কাশ্মীরের উপত্যকায় তাওহীদের প্রথম পায়গামএনেছেন যিনি!
কাশ্মীরে ইসলাম তলোয়ারের জোরে নয়, আধ্যাত্মিক শক্তি বলে।
(এই ভাষণ শ্রীনগর জামে মসজিদে জুমার আগে এক বিরাট মজমায় করা হয়েছে, যাতে শ্রীনগর ও তার আশপাশের বহু মুসলিম ও বিশিষ্টজন শরীক হয়েছেন। তারিখ, পয়লা মুর্হরম, ১৪০২ হি./৩০ শে অক্টোবর ১৯৮১ খৃ.
খোতবায়ে মাসনূনের পর; আম্মা বাদ!সম্মানিত হাযিরীন! আস্-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতু হ্আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনÑ‘কোন মানুষের জন্য এটা শোভন নয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে কিতাব, হিকমত ও নবুয়ত দান করবেন, আর তিনি মানুষকে বলে বেড়াবেন যে, তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে আমার বান্দা হয়ে যাও; বরং তিনি তো বলবেন, তোমরা রাব্বানী হয়ে যাও। এটা এজন্যও যে, তোমরা আসমানী কিতাব পড়াও এবং পড়ো। একই ভাবে তিনি তোমাদের এ আদেশ করতে পারেন না যে, ফিরেশতাদের এবং নবীদের তোমরা রবরূপে গ্রহণ করো। তিনি কি তোমাদের কুফুরের আদেশ করতে পারেন তোমাদের মুসলিম হওয়ার পরে!’ (৩/৭৯-৮০)
ভাই ও বন্ধুগণ! মুহতারাম মীরে ওয়াইয মাওলানা মুহম্মদ ফারূক ছাহেব যেমন বলেছেন, দীর্ঘ ছত্রিশ বছর পর আমি এখানে এসেছি। বয়স ও স্বাস্থ্য যে গতিতে পড়তির দিকে চলেছে সেদিক থেকে তো ভবিষ্যত সম্পর্কে নিশ্চয়তার সঙ্গে কিছু বলার উপায় নেই। সবকিছু সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আল্লাহ্র ইচ্ছা ও ফায়ছালার উপর। আজ থেকে কত বছর আগে, সেই ১৩৬৪ হিজরীর রামাযানে (আগস্ট, ১৯৪৯ খৃ.) যখন আমি এখানে এসেছিলাম, মীরে ওয়াইয হযরত মাওলানা ইউসুফ শাহ ছাহেব রহ. জীবদ্দশায় ছিলেন। আমি তাঁর মেহমান ছিলাম। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিলো হিন্দুস্তানে নয়া দিল্লীতে নিযামুদ্দীনের তাবলীগী মারকাযে এবং নদওয়াতুল উলামার শিক্ষাকেন্দ্রে। আজ যখন এখানে উপস্থিত হলাম, নিজের অজান্তেই ঐ দিনগুলো মনে পড়ে গেলো এবং ঐ সুন্দর স্মৃতিগুলো জাগ্রত হলো, যখন তিনি এই জামে মসজিদের মিম্বর থেকেই মানুষের মাঝে কোরআন ও হাদীছের মহামূল্যবান মণিমুক্তা বিতরণ করতেন। কল্পনার চোখে আজ তাঁর মুখচ্ছবি আমার সামনে জ¦লজ¦ল করছে। এবার যখন এলাম, তার আগেই তিনি আপন খালিক ও মালিকের সান্নিধ্যে চলে গিয়েছেন, যেখানে নিজ নিজ সময়ে আমরা সবাই যাবো। আল্লাহ্ তাঁর দরজা বুলন্দ করুন, আর আমাদের বর্তমান মীর ওয়াইয মাওলানা মুহম্মদ ফারূক ছাহেবের যিন্দেগিতে এবং ইলম ও আমলে অনেক উন্নতি দান করুন, আমীন।
ভাই ও বন্ধুগণ! যে মুসাফির এত দূর থেকে এত দীর্ঘ সময় পরে এসেছে, তদুপরি সামনে আবার কখনো যার ফিরে আসার নিশ্চিত কোন আশাও নেই, এমন গরীব মুসাফির আপনাদের খেদমতে কোন হাদিয়া ও তোহফা যদি পেশ করতে চায়, তাহলে কী হতে পারে সেই হাদিয়া ও তোহফা! এমন সময় তো মানুষ তার দিলকলিজা খুলে পেশ করতে চায়।এজন্য ভাই ও বন্ধুগণ! আমিও চাই, আমার কাছে মূল্যবান থেকে মূল্যবান যে তোহফা আছে তা আপনাদের সামনে আমার দিল-কলিজার স্থানে পেশ করি। তবে এটাও সত্য যে, আপনাদের সামনে যে তোহফা আমি পেশ করতে যাচ্ছি তা আমার নিজের মালিকানার কিছু নয়, আমার ঘরের কিছু নয়। ঐ তোহফা আমি অর্জন করেছি আল্লাহ্র পক্ষ হতে আল্লাহ্র কালামের মাধ্যমে। এই সম্পদ আমার আগেও যারা পেয়েছে, এখান থেকেই পেয়েছে; আমার পরেও কেয়ামত পর্যন্ত যারা পাবে, এখান থেকেই পাবে। তারপরো আমি বলতে পারি, এটা আমার সম্পদ, আমার আল্লাহ্র কাছ থেকে পাওয়া। যে যখন পাবে, অবশ্যই ভাবতে পারে, এটা তার সম্পদ। এটাকে আল্লাহ্ এমনি সার্বজনীন মালিকানার সম্পদ করে দিয়েছেন। কারণ হিদায়াতের উৎস তো একটি মাত্র, হক ও সত্যের এবং আলো ও নূরের কেন্দ্র তো অভিন্ন।তো কথা হলো, মানবজীবনের সবচে’ মূল্যবান সম্পদ, সবচে’ জরুরি পায়গাম, হক ও হিদায়াতের পায়গাম তোহফা হিসাবে আমি আপনাদের পেশ করতে চাই। আরো যদি সুনির্দিষ্টভাবে বলি, তাহলে ঈমানের যে শিক্ষা যুগ যুগ ধরে আমরা আমাদের মহান পূর্ববর্তীদের কাছ থেকে পেয়ে এসেছি তাই আপনাদের সামনে আমি দোহরাতে চাই, আবার নতুনভাবে তুলে ধরতে চাই।
এই তো কিছুক্ষণ আগে মীর ওয়াইয ছাহেব কয়েকটি পবিত্র ও বরকতপূর্ণ নাম উচ্চারণ করেছেন, তার মধ্যে একটি নাম হলো হযরত আমীর কবীর সৈয়দ আলী হামদানী রহ.। মুখে, জিহŸায় উচ্চারিত এমন পুণ্য¯œাত নাম সম্পর্কেই তো কবি বলেছেনÑزباں پہ بارخدایا یہ کس کا نام آیاکہ میرے نطق نے بوسہ میری زباں کے لئے আয় আল্লাহ্! মুখে এ কার পুণ্য নামের উচ্চারণ হলো!/ আমার ঠোঁট যে আমার জিহŸার চুম্বন পেতে চায়!হাঁ, আমাদের ইসলামের গৌরবময় ইতিহাসে এমন অসংখ্য পবিত্র ও বরকতপূর্ণ নাম আছে, যা এখনো যদি মুখে উচ্চারিত হয়, সারা মুখ যেন সুবাসিত হয়ে যায়, আর ঠোঁট যেন জিহŸাকে চুম্বন করে ধন্য হতে চায়। কাশ্মীরে ইসলামের যে গৌরবময় ইতিহাস তাতে হযরত আমীরে কাবীর সৈয়দ আলী হামদানী রহ. তেমনি একটি নূরানী, তেমনি একটি খোশবুদার নাম।হযরত আলী হামদানীর নূরানী সিলসিলার সঙ্গে এবং তাঁর ব্যক্তির সঙ্গে আমার বলতে গেলে পরিবারিক ও খান্দানি সম্পর্কও রয়েছে। তা এভাবে যে, তিনি এবং আমার মহান পূর্বপুরুষ আমীর কাবীর সৈয়দ কুতবুদ্দীন মুহম্মদ মাদানী রহ, একই সিলসিলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। হয়ত এ কারণেই এই মহান মানুষটির সঙ্গে আমি অন্যরকম একটি আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করি! আমার হৃদয় যেন তাঁর হৃদয়ের উষ্ণতা অনুভব করে। আচ্ছা, সে প্রসঙ্গ থাক। এখন আমি আপনাদের কাছে যে বিষয়টি জানতে চাই তা এই যে, বলুন তো, কোন্ সে জিনিস হযরত হামদানী রহ.কে সুদূর খাতলান থেকে এই কাশ্মীর-ভ‚মিতে টেনে এনেছিলো? এই সুন্দর উপত্যকার সবুজ সৌন্দর্য! ঝরণার জলতরঙ্গ! বিচিত্র ফুলের সুবাস! হিমালয়ের চ‚ড়ার উচ্চতা! এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আপনার জানা থাকতে হবে যে, যে অঞ্চল থেকে তিনি এসেছেন সেখানকার ভ‚মিও কম সুন্দর ছিলো না। সেখানেও ফল ছিলো, ফুল ছিলো, ঝরণার প্রবাহ ছিলো, এমনকি এত উঁচু না হলেও পাহাড়-পর্বত ছিলো। তাহলে কিসের টানে, কিসের আকর্ষণে, আপন জন্মভ‚মি ছেড়ে তিনি এখানে এসেছেন! কেন তিনি আপনাদের এমন করে ভালোবাসলেন যে, এ উপত্যকাই হলো তাঁর আখেরী আরামগাহ! আপনারাই বা তাকে কেন হৃদয় ও আত্মা উজাড় করে এমন ভালোবাসলেন, এখনো কেন তাঁকে আপনারা স্মরণ করেন! এখনো কেন তাঁর পুণ্যনাম উচ্চারণ করেন! কোথায় এর রহস্য যে, আজ এত শতাব্দী পরো তাঁর সঙ্গে হৃদয় ও আত্মার এমন গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক আপনারা অনুভব করেন! উদাহরণ তো অনেক আছে, তার একটি হলোÑ অজ্ঞ মূর্খের কাছে হীরকখÐ, আর কাঁচের টুকরোর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অবহেলায় দু’টোই সে ছুঁড়ে ফেলে। কিন্তু জহুরী! তার কাছে তো হীরকখÐ প্রাণের চেয়ে প্রিয়! কত যতেœর সঙ্গে সে তা সংরক্ষণ করে!আসলে উদাহরণ তো উদাহরণই! শুধু সত্যকে আমাদের বুঝের কাছাকাছি আনার চেষ্টা। নইলে কোথায় আল্লাহ্র প্রতি মুহব্বতের গায়রত, ঈমান ও বিশ^াসের প্রতি মুহব্বতের গায়রত, আর কোথায় কাঁচের তুলনায় হীরকখÐের প্রতি মুহব্বতের গায়রত!আবার বাগানের দরদী মালীকে দেখুন! এক একটি ফুলের প্রতি তার কী যতœ, কী দরদ মায়া! কী সতর্কতা, যেন পোকায় না কেটে ফেলে!বুলবুলকে জিজ্ঞাসা করুন ফুলের কথা, প্যরওয়ানাকে জিজ্ঞাসা করুন মোমের আলোর কথা! প্রেমিককে জিজ্ঞাসা করুন প্রেমাস্পদ সম্পর্কে তার উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার কথা! প্রেমাস্পদের প্রতি যদি কারো পক্ষ হতে সামান্য থেকে সামান্য অনাদর বা অবহেলা প্রকাশ পায়, কেমন ভাবে জ¦লে ওঠে তার গায়রত ও আত্মমর্যাদা! প্রেমাস্পদের জন্য এমনকি প্রাণ বিসর্জন দেয়াও যেন আনন্দের বিষয়। তো মেরে ভাই, যারা আল্লাহ্র প্রেরিত পুরুষ, মহান নবী ও রাসূল! যারা ছাহাবা কেরামের নূরানী জামাত, যারা আল্লাহ্র মা’রিফাত ও পরিচয়ধন্য পুণ্যাত্মা আওলিয়া তাঁদের জিজ্ঞাসা করুন, আল্লাহ্র প্রতি কেমন তাঁদের প্রেম! ঈমান ও তাওহীদের প্রতি কেমন তাদের গায়রাত! কোন শক্তি নেই, কোন উপায় উপকরণ নেই, তবু ঈমান ও তাওহীদের জন্য সারা দুনিয়ার সকল তাগুতি শক্তির সঙ্গে লড়াই করার জন্য এবং জান দেয়ার জন্য তৈয়ার! যেমন হাদীছ শরীফে এসেছেÑঈমানের সম্পদ হাছিল করার পর কুফুরের দিকে ফিরে যাওয়া তার জন্য এমনই কঠিন যেমন আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া। পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো হলেন ঈমান ও তাওহীদের সবচে’ বড় রক্ষক ও আমানতদার, সবচে’ বড় দা‘ঈ ও মুবাল্লিগ! এবং ঈমান ও তাওহীদের মর্ম ও হকীকত সম্পকে সবচে’ বড় অন্তর্জ্ঞানী! এ তো আসমান থেকে তাঁরই বহন করে আনা সম্পদ, যা বহু শতাব্দী ধরে মানুষের সমাজে এবং মানুষের জনপদে বণ্টিত হয়ে চলেছে। কেয়ামত পর্যন্ত তাঁর পক্ষ হতে বণ্টিত হতেই থাকবে। আল্লাহ্র দয়া ও রহমতে আমাদের আঁচলেও আজ সেই মহাসম্পদ বিদ্যমান! আল্লাহ্ করুন, ঈমান ও তাওহীদের প্রতি তাঁর যে মুহব্বত, তাঁর যে গায়রাত, তার ছিটেফোঁটাও যেন আমাদের মত উম্মতীর নছীবে এসে যায়! (তাঁর প্রতি আমার জান কোরবান) তিনিই তো আল্লাহ্কে সবচে’ বেশী জানেন চেনেন! আল্লাহ্র পরিচয় ও মা‘রিফাত তাঁর চেয়ে বেশী তো পৃথিবীতে কারো নয়! আল্লাহ্র প্রতি ইশক ও মুহব্বত এবং প্রেম ও ভালোবাসার ক্ষেত্রে তিনিই তো সবার আগে, সবার উপরে! আল্লাহ্র জন্য নিজেকে কোরবান করার ক্ষেত্রে, তিনিই তো ইবরাহীমী ও ইসমাঈলী কোরবানির সর্বোচ্চ নমুনা! তাই দেখুন, ঈমান ও তাওহীদের প্রতি তাঁর গায়রাতের অবস্থা ছিলো এই যে, জনৈক ছাহাবী তাঁর তখনকার বুঝমত শুধু বলেছিলেনÑمَـنْ يُـطِـعِ اللهَ ورسـولـه فَـقَـدْ رشـد؛ وَمَـنْ يَـعْـصِـعِـهِـما فـقـد غَـوَىযে আল্লাহ্ ও তার রাসূলকে মান্য করবে সে তো সুপথ লাভ করলো, আর যে তাদের (দু’জনের) নাফরমানি করবে সে ভ্রষ্ট হবে।আল্লাহ্র নবী যেন তা বরদাশত করতে পারলেন না! সঙ্গে সঙ্গে কঠোর তিরস্কার করে বললেনÑبِـئْـسَ الـخَـطِـيـبُ أنْـتَ! قُـلْ وَمَـنْ يَـعْـصِ اللهَ وَرَسـولَـهতুমি তো বড় মন্দ খতীব! তোমার তো কথা বলার সালীকা ও রুচি নেই! এভাবে বলো, আর যে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করবে সে ভ্রষ্ট হবে। অন্যঘটনায় কোন ছাহাবী বললেনÑمَـا شـاءَ اللهُ وَشِـئْـتَযদি আল্লাহ্ চান এবং আপনি চান! তাঁকেও তিরস্কার করে আল্লাহ্র পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনÑجَـعَـلْـتَـنِي واللهَ عَـدْلًا، بَـلْ مـا شـاءَ اللهُ وَحْـدَهতুমি তো আমাকে আল্লাহ্র সমস্তরে নিয়ে এলে! বরং বলো, যদি আল্লাহ্ একা চান!ঈমান ও তাওহীদের বিষয়ে এই হলো গায়রাতে নবী এবং নববী চেতনা! এর কিছু না কিছু ছায়াপাত আমাদের জীবনে তো অবশ্যই হতে হবে।একজন সাচ্চা আশিক ও সত্য প্রেমিক প্রেমাস্পদের প্রতি যত বেশী ইশক ও মুহব্বত এবং প্রেম ও ভালোবাসা ধারণ করবে তার গায়রাত ও আত্মমর্যাদাবোধও সেই পরিমাণ নাযুক ও সংবেদনশীল হবে। গায়রাত হলো ইশক ও মুহব্বতের অনুগামী! গায়রাত হলো জ্ঞান ও পরিচয়ের অনুগামী! গায়রাত হলো সম্পর্কের গভীরতা ও এককতার অনুগামী!উদাহরণ বলি, আর যাই বলি, আদবের তো খেলাফ! কিন্তু আমাদের মজবূরি এই যে, আল্লাহ্র বিষয়ে, ঈমান ও তাওহীদের বিষয়ে কাকে বলে গায়রাত এবং কী এর হাকীকত, তা কিছুটা হলেও বোঝার জন্য এর চে’ উপযুক্ত উদাহরণ আমাদের কাছে নেই। দেখুন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কত নাযুক ও সংবেদনশীল! কত হৃদ্যতা ও নিষ্ঠার উপর নির্ভরশীল। একদিকে স্ত্রীর জন্য স্বামীর চেয়ে আপন যেমন কেউ নেই, তেমনি অন্যদিকে স্বামীর জন্য স্ত্রীর চেয়ে আপন কেউ নেই। এখন দেখুন স্ত্রীর বিষয়ে স্বামীর গায়রাত এবং স্বামীর বিষয়ে স্ত্রীর গায়রাত কেমন, কত কঠিন! স্বামী, যদি ভদ্র, অভিজাত ও শরীফ হয়, সঠিক অর্থেই যদি পুরুষ হয় এবং মরদ হয়, তাহলে সে কিছুতেই বরদাশত করতে পারে না যে, তার স্ত্রীর উপর কারো ছায়াও পড়ে, অন্য কারো দিকে তার সামান্য ঝোঁক প্রকাশ পায়; স্ত্রী হয়ত দুর্বল, অবলা, তাই কিছু করার শক্তি তার নেই, কিন্তু সত্য এই যে, স্বামীর বিষয়ে তার গায়রাত আরো কঠিন, আরো ভয়ানক!এবার আসুন হযরত আমীর কাবীর সৈয়দ আলী হামদানী রহ. সম্পর্কে। তিনি যেহেতু ওলিয়ে কামিল ছিলেন; আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের সাচ্চা আশিক ও আত্মনিবেদিত প্রেমিক ছিলেন, যেহেতু তার অন্তরে আল্লাহ্র পরিচয় ও মা’রিফাত ছিলো অতি উচ্চ স্তরের, সেহেতু ঈমান ও তাওহীদের বিষয়ে তাঁর গায়রাত ও আত্মমর্যাদাও ছিলো অতি উচ্চ স্তরের। এমন গায়রাত নিঃসন্দেহে লাখ লাখ কোটি কোটি মানুষের মধ্যেও হয়ত পাওয়া যাবে না। তিনি যখন শুনলেন, কাশ্মীর নামের এক বিশাল বিস্তৃত উপত্যকা রয়েছে, মানুষ যেখানে আল্লাহ্কে চেনে না, আল্লাহ্র পরিচয় জানে না। যিনি বিশ^জাহানের একমাত্র ¯্রষ্টা, একমাত্র প্রতিপালক, যিনি ওয়াহদাহূ লা-শরীকা লাহূ ওখানে সেই আল্লাহ্র ইবাদত হয় না, বরং আল্লাহ্ ছাড়া বহু দেবদেবী ও পাথরে গড়া মূর্তির পূজা হয়। মানুষ জানে না, কে তার ¯্রষ্টা! কে তার প্রতিপালক! কে তার ইবাদত ও আনুগত্যের একমাত্র হকদার?পথভোলা মানুষ সৃষ্টি ও প্রকৃতির যা কিছুর মধ্যে সামান্য শক্তির প্রকাশ দেখে, সামান্য সৌন্দর্যের উদ্ভাস দেখে এবং উপকার ও ক্ষতি করার সামান্য যোগ্যতার পরিচয় পায় তার সামনেই মাথা নত করে, তাকেই বিভিন্ন নামে উপাস্যের মর্যাদা দেয়। ...আমার ধারণা, সৈয়দ আলী হামদানী রহ. যদি সেই সুদূর খাতলান থেকে এখানে, এই সবুজ উপত্যকায় না আসতেন তাহলে হয়ত আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে তিনি কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতেন না। কারণ ঐ এলাকা থেকে এই উপত্যকা পর্যন্ত, মাঝখানের বিস্তীর্ণ ভ‚খÐে দ্বীনের বড় বড় আধ্যাত্মিক কেন্দ্র ও রূহানী মারকায ছিলো। হিমালয়ের পাদদেশে পুরা হিন্দুস্তান পড়ে ছিলো, যেখানে হাযার হাযার আলিম ছিলেন, শত শত দ্বীনী মাদরাসা ও খানকাহ্ ছিলো। এ সবকিছু পার হয়ে, এগুলোকে ডিঙ্গিয়ে তাঁর উপর দায়দায়িত্ব আরোপিত হওয়ার কথা তো ছিলো না। একটা কথাই শুধু ছিলো, বুলন্দ হিম্মত ও সুউচ্চ মনোবলের অধিকারী আল্লাহ্র বান্দারা কখনো দেখেন না যে, দায়দায়িত্ব তার একার, না অন্যদেরও! বরং দূরের বা কাছের যে কোন দায়িত্বকে তিনি মনে করেন, তাঁর একার দায়িত্ব। এজন্য, সবার আগে তিনিই আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের কাছে জবাবদেহির সম্মুখীন। আপনজনেরা তাঁকে হাযার বাধা দিক, যত প্রতিক‚লতা সামনে আসুক, মরুভ‚মি ও পাহাড়-পর্বত প্রতিবন্ধক হোক, তিনি কোন পরোয়া করেন না। যেন কোন আসামানি আওয়ায, কোন ঐশী ডাক তিনি শুনতে পেয়েছেন যে, হামদানী, তুমি কাশ্মীরের উপত্যকায় যাও! আমার পথভোলা বান্দাদের তাওহীদের পথ দেখাও! বিস্তীর্ণ উপত্যকায় হক ও সত্যের ছায়াবিস্তার করো!আমার বিশ^াস, সৈয়দ আলী হামদানী রহ.র অন্তরে একটা তড়প, একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিলো! তিনি স্পষ্ট অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, ময়দানে হাশর কায়েম হয়েছে, আল্লাহ্র আরশ নেমে এসেছে, খালকে খোদা ভয়ে কম্পমান, আর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে, বলো হে হামদানী! তুমি তো জানতে যে, আমার যমীনের একটি উপত্যকায় শিরকের অপ্রতিহত প্রভাব ছিলো! গায়রুল্লাহ্র, সৃষ্টির বিভিন্ন বাতিল শক্তির পূজা চলছিলো, মানুষ যেখানে আল্লাহ্র পরিবর্তে অন্য-কিছুর এবং অন্যকারো সামনে ভিক্ষার হাত পাতে! বলো হামদানী, তোমার ঈমানি গায়রাত এটা কীভাবে বরদাশত করলো? সৈয়দ আলী কাবীর হামদানী রহ.র সামনে যেহেতু কল্পনার এ কঠিন দৃশ্য ছিলো সেহেতু তখনকার সমস্ত আলিম ও আহলে ইলম এবং রূহানী ব্যক্তি ও আধ্যত্মিক পুরুষ একত্র হয়েও যদি তাঁকে বোঝাতেন যে, হযরত, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন! নিজের এলাকায়, আপনজনদের মধ্যেই দ্বীনের কাজ করুন, এত দূরের আনজান ও আজনবী মানুষদের সম্পর্কে আপনাকে প্রশ্ন করা হবে না। আমার বিশ^াস, তিনি তাঁদের ছাফ ছাফ বলে দিতেন, আমার ঈমানি গায়রাত, আমার তাওহীদী জোশ এটা কিছুতেই বরদাশত করতে পারে না যে, আল্লাহ্র বিশাল বিস্তৃত এ ভ‚খÐের কোন অঞ্চলে, কোন উপত্যকায়, কোথাও আল্লাহ্র পরিবর্তে গায়রুল্লাহ্র পূজা হবে! দেবদেবী ও মূর্তি-প্রতিমার রাজত্ব হবে!আমি যদি জানতে পারি, উত্তর মেরুতে, দক্ষিণ মেরুতে, বা হিমালয়ের চ‚ড়ায় একজনও ‘আদমযাদ’ এমন আছে যে, আল্লাহ্র পরিবর্তে গায়রুল্লাহ্র পূজা-উপাসনা করে! গায়রুল্লাহ্র আনুগত্য করে! গায়রুল্লাহ্র রাজত্ব স্বীকার করে এবং আল্লাহ্র পরিবর্তে গায়রুল্লাহ্কে লাভ-ক্ষতি ও কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক বলে বিশ^াস করে তাহলে সবার আগে আমার কর্তব্য হবে, পথের সমস্ত বাধা ও প্রতিক‚লতা অতিক্রম করে সেখানে পৌঁছা এবং মানুষের সামনে আল্লাহ্র পরিচয় তুলে ধরা, ঈমান ও তাওহীদের পায়গাম তাদের কাছে পৌঁছে দেয়া।ছোট বড় যত শক্তি ও তাগূত সেখানে থাক না কেন, তাদের সামনে নির্ভয়ে আমি এ ঘোষণা দেবোÑألا لَـهُ الـخَـلْـقُ وَالأمْـرُশোনো, আল্লাহ্রই কর্ম সৃষ্টি করা এবং (আল্লাহ্রই কর্ম) পরিচালনা করা (এবং নিরঙ্কুশ রাজত্ব করা)। এমন কিছুতেই হতে পারে না যে, সৃষ্টি তো করবেন আল্লাহ্, কিন্তু হুকুম ও রাজত্ব চলবে অন্যকারো, অন্যকিছুর। এমন কিছুতেই নয় যে, এ বিশ^জাহান, এই মানব -জাতি সৃষ্টি করার পর, রাজত্ব তিনি অন্যকারো হাওয়ালা করে দিয়েছেন যে, সৃষ্টি তো আমি করেছি, এখন পরিচালনা তুমি করো, তোমার ইচ্ছামত শাসন করো, রাজত্ব করো।না, ¯্রষ্টাও তিনি, খালিক ও মালিকও তিনি, প্রতিপালক ও পরিচালকও তিনি!
তাজমহল বানিয়েছেন কে? শাহজাহান বাদশাহ! এখন তাজমহলের উপর কার অধিকার! অন্যমানুষের, অন্যশাসকের! এই দুনিয়া কিন্তু তাজমহল নয়, কুতুবমিনার নয়! এই সৃষ্টিজগত ও কুলজাহান কোন প্রতœতাত্তি¡ক সম্পদ নয়, কোন জাদুঘর নয়! এটা আল্লাহ্র একার পয়দা করা দুনিয়া। পুরা জাহানের সমস্ত নেযাম একমাত্র তাঁরই কুদরতের নিয়ন্ত্রণে। সামান্য থেকে সামান্য কোন বিষয়ও তিনি কারো হাওয়ালা করেননি। وَسِعَ كُرْسِـيُّه السموات والأرضতাঁর রাজত্ব, কুদরত ও নিয়ন্ত্রণ আসমান-যমীন সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে। সামান্য পৃথিবীর এই গ্রহ ও তার বাসিন্দারা আর কী! সমস্ত গ্রহ-উপগ্রহ, সমস্ত সৌরজগত, সমস্ত নিহারিকা ও ছায়াপথ, এককথায়, এ মহাবিশে^র ‘র্যারা থেকে র্কোরা’ সবকিছু তাঁর কুদরতের একক নিয়ন্ত্রণে। বিশ^জগতের সমস্ত সৃষ্টির মত মানুষেরও কর্তব্য শুধু এবং শুধু তাঁরই ইবাদত করা, তাঁরই আনুগত্য করা এবং তাঁরই কাছে সাহায্য চাওয়া। তো একই কথা আবার বলছি, হযরত আলী কাবীর সৈয়দ হামদানী রহ.কে যে জিনিস এখানে, কাশ্মীরের উপত্যকায় টেনে এনেছে তা আর কিছু নয়, শুধু এবং শুধু তার দিলের ঈমানী উত্তাপ ও তাওহীদী গায়রাত। তারপর এ সত্য আপনারা অবশ্যই মনে রাখবেন যে, এই সুন্দর ভ‚খÐকে তিনি শক্তির বলে, বা তলোয়ারের জোরে জয় করেননি! শক্তি ও তলোয়ার তো তাঁর ছিলোই না! এই পুরো ভ‚খÐ তিনি প্রেম ও ভালোবাসার শক্তিতে জয় করেছেন, রূহানিয়াত ও আধ্যাত্মিকতার বলে জয় করেছেন, ইনসানিয়াত ও মানবতার প্রতি দরদ-ব্যথা দ্বারা জয় করেছেন। ওলামায়ে আরবের মজলিসে, আরব বিদ্বানদের সভায়ও আমি একথা বলেছি যে, কেউ কি ধারণাও করতে পারে এই মহান মানুষটির রূহানী তাকত ও আধ্যাত্মিক শক্তির যে, মাত্র তিন -বার তিনি এ উপত্যকা সফর করলেন, আর পুরো অঞ্চল, পুরো উপত্যকা ইসলামের শান্তি ও নিরাপত্তার শীতল ছায়াতলে এসে গেলো! ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, কাশ্মীর উপত্যকায় তিনি তিনটি সফর করেছিলেন। প্রথম সফরটি ছিলো, অল্প সময়ের জন্য এবং পর্যবেক্ষণের জন্য। দ্বিতীয় সফরটি ছিলো তুলনামূলক দীর্ঘ সময়ের জন্য এবং দাওয়াতের বুনিয়াদ রাখার জন্য। তৃতীয় সফরে তিনি উপত্যকার ঘরে ঘরে, মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছেন এবং সবার কানে আল্লাহ্র পায়গাম এবং ঈমান ও তাওহীদের আওয়ায পৌঁছে দিয়েছেন।কল্পনা করুন, আল্লাহ্র এক বান্দা কয়েকজন মাত্র সঙ্গী-সাথী নিয়ে এলেন, না আছে সহায় সম্বল, না ধনসম্পদ, আর না জাগতিক কোন শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা! অথচ দেখতে দেখতে পুরো উপত্যকা ইসলামের শান্তি ও নিরাপত্তার ছায়াতলে এসে গেলো! ঈমান ও তাওহীদের অপ্রতিহত প্রভাব বিস্তার লাভ করলো! আল্লাহ্র দয়া ও অনুগ্রহে আজো তা মুসলিম জনপদরূপেই টিকে আছে। ঈমানের তাপ ও উত্তাপ এবং তাওহীদের অপ্রতিহত প্রতাপ আজো মানুষের দিলের জাহানে বিদ্যমান রয়েছে। দুনিয়ার কোন শক্তি, কোন তাগূত তাওহীদের এ আমানতকে তাদের থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে না। খালিক ও মাখলূক এবং আব্দ ও মা‘বূদের মাঝে যে অটুট বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে, কেউ তা বিচ্ছিন্ন করতে পারে না।
তো ভাই ও বন্ধুগণ! মনে রেখো, এ সুন্দর উপত্যকার কোথাও যদি শিরকের কোন প্রকাশ ঘটে, গায়রুল্লাহ্র পূজা-আনুগত্যের ছায়া পর্যন্ত পড়ে; মাজারে, দরগায় কেউ যদি সন্তান চায়, হাজাত ও প্রয়োজনের জন্য হস্ত প্রসারিত করে তাহলে সৈয়দ হামদানী রহ., তোমাদের ভালোবেসে, তোমাদের নাজাত ও মুক্তির জন্য এবং তোমাদের ঈমান ও তাওহীদের জন্য যিনি নিজের বাড়ীঘর ছেড়ে, আপনজনদের ত্যাগ করে এখানে এত দূরের অঞ্চলে এসেছিলেন, কবরে তাঁর রূহ, তাঁর আত্মা অবশ্যই কষ্ট পাবে, যন্ত্রণায় ছটফট করবে, আর কেয়ামতের দিন তোমাদের নামে আল্লাহ্র দরবারে তিনি নালিশ জানাবেন। কেয়ামত অবশ্যই আসবে! হাশর ও বিচার অবশ্যই কায়েম হবে! তখন কী উপায় হবে আমাদের, যদি আল্লাহ্র সামনে ‘র্সুখ রো’ এবং উদ্ভাসিতমুখ না হতে পারি!এতক্ষণ ঈমান ও তাওহীদের যে গায়রাতের কথা বলা হলো, তার একটি নমুনা কোরআন থেকে এখানে পেশ করতে চাই। বনী ইসরাঈলের নবী হযরত ইয়াক‚ব আ. তাঁর শেষ সময় যখন ঘনিয়ে এলো তখন তিনি না নিজের কোন ফিকির করলেন, না মৃত্যু-যন্ত্রণায় কাতর হলেন, আর না সন্তানপরিজনের দুনিয়ার কোন চিন্তা করলেন। শুধু চিন্তা করলেন তাদের আখেরাতের কথা, তাদের ঈমান ও তাওহীদের কথা! পরিবারের সবাইকে, ছেলে মেয়ে নাতি পুতি সবাইকে একত্র করে অস্থির চিত্তে ও ব্যাকুল কণ্ঠে তিনি জিজ্ঞাসা করলেনÑمَـا تَـعْـبُـدُونَ مِـنْ بَـعْـدِي؟আল্লাহ্র ওয়াস্তে আমাকে একটু আশ^স্ত করো, আমাকে জানাও, আমার মৃত্যুর পর, আমার অবর্তমানে তোমরা কার, কিসের ইবাদত করবে, কার সামনে হাত পাতবে, কার সামনে মাথা নত করবে?قَـالُـوا نَـعْـبُـدُ إلـهَكَ وإلهَ آبـائِكَ إبْـرهيـمَ واسْـمـعيـلَ وَإسْحقَ إلـهًا واحِـدًا وَنَـحْـنُ لَـه مُـسْـلِـمُـونَপূর্ণ দৃঢ়তার সঙ্গে সমস্বরে তারা বললো, নিশ্চিন্ত থাকুন, আমরা ইবাদত করবো একমাত্র আপনার উপাস্য, আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম, ইসমা‘ঈল ও ইসহাকের উপাস্য আল্লাহ্র, যিনি এক ও একক উপাস্য, যার কোন শরীক নাই, আর আমরা একমাত্র তাঁরই হুকুম মান্য করবো।তাদের মনের ভাষা ছিলো যেন এমনÑ আব্বাজান, নানাজান, দাদাজান আপনার মনে কিসের দুশ্চিন্তা উৎকণ্ঠা, আপনার মুখে কেন এ প্রশ্ন! শৈশব থেকে আপনি আমাদের যে তারবিয়াত করেছেন এবং দিলের নরম যমীনে ঈমান ও তাওহীদের যে বীজ বপন করেছেন তা থেকে তো আমরা বিচ্যুত হতে পারি না, কিছুতেই না! আমরা তো আপনার উপাস্য এক আল্লাহ্রই ইবাদত করবো, আনুগত্য করবো, যার ইবাদত ও আনুগত্য করেছেন ইবরাহীম, ইসমা‘ঈল ও ইসহাক। তখন হযরত ইয়াকূব আ.র ইতমিনান হলো, আস্বস্তি হলো, আর তিনি খুশি খুশি দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। এই যে আওলিয়ায় কেরাম, এই যে দা‘ঈয়ানে ইসলাম, ঈমান ও তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে যারা দুনিয়ার দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন তাঁরা তো এই সব নবী-পয়গম্বরেরই উত্তরাধিকারী। সুতরাং তাঁদেরও দিলে, এমনকি মাউতের সময় শুধু এ চিন্তা ও দুশ্চিন্তাই খচখচ করে বিঁধতে থাকে যে, আমার পরে, আমার অবর্তমানে কী হবে? আমার পরবর্তীরা শয়তানের ধোকায় তো এসে যাবে না! শিরকের মায়াজালে তো ফেঁসে যাবে না, যেমন বহু খান্দান, বহু জনপদের অবস্থা হয়েছে তাদের প্রাণপুরুষদের অবর্তমানে!
ভাই ও বন্ধুগণ! অবাক হওয়ার কিছু নেই, যদি সৈয়দ হামদানী রহ.র পাক রূহ, কবরে আপনাদের চিন্তায় অস্থির থাকে, তড়পাতে থাকে যে, কখন কোন অশুভমুহূর্তে তাওহীদের সরল পথ থেকে এ উপত্যকার মানুষ বিচ্যুত না হয়ে পড়ে! শিরকের মোহজালে আটকা না পড়ে! আল্লাহ্র ওয়াস্তে সাবধান হও! আল্লাহ্র ওয়াস্তে সাবধান থেকো!
ভাই ও বন্ধুগণ! যাকিছু আরয করা হলো, তা দিলের কানে শুনুন এবং আমল করুন। কাশ্মীরের এ উপত্যকার জন্য সৈয়দ আমীর কাবীর আলী হামদানী ও তাঁর অনুগামীগণ আপনাদের জন্য যে তোহফা ও পায়গাম নিয়ে এসেছিলেন আসলে তা ছিলো ঈমান ও তাওহীদের অমূল্য সম্পদ। বুকের সঙ্গে, সিনার সঙ্গে তা লাগিয়ে রাখুন। একমাত্র আল্লাহ্কে মনে করুন বিশ^জাহানের মালিক, ব্যক্তি ও জাতির উত্থান-পতনের একমাত্র নিয়ন্তা। একমাত্র তাঁরই সামনে মাথা নত করুন, একমাত্র তাঁরই আনুগত্য করুন। এটাই হলো আবাদী পায়গাম, সেই চিরন্তন বাণী যা আল্লাহ্র প্রেরিত নবী-রাসূল দুনিয়াতে নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ্র প্রিয় অলী-বুযুর্গান জনপদে জনপদে যা শুনিয়েছেন। মহান মুজাদ্দিদ ও সংস্কারকগণ যার জন্য, ‘আন্থক’ মেহনত ও সাধনা-মোজাহাদা করেছেন। এখন কোন জাতি ও জনপদ যদি সফলতা ও কামিয়াবি পেতে চায়, ফাতাহ ও বিজয় অর্জন করতে চায়, ইয্যত ও মর্যাদা লাভ করতে চায় তাহলে এটাই তার একমাত্র পথ, একমাত্র উপায়; শুধু এবং শুধু আল্লাহ্র প্রতি অনুগত থাকা, ঈমান ও তাওহীদের প্রতি বিশ^স্ত থাকা। তাঁরই সামনে হাত পাতা, তাঁরই সামনে মাথা নত করা। কোরআনের সতর্কবাণী শুনুনÑবাছুরকে যারা (উপাস্য) বানিয়েছে, তাদের প্রতিপালক (আল্লাহ্)র পক্ষ হতে গযব এবং দুনিয়ার যিন্দেগির যিল্লত অবশ্যই তাদের পাকড়াও করবে। আর এভাবেই আমি অপরাধীদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। হতে পারে যে, কোন জনপদের মানুষ বলবে, এটা তো বনী ইসরাঈলের নির্বুদ্ধিতা যে, তারা বাছুরপূজায় মেতে ছিলো! আমরা এমন নির্বোধের মত কাজ কবে করলাম, কীভাবে করতে পারি! তাওবা তাওবা!কিন্তু এখানে শেষ বাক্যটি দিয়ে আল্লাহ্ শেষকথা বলে দিয়েছেন যে, শুধু বাছুরপূজা নয়, শুধু মূর্তিপূজা নয়, বরং শিরকের যাবতীয় পথ ও পন্থাই হলো আযাব-গযবের কারণ। শিরকের যত প্রকার আছে, সবকিছুর বুনিয়াদই হলো মনগড়া অপবাদ, ভিত্তিহীন কথা ও কাহিনী। এজন্যই শিরকের প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেছেনÑفَـاجْـتَـنِـبُـوا الرِّجْسَ مِـنَ الأَوْثانِ وَاجْـتَـنِـبوا قَـولَ الزُّورমূর্তির নাজাসাত ও গান্দেগি থেকে বেঁচে থাকো, আর বেঁচে থাকো মিথ্যা কথা (ও মনগড়া কল্পকাহিনী) থেকে। কোরআনে শিরককে আল্লাহ্ তা‘আলা ‘কঠিন অপবাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেনÑوَمَـنْ يُـشْـرِكْ بِـاللهِ فَـقَـدِ افْـتَـرى إثْـمًـا عَـظيـمًـاআর যে কেউ আল্লাহ্র সঙ্গে (কোন প্রকার) শিরক করবে সে তো আসলে (আল্লাহ্র নামে) কঠিন আপবাদই আরোপ করলো!সুতরাং শিরক থেকে যদি দূরে থাকতে হয়, শিরক থেকে যদি বেঁচে থাকতে হয় তাহলে আল্লাহ্র নামে যতপ্রকার অপবাদ আছে তা থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল যাকিছু বলেননি, তা শরী‘আতের নামে যুক্ত করা মানেই হলো আল্লাহ্র নামে অপবাদ আরোপ করা।আমি এখন এই মিম্বর থেকে আপনাদের খেতাব করছি, যা মিম্বরে রাসূলের প্রতিনিধি, মসজিদে নববীর মিম্বারের স্মারক, সুতরাং এই মিম্বারের (এবং দুনিয়ার সমস্ত মসজিদের মিম্বারের) মর্যাদা অত্যন্ত উঁচুতে। এখান থেকে যাকিছু বলা হয়, পূর্ণ দায়িত্ববোধ ও সচেতনতার সঙ্গে বলা কর্তব্য। তো এই দায়দায়িত্বের পূর্ণ সচেতনতার সঙ্গেই আমি আপনাদের বলছি, আর এই শেষকথা বলেই আমি বিদায় নিচ্ছি, আপনাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, আপনাদের সমস্ত দুঃখকষ্টের কুয়াসা কেটে যাবে এবং সমস্ত বিপদ-মুছীবত কর্পুরের মত উবে যাবে, যদি আপনারা তাওহীদের আঁচল দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেন এবং জীবনের প্রতিটি কাজে কর্মে তাওহীদের উপর অবিচল থাকেন, আর শিরকের যত প্রকাশক্ষেত্র আছে তা থেকে দূরে থাকেন। পক্ষান্তরে যদি নির্ভেজাল তাওহীদ এ উপত্যকার জীবনে না আসে এবং শিরকের যত মনগড়া রূপ আছে, যত কুসংস্কার ও অপবাদ আছে, যদি তা এই জনপদ থেকে, এই সমাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে দূর না হয় তাহলে আমার বড় ভয় আছে, খুব আশঙ্কা আছে যে, যত চেষ্টা তদবীরই করা হোক, যত দৌড়ঝাঁপই করা হোক, যত জানের বাজিই লাগানো হোক, আপনাদের কোন সমস্যারই সমাধান হবে না। আল্লাহ্র মদদ না হলে কোন তদবীরই কাজে আসে না, আর গায়বের মদদ হলে কোন প্রতিক‚লতাই আর বাকি থাকে না। إنْ يَـنْـصُرْكُـمْ اللهُ فَلا غَـالِـبَ لَكُـمْ، وإنْ يَـخْـذُلْـكُـمْ فَـمَـنْ ذا الَّـذِي يَـنْـصُـرُكُـمْ مِـنْ بَـعْـده، وَعـلى اللهِ فَـلْـيَـتَـوَكَّـلِ الـمُـؤْمِـنـونَযদি আল্লাহ্ তোমাদের সাহায্য করেন তাহলে তোমাদের উপর কোন বিজয়ী শক্তি নেই, আর যদি তিনি তোমাদের ত্যাগ করেন তাহলে তারপরে কে তোমাদের সাহায্য করতে পারে। আর মুমিনরা যেন আল্লাহ্রই উপর পূর্ণ ভরসা রাখে। আল্লাহ্ হাফেয!