রজব ১৪৩৯ হিঃ (৩/৩)

পুষ্পকলি

পুষ্পকলি - ৩

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

আমাদের মাদরাসাতুল মাদীনায় খুব সামান্য একটি ফুলের বাগান আছে।

আল্লাহর ইচ্ছায় তাতে অনেক ফুল ফোটে; অনেক সুবাস হয়।

যদিও ফুলের মত সুন্দর হতে পারিনি এবং জীবনের অঙ্গনে তেমন করে ফুলের সুবাস গ্রহণ করতে পারিনি, তবু ফুলের প্রতি আমার ভালোবাসা দূর শৈশব থেকে।

আমার কামনা নিজের জন্য এবং সবার জন্য, আমরা যেন হতে পারি ফুলের মত সুন্দর, সুবাসিত ও পবিত্র।

ফুলের সৌন্দর্য আল্লাহর সৃষ্টি! আর ফুলের সজ্জার সৌন্দর্য বান্দার রুচি ও শিল্পগুণের প্রকাশ। সর্বাবস্থায় প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর। ফুল সাজানো এবং ফুলের সজ্জা আজ সারা পৃথিবীতে একটি স্বীকৃত শিল্প। ফুলের সজ্জাসৌন্দর্যে, বলা হয়, জাপান পৃথিবীর সব জাতি থেকে অনেক এগিয়ে।

আমি জানতাম না, আমার ছেলেরা এত সুন্দর করে ফুল সাজাতে জানে!

গাছ থেকে ফুল ছেঁড়া আমি সমর্থন করি না। আমার ছেলেরা গাছের নীচে মাটিতে ছড়িয়ে থাকা ফুল যতেœর সঙ্গে তুলে নেয় এবং ফুলদানিতে সাজিয়ে আমাকের ‘উপহার’ দেয়। আমি বলিনি, ওরা নিজ থেকেই করে, হয়ত বুড়ো মানুষটাকে ভালোবেসে! আর ভালোবাসার বিনিময় তো শুধু আল্লাহর কাছে।

আমাদের মাদরাসার পঞ্চম বর্ষের তালেবানে ইলম। প্রতিদিন আমাকে ফুল সাজিয়ে দেয়। প্রতিদিনের সজ্জায় থাকে নানা রকম শিল্পসৌন্দর্যের প্রকাশ। সবক’টি সজ্জার ছবি যদি, ছোট্ট বন্ধুরা, তোমাদের উপহার দিতে পারতাম, ভালো লাগতো। কারণ মানুষ চায়, যে কোন সুন্দরকে তার প্রিয়জনের সঙ্গে উপভোগ করতে।

তবে সবগুলো থেকে একটিকে নির্বাচন করে এখানে তোমাদের উপহার দিলাম, তোমরাও যেন পুষ্পসজ্জার সৌন্দর্যের আনন্দে শরীক হতে পারো।

এই ফুলগুলো পঞ্চম বর্ষের তালেবানে ইলম সাজিয়েছে আজ ১৯/৫/৩৯ হি.

দেখো তো, ফুলের সজ্জা দিয়ে কত সুন্দর করে ‘সাব‘আ সানাবিল’ এর ছায়া ধারণ করা হয়েছে!

কার না ভালো লাগবে! কার না হৃদয় প্রফুল্ল হবে!!

ফুলের সজ্জার যে সৌন্দর্য, তা আসলে ফুলের সৌন্দর্য যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতারই সুন্দর প্রকাশ।

আমি প্রথমে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ ফুলের সৌন্দর্যের জন্য; তারপর কৃতজ্ঞ আমার ছেলেদের প্রতি, ফুলের এমন সুন্দর সজ্জার মাধ্যমে ফুলের ¯্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।

পৃথিবীর বাগানে যত ফুল ফোটে, হয়ত তা বাগে জান্নাতের ফুলের ছায়া নিয়ে আসে। হয়ত এজন্য যে, আমরা যেন ঐ ফুলের সৌন্দর্য গ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারি।

সুবহান, আর কতভাবে বান্দার প্রতি তুমি তোমার মায়া ও মমতার ....!!

কামনা করি, আমি, তুমি, আমরা সবাই যেন ফুলের মত সুন্দর হতে পারি। সবার জীবন যেন ফুলের মত সুবাসিত হয়, ‘জান্নাতের বাগানে বসে আমরা যেন হাসতে পারি পুষ্পের হাসি।’

আমার ছেলেদের এই পুষ্পসজ্জা থেকে দেখো, কেমন সুন্দর একটি লেখা উপহার পেলাম! তাহলেই দেখো, কীভাবে তোমরা আমাকে সাহায্য করতে পারো পুষ্পের সম্পাদনার কাজে!

নিয়ত করেছি, আগামী শুক্রবার সবাইকে চমচম দ্বারা আপ্যায়ন করবো। তোমরা যারা ‘দূরে’ আছো, তোমাদেরও দাওয়াত। ‘কাছে’ এসে মিষ্টি মুখ হয়ে যাবে, আশা করি!! আগামী শুক্রবারের আছে অবশ্য আর মাত্র তিনদিন!!

আরবদেশকে আল্লাহ দান করেছেন খেজুর,

আমাদের দান করেছেন খেজুরের রস। শীতকালের জন্য আসমানের সত্যি এক অতুলনীয় দান! যেমন ঘ্রাণে তেমনি স্বাদে। যারা রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ   তৈরী করে তাদের বলা হয় গাছী। গাছীর দক্ষতারও ভূমিকা থাকে উৎকৃষ্ট রস পাওয়ার ক্ষেত্রে। শীতের শুরুতে, যখন উত্তরের হিমেল বাতাস বইতে শুরু করে, গাছী গাছ ‘ছিলাই’ করে। ছিলাই করা অংশে একটা কাঠি ঢুকিয়ে দেয়, যা থেকে   ফোঁটা ফোঁটা রস ঝরে।

গাছী প্রতিদিন বিকেলে গাছ বেয়ে গাছের মাথায় কলস বসিয়ে দেয়। সারা রাত তাতে ফোঁটা ফোঁটা রস জমে। ফজরের আগে রসের কলস নামিয়ে আনতে হয়। কাঁচা রসের আহারে কী স্বাদ! দূর শৈশবের স্মৃতি মনে হলে এখনো জিভে ‘জল’ আসে!

একবার, আমি তখন, এই ধরো তোমাদেরই মত ছোট; শহর থেকে গ্রামে গিয়েছি বেড়াতে!

আমরা যেমন ভাবি, গ্রামের ছেলে মেয়ে কত ভাগ্যবান! সারা দিন কাদাজলে মাছ ধরতে পারে। ডুবিয়ে শাপলা-শালুক তুলতে পারে। আর ওষপড়া শীতের সকালে ইচ্ছে হলেই ইচ্ছে মত কাঁচা খেজুরের রস খেতে পারে, গ্রামের লোকেরা তেমনি ভাবে, শহরের ছেলে মেয়ে কত ভাগ্যবান! আলিশান দালান কোঠায় বাস করে। গাড়ী-ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায়। কেক পুডিং আইসক্রিম কত কী খায়!

তাই গ্রামের মানুষের কাছে শহুরে ছেলে মেয়েদের আলাদা কদর, আলাদা খাতির!

হাঁ, আমি শহরের ছেলে গ্রামে গিয়েছি বেড়াতে। যে দেখে সেই আদর করে, খাতির করে, আর খুব নরম করে জানতে চায়, খোকা বাবু কেমন আছেন! মুড়ির  মোয়া খাবেন?!

যদি বলি, খাবো, দাও না একটা, ওরা খুশী হয়। খুশীতে যেন গলে যায়।

কিন্তু আমি তো শহরের ছেলে, যত ইচ্ছেই করুক, বললেই তো আর খেতে পারি না! তাই চটজলদি বলি, ওসব আমরা খাই না!

কিন্তু গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের কাঁচা রস! সাধলে আর না করতে পারি না! না সাধলেও বলি, দেখি তো খেতে কেমন!!

হাঁ, বলছিলাম কী! গ্রামে গিয়েছি বেড়াতে। শীতটা তখন বেশ জেঁকে বসেছে। ভোর বেলা লেপের ভেতর থেকে বের হয় কার সাধ্য! কিন্তু খেজুরের রস বলে কথা! চাচা তো ভাই, বয়সে বড়, চুপি চুপি ডাকে, চল্ খেজুরের রস খাবি!

কোথায় যে পালায় শীত! এত ওষ পড়ছে যে, কাছের কিছু ভালো মত দেখা  যায় না। গিয়ে হাজির খেজুর গাছের তলায়।

গাছী তখন মাত্র নেমেছে গাছ থেকে রসভরা কলস নিয়ে! কাঁচা রসের ঘ্রাণটা নাকে এসে কেমন যেন নেশা ধরায়। গাছী বলে, খোকা বাবু, রস খাবেন!!

এত ঠা-া যেন এই মাত্র ফ্রিজ থেকে বের করে আনা!

শীতের মধ্যেও খেজুরের রস কিন্তু ঠা-াই মজা!

সেদিন যে রসটা খেলাম, না! তার স্বাদ যেন এখনো লেগে আছে শুধু জিভে নয়, ঠোঁটেও!!

পুরো শীত মৌসুম চলে খেজুরের  রসে পিঠে তৈরীর উৎসব। হায়, তোমরা যারা শহরের ‘অভাগা’ ছেলে মেয়ে, তোমাদের যদি খাওয়াতে পারতাম, এখনই গাছ থেকে নামিয়ে আনা একমগ খেজুরের কাঁচা রস! কিংবা মায়ের হাতে তৈরী একটা দু’টো পিঠে!! চলো না আমার সঙ্গে, একদিনের জন্য হলেও যাই গ্রামে! এ শীতে না হোক আগামী শীতে! (আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখেন!)

খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে তৈরী করা হয় খেজুরের গুড়। ঘ্রাণে আর স্বাদে তারও নেই কোন তুলনা! গুড়টা অবশ্য তোমরা শহরে বসেও খেতে পারো, একটু যদি চেষ্টা করো, তবে এইমাত্র তৈরী গুড়ের ‘কারিশমা’ই আলাদা।

ছবিতে দেখো, গাছী খেজুর গাছ বেয়ে কলস বসাচ্ছে। পাশের ছবিতে নামিয়ে আনা রস জ্বাল দেয়া হচ্ছে। আর তৃতীয় ছবিতে জ্বাল দেয়া রস ঢেলে গুড় তৈরী করা হচ্ছে।

গুড় তৈরীর জন্য রস জাল দেয়া কিন্তু খুব সহজ নয়। সবাই পারে না, যারা পারে, পুরো গ্রামে তাদের কদরই আলাদা। বুঝতে হয়, কতটা আগুনে কতক্ষণ জ্বাল দিতে হবে! কতটা ঘন হলে আগুন থেকে নামিয়ে ফেলতে হবে। একটু এদিক সেদিক হলো তো গুড় নষ্ট! বাজারে নেবে, কেউ কিনবে না। কারণ গুড়ে ঘ্রাণ নেই।

যদি জ্বালটা ঠিক মত হয়, গুড়ের ঘ্রাণটাই হয় অন্য রকম। বাজারে রীতিমত কাড়াকাড়ি পড়ে যায়।

আগে গ্রামবাংলায় খেজুর গাছের অভাব ছিলো না। এখন খেজুর গাছ অনেক কমে গিয়েছে। মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে খেজুর গাছ কেটে ফেলে, কিন্তু নতুন চারা রোপণ করে না। তাই আগের মত খেজুর রসের এবং খেজুরগুড়ের অত ছড়াছড়ি নেই। এখন গাছ থেকে নেমে ছোট ছেলে মেয়ে দেখে গাছী আর বলে না, রস খাবে! দেবো এক মগ!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা