, হিন্দুস্তানের মসুলিম জনগোষ্ঠী দ্বীনের উপর পূর্ণ অবিচল রয়েছে। আর অনুকূল-প্রতিকূল যে কোন পরিস্থিতিতে তারা হিন্দুস্তানের ভূমিতে থাকার স্থির প্রত্যয় পোষণ করে।
হিন্দুস্তানে মুসলিম জাতির বড় বড় দ্বীনী ও ইলমী মারকায এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র রয়েছে, যা তাদের ঈমান-আকীদা ও তাহযীব-তামাদ্দুনের হিফাযত করে আসছে।
আমি একে একে ঐ সকল মারকাযের নাম ও পরিচয় তুলে ধরলাম, তবে খুব সংক্ষেপে।
আলাপ-আলোচনা শেষ হলে শায়খ হামিদ শায়খে আযহারের অনুমতি নিয়ে উঠলেন। শায়খে আযহার মেহমানদারির হক হিসাবে পূর্ণ বিনয় ও আন্তরিকতা -র সঙ্গে দরজা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এলেন এবং ইকরাম ও মর্যাদার সঙ্গে বিদায় জানালেন।
শায়খুল আযহার সম্পর্কে
যে অল্পসময় শায়খুল আযহারের সান্নিধ্যে ছিলাম, আমার মনে হলো বিনয় ও আত্মবিলোপ, মহৎ চরিত্র ও সৌজন্যবোধ এবং জ্ঞানবৈদগ্ধ্য ও ভাবমর্যাদা ইত্যাদির ক্ষেত্রে অতি উচ্চস্তরে তাঁর অবস্থান। যেমন বয়োবৃদ্ধ তেমনি রাশভারী ও সমুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব।
বারবার একটা কথা মনে হয়েছে, আযহারের পদ তাঁকে মহিমান্বিত করেনি, বরং তাঁর দ্বারা আযহার মহিমান্বিত হয়েছে।
ফেরার পথে শায়খ হামিদকে জিজ্ঞাসা করলাম শায়খুল আযহারের ইলমী মাকাম ও জ্ঞানস্তর সম্পর্কে।
তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবিজড়িত কণ্ঠে বললেন, বর্তমানে মিশরে তাঁর স্তরের কোন আলিম নেই। আমি তাঁকে তখন থেকে জানি যখন তিনি কিং ফুয়াদের ইমাম। পরে তিনি শরীয়া আদালতের সহকারী বিচারক নিযুক্ত হয়েছেন। তারপর মিশরের জাতীয় মুফতী নির্বাচিত হয়েছেন এবং সেই পদ থেকে অবসরে গিয়েছেন। আর এখন আযহারের শায়খরূপে বরিত হয়েছেন, যা সবদিক থেকে তাঁরই শান-উপযোগী ছিলো।
আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, বেতনবৃদ্ধির দাবীতে আযহারের শিক্ষকদের ধর্মঘট সম্পর্কে আপনার কী প্রতিক্রিয়া?
তিনি বেদনাক্লিষ্ট কণ্ঠে বললেন, এর চেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা আর কী হতে পারে! আসলে এর কারণ আর কিছু না, শুধু এই যে, আল্লাহর কাছে প্রাপ্তির প্রেরণা দুর্বল হয়ে গেছে, পক্ষান্তরে অর্থলিপ্সা অনেক বেড়ে গিয়েছে!
তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন, শায়খে আযহারের মজলিসে ওলামায়ে হিন্দের উচ্চ আখলাক, দ্বীনী জাযবা এবং তালীম ও তারবিয়াতের ক্ষেত্রে আত্মিক চেতনা, আর শিক্ষাব্যবস্থার প্রকৃতি সম্পর্কে যে আলোচনা হলো তা যেন একটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ আকারে লিখে দিই। তিনি বিশেষ করে আলহুদা পত্রিকায় তা প্রকাশের ব্যবস্থা করবেন। তিনি খুব অফসোসের স্বরে বললেন, মিশরের আলেমসমাজ, দ্বীনদার তাবকা ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী কেউই মুসলিমানে হিন্দের দ্বীনী, ইলমী ও তা‘লীমী অবস্থা এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রা সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না।
শায়খ হামিদ ফাকী-এর দরসে
চলার পথেই কথায় কথায় জানা গেলো, রাতে এশার পর তাঁর নিয়মিত কোরআনের দরস হয়। আমি তাঁর নিকট দরসে হাযির হওয়ার অনুমতি চাইলাম এবং তাঁর সঙ্গেই জামা‘আতের কেন্দ্রীয় দফতরে উপস্থিত হলাম। এশার ছালাতের পর দরস শুরু হলো। প্রথমে যে জিনিসটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো তা হলো তরুণ প্রজন্ম এবং আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর ব্যাপক উপস্থিতি। পরিষ্কার বোঝা যায়, জমিয়তের দাওয়াতী প্রয়াস-প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হচ্ছে এবং প্রভাববলয় ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে।
দরসের ব্যবস্থা উপরের তলায়। তিনশ বা আরো বেশী হবে উপস্থিতি। দরসের পতি সবার আগ্রহ ও ব্যাকুলতা ছিলো দেখবার মত!
আজকের দরসে আলোচনার বিষয় ছিলো কোরআনের আয়াতÑ
يا يحى خذ الكتاب بقوة
সুন্দর ও মনোজ্ঞ দরস ছিলো। বয়ানের আন্দায ও শৈলী এবং মিছাল ও উপমাগুলো হৃদয়গ্রাহী ছিলো। মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থার যে সমালোচনা তিনি করেছেন তা যেমন সারগর্ভ ছিলো তেমনি ছিলো পূর্ণ বাস্তবতাপূর্ণ।
শায়খ হামিদের বাগ্মিতা, বক্তৃতার জাদুময়তা এবং শ্রোতাচিত্তকে আচ্ছন্ন করার ক্ষমতা সম্পর্কে আমার তেমন কিছু জানা ছিলো না। সত্যি অপূর্ব!
তবে, যারা ইমামের তাকলীদ করে, বিশেষ করে যারা চার মাযহাবের অনুসারী তাদের সম্পর্কে তাঁর তির্যক বাকভঙ্গি এবং বিঁধিয়ে কথা বলার আন্দায আমার বিলকুল পছন্দ হয়নি। মনে হয়েছে, এরূপ বিদ্রƒপাত্মক ও হুলফুটানো মন্তব্য তাঁর নিজেরই মর্যাদা ও অবস্থান থেকে অনেক নীচে। ‘মাযহাবী’ মুসলিমদের সম্পর্কে তাঁর একটি মন্তব্য হলো, ‘এরা দ্বীন ও দুনিয়া উভয় দিক থেকে অন্ধ ও বধির!’ এ ধরনের মনমাসকিতা আল্লাহর কোন মুখলিছ ও নিবেদিতপ্রাণ দা‘ঈ ও সংস্কারকের জন্য কিছুতেই শোভন নয়। এটা তো মুসলিমদের মধ্যে প্রীতি ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করবে না, বরং ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করবে। এটা তো কোনভাবেই দ্বীনের কোন প্রকারেরই খিদমত নয়। এটা তো ...!!
আরেকটা কথা মনে হলো, যদি তাঁর দরসে, বয়ান ও বক্তব্যে আকলের সঙ্গে কলবের, বুদ্ধির সঙ্গে হৃদয়ের এবং মস্তিষ্কের সঙ্গে আত্মার বন্ধন তৈরী হতো, অনেক ভালো হতো। কারণ এটাই হলো নফসের সংশোধন, তাকওয়া ও আল্লাহভীতি, যুহদ ও নির্মোহতা এবং ফানাইয়্যাত ও আত্মনিবেদনের মহাসম্পদ অর্জনের একমাত্র পথ। আর এ সম্পদ এমন দল, সংগঠন ও জামা‘আতের জন্য অপরিহার্য প্রয়োজন যারা মুসলিম উম্মাহর ইছলাহ ও সংশোধন এবং দ্বীনের খেদমত ও সমাজসংস্কারের কথা বলে।
যাই হোক, যা সত্য তা অনুকূল হোক বা প্রতিকূল, স্বীকার করে নেয়াই মুক্তবুদ্ধির দাবী। এ দরস Ñযথেষ্ট পরিমাণ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেওÑ ছাহেবে দরসের জন্য যেমন মর্যাদার বিষয় তেমনি শ্রোতাদের জন্যও সামগ্রিকভাবে উপকারী ও কল্যাণপ্রসূ ছিলো।
দরসের পর শায়খ হামিদ ‘আমাকে না জানিয়েই’ ঘোষণা করে দিলেন, মঙ্গলবার আমার বয়ান হবে।
আমি কিছুটা ‘অপ্রস্তুত’ হলেও সম্মতি প্রকাশ করলাম। কারণ আমি নিজেও সুযোগের সন্ধানে ছিলাম এই সংস্থার কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারক ব্যক্তিবর্গ এবং অনুসারী ও হিতাকাক্সক্ষীদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলার জন্য। এদিক থেকে শায়খ হামিদের ঘোষণাটি আমার কাছে মনে হলো আসমানের গায়বি মদদ।
দরসের পর সংগঠনের কোন একটি বর্ধিষ্ণু শাখার প্রধান বা সেক্রেটারী উস্তায আলী আদালী
আলমুরশিদী ‘পুরখুলূছ’ মুহাব্বাত ও উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে মিলিত হলেন। তিনিই গত বছর আমার পুস্তিকা من الجاهلية إلى الإسلام (যা মূলত মাযা খাসিরা-এর অংশবিশেষ) ছাপার ও প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে জানালেন, মিশর ও সুদানে পুস্তিকাটি ব্যাপক প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সুদান থেকে তো অব্যাহতভাবে চাহিদা আসছে। তিনি নিজে থেকেই প্রতিশ্রুতি দিলেন, মঙ্গলবার উক্ত পুস্তিকার কিছু নুসখা আমার জন্য নিয়ে আসবেন।
এখান থেকে আমরা আপন অবস্থানক্ষেত্রে ফিরে এলাম। তখন জানা গেলো, উস্তায সাঈদ রামাযানের বার্তাবাহক এই বার্তা রেখে গিয়েছেন যে, আগামীকাল বাদ যোহর উস্তায সাঈদ রামাযান তাঁর দফতরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন এবং সেখান থেকে আমাদের উস্তায ছালেহ আছমাবীর বাসস্থানে নিয়ে যাবেন। সেখানে দুপুরের দস্তরখান হবে এবং কথা হবে।
রোববার/২০-৪-৭০হি./২৮-১-৫১ খৃ.
ইখওয়ানী যুবকদের সঙ্গে
সকালে দুই ইখওয়ানি ছাত্র ইউসুফ কারযাবী ও মুহাম্মদ মিরদাশী এলো। তাদের মুখণ্ডলে উচ্চ মনোবল ও অগাধ বুদ্ধিমত্তার ছাপ সুস্পষ্ট ছিলো এবং ছিলো দ্বীনী জাযবা, গায়রাত ও হামিয়্যাতের উদ্ভাস। এরা এমনই প্রতিভাবান যে, চোখ জুড়ায় এবং এ দেশে ইসলামের উজ্জ্বল ভবিষ্যত সম্পর্কে দৃঢ় আশাবাদ জাগায়। ইখওয়ানে এমন আরো বহু তরুণ-যুবক রয়েছে নিশ্চয়! মুসলিম উম্মাহর এই তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দ্বীনী জাযবা ও উদ্যম, ইসলামী প্রেরণা ও প্রাণশক্তি এবং ইসলামের জীবনবিধানের দিকে ফিরে আসার আকুতি সৃষ্টি হচ্ছে; ইখওয়ানের আর যদি কোন কর্ম ও কীর্তি নাও থাকে, গর্ব ও গৌরবের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট।
ইউসুফ কারযাবী জানালো, ইখওয়ানী যুবকদল মাযা খাসিরাল আলামু.. কিতাবটি নিয়মিত পড়ে। বইটি তাদের অন্তর্জগতে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ইখওয়ানের সাংস্কৃতিক ও তারবিয়াতি পরামর্শক উস্তায আব্দুল আযীয কামেল এ বইটি সংরক্ষণে রাখার জন্য জোর তাগিদ দেন। তাই প্রায় সব যুবকের সংগ্রহেই বইটি রয়েছে।
এরা দু’জন আমাকে ‘শরীয়া মূলনীতি অনুষদের’ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার অনুরোধ জানালো। আমি সানন্দে তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলাম। কারণ আমার সফরের মূল উদ্দেশ্যই তো হলো যত বেশী সম্ভব তরুণ প্রজন্মের সান্নিধ্যে আসা; তাদের কিছু শোনা এবং তাদের কিছু শোনানো।
আমি সঙ্গে আনা দু’টি পাণ্ডুলিপি من العالم إلى جزيرة العرب এবং من الجزيرة العربية إلى العالم সম্পর্কে তাদের বললাম। তারা পাণ্ডুলিপিদু’টি সাগ্রহে নিলো এবং তাদের সঙ্গে ‘নিকটসম্পর্ক’ রয়েছে এমন একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে তা ছাপানোর কথা বললো। বয়সে মাত্র তরুণ হলেও তাদের কর্মযোগ্যতার প্রতি আমার আস্থা হলো। তাই স্বচ্ছন্দে পাণ্ডুলিপি তাদের হাতে অর্পণ করলাম।
তারা প্রস্থান করার কিছু পরে আব্দুল্লাহ আল-আকীল নামে শরীয়া অনুষদের ছাত্র এক ইরাকী যুবক এলো; ইখওয়ানের আদর্শ ও চিন্তাধারার সঙ্গে মনে প্রাণে একাত্ম ও নিবেদিত। ইখওয়ানের হয়ে কিছু করার জন্য সদাপ্রস্তুত।
আমি বললাম, তুমি আগে থেকেই আমার পরিচিত। কারণ আমার বন্ধু মাসঊদ আলম নাদাবী তাঁর সফরনামায় তোমার এবং তোমার ঘর-পরিবারের কথা আলোচনা করেছেন। আকীল অবাক হয়ে বললো, তাই!! মনে হলো, খুব খুশী হয়েছে!! এটা দোষের কিছু নয়; এটা মানব-স্বভাবের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ।
আকীল আসলে এসেছে আমাকে উস্তায ছালেহ আছমাবীর দফতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আমরা বের হলাম। সারা পথ সে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের আন্দোলন এবং বিশিষ্ট ইখওয়ানী ব্যক্তিবর্গ সম্পর্কে আলোচনা করলো। বিশেষভাবে শায়খ মুহম্মদ আল-গাযালী, উস্তায আব্দুল আযীয় আলকামিল ও উস্তায বাহী আলখাওলী-এর প্রশংসা করলো। শায়খ গাযালী-এর কিছু কিতাব সে আমার জন্য হাদিয়া এনেছিলো।
***
অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর আজ কাঙ্ক্ষিত সুযোগটি এলো। আমি উস্তায ছালেহ আছমাবীর সাক্ষাৎ লাভ করলাম। আসলে গায়েবানা আমরা উভয়ে একে অপরের প্রতি অন্তরঙ্গ ছিলাম এবং সাক্ষাতের জন্য ব্যাকুল ছিলাম। তাই এমনভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম যেন, হৃদয়ের স্পন্দন বিনিময় হচ্ছে; যেন আমরা কত যুগের পরিচিত, কত দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব আমাদের!!
***
যোহরের পর আমরা সাঈদ রামাযানের বাড়ীতে গেলাম। কিছু সময় হিন্দুস্তানী মুসলমানদের সম্পর্কে কথা হলো। সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থান ও মর্যাদা এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অনুকূল-প্রতিকূল পরিস্থিতি, দ্বীনী শিক্ষার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলো। বিভিন্ন ইসলামী দল, সংগঠন ও জামা‘আত এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, কার্যকলাপ ও কর্মকৌশল, এসবও আলোচনায় এলো। সবমিলিয়ে বেশ সারগর্ভ ও মৌলিক আলোচনা ছিলো, যা লিপিবদ্ধ করে রাখলে উপকারী হতো।
যথাসময়ে দুপুরের দস্তরখান বিছানো হলো; বে-তাকাল্লুফ, তবে অন্তরঙ্গতাপূর্ণ দস্তরখান যা সবসময় আমার ভালো লাগে, কিন্তু সবসময় নছীবে হয় না। দস্তরখান থেকে ফারেগ হয়ে আমরা আছর আদায় করলাম।
বাদ মাগরিব আনছারুছ্-ছুন্নাহর দফতরে গেলাম। এশার পর শায়খ হামিদ আলফাকী-এর সঙ্গে বের হলাম বুলাক মহল্লায় সংগঠনের একটি নতুন শাখার উদ্বোধনের জলসায় শরীক হতে।
বড় জাকজমকপূর্ণ জলসা ছিলো। বিজলী বাতির অতি ঝলমলে আলোকসজ্জা, যেমন আমাদের দেশে মীলাদুন্নবীসহ বিভিন্ন উপলক্ষে হয়। বড় ‘বা-রওনক’ মানযার ও দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য! শ্রোতাদের মাথায় উঁচু উঁচু তুর্কী টুপি জলসার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ করে তুলেছিলো।
উস্তায হামিদ আলফাকী দীর্ঘ ও সারগর্ভ বক্তব্য রাখলেন। তাতে যেমন জোশ-উদ্দীপনার উপাদান ছিলো তেমনি ছিলো প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা। শ্রোতাদের মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে বলে মনে হলো।
জলসার ব্যস্ততা সেরে গভীর রাতে আমরা অবস্থানক্ষেত্রে ফিরে এলাম। এভাবে মিশরসফরের আরেকটি দিন অতীত হলো, আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
সোমবার /২১-৪-৭০ হি./১৯-১-৫১ খৃ.
আজ ড. আহমদ আমীনের সঙ্গে দেখা করার ‘তারতীব’ ছিলো। হিজায থেকে তাঁর জন্য কিছু হাদিয়া এনেছি, তা পৌঁছাবো এবং কিছুটা সময় তাঁর সঙ্গে যাপন করবো। কিন্তু দফতরে গিয়ে জানা গেলো, অভ্যাসের বাইরে আজ তিনি সময়ের আগেই দফতর ত্যাগ করেছেন। আফসোস হলো; (কারণ যার দায়িত্ব ছিলো তিনি আগে থেকে সময় নেননি)। কিন্তু তখন করার কিছু ছিলো না। এই সাংস্কৃতিক দফতরেরই পাণ্ডুলিপি শাখায় কর্মরত হলেন রাশাদ আব্দুল মুত্তালিব নামে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ এক ব্যক্তি। অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত। বিশেষ করে প্রাচীন অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে তার জানাশোনার পরিধি বিস্ময়কর পর্যায়ে বিস্তৃত, অথচ অতি বিনয়ী, জ্ঞানগরিমা বলতে কিছু নেই।
আমরা তার সঙ্গে তার কক্ষে সাক্ষাৎ করলাম। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমাদের সঙ্গে সহজ ও স্বতঃস্ফূর্ত হলেন। অনির্ধারিত সাক্ষাৎ সত্ত্বেও যথেষ্ট সময় দিলেন। প্রাচীন যুগের বিভিন্ন ইলমী কর্ম ও কীর্তি সম্পর্কে আলোচনা করলেন, যা এখনো
আলোর মুখ দেখেনি। বিভিন্ন দুর্লভ পাণ্ডুলিপি সম্পর্কেও মূল্যবান আলোচনা করলেন। বেশ কিছু অজানা চমকপ্রদ তথ্য তার কাছ থেকে জানা হলো।
ড. আহমদ আমীনের ঘরে ফোন করে জানা গেলো, তিনি ফুয়াদ একাডেমিতে অবস্থান করছেন। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে আমরা তার ঘরে গেলাম। তখনো তিনি আসেননি। আজ অভ্যাসের বাইরে বিলম্ব হচ্ছে! যা হবে তা সহজেই হয়ে যায়, যা হবার নয়, তা কোনভাবেই হতে চায় না! কী আর করা, হাদিয়াগুলো তাঁর পুত্রের হাওয়ালা করে ক্লান্ত শ্রান্ত অবস্থায় ফিরে এলাম। অবশ্য পরিচয়-বেতাকা রেখে এলাম।
***
সন্ধ্যায় আল্লামা আহমদ মুহাম্মদ শাকিরের সঙ্গে সাক্ষাতের মনস্থ করলাম। আনছারুছ্-ছুন্নাহর কার্যালয় থেকে ফোনে যোগাযোগ করা হলো। তিনি আহমদ ফাকী-এর গাড়ী চেয়ে পাঠালেন, যাতে আনছারের কার্যালয়ে দ্রুত পৌঁছতে পারেন। কিন্তু শায়খ মুহম্মাদ হামিদ আজ অভ্যাসের বাইরে বেশ বিলম্বে এলেন। একদিনে এতগুলো অভিজ্ঞতা, উপভোগ্যই বটে!
শেষে চিন্তা করলাম, শায়খ মুহম্মদ বিন ইবরাহীম আলে শায়খ-এর সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করি। তিনি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মিশরে এসেছেন। জীযা অঞ্চলে একটি ভাড়া বাসায় উঠেছেন। আমরা সেখানে গেলাম। বাড়ী তো নয়, আলীশান বালাখানা, যা অতি প্রাচুর্যের অধিকারী বিত্তশালী এবং উচ্চ পদস্থ লোকজনের উপযোগী!! কামরাগুলো আধুনিক সাজসজ্জা ও বিলাসী আসবাবপত্রে সুসজ্জিত। অবাক হওয়ার মত বিষয়ই বটে।
আমরা শায়খকে সালাম দিলাম এবং আমাদের দ্বীনী ভাই, শায়খের প্রিয়ভাজন ওমর বিন হাসান আলে শায়খের পত্র হস্তান্তর করলাম।
শায়খ ইবরাহীম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী; তাই একজনকে পড়ে শোনাতে বললেন।
এরপর আলোচনা শুরু হলো। প্রসঙ্গক্রমে আমি তাঁকে ওবায়দুল্লাহ যাহিদ দারবেশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, যিনি হিন্দুস্তান থেকে হিজরত করে গিয়েছেন। নজদের লোকেরা তাঁর বেশ সুখ্যাতি করেন। বহু বিশিষ্ট নজদী লেখক অত্যন্ত ভালো আন্দাযে তাঁর কথা লিখেছেন।
শায়খ এ প্রসঙ্গে আব্দুল কারীম দারবেশ এবং আব্দুল্লাহ দারবেশের কথাও আলোচনা করলেন।
এদু’জনের আলোচনার প্রসঙ্গ ধরে হযরত শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ. এবং হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ.-এর আলোচনাও এলো। তখন জানা গেলো, শায়খ ইবরাহীম এবং শায়খ মুহম্মদ হামিদ উভয়েই ঐ মহান ব্যক্তিদ্বয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ ‘অনবগত’! তাঁদের জিহাদ ও কোরবানি এবং খেলাফতে ইসলামিয়া কায়েমের মেহনত-মুজাহাদার ইতিহাস তো অনেক পরের কথা! দুঃখজনক হলেও অনেক বড় বড় ব্যক্তির সঙ্গে এটাই হলো আমার বহুবারের অভিজ্ঞতা।
সৌভাগ্যক্রমে আমার পূর্বপ্রস্তুতি ছিলো। আটখ-ের সুবিশাল গ্রন্থ নুজহাতুল খাওয়তির-এর সংক্ষিপ্ত -সার الإعلام بمن في تاريخ الهند من الأعلام গ্রন্থটি সঙ্গে নিয়েছিলাম। সেখান থেকে শায়খকে আমি শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ.-এর আলোচনা আংশিক পড়ে শোনালাম। শায়খ গ্রন্থটি পড়ার আগ্রহ ব্যক্ত করলেন। আমি তা তাঁর কাছে রেখে এলাম।
শায়খ তাঁর মহান দাদা আব্দুল ওয়াহ্হাব রহ. সম্পর্কে বেশ ওয়াকিফহাল। এমনকি কে তাঁর পক্ষে-বিপক্ষে কী লিখেছে তাও তাঁর নখদর্পণে। এছাড়াও তিনি তাঁর সমস্ত পূর্ব-পুরুষ এবং নজদী আলেমগণের রচনাসম্ভার ও গ্রন্থভাণ্ডার সম্পর্কে যথেষ্ট বা-খবর।
এ প্রসঙ্গে শায়খ আমার প্রিয় বন্ধু মসঊদ আলম নাদাবীর কথা উল্লেখ করলেন, যিনি রিয়াদে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং শায়খ আব্দুল ওয়াহ্হাব রহ. সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছেন।