কোরআনের আলো
بسم الله الرحمن الرحيم
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন‘যামানার কসম, মানুষ বড় খাসারা ও ক্ষতির মধ্যে রয়েছে; তবে তারা নয় যারা আমলে ছালেহ ও সৎ কর্ম করে এবং হক ও সত্যের বিষয়ে পরস্পরকে উদ্বুদ্ধ করে, আর উদ্বুদ্ধ করে ছবর ও ধৈর্যের বিষয়ে। - সূরাতুল আছর
ফায়দা
ছোট ছোট তিন আয়াতের এই ছোট্ট সূরায় আল্লাহ তা‘আলা মানব জীবনের সবচে’ বড় সত্য তুলে ধরেছেন। মানুষ যদি এই আয়াতের সতর্কবাণী জীবনে সঠিকভাবে গ্রহণ করে তাহলেই তার কল্যাণ।কসম করার প্রয়োজন আল্লাহর দিক থেকে নয়, বান্দার দিক থেকে। কারণ মানুষ কসম করে বলা কথাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে এবং বিশ্বাস করে।সময়ের কসম করার তাৎপর্য এই যে, মানুষের খাসারা বা কামিয়াবি সময়ের অপচয় বা সদ্ব্যবহার দ্বারাই হয়ে থাকে। যদি সময় নষ্ট করে এবং জীবনের অপচয় করে তাহলে সে বরবাদ হয়, দুনিয়ার জীবনেও, আখেরাতের জীবনেও; আর যদি সময়ের সদ্ব্যবহার করে তাহলে দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানেই সে কামিয়াবি হাছিল করে।কামিয়াবি হাছিল করার উপায় হলো আমলে ছালেহ বা সৎ কর্ম করা, অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ-নিষেধের বিচারে যা করা উচিত তা করা এবং যা করা উচিত নয় তা থেকে বিরত থাকা। তারপরবিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে যা সত্য তা গ্রহণ ও পালন করার জন্য দাওয়াত দেয়া।সত্যের পথে চলার ক্ষেত্রে যত কষ্ট ও বিপদ আসুক, যত প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা দেখা দিক, ছবর ও ধৈর্যের সঙ্গে তা অতিক্রম করার জন্য একে অন্যকে উদ্বুদ্ধ করা।এর অর্থ হলো, সত্যকে পালন করা এবং ছবর করা যেমন আমাদের কর্তব্য, তেমনি সত্যের প্রতি আহ্বান এবং ছবর ও ধৈর্যের সঙ্গে সত্যের উপর অবিচল থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করা, এটাও সমান গুরুত্বের সঙ্গে কর্তব্য। অর্থাৎ যুগপৎ আমল ও দাওয়াত... !
কোরআন সম্পর্কে
কোরআন সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা বলেন, যদি এ কোরআন আমি নাযিল করতাম কোন পাহাড়ের উপর তাহলে তুমি দেখতে পেতে ঐ পাহাড়কে আল্লাহ্র ভয়ের কারণে দেবে যাচ্ছে, ফেটে যাচ্ছে।আরো এরশাদ হয়েছে, আমি তো এই আমানত বহন করার জন্য আসমানসমূহ এবং যমীন এবং পাহাড়সমূহের সামনে পেশ করেছি, কিন্তু তারা তা বহনে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে, অথচ ইনসান তা বহন করেছে ...।
তথ্যকণিকা-১
জনৈক তত্ত্বজ্ঞানী বলেন, সূরাতুল আছর-এর আসল হাকীকত আমি সেই দিন বুঝেছি যেদিন বাজারে দেখলাম, এক বরফবিক্রেতা সবার করুণা আকর্ষণের চেষ্টা করে বলছে, হে লোকসকল, ঐ দুর্ভাগা মানুষটার উপর দয়া করো যার সমস্ত পুঁজি গলে গলে শেষ হয়ে যাচ্ছে!লোকটির এরূপ করুণ আর্তি শুনে আমি চমকে উঠলাম! আমার অন্তরে বিরাট ভাবান্তর হলো, আমাদের জীবনের সময়গুলোও তো এভাবে বরফের মত গলে গলে শেষ হয়ে যাচ্ছে! যদি জীবনের সময়গুলো জীবনদাতার সন্তুষ্টির পথে ব্যয় না করি তাহলে তো গলে যাওয়া বরফের মত আমাদের জীবনও হয়ে যাবে বরবাদ!!
তথ্যকণিকা-২
عصر শব্দটি সমগ্র কোরআনে এই একবারই শুধু এসেছে। এতে এখানে কসমের ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহারের গুরুত্ব প্রকাশ পায়। কারণ আছর বা সময়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা মিলেই তো জীবন!আছর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো দিন-রাত ও সকাল-সন্ধ্যার সম্মিলিত রূপ। রাত আসে, অন্ধকার ছেয়ে যায়; দিন আসে, আলো উদ্ভাসিত হয়। আবার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মৌসুমের উদয় হয়। রাত-দিন বাড়ে কমে। এসবই আল্লাহ তা‘আলার অসীম কুদরতের প্রকাশ। আছর-এর নামে কসম করার এটিও একটি কারণ।কারো কারো মতে العصر দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আছরের নামায, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাদীছের আলো
بسم الله الرحمن الرحيم
হযরত আবু হোরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (হাদীছে কুদসীতে) আল্লাহ তা‘আলা বলেনআদমের বেটারা দাহর (ও যুগ)কে মন্দ বলে, অথচ আমিই দাহর, রাতদিনের আবর্তন আমারই নিয়ন্ত্রণে।’ (বুখারী)মুসলিমের বর্ণনায় হাদীছে কুদসীটি এরূপ, ‘আল্লাহ বলেন, আদমের বেটা আমাকে ‘হায়, যামানার বঞ্চনা’ বলে কষ্ট দেয়। অথচ আমিই দাহ্র! আমারই হাতে সবকিছু! আমিই রাতদিনের আবর্তন ঘটাই।মুসলিমের বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা দাহ্রকে মন্দ বলো না, কারণ আল্লাহই দাহর!
ফায়দা
দাহ্র ও যামানাকে মন্দ বলতে নিষেধ করার কারণ এই যে, কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, দাহরই হচ্ছে ঘটনার কর্তা ও সঙ্ঘটক তাহলে তো ঈমান সম্পর্কেই প্রশ্ন দেখা দেবে, যেমন মুহাক্কিক আলিমগণ বলেছেন যে, কেউ যদি হাকীকত হিসাবে কোন ঘটনাকে দাহরের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তাহলে সেটা পরিষ্কার কুফরি হবে। পক্ষান্তরে যদি অভ্যাসবশত, বা প্রচলনবশত মুখে এসে যায় তাহলে কুফুরি তো হবে না, তবে মাকরূহ ও চরম নিন্দনীয় হবে; কারণ আহলে কুফরের কালামের সঙ্গে সাদৃশ্য হচ্ছে।পক্ষান্তরে যদি বিশ্বাস করে যে, ঘটনার সঙ্ঘটক দাহ্র নয় তাহলে তার এ নিন্দা-সমালোচনা হবে অমূলক; বরং তার নিন্দা-সমালোচনা তো প্রকারান্তরে আল্লাহ তা‘আলার মহান সত্তাকে আঘাত করে।হায়, যামানার বঞ্চনা কারো কারো মতে এর অর্থ হলো যামানার আবর্তনের কারণে যে বঞ্চনার সম্মুখীন সে হয়েছে তার উপর হায়হুতাশ করা। অন্যমতে এটা আসলে যামানাকে অভিসম্পাত করা। উভয় অর্থেই আল্লাহ তা‘আলার যাতে পাক অসম্মান ও অমর্যাদার সম্মুখীন হয়।আমিই দাহ্র, এর ব্যখ্যায় বলা হয়েছে, ‘আমিই দাহরের নিয়ন্তা’।আমাদের জীবনে যখনই যে দুর্যোগ আসে তা আমাদের কল্যাণের জন্য, বা পরীক্ষার জন্য আল্লাহ তা‘আলার আদেশে, তাকদীরের ফায়ছালারূপেই এসে থাকে। জীবনে সব উত্থান-পতন আল্লাহরই আদেশে হয়। বান্দার কর্তব্য হলো তাকদীরের ফায়ছালা বলে বিশ্বাস করে ছবরের উপর অবিচল থাকা। তবে পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য চেষ্টাতদবীর করার মধ্যে কোন দোষ নেই, বরং সেটাই করণীয়।
বিশ্বনবী সম্পর্কে
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সম্পর্কে বলেছেন, আমি আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী। বস্তুত আল্লাহর নবীর কথাই তো যথেষ্ট। কোন প্রমাণের প্রয়োজন নেই। তবে সমগ্র হাদীছভা-ার এটাই প্রমাণ করে যে, তিনি ছিলেন আরবের বিশুদ্ধতম ভাষী। কারণ কোন হাদীছ তো দীর্ঘ সময়ের চিন্তা ভাবনা করে লেখা বিষয় নয়, বরং তা হচ্ছে মজলিসের উপস্থিত আলাপ-আলোচনা। অথচ এগুলো আজ শুধু সাহিত্যিক বিচারেও আরবীভাষার অমূল্য সম্পদরূপে বিবেচিত। আমাদেরও বিশুদ্ধভাষী হওয়ার চেষ্টা করা কর্তব্য।
তথ্যকণিকা-১
হযরত আবু হোরায়রা রা. হিজরতের পূর্বে দাউসগোত্রের নেতা হযরত তোফায়ল রা. এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং খায়বারযুদ্ধের সময় মদীনায় আগমন করেন। তিনি পাঁচহাজার তিনশ চুয়াত্তরটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। এত অধিক হাদীছ আর কোন ছাহাবী হতে বর্ণিত হয়নি।তিনি বলেন, লোকেরা বলে, আবু হোরায়রা এত হাদীছ কোত্থেকে বলে?! ঘটনা তো এই যে, অন্যদের কৃষিকাজ ছিলো, ব্যবসা ছিলো. বাড়িঘর ছিলো; আমার কিছুই ছিলো না আমি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারেই পড়ে থাকতাম। অনেক সময় ক্ষুধার যন্ত্রণায় বেহুঁশ হয়ে যেতাম, আর মানুষ ভাবতো মৃগীরোগ! আসলে সেটা ছিলো ক্ষুধা...
তথ্যকণিকা-২
দাউস গোত্রের হযরত আবু হোরায়রা রা. অত্যন্ত উচ্চ স্তরের ছাহাবী। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে খুব মুহব্বত করতেন।ইসলামপূর্ব যুগে তাঁর নাম ছিলো আবদে শামস, ইসলামী যুগের নাম হলো আব্দুর-রহমান।আবু হোরায়রা হলো তাঁর উপনাম। পথিমধ্যে একটি বিড়ালছানা উদ্ধার করে জামার হাতার ভিতরে করে তিনি দরবারে নববীতে হাজির হয়েছিলেন। নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন স্নেহবশে বললেন, তুমি তো আবু হোরায়রা (বিড়ালছানার পিতা)! এ উপনাম এতই প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে যে, আসল নাম একেবারে আড়ালে চলে গিয়েছে।