কাশ্মীরে
হযরত আলী মিয়াঁর বয়ান
আল্লাহর সাহায্য ও নুছরত কখন আসে?
(এই ভাষণ প্রদান করা হয়েছে আন্জুমানে নুছরাতুল ইসলাম-এর সুপরিসর মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক বিরাট সুধিসমাবেশে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন শ্রীনগর ও আশপাশের বিপুলসংখ্যক আলেমওলামা, চিন্তাশীল ও বুদ্ধিজীবী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তারীখ, ৪ঠা নভেম্বর, ১৯৮১ রোয বুধবার, বিকেল চারটা)
হামদ ছালাত ও খোতবায়ে মাসনূনের পর; আম্মা বাদ!
জনাব ছাদরে আন্জুমান ও ছাদরে জালসা, ওলামায়ে কেরাম এবং শহরের উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ। আজকের এ মহতী সভার মাধ্যমে শ্রীনগরে আমার সপ্তাহব্যাপী অবস্থানের সমাপ্তি হতে চলেছে। আমি মনে করি, এটা নিছক ঘটনাক্রম নয়, বরং একটি অত্যন্ত শুভঘটনাক্রম যে, এ নামের একটি সংস্থার পক্ষ হতে আমাকে বিদায়সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করা হচ্ছে, আর সংস্থার শুভনাম থেকেই আমি আমার বক্তব্যের বিষয়বস্তু পেয়ে যাচ্ছি।
পৃথিবীর জানাশোনা বেশীর ভাগ দেশেই আমি গিয়েছি। কিন্তু আমি এমনই এক দুর্ভাগা মুসাফির যার জন্য আল্লামা ইকবালের এই কবিতাংশটি খুবই উপযোগী
تسکین مسافر نہ سفر میں نہ حضر میں
যে মুসাফির অস্থির ব্যাকুল, তার শান্তি না ঘরে, না সফরে।
ইসলামী জাহান ও মুসলিম জনপদের যেখানে যেখানে আমি গিয়েছি সেখান থেকে শান্তি ও স্বস্তি নিয়ে ফেরার পরিবর্তে বিভিন্ন চিন্তা, উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তাই নিয়ে এসেছি। এটাই ছিলো আমার নছীবের লেখা। জানি না, এর কারণ কি আমার চিন্তা, চেতনা ও অনুভব-অনুভূতির অতিসংবেদনশীলতা, না আসলেই ঘটনা এই যে, আমার প্রিয় মুসলিম জনপদগুলোর যেখানেই আমি যাই, সঙ্গে যায়, দীর্ঘ অধ্যয়নের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতা থেকে অর্জন করা আমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বিচারবোধ! ইতিহাসের শিক্ষা আমি কখনো ভুলতে পারি না। ইসলামের ইতিহাসে বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন ভূখ- যে সকল ঘটনা ঘটেছে, আমার স্মৃতিতে, বরং আমার চোখের সামনে তা জ্¦ল জ¦ল করতে থাকে। প্রতিটি ঘটনা থেকে যে শিক্ষা, যে ফলাফল আহরণ করা সম্ভব তা থেকে আমার চিন্তা কখনো মুক্ত হতে পারে না। স্বয়ং কুরআনুল কারীম মানুষের এ স্বভাবের নিন্দা করেছে যে, চোখের সামনে সবকিছু দেখবে, অথচ কোন কিছু থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করবে না। ইরশাদ হয়েছে
وَ كَـأيِّـن مِّـنْ آيَـةٍ فِـي السَّـمـوات وَ الأرْضِ يَـمُـرُّونَ عَـلَـيْـها وَهُـمْ عَنْـها مُـعْرِضُـون
কত নিদর্শন রয়েছে আসমানে যমীনে, লোকেরা তার উপর দিয়ে পার হয়ে যায়, তা এড়িয়ে এড়িয়ে। (না কিছু ভাবে, না কোন শিক্ষা গ্রহণ করে।)
সূরা ইউসুফ, ১০৫
আমার ভাই ও বন্ধুগণ! নিজেকে বড় ভাগ্যবান ও খোশনছীব মনে হতো যদি যাওয়ার সময় আপনাদের কোন আনন্দের বার্তা দিয়ে যেতে পারতাম, যদি আপনাদের শান্তি ও স্বস্তিতে আরো কিছু বৃদ্ধি ঘটাতে পারতাম। আল্লাহ্ তা‘আলা যে সুন্দর সবুজ সজীব উপত্যকা এবং প্রকৃতির যে সমস্ত হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য দান করেছেন; আসমান থেকে আপনাদের উপর নেয়ামতের যে অফুরন্ত বারিবর্ষণ হয়ে চলেছে, বড় খুশির বিষয় হতো, যদি আপনাদের বলতে পারতাম, ‘এ সবকিছু আপনাদের জন্য শুভ হোক, নিশ্চিন্ত মনে উপভোগ করুণ, চিন্তা ও উৎকণ্ঠার কিছু নেই।’
কিন্তু এমন কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এর বড় কারণ হলো আমার ‘টুটাফাটা’ কোরআন-অধ্যয়ন। কোরআন আমি এই চিন্তা ও বিশস থেকে অধ্যয়ন করেছি যে, তা একটি জীবন্ত কিতাব; তা এমন এক জীবন-দর্পণ যাতে সবাই নিজেদের মুখ ও মুখম-ল দেখতে পারে। ব্যক্তি যেমন দেখতে পারে তেমনি দেখতে পারে জাতি ও সমাজ। বিভিন্ন সভ্যতা ও সরাজ্যের উত্থান ও পতন এবং পরিণাম পরিণতির চিত্রও দেখাযেতে পারে এ কিতাবের পাতায়। এরশাদ হয়েছে
لَـقَـدْ أَنْـزَلْـنـا إلَـيْـكُـمْ كِتـابًـا فِـيـه ذِكْـرُكُـمْ أفَـلا تَـعْـقِـلونَ
আমি তোমাদের প্রতি নাযিল করেছি এমন কিতাব যাতে রয়েছে তোমাদের যিক্র ও আলোচনা; তো তোমরা কি (এ সম্পর্কে) চিন্তা করো না? (আম্বিয়া, ১০)
‘যিক্রুকুম’ এর অন্যান্য অর্থও মুফাস্সিরীন উল্লেখ করেছেন, তবে এর সমান্তরাল অর্থ এটাই যে, তাতে তোমাদের আলোচনা রয়েছে; فِيْـهِ حَـدِيـثُـكُـمْ অর্থাৎকোরআনুল কারীমে কর্ম ও পরিণামের বয়ান বিশদরূপে বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলার কানূনে মুকাফাত ও শাস্তি-পুরস্কারের চিরন্তন বিধান বিভিন্ন উপলক্ষে, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে। আলকুরআন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে
لَـيْـسَ بِـأمـانِـيِّـكُـمْ وَلا أمَـانِـيِّ أَهْـلِ الكِـتابِ ط وَمَـن يَّـعْـمَـلْ سَـوءً يُّـجْـزَ بِـه
না তোমাদের আকাক্সক্ষা মতে হবে, আর না আহলে কিতাবের আকাক্সক্ষা মতে; যে কেউ মন্দ কর্ম করবে, তার শাস্তি তাকে দেয়া হবে। (নিসা, ১২৩)
হে উম্মতে মুসলিমা, আহলে কিতাব ইহুদি ও নাছারা তাদের মত তোমরাও যেন আত্মপ্রসাদে লিপ্ত না হও। ওরা তো বুক ফুলিয়ে বড় বড় কথা বলে যে, যা-ই করি না কেন, আমাদের কোন শাস্তি নেই, কারণ আমরা তো আল্লাহ্র পুত্র ও তার প্রিয়পাত্র। না, এটা নিছক আত্মপ্রতারণা। মনে রেখো, আল্লাহর বিধান পক্ষপাতমুক্ত। যে কোন সময়ের, যে কোন সম্প্রদায়ের জন্য কুদরতের শাশত বিধান হলো, যেমন কর্ম তেমন ফল। প্রতিটি অবস্থার জন্য রয়েছে আলাদা ফল ও পরিণাম, তাতে কোন ছাড় নেই এবং নেই কোন ব্যতিক্রম। ভীরুতা ও দুর্বলতা, শৈথিল্য ও অলসতা, গাফলত ও উদাসীনতা, অনৈক্য ও বিভেদ, বিশসভঙ্গ ও খেয়ানত, ক্ষমতার মোহ ও সম্পদলিপ্সা, এসবের অনিবার্য পরিণাম হলো যিল্লতি ও লাঞ্ছনা। এতে কোন ছাড় ও ব্যতিক্রম নেই, কারো প্রতি কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। এ সতর্কবাণী কোরআনুল কারীমে কোথাও স্পষ্ট ভাষায়, কোথাও পরোক্ষভাবে বর্ণিত হয়েছে। তাতে বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন সারাজ্যের, বড় বড় প্রতাপশালী শাসক ও সরাটের আলোচনা এসেছে। একই ভাবে এসেছে দুর্বল ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর কথাও, পৃথিবীতে যাদের কোন সহায় ও আশ্রয় ছিলো না, অথচ তারা আল্লাহ্র সাহায্য লাভ করেছে। দেখুন কোরআনের আয়াত
وَأوْرَثْـنـا القَـومَ الَّـذينَ كـانـوا يُـسْـتَـضْـعَـفونَ مَشَـارِقَ الأرْضِ وَمَـغَـارِبَـهـا الَّـتِـي بـركْـنـا فِـيـهـا، وَتَـمَّـتْ كَـلِـمَـةُ رَبِّـكَ الـحُـسْـنـى عَـلى بَـنِـي إسْـرائـيـلَ بِـما صَـبَـروا ط وَدَمَّـرْنـا مـا كـان يَـصْـنَـعُ فِـرْعَـونُ وَقَـوْمُـه، وَمـا كانوا يَـعْـرِشون
যে জনগোষ্ঠীকে দুর্বল ভাবা হতো তাদের আমি উত্তরাধিকার দান করেছি মাশরিক ও মাগরিব ভূখ-র, যাতে আমি কল্যাণ রেখেছি। এভাবে তোমার প্রতিপালকের শুভপ্রতিশ্রুতি সম্পন্ন হয়েছে বনী ইসরাঈলের ক্ষেত্রে তাদের ধৈর্যধারণের কারণে। পক্ষান্তরে ফির‘আউনের গোষ্ঠীযে দালান-মহল বানাতো, আর যে ‘আঙ্গুরমাচা’ তৈরী করতো, আমি তা ধ্বংস করে দিয়েছি।
একই ভাবে অন্যত্র এরশাদ হয়েছে
আর আমি চেয়েছি যে, অনুগ্রহ করবো তাদের উপর, ভূখ- যাদের দুর্বল ভাবা হয়েছে, আর (চেয়েছি যে,) তাদের বানাবো নেতা ও শাসক এবং তাদের বানাবো উত্তরাধিকারী; আর তাদের দখল দান করবো ভূখ-, আর ফির‘আউন, হামান ও তাদের বাহিনীকে দেখাবো ঐ পরিণতি যার তারা আশঙ্কা করেছিলো তাদের (বনী ইসরাঈলের) পক্ষ হতে। (কাছাছ, ৫-৬)
মোটকথা, কোআনুল কারীম হচ্ছে জাতি ও সম্প্রদায়ের, সভ্যতা ও সারাজ্যের, ইতিহাসের বিভিন্ন স্তর এবং জীবনের বিভিন্ন আবর্তন ও পরিবর্তনের এক স্বচ্ছ দর্পণ ও জীবন্ত আয়না। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, দল বা সংগঠন, গোত্র বা পরিবার, যে কেউ ইচ্ছে করলেই তাতে নিজ নিজ রূপ ও প্রকৃতি এবং অবস্থান ও পরিণতির চিত্র দেখে নিতে পারে। কোরআনের আয়নায় যে কেউ সহজেই নিজের বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে, আমার বা আমাদের সম্পর্কে কুদরতের কী ফায়ছালা হতে যাচ্ছে। আল্লাহ্ তা‘আলা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, তিনি কারো স্বজন ও আত্মীয় নন
‘আর ইহুদি ও নাছারা বলে, আমরা তো আল্লাহ্র পুত্র ও প্রিয়পাত্র; আপনি বলে দিন, তাহলে কেন তিনি তোমাদের সাজা দেন তোমাদের পাপকর্মের? বরং তোমরাও, যাদের তিনি সৃষ্টি করেছেন তাদেরই মত সাধারণ মানুষ।
(আলমাইদা, ১৮)
আয়াতের বার্তা ও পায়গাম সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখুন যে, ইহুদি-নাছারাদের অহং ও দম্ভের প্রতি কেমন ‘লালকার’ ছুঁড়ে দেয়া হয়েছে! আল্লাহ্র তথাকথিত ‘পুত্রস্বজন’ হওয়ার সুবাদে তোমরা যে নিজেদের কানূনে কুদরতের ঊর্ধ্বে মনে করছো, তাহলে বলো দেখি, সাজা ও শাস্তির ক্ষেত্রে তোমাদের কোন ছাড় কেন দেয়া হয় না! কেন পরিণাম ও পরিণতির শাশত বিধান তোমাদেরও উপর একই ভাবে প্রযুক্ত হয়! আসল কথা হলো, অন্যরা যেমন সাধারণ মানুষ, তোমরাও তেমনি। তোমরা সবাই আমার সৃষ্টি। অন্যদের মত তোমরাও শাস্তি-পুরস্কারের চিরন্তন বিধানের অনুগত।
আমার প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! আপনাদের আন্তরিকতা ও অন্তরঙ্গতা এবং আপনাদের ভক্তিশ্রদ্ধা ও সম্মাননায় আমি অত্যন্ত আপ্লুত। আপনাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ ও শোকরগুজার হতে চাই; আমি অকৃতজ্ঞ ও নাশোকরগুজার হতে চাই না। তবে কথা হলো, শোকর ও কৃতজ্ঞতার দাবী আমার মতে এটা নয় যে, কিছু অবাস্তব আশ^স ও স্বস্তির কথা বলে এবং কিছু তারিফ-তোশামোদ করে চলে যাবো, ব্যস। এটা প্রকৃত শোকরগুজারি ও কৃতজ্ঞতা নয়। কারো প্রতি যখন কারো মুহব্বত ও ভালোবাসা হয়, শোকর ও কৃতজ্ঞতার অনুভূতি হয় তখন সে তাকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে এবং সবসময় একটা অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকে যে, আমার প্রিয় ও মুহসিন মানুষগুলোর উপর তাদের অজান্তে অসতর্ক অবস্থায় কোন বিপদ এসে পড়ছে না তো! এ জন্য সে জাগ্রত প্রহরীর মত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে এবং প্রয়োজনীয় সতর্কবাণী উচ্চারণ করতে থাকে।
আপনজন যদি বিরক্তি প্রকাশ করে তাতেও সে ক্ষান্ত হয় না। এটাই কৃতজ্ঞতাবোধের প্রকৃত দাবী।
তাই আপনাদের অন্তরঙ্গতা ও ভক্তিশ্রদ্ধার প্রতি কৃতজ্ঞতার অবস্থান থেকে স্পষ্ট ভাষায় আমি বলতে চাই, আপনারা এখন অত্যন্ত নাযুক ও ঝুঁকিপূর্ণ সময় অতিক্রম করছেন। বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য আন্জুমানে নুছরাতুল ইসলামের চেয়ে উত্তম কোন মঞ্চ হতে পারে বলে আমি মনে করি না। বস্তুত কাউম ও মিল্লাতের সামনে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা, এটাই
হচ্ছে ইসলামের আসল সাহায্য ও নুছরত। এই আন্জুমানের ‘বানী’ ও প্রতিষ্ঠাতা আমাদের দু‘আর হকদার যে, তিনি এমন একটি কেন্দ্র তৈরী করছেন যেখানে সমবেত হয়ে ইসলামের নুছরাত ও সাহায্যের জন্য কিছু কথা বলা যায় এবং সাধ্যমত কিছু কাজ করা যায়। তবে সবার আগে এ উপলব্ধি আমাদের অর্জন করতে হবে যে, নুছরাতে ইসলাম, বা ইসলামের সাহায্য, চিন্তা ও কর্ম হিসাবে এর ক্ষেত্র অত্যন্ত বিস্তৃত এবং বহুমুখী। কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এর দায় ও পরিধি থেকে বাইরে নয়। তদ্রপ সাধারণ থেকে সাধারণ মানুষ এবং বড় থেকে বড় কোন ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব এ বিষয়ে নিস্পৃহ ও চিন্তামুক্ত হতে পারেন না।
আমার প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! এখন আমি একটি ঘটনা বলবো আমাদের অতীত ইতিহাসের, আমাদের খায়রুল কুরূনের, যার মধ্যে আমাদের মত গাফেলদের জন্য রয়েছে এক বড় ‘ধামাকা’; হয়ত তাতে আল্লাহ্র ইচ্ছায় আমাদের চেতনা জাগ্রত হবে। হযরত আমর ইবনুল আছ রা. যখন মিশর জয় করলেন, যা তখনকার সভ্য পৃথিবীর ‘আলোকবিন্দু’ ছিলো এবং সবুজ সজীবতার বিচারে ঐ সমগ্র অঞ্চলের জন্য ‘কাশ্মীর’ ছিলো। ভূসম্পদ, প্রাণীসম্পদ, খনিজসম্পদ ও মানব-সম্পদে সুসমৃদ্ধ সুখী সুন্দর দেশটি হযরত আমর ইবনুল আছ রা. জয় করলেন। কিন্তু একজন বিজয়ী সেনাপতির অন্তরে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস এবং যে শান্তি ও স্বস্তি হওয়ার কথা, তা হলো না। এর কারণ এই যে, তিনি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ছোহবত ও সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তো কোরআনের শিক্ষা ও নবীর দীক্ষা-এর বরকতে তাঁর চক্ষু, বরং তাঁর চিন্তা-চেতনা ও দিল-দেমাগ রওশন ও আলোকিত হয়েছিলো। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে ঈমানী ফিরাসাত দান করেছিলেন, বরং আরো অগ্রসর হয়ে বলবো, তিনি ছাহাবিয়াতের ফিরাসাত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তো এই ফিরাসাত ও ‘আত্মিক প্রজ্ঞা’ই আসলে এত বড় বিজয়ের পরো তাঁকে অস্থির বেকারার করে রেখেছিলো। সেই অস্থিরতা ও বেকারারি থেকে তিনি বিজয়ী বাহিনীর আরব-মুসলিম মুজাহিদীনকে একটি কথা বলেছিলেন, যা নূরের হরফে লিখে রাখার মত। তিনি বলেছিলেন
أنْـتُـمْ فِـي رِبـاطٍ دائِـمٍ
দেখো, হুঁশিয়ার সাবধান, এখানকার সভ্যতা-সংস্কৃতি, এখানকার সম্পদ-সমৃদ্ধি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তোমাদের যেন আকৃষ্ট করতে না পারে। নিজেদের তোমরা এখানে হারিয়ে ফেলো না, বরং নিজেদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থেকো। একটি বাস্তব সত্য চিন্তায় জাগ্রত রেখে তোমরা এখানে বাস করো। কী সেই বাস্তব সত্য?!
أَنْـتُـمْ فِـي رِبـاطٍ دائِـم
সর্বক্ষণ তোমরা এক সীমান্ত চৌকিতে প্রহরায় রয়েছো। এই আত্মতুষ্টি যেন তোমাদের পেয়ে না বসে যে, কিবতীদের তোমরা পরাজিত করেছো। রোমান সারাজ্যের সুন্দরতম এবং উর্বরতম ভূখ- তোমাদের দখলে চলে এসেছে এবং চিরকালের জন্য চলে এসেছে। পুরো নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা তোমরা সাজিয়ে ফেলেছো, তদুপরি জাযীরাতুল আরব তো কাছেই রয়েছে! না এসব ভেবে তোমরা ধোকায় পড়ো না। এটা হবে আগাগোড়া এক আত্মঘাতী চিন্তা। কারণ
أَنْـتُـمْ فِـي رِباطٍ دائِـم
তোমরা এমন বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছো যে, একটু যদি চোখ লেগেছে, নির্ঘাত মারা পড়েছো। এখানে সর্বক্ষণ তোমাদের জাগ্রত ও সতর্ক সচেতন থাকতে হবে। তোমরা এক বিশেষ পায়গাম ও রিসালাতের বাহক। এক বিরাট ইনকিলাবি দাওয়াত নিয়ে এখানে তোমাদের আগমন। এক মহান সীরাত ও জীবনদর্শন তোমাদের সঙ্গে রয়েছে। দাওয়াতের দিক থেকে যদি তোমরা সামান্য গাফলত ও শৈথিল্যের পরিচয় দাও, যদি তোমরা ঐ মহান সীরাত ও জীবন দর্শন হারিয়ে ফেলো যা ইমলামের প্রাণকেন্দ্র মদীনা মুনাওয়ারা থেকে নিয়ে এসেছো তাহলে তোমাদের আর কোন শ্রেষ্ঠত্ব থাকবে না, এমনকি থাকবে না কোন গ্রহণযোগ্যতা। যদি কখনো এ ভ্রান্তিতে লিপ্ত হও যে, এখানে তোমরা এসেছো কিছু অর্জন বা উপার্জন করার জন্য, এখানকার সম্পদ ঐশর্য ও রূপসৌন্দর্য ভোগ করার জন্য, তাহলে মনে রেখো, তোমার বাঁচার কোন উপায় থাকবে না, কেউ তোমাদের প্রতি সামান্য দয়াও করবে না।
আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে যে কথা বলেছিলেন আরবের এক সিপাহসালার, যিনি কোন আধুনিক শিক্ষাঙ্গন বা সামরিক বিদ্যালয় থেকে সনদপ্রাপ্ত ছিলেন না, সেই সিপাহসালারের সেই চৌদ্দশ বছরের পুরোনো সতর্কবাণী আজকের আধুনিক যুগেও একই রকম সত্য। বিশাল বিস্তৃত ইসলামী জাহানের যে কোন দেশ, জনপদ ও ভূখ-র ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য যে, তোমরা স্থায়ী পাহারাদারিতে নিয়োজিত রয়েছো। এমনকি আজকের কাশ্মীরেও এটাই হলো আপনাদের সার্বক্ষণিক জাতীয় দায়িত্ব, প্রত্যেক কাশ্মীরী মুসলিমের ঈমানি দায়িত্ব
أَنْـتُـمْ فِـي رِبـاطٍ دائِـم
অন্য ঘটনায় দেখুন, জাযীরাতুল আরবে যখন ইরতিদাদ ও ধর্মত্যাগের দাবানল ছড়িয়ে পড়লো তখন এর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো এবং কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সবারই দায়িত্ব ছিলো। তবে মানুষে মানুষে দায়িত্বের পরিধি ও অনুভূতিতে পার্থক্য হয়। এই পার্থক্যই প্রকৃতপক্ষে মানুষকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় এবং অমরত্ব দান করে।
তখন হযরত আবুবকর রা. ছিলেন বর্তমান খলীফা। উম্মাহ্র জীবন যখন অস্তিত্বের সঙ্কটের মুখে তখন জলদগম্ভীর কণ্ঠে হযরত ছিদ্দীকে আকবার রা. বলেছিলেন
أَ يَـنْـقُـصُ الدِّينُ وَأنـا حَـيٌّ
আমি বেঁচে থাকতে কি দ্বীনের কোন অঙ্গহানি হতে পারে! হতে পারে সামান্য কাঁটাছেঁড়া!! আমার সামনেই যদি আহকামে শরীয়াতের মধ্যে কমতি-বাড়তি শুরু হয়; আহকাম ও ফারায়েযের বিষয়ে ইনতিখাব ও বাছাইপ্রক্রিয়া শুরু হয়। একজন বলে, নামায রোযা, হজ্জ ঠিক আছে, কিন্তু যাকাতের বিষয়ে মাফ চাই। আমি বেঁচে আছি, আর আমারই সামনে যদি দ্বীনের এই বিকৃতি ঘটে তাহলে ধিক্কার আমার জীবনের প্রতি। আমি বেঁচে থাকতে তো এটা হতে পারে না!
তো এ-ই ছিলো ছিদ্দীকী গায়রাত ও হামিয়্যাত, এ-ই ছিলো ছিদ্দীকী জাযবা ও চেতনা, যা দিলের জোয়ার থেকে মুখে এসে উপচে পড়েছিলো। ছিদ্দীকে আকবারের যবানে উচ্চারিত এই ‘লালকার’ যামানার ‘কব্জি মুচড়ে’ দিয়েছিলো এবং ইতিহাসের ধারা পরিবর্তন করে দিয়েছিলো। একজনমাত্র মানুষের গায়রাত ও হামিয়্যাত এবং আত্মচেতনা ও মর্যাদাবোধ; একজনমাত্র মানুষের দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যের আকুতি সর্বগ্রাসী তুফান ও সায়লাবের মুখে প্রতিরোধের এমনই এক দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর তৈরী করে দিলো যে, ঝড়, তুফান ও সায়লাব নিজেই যেন শারমিন্দা হয়ে মাথা নীচু করে ফিরে গেলো। ইরতিদাদ ও তার প্রতিরোধ, ইতিহাস তো অনেক দীর্ঘ; এর বিশদ বিবরণ কিতাবের পাতায় সংরক্ষিত রয়েছে। তবে পুরো সঙ্কটকালে ফায়ছালাকুন ও ভাগ্যনির্ধারক যে বিষয়টি ছিলো তা হলো হযরত ছিদ্দীকে আকবার রা. এর এই নিষ্কম্প, সাহসী ও জলদগম্ভীর ঘোষণা যে
أَ يَـنْـقُـصُ الدِّينُ وَأنـا حَـيٌّ
আমি বেঁচে থাকবো, আর দ্বীনের গায়ে কোন আঁচড় আসবে, তা তো হতে পারে না, কিছুতেই না! রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট হতে যে দ্বীন ও শরী‘আত আমরা পেয়েছি, যে কোন মূল্যে, এমনকি আবু বকরের জানের বিনিময়ে হলেও তা পূর্ণ অক্ষত থাকবে, তাতে ‘নোকতা’রও কমবেশী হতে পারবে না।
এটা শুধু তাঁর মুখের উচ্চারণ ছিলো; মাঠের আচরণও ছিলো। যা তিনি বলেছেন, আসমান-যমীন দেখেছে, তা তিনি করেও দেখিয়েছেন।
হাযারাত! আপনারা হলেন ওলামায়ে উম্মত এবং জাতির নেতা ও কর্ণধার। আপনারা প্রত্যেকে নিজস্ব জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মিনার, আপনারা সময়ের স্বীকৃত খতীব, বক্তা, লেখক ও চিন্তাবিদ। বড় বড় আন্জুমান ও সংগঠনের আপনারা প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার। এককথায় আপনারাই হলেন কাশ্মীরের কল্ব ও দেমাগ, হৃদয় ও মস্তিষ্ক। আপনাদের চিন্তা, চেতনা ও সিদ্ধান্তই হবে জাতির জন্য চূড়ান্ত। সুতরাং অনুমতি হলে এই সুযোগে বিনয়ের সঙ্গে কিছু কথা আপনাদের বলতে চাই। প্রথম কথা হলো, এই ভূখ-র ইসলামী ব্যক্তিত্ব এবং ইসলামী চরিত্র যেন অক্ষুণ থাকে।
আরো সোজা কথায়, এখানে মুসলিমযেমন আছে, থাকবে তেমনি ইসলামও যেন থাকে; বরং ইসলাম যদি থাকে তাহলেই এখানে মুসলিমানের অস্তিত্ব নিরাপদ থাকবে। তো এটা হলো প্রধানত আপনাদেরই দায়িত্ব। আমি বলে যাচ্ছি, সাবধান, কাল হাশরের ময়দান হবে, রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘তাশরীফ ফরমা’ হবেন। আসমানি আদালতের কুরসি হবে; আর হবে আপনাদের অবনত মস্তক এবং আল্লাহ্র নবীর ব্যথিত হৃদয়। আপনাদের জিজ্ঞাসা করা হবে, এই ভূখ-কে আল্লাহ্ তা‘আলা ইসলামের সৌভাগ্য দ্বারা সমুদ্ভাসিত করেছিলেন। আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় বান্দাদের প্রেরণ করেছিলেন। জানের খাতরা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং সর্বপ্রকার প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে তাঁরা ঐ উপত্যকায় গিয়েছেন, অবস্থান করেছেন এবং আল্লাহ্ কালাম ও দ্বীনের পায়গাম মানুষের কাছে পৌঁছিয়েছেন। তারপর আমি ইসলামের চারাগাছকে ফলদার, ফুলদার ও ছায়াদার বিশাল বৃক্ষে পরিণত করেছি। শত শত বছর তোমাদের ভূখ-তা ফল দিয়েছে, ফুল দিয়েছে এবং ছায়া দিয়েছে। কত শত মসজিদ, মাদরাসা ও খানকাহ কায়েম হয়েছে। কত শত জালীলুল কদর ও বরেণ্য আলিম-উলামা, মুহাদ্দিছীন ও ফোকাহা পয়দা হয়েছেন।
তারপর কী হলো! তোমাদের সামান্য গাফলত ও অলসতা, তোমাদের তুচ্ছ বিবাদ-বিক্ষেপ এবং অবিবেচনা ও অদূরদর্শিতার কারণে ইসলামের এই বসন্ত-উদ্যান উজাড় হয়ে গিয়েছে। বলো, আজ তোমাদের কী জবাব? কী কৈফিয়ত?
ভাই ও বন্ধুগণ! কী কারণে জানি না, আজকের স্পেন এবং অতীতের উন্দুলুসের কথা মনে পড়ে গেলো। হয়ত দু’টি ভূখ-র মধ্যে রয়েছে কোন না কোন সংযোগ। আমি স্পেন গিয়েছিলাম। সেখান থেকে দিলের ভিতরে এই চোট ও আঘাত নিয়ে ফিরে এসেছি যে, আল্লাহ্ ভালো জানেন, কী ভুল ছিলো যার কারণে এমন ‘রিজালসাজ’ ও রতগর্ভা ভূখ-, এমন সমৃদ্ধ শহর নগর ও জনপদ এবং উম্মাহ্র এমন নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র ইসলাম থেকেই বঞ্চিত হয়ে গেলো! ইকবালের কবিতার ভাষায় আজ তো অবস্থা এই যে
آہ کہ صدیوں سے ہے تیری فضا بے ا ذاں
কত শতাব্দী হায়, বঞ্চিত তোমার আকাশ-বাতাস আযানের ধ্বনি থেকে।
ইতিহাস আমাদের বলে, ভুল এবং ভুলের শাস্তি সমানুপাতে হওয়া জরুরি নয়। অনেক সময় সামান্য ভুলে গুরুতর শাস্তি হয়ে যায়, যার নিজস্ব কিছু কারণ থাকে। সামান্য একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিচ্যুতি ঘটে, কিন্তু তার ফল ও পরিণতি হয়ে পড়ে বহু শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত। পৃথিবীতে বহু জাতি ও সম্প্রদায় ভুল করেছে এবং বিশেষ কোন মুহূর্তে দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে, আর কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এর সাজা ভোগ করতে হয়েছে। উন্দুলুসে মুসলমানদের পতন এবং তার কারণ ও কার্যকারণ যদি খুঁজে দেখেন, আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, ভিনদেশের মাটিতে আরবগোত্রগুলোর ঈর্ষাবিদ্বেষ ও বিরোধ বিবাদই ছিলো এর বড় কারণ। সেখানে রাবী‘আ-মুযার, আদনানী-কাহতানী এবং হিজাযী ইয়ামানী বিরোধ-সঙ্ঘাতই ভিতর থেকে পুরো কাউমকে খোকলা করে দিয়েছিলো। আদনানী হিজাযীদের চাহিদা ছিলো, যে কোন মূল্যে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি যেন তাদের কাছে থাকে; পক্ষান্তরে কাহতানী ইয়ামানীদের ‘চাহাত’ ছিলো ক্ষমতা ও প্রতাপ তাদের অনুকূলে নিরঙ্কুশ হতে হবে, খুনের দরিয়া বয়ে যাক না কেন!
ক্ষমতার লোভে আরবগোত্রগুলো সবই করেছে, শুধু ইসলামের দাওয়াত ও প্রচার-প্রসারের প্রতি মনোযোগী হয়নি, না শক্তির মাধ্যমে, না যুক্তির মাধ্যমে, আর না আখলাক ও মহত্বের মাধ্যমে। উন্দুলুসে তারা উত্তরের দিকে আগে বাড়বে কী, ধীরে ধীরে দক্ষিণের দিকেই গুটিয়ে এসেছে (যেখান থেকে মুসলিম দেশ মরক্কো খুব কাছে)।
নির্মাণকর্ম ও স্থাপত্যশিল্পে তারা বিস্ময়কর সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে এবং গানবাজনা ও নৃত্যসঙ্গীতে নিমগ্ন থেকেছে; সাহিত্যচর্চা ও কাব্যবন্দনায়ও পিছিয়ে থাকেনি; এমনকি ইলমের বহুমুখী সাধনা ও জ্ঞানতপস্যায়ও তারাই ছিলো সময়ের অগ্রদূত। যা করেনি তা হলো উন্দুলুসের মাটিতে এবং উন্দুলুসীদের দিলের যমীনে ইসলামের শিকড় মযবূত করার মেহনত-মুজাহাদা।
তারা মাদীনাতুয্-যাহরা আবাদ করেছে, আলহামরা নামে কল্পনার চেয়ে সুন্দর প্রাসাদ গড়ে তুলেছে এমনকি নির্মাণ করেছে কুরতুবার মসজিদ, স্থাপত্যশিল্পের বিচারে যা পৃথিবীর অনন্য উদাহরণ। বলতে হয়, ‘তারা মসজিদ সাজিয়েছে, মসজিদ আবাদ করেনি।’ তাদের কর্তব্য ছিলো এসব না করে ইসলামের সঙ্গে পুরো জনপদের অন্তরঙ্গ পরিচয় গড়ে তোলা এবং মানুষকে শান্তির ছায়াতলে ডেকে আনা, আখলাক ও চরিত্রের মাধুর্য দ্বারা, ইনসানিয়াত ও মানবতার হাতছানি দ্বারা। অন্তত রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে তাদের কর্তব্য ছিলো দক্ষিণে (জাবালে তারিকের দিকে) সরে আসার পরিবর্তে উত্তরে এগিয়ে যাওয়া ইউরোপের ভূখ- অগ্রসর হওয়া। কিন্তু না, তাদের পেয়ে বসেছিলো তাহযীব ও তামাদ্দুন এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির উন্নতি, শিল্প-সাহিত্য, কবিতা ও নৃত্যসঙ্গীত এবং ললিতকলার উৎকর্ষসাধনের নেশা। কখনো কখনো ভুল ও বিচ্যুতি হয় বড়, কিন্তু শাস্তি ও পরিণতি তত গুরুতর হয় না। কখনো কোন জাতি এমন গুরুতর জুলুম নির্যাতনে লিপ্ত হয় যে, যদি মানুষের হাতে বিচারের ভার দেয়া হয় তাহলে তাদের সালতানাত উল্টে দেবে; পারলে পৃথিবী থেকে তাদের অস্তিত্ব মুছে ফেলবে, কিন্তু গায়বের সহস্যপূর্ণ কোন কারণে তা হয় না। অথচ কোন বিধবার আহ্ এবং এতীমের আহাযারি বিশাল সালতানাত ও সারাজ্যের ধ্বংস ও বরবাদির কারণ হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় এর উদাহরণ কম নয়।
তো প্রথম কথা হলো, এ ভূখ-ের ইসলামী চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য যে কোন মূলে অক্ষুণœ রাখতে হবে। এটা আপনাদের উপর অর্পিত আসমানি দায়িত্ব ও দ্বীনী ফারীযা। এটা আপনাদের জন্য যেমন কল্যাণকর তেমনি কল্যাণকর ইসলামের জন্য। এমনকি হিন্দুস্তানের কল্যাণও এখানেই নিহিত। হিন্দুস্তানের স্থিতি ও পরিস্থিতিরও দাবী এই যে, কাশ্মীরের মাটিতে আপনারা আপনাদের সংখ্যা-গরিষ্ঠতা ও ইসলামী চরিত্র রক্ষা করে বসবাস করবেন। হিন্দুস্তানের জাতি ও সম্প্রদায়গত সঠিক ভারসাম্যও শুধু তখনই নিশ্চিত হবে। বিশের দরবারে মহান ভারত তাতেই শুধু শক্তিশালী অবস্থান ও মর্যাদার আসন লাভ করবে।
কাশ্মীরে যদি আপনারা নিজেদের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য, নিজেদের বার্তা ও পায়গাম, নিজেদের শান্তিপ্রিয়তা ও মানবপ্রেম এবং গঠনমূলক চিন্তাচেতনা ও সৃজীনশীল যোগ্যতার সঙ্গে অবস্থান করতে পারেন তাহলে আপনাদের কল্যাণ, কাশ্মীরের কল্যাণ এবং ভারতের কল্যাণ।
যখনই কোন প্রশ্ন বা সমস্যা সামনে আসে তখন সবার আগে সিদ্ধান্তমূলক বিষয় এটাই হওয়া উচিত যে, এই ভূখ-র ইসলামী পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যের উপর এর কী প্রভাব পড়বে। শুধু তাই নয়, এখানকার ইসলামী তাহযীব তামাদ্দুন ও সমাজব্যবস্থা এবং ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর এর কী প্রভাব পড়বে, এটাও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সবচে’ জরুরি যে বিষয়টি আমার নযরে আসে তা হলো ঈমান ও আকীদার বিশুদ্ধতা। আল্লাহ্র সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হতে হবে পূর্ণ তাওহীদমুখী। আমাদের অবিচল প্রতিজ্ঞা ও প্রত্যয় হতে হবে এই যে, আল্লাহ্ ছাড়া কারো সামনে কোন আকারে এবং কোন প্রকারেই আমাদের মাথা যেন নত না হয়। তাওহীদ যদি দুর্বল হয়, আল্লাহ্র সাহায্য ও নুছরতও হবে দুর্বল । কোরআনুল কারীমে ছাফ ছাফ বলা হয়েছে যে, যে সম্প্রদায়ের তাওহীদী চেতনায় সামান্য ফাটল ধরেছে তাদের শক্তি ও প্রতাপ-প্রতিপত্তিতে বড় ধরনের ফাটল ধরেছে। শক্তির সবচে’ বড় উৎস, বরং একমাত্র উৎসই হলো তাওহীদের আকীদা ও বিশস। দেখুন আল্লাহ্ বলছেন
سَـنُـلْـقِـي فِـي قُـلوبِ الذينَ كَـفَـروا الرُّعْـبَ بِـمـا أشْـرَكوا بِـالله مـا لَـمْ يُـنَـزِّلْ بِـه سُـلْـطانًـا ج وَمَـأواهُـمُ النَّـارُ ط وَ بِـئْـسَ مَـثْـوى الظّــلِـمـيـن
এখন আমি, যারা কুফুরি করেছে তাদের অন্তরে ভীতি প্রক্ষেপণ করবো। কেননা তারা আল্লাহ্র সঙ্গে শরীক সাব্যস্ত করেছে, যার পক্ষে তিনি কোন প্রমাণ অবতারণ করেননি। তাদের ঠিকানা হলো জাহান্নাম, আর কাফিরদের ঠিকানা বড়ই মন্দ।
(আলে ইমরান ১৫১)
আরো ইরশাদ হয়েছে
إنَّ الذيـنَ اتَّـخَـذوا العِـجْـل سَـيَـنـالُـهُـمْ غَضَـبُ مِّـن رَّبِّـهِـمْ وَذِلَّـة فِـي الـحَـيـوةِ الدُّنـيـا ط وَكَـذلِكَ نَـجْـزِي الـمُـفْـتَرين
যারা মাবূদ বানিয়েছে বাছুরকে, নিঃসন্দেহে তাদের পাকড়াও করবে তাদের রবের পক্ষ হতে ক্রোধ এবং পার্থিব জীবনে লাঞ্ছনা। ওভাবেই সাজা দিয়ে থাকি আমি অপবাদ আরোপ- কারীদের। (আলআরাফ,১৫২)
বস্তুত শিরক হচ্ছে ব্যক্তির জীবনে এবং জাতি ও সম্প্রদায়ের জীবনে দুর্বলতা, ভঙ্গুরতা ও নির্বীর্যতার কারণ। এটা অতীতের জন্য যেমন তেমনি বর্তমান ও ভবিষ্যতেরও জন্য
سُنّـةَ الله في الذينَ خَلَوا مِن قَبْلُ، وَ لَنْ تَـجِـذ لِسُنَّـة الله تَـبْديلا
এটা হলো, পূর্বে যারা বিগত হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহরসুন্নাত ও বিধান, আর আল্লাহর বিধানে তুমি কোন পরিবর্তন দেখতে পাবে না।
আল্লাহ্ তা‘আলা বস্তু ও পদার্থের মধ্যে কিছু স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য গচ্ছিত রেখেছেন, যাকে বলা হয় বস্তুর ধর্ম। আগুনের নিজস্ব ধর্ম রয়েছে, অন্যান্য বস্তুরও রয়েছে নিজস্ব ধর্ম। আগুন জলায়, পানি ডুবিয়ে দেয়। বিষ ও প্রতিষেধক, উভয়েরই রয়েছে নিজ নিজ ধর্ম। বিষ মৃত্যু ঘটায়, প্রতিষেধক বিষের ক্রিয়া রোধ করে। তো একই নিয়মে শিরকের মধ্যেও একটা স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য রাখা হয়েছে, আর তা হলো দুর্বলতা ও নির্বীর্যতা। পক্ষান্তরে তাওহীদের মধ্যে রয়েছে শক্তি ও নির্ভীকতার বৈশিষ্ট্য। এ কারণেই আমাদের ব্যক্তি জীবন ও জাতীয় জীবনের সবচে’ বড় প্রয়োজন হলো ঈমান ও আকীদা-বিশসের বিশুদ্ধায়ন। ইবরাহীমী, মুহাম্মাদী ও কোরআনী শিক্ষা অনুযায়ী আল্লাহ্র সঙ্গে তাওহীদের সম্পর্ক ও বন্ধন যেমন সুসঙ্গত হতে হবে তেমনি হতে হবে সুসংহত। আর এ জন্য প্রয়োজন রয়েছে সার্বক্ষণিক সতর্কতা। কারণ শয়তান সবসময় ওত পেতে থাকে এবং তাওহীদ ও বিশসের মধ্যে খুঁত সৃষ্টি করার জন্য দিলের ঘরে হানা দিতে থাকে। চোর-ডাকাত তো সেখানেই যাবে যেখানে সম্পদ রয়েছে। আপনাদের কাছে ঈমান ও বিশস এবং তাওহীদ ও একত্ববাদের সম্পদ রয়েছে। তাই আপনাদের জন্য রয়েছে বড় বিপদ ও খাতরা। তাদের জন্য কোন বিপদ-ঝুঁকি নেই যাদের দিলে ঈমান ও তাওহীদের সম্পদ নেই। আপনাদের কাছে আল্লাহ্র ফযলে এ মহামূল্যবান নেয়ামত রয়েছে। এটা আপনারা ‘বাহির’ থেকে পেয়েছেন, আবার ‘ভিতর’ থেকেও পেয়েছেন; অর্থাৎ এ মহানেয়ামত এখন এখানকার মাটি ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে গিয়েছে; জীবন ও যৌবনের এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে, একেবারে অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে কথা হলো, এত বড় সম্পদ ঐশর্য ঘরে আসার পর নিশ্চিন্ত থাকার কোন উপায় নেই। এখন বড় উৎকণ্ঠা ও সতর্কতার প্রয়োজন, যাতে এ সম্পদ দিলের ঘরে নিরাপদ থাকে।
দ্বিতীয় যে বিষয়ে আমার ভয় সেটা হলো বিবাদ-বিরোধ এবং অনৈক্য ও নৈরাজ্য। এটার মধ্যেও আল্লাহ্ তা‘আলা দুর্বলতা ও লাঞ্ছনার বৈশিষ্ট্য রেখেছেন। এরশাদ হয়েছে
وَأطِـيـعُـوا الله وَرَسُولَـه وَلا تَـنـازَعوا فَـتَـفْـشَلوا وَتَـذْهَبَ ريـحُـكُـمْ وَاصْـبِروا ط إنَّ الله مَعَ الصّبِـرينَ
আর তোমরা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করো, আর পরস্পর ঝগড়াবিবাদে লিপ্ত হয়ো না, তাতে তোমরা মনোবল হারিয়ে ফেলবে এবং তোমাদের প্রতাপ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর তোমরা ছবর করো, (কারণ) অবশ্যই আল্লাহ্ ছবরকারীদের সঙ্গে রয়েছেন।
(আলআনফাল, ৪৬)
দেখুন, আয়াতের পরিষ্কার বার্তা হলো, ঝগড়া-বিবাদ ও বিরোধ-বিসম্বাদ হচ্ছে দুর্বলতা, ব্যর্থতা ও পরাজয়ের অনিবার্য কারণ। তাই যেখানেই ঝগড়া-বিবাদ হবে, বিভেদ ও অনৈক্য হবে সেখানেই দুর্বলতা ও নির্বীর্যতা বাসা বাঁধবে, আর জীবন তছনছ হয়ে যাবে। পরিবারের ক্ষেত্রে এটা যেমন সত্য তেমনি সত্য প্রতিষ্ঠান ও জাতীয় জীবনের ক্ষেত্রে। প্রয়োজনে বহু সংগঠন, বহু আন্জুমান ও প্রতিষ্ঠান হতে পারে। এটা জীবনের দাবী এবং জীবনের অনিবার্যতা। কিন্তু ঘরে ঘরে, এখানে ওখানে দল ও দলাদলি, এটা কিছুতেই ঠিক নয়, এটা উন্নতির লক্ষণ নয়, অবনতির অশুভ লক্ষণ।
তৃতীয় কথা এই যে, অধিকাংশ দুর্বলতা ও কমযোরি এবং বিবাদ-অনৈক্যের গোড়ায় যে বিষয়টা পাওয়া যায় তা হচ্ছে দুনিয়ার প্রতি মাত্রাছাড়া মুহব্বত এবং সীমাহীন সম্পদলিপ্সা ও যশলিপ্সা। আমি কারো প্রতি কিছু আরোপ করছি না, আমি শুধু সুন্নাতুল্লাহ্ বয়ান করছি যে, দুনিয়ার মোহ, সম্পদের লোভ, খ্যাতি ও সুখ্যাতির লিপ্সা, এগুলো কমযোরি ও দুর্বলতার অনেক বড় কারণ। বলা যায়, এগুলো ব্যক্তিকে, জাতি ও সম্প্রদায়কে ভিতর থেকে শেষ করে দেয়। যেখান থেকে আসুক, যেভাবেই আসুক, মাল আসা চাই; যে কোন মূল্যে, এমনকি সমষ্টির কল্যাণ ও জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে হলেও পদ ও সম্পদ চাই, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি চাই। সব ছাড়া যায়, সব কিছু ত্যগ করা যায়, কিন্তু এগুলো হাতছাড়া করা যায় না। এ ধরনের চিন্তা ও মানসিকতা অনেক গুরুতর বিমারি ও ব্যাধির আলামত, বড় ভয়ের কারণ। এর থেকে বাঁচতে হবে, সাধনা ও মুজাহাদার মাধ্যমে এ থেকে মুক্ত হতে হবে।
চতুর্থ বিষয় হলো সমাজ ও সভ্যতার যাবতীয় উপসর্গ, অপচয় ও অপব্যয়ের জীবনধারা; রীতি-রসমের প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং ‘কে কার চেয়ে উপরে’ তা নিয়ে দম্ভ, অহঙ্কার ও প্রতিযোগিতা। পুরো বিষয়টাকে কোরআন ‘তারাফ ও বাতার’, এ দুই শব্দে উল্লেখ করেছে। এরশাদ হয়েছে
وَمـا أرْسَـلْـنـا في قَـرْيَـةِ مِّـن نَّـذيرٍ إلا قـالَ مُـتْـرَفوها إنَّـا بِـما أرسِلْـتُـم بِـه كـفِـرون
যখনই কোন জনপদে কোন সর্তকারী আমি প্রেরণ করেছি, ওখানকার ‘সুখী-আয়েসী’ মানুষগুলো বলেছে, যে বার্তা ও বিধান দিয়ে তোমাদের প্রেরণ করা হয়েছে, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করছি। (সাবা, ২৪)
অন্যত্র এরশাদ হয়েছে
وَكَـمْ أهْـلَـكْـنـا مِـن قَـرْيَـةِمْ بَـطِـرَتْ مَـعِـيـشَـتُـها لَـمْ تُـسْكَـنمْ مِنمْ بَـعْـدهِـمْ إلاَّ قَـلِـيـلا ط وَكُـنَّـا نَـحْـنُ الوارِثِيـن
কত বস্তি আমরা হালাক করেছি, যেখানকার লোকেরা তাদের প্রাচুর্যের দম্ভ করতো। তো ঐ যে তাদের ঘরবাড়ী, যেগুলো তাদের পরে আবাদ হওয়ার খুব কমই সুযোগ হয়েছে। আর আমরাই সেগুলোর অধিকারী হয়েছি।
(কাছাছ, ৫৮)
তো আপনাদের কাছে আমার দরদভরা মিনতি, দোহাই আল্লাহ্র, সামাজিকতা ও রীতি রসমের ফুযূল খরচ যথাসম্ভব কম করুন। এমন যেন না হয় যে, খান্দানে বিয়েশাদি এভাবে, এমন জাঁকজমকের সঙ্গেই হয়ে এসেছে; খান্দানের ‘নাক’ তো বজায় রাখতে হবে! কিন্তু ভাই ও বন্ধুগণ! এখন এসব বেহুদা জিনিসের সময় নেই। পানি এখন মাথার উপর দিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। চোখ খুলুন, হুঁশে আসুন; সময়ের গতি-প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করুন। সমাজের গরীব তবকার কথা একটু ভাবুন, যাদের হাতে জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় উপকরণ পর্যন্ত নেই। এত বড় শ্রেণীবৈষম্য নিয়ে খুব বেশী দূর যাওয়া সম্ভব হবে না। যে কোন সময় পুরো সমাজব্যবস্থাই মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে পারে। কারণ এ অবস্থায় আল্লাহ্র সাহায্য আসে না; যতই যাহেরি দ্বীনদারি পালন করা হোক।
প্রসঙ্গত বলতে চাই, একটা বিষয় হলো চরিত্রের দৃঢ়তা এবং নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচলতা, এটা অবশ্যই থাকতে হবে। এমন কিছুতেই না যে, একেবারে পারদের মত হয়ে থাকবেন, বা মোমের মত গলে যাবেন। যখন বাতাস যেদিকে সেদিকে চলা শুরু হলো; যখন যেদিক থেকে ডাক এলো তাতেই সাড়া দেয়া হলো; না স্থিরতা, না অবিচলতা! এটাও ব্যক্তি ও জাতি, উভয়ের জন্যই ধ্বংস ও বরবাদির কারণ। জীবন ও চরিত্রে এবং নীতি ও কর্মে দৃঢ়তা অবিচলতা আনয়ন করুন।
এ বিষয়টা আমি সাধারণভাবে হিন্দুস্তানী মুসলমানদের বলি, এমনকি প্রয়োজন হলে আরবদেরও বলি; আরব-আজম সর্বত্রই বলি। আলহামদু লিল্লাহ্, আমার লেখায় তার প্রমাণ রয়েছে। যে সমস্ত বয়ান-বক্তব্যে আমি আরবদের সম্বোধন করেছি তার স্বতন্ত্র সঙ্কলন
العرب والإسلام নামে প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যেতে পারে। এটা আসলে সর্বব্যাপী ও সাধরণ এক ব্যাধি-বিমারি। প্রাচ্যের, এশিয়ার, বিশেষ করে আমাদের মুসলিম উম্মাহর।
তো একটা বিষয় তো হলো, ঈমান, আকীদা ও তাওহীদি বিশসের বিশুদ্ধায়ন; এটা অবশ্যই হতে হবে।
দ্বিতীয়ত এই যে, বিবাদ-সঙ্ঘাত, এই যে ঝগড়া-বিচ্ছেদ এটা অবশ্যই দূর করতে হবে। একতা, ঐক্য ও সম্প্রীতি, এটা অবশ্যই আমাদের জীবনে আসতে হবে।
তৃতীয়ত দুনিয়ার মুহব্বত এবং হুব্বে মাল ও হুব্বে জাহ- এর উপর কিছু সংযম, কিছু নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই আরোপ করা উচিত। হাদীছ শরীফে এসেছে এবং আমি মনে করি, এটি নবূয়তের ঐ সকল মু‘জিযার একটি যা হাদীছ-রূপে, নববী এরশাদ ও বাণীরূপে সংরক্ষিত রয়েছে। তিনি বলেছেন
حُـبُّ الدُّنْـيـا رأسُ كُـلِّ خَـطِـيـئَــة
দুনিয়ার মোহ-মুহব্বত সমস্ত পাপ ও বিচ্যুতির মূল।
জীবনের বিভিন্ন স্খলন ও পদস্খলন সম্পর্কে চিন্তা করে দেখুন, ঐ দুঃখজনক ঘটনাটা কেন ঘটেছে? কেন সে বিশসভঙ্গ করেছে? দু’জনের মধ্যে কেন সম্পর্কে অবনতি বা বিচ্ছেদ হয়েছে। এমন ভালো মানুষ এমন মন্দ মানুষের সঙ্গে কেন জোট বেঁধেছে? দেশের স্বার্থ, জাতির স্বার্থ কেন জলাঞ্জলি দিয়েছে? কেন এত নীচে নেমে বিবেকের সওদাবাজি করেছে?
যতই পর্যালোচনা করা হবে, দেখা যাবে, সবকিছুর গোড়ায় রয়েছে দুনিয়ার মোহ ও মুহব্বত, আর কিছু না।
আমাদের চরিত্রের আরেকটাদুর্বলতার কথা এখানে বলতে চাই। কারণ এটা মুসলিম সম্প্রদায়ের সাধারণ দুর্বলতা বলে মনে করা হয় এবং কোন কোন এলাকায় (বিশেষ কিছু কারণে) এটা বেশ উচ্চ মাত্রায় পাওয়া যায়। সেটা হলো প্রয়োজনের চেয়ে বেশী আবেগপ্রবণতা। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এর ক্ষতি হয়ত ব্যক্তি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু এটা যখন সামষ্টিক এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে শেকড় গেড়ে বসে; এটা যখন কোন দল বা সম্প্রদায়ের মেযাজ ও স্বভাবে পরিণত হয় তখন অপূরণীয় ক্ষতি ও খাসারার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি দল বা সম্প্রদায়ের ভরাডুবি ও অস্তিত্ব বিলুপ্তির মত অবস্থাও সৃষ্টি হয়ে যায়। বিভিন্ন মতলবী মহল এই আবেগপ্রবণতা থেকে গলদ ফায়দা হাছিল করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে। কোন নাদান দোস্ত এটাকে অবলম্বন করে ফায়দা পৌঁছাতে চায়, কিন্তু নিজের অজান্তেই চরম সর্বনাশ করে বসে। ইতিহাসের পাতায় আমরা বড় বড় যে সব জাতীয় বিপদ-দুর্যোগের ঘটনা দেখি, বহু ক্ষেত্রে এর পিছনে কারণ কিন্তু ছিলো এই নিয়ন্ত্রণহীন আবেগ-প্রবণতা এবং দপ করে জ¦লে ওঠার স্বভাব। কবি সত্যই বলেছেন
چوں از قومے یکے بے دانشی کرد
نہ کہ را عزتے ماند نہ مہ را
সম্প্রদায়ের কোন একজন যদি কোন বেকুবি করে বসে, বড় ছোট, বিশিষ্ট সাধারণ কারোই আর ইজ্জত থাকে না।
তদুপরি এই ‘বেকুবি’ যদি একদু’জন ব্যক্তির পক্ষ হতে না হয়ে দল, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের তরফ থেকে হয় তাহলে তো পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ ও সুদূর- প্রসারী হয়ে যায়।
আরবের প্রসিদ্ধ দার্শনিক কবি মুতানাব্বী এ বাস্তব সত্যকেই তুলে ধরেছেন এই কবিতা পংক্তিতে
وَجُـــرْمٍ جَـــرَّه سُـــفَـهـاءُ قَـــومٍ
فَـحَـلَّ بِـغَيْـرِ جـارمه العِـقـابُ
অনেক ভুল-অপরাধ করে তো সম্প্রদায়ের নির্বোধ লোকেরা/ কিন্তু সাজা নেমে আসে নিরপরাধের উপর।
আম মানুষ এটাকেই বোধ হয় বলে ‘গমের সঙ্গে ঘুণের পিষে যাওয়া।’
যে সমস্ত দল ও সম্প্রদায় জীবনের অঙ্গনে গৌরবময় কোন কর্ম ও কীর্তি সম্পন্ন করেছে, বা ইতিহাসের পাতায় যারা সভ্যতা ও সারাজ্যের ভিত্তিপুরুষরূপে বরিত হয়েছেন, অথবা দুনিয়াতে যারা দ্বীনে হকের ঝা- বুলন্দ করেছেন, স্বভাবের দিক থেকে তাঁরা উদার, সহনশীল ও প্রশান্তচিত্তরূপেই পরিচিত ছিলেন। সেই সঙ্গে তারা নির্ভীক, সাহসী এবং আত্মমর্যাদা বোধেরও অধিকারী ছিলেন। ‘ছদরে আওয়াল’ বা কল্যাণশতকের মুসলিমীন তো এর সর্বোত্তম নমুনা ছিলেন। একবার এক মজলিসে আমি বলেছিলাম, ‘একটু আগে আপনাদের এখানে উপস্থিত হওয়ার উদ্দেশ্যে যখন শহরে প্রবেশ করছি, দেখি, আমার গাড়ীর সামনে বড় এক ট্যাঙ্কার চলছে। তার পিছনে বড় বড় হরফে লেখা ছিলো
অতিদ্রুত আগুন ধরে, এমন দাহ্য পদার্থ!
আমি মনে মনে বললাম, এটা তেল-পেট্রোলের বা বারুদ-গন্ধকের পরিচয় তো হতে পারে, জীবন ও জগতের জন্য বার্তা বহনকারী মুসলিমের পরিচয় হতে পারে না, সামান্য সামান্য কারণেও যে দপ করে জ¦লে ওঠে এবং পরিণাম-পরিণতির পরোয়া না করেই যা ইচ্ছা তাই করে বসে। ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোন সঙ্গতি রক্ষা করে না। তিলকে তাল বানিয়ে ফেলে। শত্রু-মিত্র এবং দুর্বল-সবলের পার্থক্য পর্যন্ত বিবেচনা করে না। এই আবেগপ্রবণতা ও দপকরা স্বভাব বড় বিপজ্জনক ব্যাধি, অবিলম্বে যার চিকিৎসা হতে হবে। তা‘লীম, তারবিয়াত ও শিক্ষা-দীক্ষা, দ্বীনের দাওয়াত ও তাবলীগ এবং ইছলাহ ও সংস্কারের ময়দানে যারা কাজ করছেন; দা‘ঈয়ানে দ্বীন এবং আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ, এ বিষয়টার প্রতি এখনই তাদের মনোযোগ দেয়া উচিত।
হাযারাত! আমি অত্যন্ত প্রীত ও আনন্দিত যে, আমার কাশ্মীর সফরের এবং আমার নগণ্য বয়ান বক্তব্যের সমাপ্তি এমন এক স্থানে এবং এমন এক কেন্দ্র ও মারকাযে হচ্ছে, যার নামই হলো ‘নুছরাতে ইসলাম’। যেখান থেকে ইসলামের জন্য প্রজ্ঞাপূর্ণ, সুশৃঙ্খল এবং ইখলাছ ও আন্তরিকতাপূর্ণ মেহনত-প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে, যার ভিত্তি স্থাপন করেছেন আল্লাহ্র মুখলিছ বান্দা মাওলানা রাসূল শাহ ছাহেবের মত মহান ব্যক্তি। সত্যিকার অর্থেই এখানে ইসলামের নুছরাতের বুনিয়াদি কাজ হচ্ছে। আলামত দেখে মনে হচ্ছে, এই ‘নুছরাতবৃক্ষটি’ আল্লাহ্ কবুল করেছেন, ফুলদার, ফলদার ও ছায়াদার বানিয়েছেন, আলহামদু লিল্লাহ্! এ যেন কোরআনের সেই শাজারাতুন তাইয়েবা
كَـشَـجَـرَةٍ طَـيِّـبَـةٍ أصْـلُـهـا ثـابِتٌ وَفَــرْعُـها في السَّـمـاء؛ تُـؤْتِـي أكُـلَها كُـلَّ حِيـنِمْ بِـإذْنِ رَبِّـها
যেন এক উত্তম বৃক্ষশাজারাতুন তাইয়েবাহ্, যার শিকড় (মাটির গভীরে) প্রোথিত, আর শাখাপ্রশাখা ঊর্ধ্বে বিস্তৃত, আর নিজের ফল দান করে সর্বদা, নিজের প্রতিপালকের আদেশে।
(ইবরাহীম, ২৪ ২৫)
তো ভাই ও বন্ধুগণ, আপনাদের এ শাজারায়ে তাইয়েবাহ্, আগেও ফল দান করেছে, এখনো দান করছে, ইনশাআল্লাহ্ সামনেও দান করবে, করতে থাকবে। আপনাদের কাজ হলো এটিকে ‘পুষ্টি’ যোগানো, গোড়ায় পানি দেয়া; এর রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং সদা সতর্কথাকা, যেন কোনভাবে, কারো দ্বারা এর কোন ক্ষতি না হয়।
ব্যস, এখানেই আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি। আশা করি আমার কথা আপনাদের দিল দেমাগ এবং হৃদয় ও মস্তিষ্কে অবশ্যই সংরক্ষিত থাকবে এবং তাদের কাছেও পৌঁছবে যারা উম্মাহ্র নুছরাতের জন্য কিছু না কিছু করতে চায় এবং করতে পারে। তো সবাই যেন কমযোরি ও দুর্বলতার কারণ-উপকারণগুলো দূর করার চেষ্টা করি এবং আল্লাহর নুছরাত ও সাহায্য আসার শর্তগুলো পূরণ করি, অন্তত চেষ্টা করি, যার যার সাধ্যমত, যেন আল্লাহ্র রহমতের দরিয়ায় জোশ আসে এবং আল্লাহ্র নুছরাত ও সাহায্য নেমে আসে।
চিরকালের জন্য কোরআনের এ আশসবাণী ও সাবধানবাণী মনে রাখুন
إنْ يَـنْـصُـرْكُـمُ الله فَلا غـالِـبَ لَـكُـمْ، وَإن يَّـخْـذُلْـكُـمْ فَـمَـنْ ذا الذي يَـنْـصُـرُكُـمْ مِنمْ بَـعْـده ط وَعَـلَـى الله فَـلْـيَـتَـوكَّـلِ الـمُتَـوَكِّلُون
আল্লাহ্ যদি তোমাদের সাহায্য করেন তাহলে তোমাদের উপর জয়লাভকারী কেউ নেই। আর যদি তিনি তোমাদের ত্যাগ করেন তাহলে কে সে যে আল্লাহ্কে ডিঙ্গিয়ে তোমাদের সাহায্য করবে! আর মুমিনীন যেন আল্লাহ্রই উপর ভরসা ও তাওয়াক্কুল করে।
(আলে ইমরান, ১৬০)
পরিশেষে অন্তরের অন্তস্তল থেকে আপনাদের এ সম্মাননার শোকর আদায় করি, বিশেষ করে মাওলানা মুহম্মদ ফারূক ছাহেবের, তার সহকর্মীবৃন্দের এবং উপস্থিত সুধিবৃন্দের সাধারণভাবে শোকর আদায় করছি।
আল্লাহর দরবারে আমি নিজেও দু‘আ করছি, আপনারাও দু‘আ করুন, আমার এই হাযিরি, আমার এই চলা ফেরা এবং আমার এই কথা বলা যেন কবূলিয়াত লাভ করে। এখানে আমার এই যে, আটটা দিন অতিবাহিত হলো, এই যে এত দৌড়ঝাঁপ হলো এগুলো কিছুটা হলেও যেন সবার কাজে লাগে এবং আমারও উপকারে আসে। আমার এবং আপনাদের এখানে আসা, কথা বলা ও শোনা আল্লাহ্র কাছে যেন শরম ও পাকড়াও এর কারণ না হয়। আমীন।