বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশেষে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ অধিবেশনে তার বহু প্রতীক্ষিত ভাষণ দান করেছেন। বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ যেমন প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের জন্য উন্মুখ প্রতীক্ষায় ছিলেন যে, দেশের সবচে’ কঠিন ও জটিল সমস্যাটি তিনি বিশ্বের দরবারে কীভাবে তুলে ধরেন। তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ ও প্রতিপক্ষ সবারই কৌতূহলী দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের দিকে। এক কথায় এ ভাষণের উপর অনেকাংশে নির্ভর করছিলো রোহিঙ্গাসঙ্কট ও তার সমাধানের ভবিষ্যত গতিপ্রকৃিত। এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও বক্তব্যের চুলচেরা পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। তো এ উপলক্ষে আমরা পূর্ণ আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার অনুভূিত নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের একটি নির্মোহ পর্যালোচনা উপস্থাপন করতে যাচ্ছি। আল্লাহ যেন আমাদের জাতিকে এই বিপদ ও সঙ্কট থেকে মর্যাদার সঙ্গে উত্তোরণের তাওফীক দান করেন, আমীন। প্রথমেই আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ীস্বকার করছি যে, পুরো ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আবেগের দিক থেকে এবং সঙ্কট সমাধানে আন্তরিকতার দিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিলেন। তিনি তার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে বাংলাদেশ যে নাযুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে তা পূণর্রƒপে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। বাকি এক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টা কতটা সফল হবে তা ভবিষ্যতই
বলতে পারবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী হচ্ছে সহিংসতা, নৃশংসতা ও নিধনযজ্ঞের প্রত্যক্ষ শিকার, যা থেকে তারা যে কোন মূল্যে উদ্ধার পেতে চায় এবং জন্মভূমি ও জাতীয় সত্তার পরিচিতি- অধিকার ফিরে পেতে চায়। বাংলাদেশ হচ্ছে সমস্যার সবচে’ দুবর্ল পক্ষ, তথা ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ। বাংলাদেশ চায়, যে কোন মূল্যে শান্তি রক্ষা করে, নিজে ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে বেরিয়ে আসতে, সেই সঙ্গে চায়, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অধিকার যেন কোন অংশে খর্ব না হয়। মিয়ানমার হচ্ছে সমস্যা সৃষ্টিকারী পক্ষ এবং তা মিয়ানমারের ভিতরেই সৃষ্ট। এই সমস্যা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কোন ভূমিকাই নেই। মিয়ানমার সরকারপ্রধান ও সেনাশাসককেই সমাধানের দায় গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হলো সমস্যা নিরসনের শক্তিসম্পন্ন সহায়ক পক্ষ। এখন সমস্যা সৃষ্টিকারী পক্ষ যদি সমাধানের কোন যুক্তিতেই আসতে না চায় তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তথা জাতিসঙ্ঘের অবশ্য কর্তব্য হয়ে পড়ে পর্যায়ক্রমিক শক্তিপ্রয়োগ ও চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে সমস্যার যুক্তিসঙ্গত সমাধানের পথে আসতে তাকে বাধ্য করা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি তার দায়িত্ব পালন না করে তাহলে
ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ হিসাবে বাংলাদেশ কী করতে পারে? অবশ্যই এটা একটা জলন্ত প্রশ্ন যার উত্তর দেয়ার সাধ্য আমাদের নেই। আমরা শুধু বলতে পারি, প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে যা বলার কথা যেমন করেই হোক সেটা তিনি বলেছেন। কিন্তু তিনি সমস্যার একটি পক্ষমাত্র। অন্যপক্ষগুলো যদি যুক্তির পথে না আসে তাহলে কিছু করার থাকে না, অন্তত কূটনৈতিক পথে। তবে এখানে আমরা বিশিষ্ট কূটনীতিকদের একটি গুরুত্বপর্ণূ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। সারা বিশ্ব জানে, পক্ষের ও বিপক্ষের সমস্ত দেশ জানে, বাংলাদেশের এখন সবচে’ জ্বলন্ত সমস্যা হচ্ছে মিয়ানমার সরকার- সৃষ্ট রোহিঙ্গাসঙ্কট এবং বিপুল সংখ্যক মুহাজিরীনের আশ্রয় গ্রহণ। এমনকি এখন তিস্তার পানি বণ্টনও কোন সমস্যা নয়। এখন একমাত্র সমস্যা হচ্ছে মিয়ানমার, সামরিক জান্তা মিন এবং তথাকথিত গণতন্ত্রের নেত্রী, শান্তির নোবেল জয়ী অং সান সূ চী। কূটনীতির বিশারদগণ বলছেন। এমন কঠিন সময়সন্ধিক্ষণে আমাদের কথা বলতে হবে আবেগতাড়িত হয়ে নয়, মেপে মেপে। আমাদের প্রতিটি বক্তব্য হতে হবে একমাত্র প্রতিপক্ষকে কেন্দ্র করে। অন্যকোন সমস্যা, যত জরুরি হোক, বা যত আবেগস্পর্শী হোক এখনকার মত তা অবশ্যই মূলতবী রাখতে হবে, যাতে বিদ্যমান সমস্যার প্রতিপক্ষ নড়ে বসার কোন স্পেস পেয়ে না যায়। কিন্তু আমরা মনে হয় আমাদের বর্তমান বক্তব্যকে বর্তমান
প্রতিপক্ষকেন্দ্রিক রাখতে পারিনি। যেখানে একটি ফ্রন্টেই লড়াই চালিয়ে যেতে আমাদের হিমশিম খাওয়া ও দিশেহারা অবস্থা, যেখানে আমাদের একমাত্র প্রচেষ্ট হওয়ার কথা প্রতিটি দেশের সহায়তা, সহানুভূিত ও সমর্থন অর্জন করা সেখানে আমরা নতুন একটি ফ্রন্ট খুলে পুরোনো পক্ষ, হোক শত্রুপক্ষ, তার বিরুদ্ধে ফ্রন্ট খুলে বসা এবং ... বিশেষজ্ঞ কূটনীতিকগণ বলতে চান, এটা বোধহয় ঠিক হলো না। তাদের আশঙ্কা, বর্তমান সমস্যার কৌশলী প্রতিপক্ষ এখন নড়ে চড়ে বসার স্পেস পেয়ে যাবে। হয়ত তারা বলবে, যেখানে ‘ত্রিশলাখ’, আবার পড়–ন, ত্রিশ লাখ মানুষের গণহত্যার অপরাধী পকিস্তানের বিচার করেনি আন্তজর্তিক সম্প্রদায় সেখানে আমাদের চরম শত্রুও তো বলবে না কয়েক হাজারের বেশী নিহত হওয়ার কথা এবং কয়েক হাজারের বেশী যৌন নিপীড়নের ঘটনা, তাহলে আমাদের নিয়ে এত কথা কেন?! একথা বলতে পারে সামরিক জান্তা, বলতে পারেন গণতন্ত্রের নেত্রীও। বাকি থাকলো শরণার্থী সমস্যা! তো এটা আর এমনকি বিষয়। আলাপ-আলোচনা চলতে থাক না। সমস্যার সবগুলো দিক বোঝার চেষ্টা করা হোক না। সময় যত লাগে লাগুক না। ধৈর্যহারা হলে চলবে কেন? কাশ্মীর সমস্যার সমাধান কি হয়েছে এত বছরে? ফিলিস্তিনের সমস্যা!? সুতরাং তাড়াহুড়া নয়, অবিচল ধৈর্যের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। আচ্ছা, শরণার্থীদের বোঝা বহন করার কষ্ট! কেন ভারত, চীন, রাশিয়া ত্রাণসহায়তা দিতে প্রস্তুত আছে তো! যতদিন ওরা তোমাদের ওখানে থাকে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাহায্য পাঠাতে থাক না। আলোচনার মাধ্যমে যখন সমাধান হয়ে যাবে, আই প্রমিস, ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করে দেবো। আমাদের কুশলী প্রতিপক্ষ, যাকে এমনিতেই বাগে আনা যাচ্ছে না হয়ত এরূপ কৌশলী খেলা শুরু করতে পারে। তাছাড়া যদ্দুর মনে পড়ে, আমাদের রাষ্ট্রদতূ পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ করেছেন, আলোচ্য সঙ্কটে যেন বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানও সম্ভবত পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অথচ আমাদের মহান মিত্র মিয়ানমারের শুধু পক্ষই গ্রহণ করেননি বরং ... তো এক্ষেত্রে সম্ভত পাকিস্তানের সঙ্গে যে সমস্যা সেটা কৌশলগত কারণেই একটু বিলম্বে উত্থাপন করা সঙ্গত ছিলো। বাকি যারা আরো বেশী বা-খবর তারা আরো ভালো বলতে পারবেন। আমরা শুধু অন্তর দিয়ে কামনা করি, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ কাঙ্ক্ষিত সুফল যেন দান করে। সমস্যার একটা সুরাহা যেন ভাষণের দিকনির্দেশনা থেকে বের হয়ে আসে। আল্লাহ তাই করুন, আমীন।