بسم الله الرحمن الرحيم
কোরআনের আলো
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনÑ (হে মুহাম্মাদ), পড়ুন আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। (১)
সৃষ্টি করেছেন মানুষকে সেঁটে থাকা ‘সংশ্লেষ’ থেকে। (২)
পড়–ন, আর আপনার প্রতিপালক সর্বমহান। (৩)
যিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলম দ্বারা। (৪)
শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না। (৫) Ñসূরাতুল আলাক
ফায়দা
মানবজাতির প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সবচে’ বড় দয়া এই যে, তিনি আপন বড়ত্ব ও মহত্ত্বের অবস্থান থেকে তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র ইনসানের সঙ্গে ঊর্ধ্বজাগতিক এক বন্ধন স্থাপন করেছেন। তদুপরি তাদেরই মধ্য হতে একজন কামিল ইনসানকে রাসূল ও দূতরূপে নির্বাচন করেছেন।
বস্তুত এটা রাব্বুল আলামীনের পক্ষ হতে ইনসানকে দেয়া এক শ্রেষ্ঠ মর্যাদা, যার চেয়ে বড় মর্যাদা আর কিছুই হতে পারে না এবং সারা জীবন সিজদায় পড়ে থেকেও যার শোকর আদায় করা সম্ভব নয়।
এ পাঁচ আয়াত স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, মানুষ জীবনের সককিছু গ্রহণ করবে ঊর্ধ্বজগত থেকে, তার খালিক ও মালিক থেকে, আসমানের অহী থেকে, পৃথিবীর কোন সূত্র থেকে নয় এবং নয় নিজের মস্তিষ্ক ও চিন্তা থেকে।
মানবজাতির জন্য এটা সত্যি বড় এক বিস্ময় ছিলো যে, উম্মী নবীর উপর অহীর অবতরণ শুরুই হয়েছে ‘পড়ো’ দ্বারা। এটা এদিকে ইঙ্গিত করে যে, উম্মী নবীর উম্মত হবে ইলমমুখী ও জ্ঞানমনস্ক উম্মত। পড়া-লেখা ও জ্ঞানচর্চাই হবে তাদের উন্নতির পথ, আর অজ্ঞতা ও জ্ঞানবিমুখতা হবে পতন ও অধঃপতনের কারণ।
বিসমি রাব্বিক বলে বোঝানো হয়েছে, ঐ ইলম ও জ্ঞানই হবে মানবের জন্য কল্যাণপূর্ণ যার সম্পর্ক রবের সঙ্গে এবং যা রবের সন্তুষ্টির জন্য হবে নিবেদিত। কারণ তিনি যেমন মানুষের ¯্রষ্টা তেমনি জ্ঞানেরও ¯্রষ্টা।
শিক্ষা দিয়েছেন কলম দ্বারাÑ এভাবে ইলমের মাধ্যমরূপে কলমকে অত্যুচ্চ মর্যাদা দান করা হয়েছে। সুতরাং রবের পক্ষ হতে মানুষের প্রতি দায়িত্ব হলো, কলম যেন সর্বদা ¯্রষ্টার এবং অহীর মর্যাদা রক্ষায় নিবেদিত হয়।
কত দুঃখের কথা যে, মুসলিম উম্মাহ আজ ইলম ও জ্ঞানচর্চা থেকে দূরে। আরো দুঃখ এই যে, ইসলামকে আজ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলতে হচ্ছে, আমি ইলম ও জ্ঞানের বিরোধী নই, আমি তো ইলমের অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক! আমি শুধু চাই, ইলম ও জ্ঞানের লক্ষ্য যেন ঠিক থাকে; জ্ঞানের ¯্রষ্টার সঙ্গে জ্ঞানসাধনার সম্পর্ক যেন অটুট থাকে।
তথ্যকণিকা - ১
علق অর্থ জমাট বাঁধা তরল কিছু। দ্বিতীয় অর্থ সেঁটে থাকা কিছু, সংযুক্ত ও ঝুলন্ত কিছু। এখানে সম্ভবত শুক্র ও ডিম্বাণুর ‘সংশ্লেষ’কে বোঝানো হয়েছে, যা জরায়ুপ্রাচীরে সেঁটে থাকে। ‘আলাক-এর আভিধানিক অর্থের সঙ্গে এটাই সবচে’ সঙ্গতিপূর্ণ।
এখানে ‘মিন ‘আলাক’ বলার কী প্রয়োজন ছিলো? সৃষ্টি করেছেন আপন কুদরত দ্বারাÑ বলাই তো যথেষ্ট ছিলো? সম্ভবত এখানে রয়েছে জ্ঞানের বৈচিত্র্যের প্রতি ইঙ্গিত। অর্থাৎ সর্বজ্ঞান অর্জন করো, তবে ¯্রষ্টার অনুগত ও সৃষ্টির সেবক হয়ে।
১৯ আয়াতের এই সূরা মক্কী।
প্রথম অহী অবতীর্ণ হওয়ার আনুপূর্বিক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে হযরত আয়েশা রা. হতে। বুখারী শরীফের প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদ এপ্রসঙ্গেই। মুসলিমেও এসেছে এ বর্ণনা। হাদীছটির সনদের কেন্দ্রীয় রাবী হলেন ইমাম যুহরী রহ.
ঘুমের অবস্থায়ও এটা হয়েছে বলে অন্য বর্ণনা তাবারীতে এসেছে।
তথ্যকণিকা - ২
সূরাতুল আলাক-এর শুরুর পাঁচ আয়াত সর্বপ্রথম অহীরূপে হেরা-গুহায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল হয়েছে।
শুরুতে নির্জনতা তাঁর খুব প্রিয় ছিলো। তাই মাঝে মধ্যে তিনি কয়েকদিনের জন্য হেরাগুহায় নির্জনে অবস্থান করে ইবাদতে নিমগ্ন হতেন। ঐ অবস্থায় একদিন হযরত জিবরীল আ. আবির্ভূত হলেন এবং প্রবল শক্তিতে তাঁকে আলিঙ্গন করে বললেন, পড়–ন! তিনি বললেন, আমি তো পড়া জানি না! এরূপ তিনবার হলো। তারপর জিবরীল আ, এ পাঁচ আয়াত পাঠ করলেন।
সম্ভবত এই অহী ছিলো লিখিত-রূপে, যার কারণে তিনি ‘পড়তে পারি না’ বলেছেন। কারণ মুখ থেকে শুনে মুখস্ত পড়তে না পারার কথা ছিলো না।
এখানে এ ইঙ্গিতও রয়েছে যে, ইলমের আসল মাধ্যম কলম ও কিতাবের পাতা নয়, আসল মাধ্যম হচ্ছে সিনার সঙ্গে সিনার মিলন এবং বুকের সঙ্গে বুকের আলিঙ্গন।
কোরআন সম্পর্কে
ইসলাম একমাত্র ধর্ম এবং কোরআন একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যা কলমের মর্যাদার প্রতি মানবজাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কোরআন মানুষকে পড়তে বলেছে, লিখতে বলেছে এবং শিখতে বলেছে। কোরআন কখনো অন্ধবিশ্বাসের দিকে ডাকেনি, বরং বিশ্বজগতের প্রতি চিন্তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। ইসলাম মানুষকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও চিন্তা প্রয়োগ করে ঈমান ও বিশ্বাস গ্রহণ করতে বলেছে।
হাদীছের আলো
হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের দিনে আহলে জাহেলিয়াতের জন্য (বন্দীপ্রতি) চারশ দিরহাম (মুক্তিপণ) নির্ধারণ করেছিলেন।
একই ছাহাবীর ভিন্ন সনদে ভিন্ন বর্ণনায় আছে, কিছু (দরিদ্র) বন্দীর কাছে মুক্তিপণ ছিলো না। তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মুক্তিপণ এই নির্ধারণ করলেন যে, তারা আনছার শিশুদের লেখা শিখিয়ে দেবে।
ফায়দা
বদরের গাযওয়া ছিলো ইসলামের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ, যাতে মুসলিম বাহিনীর চূড়ান্ত বিজয় হয়েছিলো, আর মুশরিক বাহিনীর চরম পরাজয়। বস্তুত বদরের গাযওয়া ছিলো ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যতের ভাগ্য নির্ধারণকারী যুদ্ধ।
এর পর থেকে আজ পর্যন্ত মুসলিম বাহিনী যেখানে যত বিজয় অর্জন করেছে, যত রাজ্য ও সা¤্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছে সে সবের পিছনে অবদান ছিলো গাযওয়াতুল বদরের, যেখানে ছাহাবা কেরামের শক্তিহীন ক্ষুদ্র বাহিনী আল্লাহর সাহায্যে কোরায়শের বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছিলো। এ কারণেই এদিনটিকে কোরআন ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ বা পার্থক্যকারী দিন বলে আখ্যায়িত করেছে।
গাযওয়াতুল বদরে বন্দিদের থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ করা হয়েছিলো। এ প্রথা মুসলমানদের উদ্ভাবিত ছিলো না; বহু আগে থেকেই তা চলে আসছিলো।
যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা ছিলো জাহেলিয়াতের সাধারণ রীতি। বদরের বন্দিদের সঙ্গে ছাহাবা কেরামের আচরণ ছিলো খুবই মানবিক, যা বন্দিগণ অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছে। এই উঁচা আখলাক ও মহৎ চরিত্রের কারণেই পরবর্তী সময়ে অনেকে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছে।
শিক্ষার বিনিময়ে মুক্তিপণ মওকূফ করার যে নীতি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণ করেছিলেন তা ছিলো সত্যি এক অনন্য দৃষ্টান্ত! প্রত্যেককে তিনি দায়িত্ব দিয়েছিলেন দশজন করে আনছারী শিশুকে লেখা শেখানোর। এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, উম্মী নবী তাঁর উম্মতের শিক্ষার প্রতি কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন! আরো বোঝা যায়, শিক্ষার প্রতি আমাদের সামগ্রিক নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?
তথ্যকণিকা - ১
মুসলিম বাহিনীর সাধারণ পতাকা ছিলো হযরত মুছ‘আব বিন উমায়রের হাতে। মুহাজিরীনের পতাকা আলী ইবনে আবী তালিব রা. এবং আনছারদের পতাকা সা‘দ বিন মু‘আয রা. এর হাতে। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরীশ বা ছাউনী বানানো হয়েছিলো মুসলিম বাহিনীর বাম দিকে।
কোরায়শ বাহিনীর সংখ্যা ছিলো এক হাজারের উপরে, (একবর্ণনায় তেরশ)। অস্ত্র-ঘোড়া ও লৌহবর্ম ছিলো প্রর্যাপ্ত। পক্ষান্তরে মুসলিম বাহিনীতে মাত্র দু’জন ছিলেন অশ্বারোহী। সবার হাতে তলোয়ারও ছিলো না। কারো কারো হাতে ছিলো খেজুর-ডাল।
মুশরিক বাহিনীর সত্তরজন বিশিষ্ট ব্যক্তি নিহত হয় এবং সত্তরজন হয় বন্দী। মুহাজির শহীদ হয়েছেন ছয়জন, আনছার আটজন, মোট চৌদ্দজন।
তথ্যকণিকা - ২
বদর হচ্ছে মদীনাহ শরীফ থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে (মক্কার দিকে) ১১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি প্রান্তরযুক্ত স্থান।
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে আনছার -মুহাজির বাহিনী ১২ই রামাযান মদীনাহ থেকে রওয়ানা হয়ে বদরে পৌঁচেছে ১৬ই রামাযান সম্ভবত দুপুরের দিকে। যুদ্ধ হয়েছে ১৭ই রামাযান সকালে।
মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা তিনশতেরজন বলে প্রসিদ্ধ (তবে কিছু বেশীও বলা হয়। মুহাজিরীন ছিলেন ৭৭জন (কিছু বেশীও বলা হয়।)
আনছার ২৩৬, আউসের ৬১জন। (এ সংখ্যা দু’টিতে মতভিন্নতা নেই।)
মুসলিম বাহিনীর অবস্থান ছিলো উত্তরে মদীনার প্রান্তে কূপ ও পানির কাছাকাছি।
মুশরিকদের অবস্থান ছিলো দক্ষিণে মক্কার দিকে
বিশ্বনবী সম্পর্কে
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইনছাফ ও ন্যায়পরতা ছিলো এমন যে, বদরের যুদ্ধে তাঁর প্রিয় ও শ্রদ্ধেয় চাচাও বন্দী হন, যিনি বাধ্য হয়ে বাহিনীর সঙ্গে এসেছিলেন। বন্দিদের বেঁধে মদীনায় আনা হলো। রাতে অস্থিরতার কারণে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্ঘুম ছিলেন। জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আব্বাসের কাতরধ্বনির কারণে ঘুম আসছে না। জনৈক প্রহরী তার বাঁধন একটু শিথিল করে দিলেন। তখন তিনি বললেন, তাহলে অন্য বন্দিদের বাঁধনও শিথিল করে দাও।