আরাকান সংখ্যা (৩/১)

আরাকানসংখ্যা (বিশেষ)

আরাকান মুহাজিরীনের সান্নিধ্যে জীবনের অল্প কটি দিন

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

লিখেছেন / মুহাম্মাদ বিন মিসবাহ

বালুখালির দুর্গম পাহাড়ে আরাকানী মুহাজিরীনের আশ্রয়-শিবির। যাদের জীবনে আগে থেকেই অন্ধকার, সূর্য ডোবার পর তারা যেন নতুন আঁধারে ডুবে যায়!ওখানে পাহাড়ের ঢালে ছোট্ট একটি ঝুপড়ি। তাতে এক অসহায় মায়ের কোলে আছে দু’মাসের ছোট্ট এক শিশু! আব্দুল্লাহ আরাকানী।কীভাবে এসেছে সে আরাকান থেকে এখানে এই আশ্রয়-শিবিরে?! মাতৃগর্ভে নয় মাস বয়সে! মায়ের তাহলে কেমন কষ্ট হয়েছে?! সেটা জিজ্ঞাসা করাও যেন অবিচার ঐ মায়ের কষ্টের প্রতি। মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, রাতের আঁধারে, পাহাড়ের চড়াই উতরাই। না ছিলো ক্ষুধার অন্ন, না ছিলো পিপাসার পানি। কেউ জানে না, কখন কোন দিক থেকে এসে পড়বে ‘মউতের আজাল’! এরই মধ্যে পথ চলা, জলাভূমি, কাদাভূমি পার হয়ে। একটাই শুধু আকুতি, অনাগত সন্তানকে আমার বাঁচাতে হবে! ভাবতে ইচ্ছে করে, কেমন আছে এখন মায়ের কোলে তার আদরের সন্তান, জীবনের আঁধারে যে পেয়েছে জীবনের আলো, আজ থেকে দু’মাস আগে এক অন্ধকার রাতে?! কেমন আছেন এখন তার মা! যিনি জীবনের চেয়ে মৃত্যুর অনেক কাছে চলে গিয়েছিলেন ঐ ভয়ঙ্কর রাতে। হাঁ, খুবই ভয়ঙ্কর ছিলো তার জন্য ঐ রাত, যেন ‘মুখহাকরা’ এক আযদাহা! বহু মুসলিম জনপদের যুলুম-নির্যাতন, হিংশ্রতা নৃশংসতার কাহিনী আমি পড়েছি। পড়েছি আর কেঁদেছি। ভিতরের কষ্টগুলো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়েছে। আজ নিজের চোখে দেখলাম সেই হিংশ্রতা ও নৃশংসতার সামান্য কিছু নমুনা! প্রতিদিনের দুশ্চিন্তাহীন নিরুদ্বিগ্ন জীবনটা থেকে একটু সরে কয়েকটা দিনের জন্য আমি জীবনের অন্য এক রূপ দেখে এসেছি, যদি ওটাকে জীবন বলা যায়!এই কয়েকটি দিনের জীবন্ত অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে জীবনকে নতুন করে দেখতে, নতুন করে বুঝতে। ওখানে জীবনের আলো-বাতাসহীন যে অবয়ব, কষ্ট আর যন্ত্রণার যে মূর্ত -রূপ প্রত্যক্ষ করেছি, এর কল্যাণে জীবনের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গিতেই আমূল পরিবর্তন এসেছে। আমার ঘরে অন্নবস্ত্রের অভাব নেই, ওখানে লাখো মুহাজিরীন এখন অন্নহীন, বস্ত্রহীন! এখানে আমাদের জীবনে আরাম আয়েশের প্রাচুর্য, ওখানে জীবন মানে যন্ত্রণা ও বঞ্চনা, জীবন মানে হাহাকার ও আর্তনাদ!তাই জীবনের আনন্দ এখন আমার কাছে যেন অপরাধ! জীবনের ভোগ-বিলাস এখন আমার কাছে ...!! এখানে বসে ওখানকার জীবনের কষ্ট ও যন্ত্রণার ভাগ নিতে পারি না বলে অনুতাপ হয়, অনুশোচনা হয়। ইচ্ছে হয় এখনই ছুটে যাই ওখানে ঐ অন্ধকারের মাঝে। ইচ্ছে হয় বলি, এই আমি এসেছি তোমাদের সঙ্গে জীবনের আলো আঁধার ভাগ করে নিতে!আবার ভাবতে ইচ্ছে করে, কেমন আছে ঐ শিশুটি, দু’মাসের আব্দুল্লাহ আরাকানী? কেমন আছে সে তার মায়ের কোলে?! এত কেন মনে পড়ে শিশুটিকে? তার সঙ্গে আমার কিসের বন্ধন?! স্নেহের, প্রীতির, আলোর, আঁধারের, জীবনের, মৃত্যুর!! এত কেন মনে পড়ে তাকে?! তার নামটা আমার দেয়া, শুধু এ জন্য?! তার মায়ের প্রসববেদনা লাঘবের জন্য আমার অন্তরে কিছু আকুতি ছিলো এজন্য? কেন, কী জন্য?

***

এই তো সেদিনের কথা! মনে হয় মাত্র দু’দিন আগের কথা, হাত বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যায়। আমাদের মাদরাসার খিদমতি কাফেলা মাত্র ফিরে এসেছে উত্তরাঞ্চলের বন্যাদুর্গত ভাইদের খেদমত করে।দেশের দক্ষিণ সীমান্তে তখন মানবসৃষ্ট এক দুর্যোগের বিভীষিকা!আগের থেকে কোন পরিকল্পনা নেই, কোন পূর্বপ্রস্তুতি নেই, হঠাৎ আব্বুর আদেশ, মুহাজির ভাইদের খিদমতে যাওয়ার জন্য কাফেলা তৈয়ার করো!আমরা তো অবাক এবং হতবাক!! এখন, এভাবে?! সামার্থ্য কোথায়? আসবাব-উপকরণ কোথায়?আব্বুর এককথা, এগুলো তো আগেও ছিলো না। তখন যার মদদে হয়েছে, এখনো তাঁরই মদদে হবে।সারা দেশ থেকে কাফেলা যাচ্ছে মযলূমানের পাশে একটু দাঁড়াতে, তাদের যখমের উপর একটু মলম রাখতে। যাচ্ছে আলেমান তালেবান প্রতিটি মাদরাসা থেকে। যেভাবেই হোক আমরাও শামিল হতে চাই খেদমতের সেই মোবারক কাফেলায়।অল্পসময়ের মধ্যে কাফেলা তৈয়ার হলো। উত্তরবঙ্গের কাফেলায় বাহন দিয়ে সাহায্য করেছিলেন সালমান ভাইয়া, এবারও করলেন। নিজস্ব বাহন থাকায় পুরো সফর যেমন আরামের হয়েছে তেমনি হয়েছে অধিক কল্যাণকর, আলহামদু লিল্লাহ! وجزاه الله خيراমাওলানা ফায়রোয-এর নেতৃত্বে কাফেলা রওয়ানা হলো। মনের ভিতরে আমারও খুব ইচ্ছে ছিলো কাফেলায় শামিল হওয়ার! আব্বুকে বললাম না। আমার অবস্থা তিনি তো আমার চেয়ে ভালো জানেন।আব্বু দিকনির্দেশনা দিলেন যে, ওখানে গিয়ে সরেজমিনে সুরতে হাল আমাকে জানাবে। তখন নির্ধারণ করা হবে, কাজ কতটুকু হবে এবং কীভাবে হবে।রাত নয়টার দিকে ফোন এলো। ভাবলাম, টেকনাফে পৌঁছার খবর দেবেন। ফোন ধরলাম,কিন্তু না, তিনি তো কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছেন না! বুকটা ধুক ধুক করে উঠলো। কোন বিপদ নয় তো!রাত নয়টায় টেকনাফ পৌঁছে সামানপত্র রেখে তারা একটু বের হয়েছেন আশেপাশের অবস্থা বোঝার জন্য। মাওলানা ফায়রোযের ভাষায় ‘আর তখনই সম্মুখীন হলাম জীবনের সবচে’ হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতার।’নাফনদীর কিনার দিয়ে গিয়েছে রাস্তাটা। একটু দূরে, প্রায় নদীর তীরে কিছু একটা যেন দেখা গেলো। গাড়ি থামিয়ে মাওলানা ফায়রোয এগিয়ে গেলেন। দেখেন, ঝোপের আড়াল থেকে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে মুহাজিরীনের বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত পুরো একটা দল। সারা গায়ে কাদামাটি, ছেঁড়াফাটা কাপড়, কঙ্কালসার কিছু বনী আদম! কয়েকদিনের ক্ষুধা অনাহারে এমনই কাতর যে, কথাও বলতে পারছে না। একদু’জন বয়স্ক পুরুষ, আর সব নারী-শিশু।কিছু দূরে আরো একটি দল, কিছু দূরে আরো একটি। সবার একই রকম বিপর্যস্ত অবস্থা। রাতের আঁধারে একটু আগে নদী পার হয়েছেন।আল্লাহর শোকর, কাছেই দোকান খোলা পাওয়া গেলো এবং পাওয়া গেলো প্রয়োজনীয় শুকনো খাবার। কাদামাখা হাতেই খাবার নিলো বাচ্চারা। ওদের অবস্থা তখন চোখ মেলে দেখবার মত নয়। মাওলানা ফায়রোয বললেন, ‘কয়েকজন নারী, কত অভিজাত! কী প্রখর আত্মমর্যাদাবোধ!! এমন কঠিন অবস্থায়ও হাত বাড়াতে সঙ্কোচ। হঠাৎ খেয়াল হলো। আমি নিজে না দিয়ে বাচ্চাদের মাধ্যমে দিলাম। সঙ্কোচের সঙ্গে হলেও এবার তারা নিলেন। একটু দূরে গিয়ে আহার করলেন। আমি শুধু দেখে থাকলাম শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে।’এ বিষয়ে পরবর্তী সময়ে আমার নিজেরও কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিছু প্রীতিকর, কিছু ...কঠিন ও বিপর্যয়কর পরিস্থিতি আজ বাধ্য করেছে আমাদের আরাকানী ভাইবোনদের, একটুকরো রুটির জন্য হাত বাড়াতে। আমরা যদি ভাবি, তারা ...। আমাদের আচরণে বা উচ্চারণে যদি প্রকাশ পায় সামান্যতম অবহেলা বা অবজ্ঞা, কিংবা করুণা তাহলে আমরাই ছোট হয়ে যাই নিজের কাছে এবং আমার স্রষ্টার কাছে। কত শরীফ, সম্ভ্রান্ত ও অভিজাত মানুষ, কখনো যারা কারো সামনে হাত পাতেনি, বরং বহু হাত তাদের দানে ধন্য হয়েছে, আজ কী ভয়াবহ পরিস্থিতি তাদের এনে দাঁড় করিয়েছে ...!!অনেক নারীকে দেখেছি, তাদের কালো বোরকার উপরে যেন আরেকটি বোরকা! লজ্জার, সঙ্কোচের, আত্মমর্যাদার!! যেন মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার আকুতি হাত পাতার লজ্জার কারণে। এ অবস্থায় আমরা যদি আগে বেড়ে লজ্জা দেয়ার মত কিছু বলি তাহলে তো আমাদের মনুষ্যত্বের দৈন্যই শুধু প্রকাশ পাবে! পক্ষান্তরে যদি তাদের মর্যাদা রক্ষা করে কথা বলি, অন্তত আমার কাছে হাত পাতার লজ্জা থেকে তাদের উদ্ধার করি, নিজেই প্রার্থী হয়ে তাদের কাছে যাই, অমর্যাদা থেকে তাদের রক্ষা করি, আল্লাহ খুশী হবেন। দুনিয়া-আখেরাতে তিনি আমাদের মর্যাদা দান করবেন।এই মুহাজিরীনের সঙ্গে যেখানে মাওলানা ফায়রোযের দেখা হলো সেখান থেকে নিকটতম শিবিরটি হলো ‘মুছনি’। প্রায় তিন কিলো- মিটার দূরে! কল্পনা করুন, তিন কিলোমিটার দূরে! কীভাবে সেখান পর্যন্ত যাবে এই বিধ্বস্ত কাফেলা! মাওলানা ফায়রোয বলেন, ‘আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে, এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন কীভাবে তারা!!’ প্রতিটি মায়ের কোলে শিশু। কোন কোন ছেলে মেয়ের কোলে তাদের ছোট ভাই বা বোন। আরো আছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা! কিন্তু উপায় নেই, যেতেই হবে এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ঐ মুছনি শিবিরে! কিন্তু সেখানেও কি আছে অন্ধকারের শেষ এবং আলোর শুরু?! সেখানেও তো অনিশ্চিত জীবন এবং জীবনের অনিশ্চয়তা! সেখানেও তো ক্ষুধা পিপাসা, কষ্ট আর দুর্ভোগ! সেখানেও তো ছায়ার অভাব, মায়ার অভাব!!তবু মনে হলো তাদের মুখে স্বস্তির আভাস! মৃত্যুর থাবা থেকে তো বেঁচে এসেছে! আবরুর লুণ্ঠন থেকে তো রক্ষা পেয়েছে!!সত্য যে, এখানে সকালের অনাহারের সঙ্গে নেই রাতে একটুকরো রুটির নিশ্চয়তা; রাতের অনাহারের সঙ্গে নেই সকালে ...!! তবু তারা ভাবছে, এখানে তো আমাদের মুসলিম ভাইবোনেরা আছে! নিশ্চয় তারা এগিয়ে আসবে জীবনের দুঃসহ ভার কিছুটা হলেও লাঘব করার জন্য। নিশ্চয় আমাদের প্রতি দয়া হবে তাদের, যেখানে যত মুসলিম আছে সবার!! তারা ভেবেছে, হয়ত এভাবে একসময় দূর হয়ে যাবে জীবন থেকে সব অনিশ্চয়তা, সব অন্ধকার! মানুষের সামনে যখন থাকে সীমাহীন অন্ধকার, আর অনিশ্চয়তা তখন অনেক দুর্বল পাটাতনের উপর দাঁড়িয়েও বড় আশা ও বিশ্বাস লালন করতে চায়! হয়ত তাতেও কিছুটা সাহস ও শক্তি সঞ্চিত হয়।কোথায় কত দূরে আশ্রয়শিবির? কীভাবে যেতে হয় সেখানে, কিছুই জানা নেই। মাওলানা ফায়রোয মুহাজিরীনদের বিশ্রামে রেখে নিজেই দৌড়ঝাঁপ করে যতটা সম্ভব সহজে তাদের আশ্রয়শিবিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।যাওয়ার সময় মানুষগুলো দু‘আ দিতে আর কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুললো না।মাওলানা ফায়রোযের চিন্তা আমার কাছে ভালো লাগলো। তিনি বললেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে তাওফীক দিয়েছেন, তাই এমন অপ্রত্যাশিতভাবে বিপদগ্রস্ত ভাইদের সামান্য খেদমতের সুযোগ হয়ে গেলো। খুবই সামান্য। যা করা দরকার ছিলো, যেভাবে করা দরকার ছিলো সেভাবে তো আর করতে পারিনি।’বিবরণ শুনে আব্বু মাওলানা ফায়রোযকে বললেন, আমার মনে হয় তোমাদের কাজ এখন শাহপরীর দ্বীপে। যত তাড়াতাড়ি পারো শাহপরীর দ্বীপে যাও।মাওলানা ফায়রোয পরে বলেছেন, ‘আল্লাহ জানেন, হুযূর কীভাবে বুঝতে পেরেছেন! শাহপরীর দ্বীপে গিয়ে দেখি, সত্যি বড় করুণ অবস্থা নাফ পার হয়ে আসা শত শত বিপর্যস্ত মুহাজিরীনের। অথচ তাদের ‘হালপুরসি’ করার কেউ নেই! পুরো সফরে হুযূরের প্রতিটি আদেশের যথার্থতা এভাবে আমরা উপলব্ধি করেছি।

***

আমাদের মানচিত্রে একেবারে নীচের দিকে দক্ষিণে যে বিন্দুটি তার নাম শাহপরীর দ্বীপ। দু’দিকে সাগর, একদিকে নাফনদী। টেকনাফের মূল ভূমি থেকে শাহপরীর দ্বীপে যাওয়ার পথে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটা জলাভূমি পার হতে হয়। জোয়ারের সময় নৌকা বা স্পীডবোট হলো মাধ্যম। ভাটার সময় কাদাপানির হাঁটা পথ; সে এক কঠিন অবস্থা!একসময় সড়ক যোগাযোগ ছিলো। বাঁধ ভেঙ্গে সমুদ্রে ভেসে গিয়েছে। কবে বাঁধ আবার তৈরী হবে, কেউ জানে না। যে ক’টি পথে মুহাজিরীন আরাকান থেকে আসছেন তার মধ্যে একটি হলো শাহপরীর দ্বীপ। শুধু এ পথেই প্রতিদিন গড়ে পাঁচহাজার মুহাজিরীন প্রবেশ করছেন (অথবা অনুপ্রবেশ!) মানুষগুলো যে এসে, নৌকা থেকে প্রায় চলৎশক্তি রহিত অবস্থায় সেখানে তাদেরকে একটু হামদর্দির সঙ্গে স্বাগত জানানোরও কেউ নেই। একটু সমবেদনার সঙ্গে যে তাদের গ্রহণ করা হবে সে ব্যবস্থাও নেই।নৌকা থেকে নামার পর অসহায় শিশু-নারী-বৃদ্ধ মুহাজিরীনের প্রথম যে জিনিসটির প্রয়োজন তা হাসি মুখের একটি সালাম!তারপর প্রয়োজন একটুকরো রুটির, কয়েক ফোঁটা পানির।মানবতার ডাকে, ঈমান ও ভ্রাতৃত্বের আহ্বানে বহু মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে আসছেন। তারা যা করেছেন এবং করছেন, সত্যি তার কোন তুলনা নেই। তাদের জাযা তো একমাত্র আল্লাহর কাছে। তবে একটুকরো রুটির সঙ্গে যদি আমরা উপহার দিতে পারি আশ্বাসের, বিশ্বাসের এবং সান্ত¦নার প্রাণ শীতল করা একটুকরো হাসি তাহলে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মানুষগুলো পথের সব দুঃখ, কষ্ট ও দুর্দশার কথা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যেতে পারে।একথাগুলো আব্বুর মুখ থেকে শোনা। কাফেলার উদ্দেশ্যে তিনি বলেছেন একাধিকবার। আল্লাহর শোকর আমাদের কাফেলা আচরণে উচ্চারণে একথাগুলো পালন করার চেষ্টা করেছে যথা-সাধ্য এবং সুফলও তারা প্রত্যক্ষ করেছে। শাহপরীর দ্বীপে আমাদের কাফেলার সাময়িক ঠিকানা ছিলো বড় মাদরাসা নামে পরিচিত বাহরুল উলূম মাদরাসা,  যার মুহতামিম হযরত মাওলানা  হোসায়ন ।১

(লেখাটির সম্পাদনার সময়, মাওলানা ফায়রোয যখন চতুর্থ কাফেলা নিয়ে মুহাজিরীন শিবিরে, তখন ... তিনি ইন্তিকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। আল্লাহ তা‘আলা বেলা হিসাব জান্নাত নছীব করুন, আমীন। তামান্না থাকা সত্ত্বেও মাওলানা ফায়রোয তার জানাযায় শরীক হতে পারেননি। কারণ সদাশয় সরকার আদেশ করেছেন, বাইরে থেকে কেউ শাহপরীতে যেতে পারবে না।)

ঐ মাদরাসার শিক্ষক, আমাদের ফায়রোয ভাইয়ের উস্তায, মাওলানা ইউনুস তিনি আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা উত্তম বিনিময় দান করুন।শাহপরীর দ্বীপে কাফেলার অবস্থান ছিলো পনের দিন। যিম্মাদার কর্মবণ্টন করে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যার পর রাতের আঁধারে শুরু হয় মুহাজির নৌকার আগমন। তিনজন সেখানে উপস্থিত থাকতেন সালাম ও হাসিমুখে ইসতিকবালের জন্য! সঙ্গে পানি ও শুকনো খাবার। হাসি মুখের সালাম যেন আধমরা মানুষ-গুলোর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করতো। একটা যেন আপনত্বের আশ্বাস লাভ করতো! নৌকা থেকে নামার পর তাদের সামনে প্রথম প্রশ্ন, কোথায় যাবে, রাতের আশ্রয় কোথায় হবে? এতদিন কীভাবে হয়েছে শুনে কষ্টই হলো। একটু সুচিন্তা, একটু শৃঙ্খলা কষ্ট ও দুর্ভোগ লাঘবে কতটা যে সহায়ক ...!শাহপরীর দ্বীপের বড় মাদরাসা-সহ প্রতিটি মাদরাসা দিলের ও ঘরের দুয়ার খুলে দিয়েছিলো তাদের মুহাজির ভাইদের জন্য।আমরা অর্থের বিনিময়ে রাহবার নিযুক্ত করেছিলাম তিনি মুহাজির -দলকে আলো দিয়ে পথ দেখিয়ে দেড় কিলোমিটার দূরের মাদরাসায় নিয়ে আসতেন। এ মাদরাসাই ছিলো পরদিন দুপুর পর্যন্ত তাদের আশ্রয়স্থল। রাতের ও সকালের শুকনো খাবারের ইনতিযাম ছিলো আমাদের যিম্মায়। দুপুরের দস্তরখান ছিলো ভাত-গোশতের। ইন্তিযাম কখনো আমাদের কাফেলা করেছে। কখনো খেদমতের জন্য আসা কোন কাফেলা চেয়েছে শরীক হতে, আমরা খুশী মনে শরীক করেছি। দুপুরে আমরা প্রয়োজনীয় রাহাখরচ দিয়ে মুহাজিরীনদের পাঠাতাম টেকনাফে। সেখান থেকে পাঠানো হতো আশ্রয়শিবির-গুলোতে। এ দায়িত্ব খুব নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আঞ্জাম দিচ্ছেন আমাদের দাওয়াত ও তাবলীগের ভাইয়েরা। এটা কর্মধারায় ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত-বাহী, যা প্রশংসার যোগ্য।একটি রাত ও একটি দুপুর যদি ছয়শ/হাজার/বারশ বিপর্যস্ত, বিশৃঙ্খল মানুষ ,শিশু, নারী, বৃদ্ধ , যদি কোন স্থানে অবস্থান করে, ঘরের, মাঠের, হাম্মামের পরিচ্ছন্নতা-পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে, সহজেই বোঝা যায়।

আমাদের কাফেলা প্রতিদিন পরবর্তী মুহাজিরদল আসার আগে সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখতো। এ কাজে স্থানীয় লোকদেরও সাহায্য নেয়া হয়েছিলো। উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেয়ে তারাও কাজ করেছে খুশী মনে। মুহতামিম ছাহেব আমাদের কাফেলার, বিশেষ করে পরিচ্ছন্নতার নেযাম দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।স্থানীয় তালেবানে ইলমের কথা আবার বলতে হয়। সারা দেশের আলিমসমাজ, যারা নীরবে, প্রচার-প্রচারণা এড়িয়ে সবার আগে ছুটে এসেছেন খিদমতের জাযবায়, ঈমান-ইনসানিয়াতের দাবিতে, স্থানীয় তালিবানে ইলমের ইখলাছ ও আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতার ওছিলায় তাদের কাজ অনেক আসান হয়েছে। আল্লাহ সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন।একদিন এক তালিবে ইলমকে বলা হলো, আপনি তো অনেক কষ্ট করছেন ...তিনি খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, এতটুকু যদি না করি তাহলে কাল হাশরে কী জবাব দেবো যখন আল্লাহ বলবেন, আমি তো গিয়েছিলাম শাহপরীর দ্বীপে তোমার কাছে ক্ষুধা নিয়ে। খাবার চেয়েছি তোমার কাছে ... তখন কী জবাব দেবো বলেন? কথাগুলো যখন বলছেন দেখা গেলো তার চোখ দু’টো ভিজে উঠেছে। ব্যস, এখানেই পার্থক্য খেদমত ও ত্রাণের মধ্যে। খেদমতের খাদেম তার আচরণে উচ্চারণে হবেন বিনয়ী এবং ... পক্ষান্তরে ত্রাণের ক্ষেত্রে ত্রাতা তার আচরণে উচ্চারণে হতে পারেন অনেক কিছু।মাওলানা ফায়রোযের ভাষায়, ‘কেউ যদি কিছুটা হলেও বুঝতে চায় ঐ পারে আরাকানের মুসলিম জনপদে চলছে কী হিং¯্রতা ও নৃশংসতা এবং কী ভয়াবহ গণহত্যা তাহলে তিনি একটি রাত, সন্ধ্যা থেকে সকাল শাহপরীর দ্বীপে নাফনদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকলেই ...! যিন্দা লাশ কথাটা উর্দূ কিতাবে পড়েছি, এখানে শাহপরীর দ্বীপে যেন তা বাস্তবে দেখা হলো!এক দু’দিন ঝড় হয়েছে, মোষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। এই ঝড়বৃষ্টিকবলিত রাতের অন্ধকারেও মুহাজিরীনের আগমন¯্রােত থামেনি। তাদের অনেকেরই ভেজাকাপড় শরীরেই শুকিয়েছে। কারণ গায়ের কাপড়ই ছিলো একমাত্র কাপড়!মাওলানা ফায়রোয ফোনে একদিন কান্নারুদ্ধ কণ্ঠে যা বলেছেন তা মনে পড়লে এখনো বুকের ভিতরটা কেমন করে ওঠে! তিনি বলেন, একেকটা নৌকা যখন তীর থেকে একটু দূরে কোমর পানিতে এসে ভিড়ে, কতগুলো বুকফাটা আর্তনাদ একসঙ্গে শোনা যায়। যেন জনমের মত দুঃখ-কষ্টগুলো সব একসঙ্গে বের হয়ে আসতে চায় বুকের ভিতর থেকে। ওপারে তো এই আর্তনাদেরও সুযোগ ছিলো না।এ সময় নৌকার মাঝি এবং স্থানীয় কিছু ... এমনকি আমাদের এত সুনামের সীমান্তরক্ষী ... নাহ্ থাক!আমাদের কাফেলা শাহপরীর দ্বীপে থাকার সময়ের ঘটনা। বুক পানিতেই নামতে বাধ্য করা হলো অসহায় মুহাজিরীনকে। কীভাবে নামবে?! সাহায্যকারীরা অনেক চেয়েছিলেন পোল করে দিতে ... না, নিষেধ! এক মা, দুমাসের কোলের সন্তান নিয়ে কীভাবে এ পর্যন্ত এসেছেন সে তো আলাদা কাহিনী! নৌকা থেকে কীভাবে নামবেন বুঝতে পারছেন না। কড়া ধমক খেয়ে তাড়াতাড়ি নামতে গেলেন, আর ... আর পিছন থেকে ধাক্কা খেয়ে বাচ্চাসহ পড়ে গেলেন পানিতে। অনেক কষ্টে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু বাচ্চাটা আর বুকে নেই!ইয়া আল্লাহ! আমাদের নির্দয়তা থেকে কে বাঁচাবে আমাদের!! এই মা যতদিন বেঁচে থাকবেন, যতদিন পৃথিবীর আলো এবং বাতাস গ্রহণ করবেন, এ মায়ের বুকের যন্ত্রণা কেমন হবে?! কেমন হতে পারে?!এ তো হলো হাজার ঘটনার একটা ঘটনা!তারপরো এই মানুষগুলো খুশী একটু পা রাখার জায়গা হয়েছে বলে, হোক না বুকপানিতে! তাতেই ওরা সন্তানের নাম রাখে আমাদের নামে! মিনতি জানায় আমাদেরকে সন্তানের নাম রেখে দিতে!! আমরাও ভাবি, কত কিছু বুঝি করে ফেললাম! আসমানের হিসাবে কিন্তু দিলের হালত আসে সবার আগে!মাওলানা ফায়রোয বলেন, ‘শাহপরীর দ্বীপ থেকে ‘ভাঙ্গা’ পর্যন্ত তো আমরা নিরাপদে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দিই। কিন্তু ভাঙ্গা পার হওয়ার পর ভাগ্য যদি না ভাঙ্গে তাহলে তো নিরাপদে পৌঁছে যাবে কোন না কোন শিবিরে, যেখানে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে আলোহীন, আশাহীন,অনিশ্চয়তাপূর্ণ এক জীবন।’Ñ ‘ভাগ্য যদি না ভাঙ্গে’ একথা কেন বলছেন?!মাওলানা ফায়রোয কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, তা যদি বলতে যাই, তাহলে তো বলতে হবে আমাদের জাতীয় কলঙ্কের কথা, জাতির সন্তান হিসাবে দায় তো আমাদেরও বহন করতে হবে।আসলে তিনি যা বলতে গিয়েও বলতে পারেননি তা তো প্রতিদিনের পত্রিকার পাতায় আসছে সমগ্র জাতির মুখে কলঙ্কের কালিমা লেপন করে। পথের বিভিন্ন ঝোপঝাড়ের আড়ালে ওৎ পেতে থাকে একদল নরপশু, যারা এদেশেরই সন্তান, এ মাটিতেই যাদের জন্ম!! লুণ্ঠিত কাফেলাকেই তারা আবার লুট করে বিভিন্নভাবে। এমনকি অসহায় নারীদের সম্ভ্রমের দিকেও বাড়ায় তাদের কালো হাত। ভাবছি তুরস্কের কথা। সেখানেও তো এসেছে ৩০ লাখের বেশী সিরীয় মুহাজির এবং সত্যিকারের ত্রিশলাখ!! তুরস্ক তাদের মুহাজির ভাইদের বুকে টেনে নিয়েছে ভাই হয়ে, সত্যিকারের ভাই!! সেখানে তো ...! পশ্চিমা গণমাধ্যম তো তুরস্কের কোন তিলকে তাল না বানিয়ে ছাড়ে না! তারাও খুঁজে পায়নি অসুন্দর কিছু!! হায়, কী করে এড়াবো মাটির দায়!!আমাদের কাফেলার আনছার, তারা এখন কী মানসিক অস্থিরতা ও যন্ত্রণার মধ্যে আছেন, কিছুটা আন্দায করা যায় মাওলানা ফাইরোযের কথায়। আমার দায়িত্ব হলো ফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার। তাই আমার কাছেই আসে প্রথমে সব কথা।দিনের আলো নিভে আসার সঙ্গে সঙ্গে শাহপরীর দীর্ঘ উপকূল জুড়ে যখন মুহাজিরীনের ঢল আসা শুরু হয়, কী যে হৃদয়বিদারক দৃশ্য! এমন বহু শিশু থাকে, যারা মা-বাবা দু’জনই তাদের চোখের সামনে ... তাদের মাথায় ছায়া দেয়ার মত কোন অভিভাবক নেই! চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে, কিছু ভয়াবহ স্মৃতি বুকে নিয়ে ‘স্রোতের’ সঙ্গে তারাও ভেসে চলে এসেছে! কিন্তু সবার তো তখন ‘ইয়া নাফসি’ অবস্থা! কে কার খোঁজ রাখে! কে কার হাত ধরে!!এই যে হাজার হাজার এতীম! শাব্দিক অর্থেই এতীম, তাদের কাফালাতের জন্য কি এগিয়ে আসবে কোন মুসলিম দেশ?! না আগের প্রথা অনুযায়ী এরাও হবে পশ্চিমের ‘দত্তক বলী’?!মাওলানা ফায়রোযের সঙ্গে কথা বলছি, আমার চোখ তখন পত্রিকার পাতায়! বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য দশহাজার বর্গমাইলের তিন লাখ জনসংখ্যার কাতারের বাজেট হচ্ছে মাত্র ...!!ব্যতিক্রম আছে অবশ্য একটি দেশ এবং একজন দেশনায়ক। কিন্তু বেচারা! তাকে উৎখাতের জন্য তো পশ্চিমের ঘুম হারাম। বাইরের এবং ভিতরের বন্ধুরা যে কোন অজুহাতে ... (বাধা শুধু টেঙ্কের সামনে শুয়ে পড়া জনতা) তার মধ্যেও এরদোগান আরাকানের অভিভাকহীন এতীম শিশুদের নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন, যেমন ভাবছেন সিরিয়ার এতীম শিশুদের কথা!আরাকানের জনপদে না হয় যাওয়ার সাহস নেই, ‘এমিনি’ এরদোগানের মত, শাহপরীর উপকূলেও কি এসে দাঁড়াতে পারেন না কিছু সময়ের জন্য?!মাওলানা ফায়রোয জানালেন। নাফনদীর ওপারে বহু অসহায় মানুষ পড়ে আছে, যারা অর্থের অভাবে ‘নৌকায় উঠতে’ পারছেন না। যদি জনপ্রতি তিনহাজার টাকার নিশ্চয়তা দেয়া যায় তাহলে কিছু মানুষ অন্তত আসতে পারে। ঢাকা থেকে খেদমতের জন্য আসা ‘রাহমানি কাফেলার’ আমীর মাওলানা ... কিছু অসহায় মানুষের পার হওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।আব্বু বললেন, কাফেলার পক্ষ হতে একশজনের ব্যবস্থা করো।অর্থ?আবার শুনলাম সেই কথাটি যা শুনতে সবসময় ভালো লাগে এবং অন্তরে কোমল একটি ইচ্ছে জাগে, বিশ্বাস দিয়ে জীবনের মধ্যে যেন কথাটি ধারণ করতে পারি। বললেন, অর্থের চিন্তা করো না, অর্থ আসমান থেকে আসবে, শুধু চিন্তা করো, আমলের মধ্যে যেন ‘অনর্থ’ সৃষ্টি না হয়!আল্লাহর রহমতে স্থানীয় তালিবে ইলমের সহায়তায় কাজটা আঞ্জাম দেয়া সম্ভ হলো। তবে খুব গোপনে, সাবধানে!! এটা নাকি আমাদের দিক থেকে নিষেধ। এ অপরাধে বেশ কিছু নৌকাও নাকি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা হলো এখন ‘শিথিলতা’র সময়ের অবস্থা।অসুস্থ, আহত, গুলিবিদ্ধ, পায়ে শরীরে পচনধরা ঘা, এরকম মুহাজিরীনের সংখ্যাও কম নয়। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অবস্থা সবচে’ করুণ। আমাদের কাফেলা এরকম মুহাজিরীনের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে সাধ্যমত। স্থানীয় চিকিৎসাব্যবস্থা এমনিতেই যাকে বলে ‘নাযুক’! তার উপর রয়েছে সহজ সরল মানুষগুলোকে ... এর মধ্যে পাওয়া গেলো একজন চিকিৎসক, যিনি কিছুটা মানবিকতা লালন করেন, তাকে মাদরাসায় বসার স্থান করে দেয়া হলো এবং যেভাবে তিনি ‘উৎসাহ’ বোধ করবেন সেভাবেই কথা হলো। তিনি সাধ্যমত চিকিৎসা করেছেন। আমরাও তাকে সন্তুষ্ট রেখেছি। আল্লাহর শোকর। একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর অবস্থা ছিলো খুব গুরুতর। স্বামী তখন দিশেহারা। কী করবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না। মাওলানা ফায়রোয তাকে সান্ত¦না দিলেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। তার উস্তাদ মাওলানা ... এর সাহায্যে একটা ঘরভাড়ার ব্যবস্থা করা হলো। সেখানেই তাকে রাখা হলো। খুব গোপনে। কারণ কাজটা ‘বেআইনী’ একমাত্র আইনসম্মত হলো, মরে আর বাঁচে, টেকনাফ পাঠাও।আমাদের কাফেলার মত আরো বহু কাফেলা সেখানে কাজ করছে এবং সাধ্যমতই করছে। কিন্তু আমাদের সম্মিলিত সাধ্যটুকুও ছিলো প্রয়োজনের সমুদ্রে মাত্র কয়েকটি বিন্দু!!

***

রাত দশটার দিকে মাওলানা ফায়রোয জানালেন একজন অসুস্থ বৃদ্ধা, গতকালই এসেছেন, মানে আনা হয়েছে। শুধু দু’জন মেয়ে। কীভাবে তারা মাকে এনেছে, জিজ্ঞাসা করার সাহস হয়নি। কারণ তারা নিজেরাও হয়ত ..। ব্যস, সম্ভব হয়েছে শুধু আল্লাহর সাহায্যে !লিখবো কি না বুঝে উঠতে পারছি না। ভুল হলে আল্লাহ যেন মাফ করেন। তাদের একমাত্র ভাইটি মা-বোনদের ফেলে স্ত্রীপুত্রসহ আগেই বের হয়ে গেছে। মেয়েরা তো আর মাকে ফেলে আসতে পারে না! তাই যেভাবেই হোক ‘বহন’ করে এনেছে! তবু কি পেরেছে মুক্ত হতে নয় মাস বহনের দায় থেকে!কে জানে! এটাকেই হয়ত বলে হাশরের ইয়া নাফসি!! হয়ত এমন কঠিন পরিস্থিতিতে এমন দুর্বলতা যে কোন মানুষের হতে পারে। আল্লাহ মাফ করুন।মাওলানা ফায়রোয বললেন, বৃদ্ধার খুবই মুমূর্ষু অবস্থা। চিকিৎসক বলছেন, এখনই নিতে হবে টেকনাফের হাসপাতালে।মাদরাসার মুহতামিম ছাহেব সতর্ক করলেন, ‘এই বুড়িকে নিয়ে বের হলে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও বিপদ, আর পথে মারা গেলে তো...! আব্বু বললেন, দেখো, আমি তো নিরাপদ স্থানে বসে বলছি, তুমি আছো ঘটনার স্থানে। সিদ্ধান্ত তুমিই নেবে। তবে আল্লাহর উপর ভরসা করে যদি বের হও, দেখবে, আল্লাহ সাহায্য করছেন!মাওলানা ফায়রোয আল্লাহর উপর ভরসা করে বের হলেন কাফেলার একজনকে নিয়ে। রাত তখন এগারটা। জনশূন্য এবং যানশূন্য রাস্তা! এর মধ্যেও একজনকে পাওয়া গেলো কয়েক গুণ ভাড়ার কথা বলে। জলাভূমি পর্যন্ত আসা হলো, স্থানীয়রা যাকে বলে ‘ভাঙ্গা]। জোয়ারের সময় গাড়ী থেকে নেমেই নৌকা বা বোট পাওয়া যায়। তখন ছিলো ‘পূর্ণ’ ভাটা। নৌকা যদি পাওয়াও যায়, জলাভূমির মাঝ পর্যন্ত যেতে হবে কাদাপানি পাড়িয়ে।আমাদের তালিবে ইলম, ‘ভাই’ আরীফ বিসমিল্লাহ বলে বৃদ্ধাকে কাঁধে তুলে নিলেন। আল্লাহু আকবার! ঐ জলাভূমি দেখেননি যারা তাদের বোঝানো যাবে না, কী অকল্পনীয় ঘটনা এটা! অন্ধকার গভীর রাত। জলাভূমির পিচ্ছিল কাদাপানিতে একজন বৃদ্ধাকে নিয়ে ...মাওলানা ফায়রোয উচ্চস্বরে  যিকির করছেন হয়ত সাহস সঞ্চয়ের জন্য।ভাই আরিফ যখন সামর্থ্যরে শেষ বিন্দুতে এসে পড়েছে ঠিক তখন এই গভীর রাতে, জনমানবহীন পথে, কাদাপানির জলাভূমিতে আল্লাহ একজন ‘ফিরেশতা’ পাঠালেন। ফিরেশতা ছাড়া আর কী বলা যায়?! তিনিও নাকি অনিবার্য প্রয়োজনে বের হতে বাধ্য হয়েছেন। যিকিরের আওয়ায শুনে একটু থেমেছেন! আসলে সবই হয় আসমানের ইশারায়।তো এই ফিরেশতা এবার বৃদ্ধাকে কাঁধে তুলে নিলেন। এভাবে পালাক্রমে বহন করে তারা এসে পৌঁছলেন জলাভূমির মাঝখানে। পানি অনেক। আর হাঁটা সম্ভব নয়। বৃদ্ধাকে কাঁধে করে তারা দাঁড়িয়ে থাকলেন নৌকার অপেক্ষায়।মনে হতে পারে গল্প, কিন্তু বাস্তব!সঙ্গে ছিলেন বৃদ্ধার এক মেয়ে। মায়ের তখন শ্বাসকষ্ট চরম! কিন্তু তার চেয়ে কঠিন হলো তার মনের আতঙ্ক! একটু পর পর মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আঁরে খোন্ডে নেদ্দে?! (কোথায় নিয়ে যায় আমাকে?) মেয়ে সান্ত¦না দেন, মা, ভয় নাই। এখানে ‘মিলিটারি’ নাই। আর এরা মৌলভি, তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে।বৃদ্ধা কিছু সময়ের জন্য চুপ করেন। আবার ...।ভাই আরিফের মন্তব্য এখানে লিখতে ইচ্ছে করছে, ‘যখন পা ভেঙ্গে আসতে চায়, শুধু ভাবি, দুই মেয়ে তাদের বৃদ্ধা মাকে নিয়ে পাহাড়ের চড়াই উৎরাই ডিঙ্গিয়ে এরকম কত জলাভূমি পার হয়ে যদি আসতে পারেন, আমি কেন পারবো না, যদি ইনি আমার মা হন!!’মাওলানা ফায়রোয ঐ জলাভূমি থেকেই ফোনে বলছিলেন, বৃদ্ধাকে কাঁধে নিয়ে অপেক্ষার পুরো সময়টা খালি মনে হয়েছে, এমন কত রাত পার হয়েছে এবং হচ্ছে আরাকানে আমাদের মযলূম ভাই-বোনদের! ...দুঘণ্টা অপেক্ষার পর দূরে একটা নৌকার আলো দেখা গেলো। তাকে ডাকা হলো এবং ভাড়া দেয়া হলো পাঁচগুণ! বেচারা যদি সাহস করে দশগুণ চাইতো, পেয়ে যেতো! তো সাহস করে যা চেয়েছে তাই পেয়েছে!এপারে তো আলহামদু লিল্লাহ আমাদের নিজস্ব বাহন অপেক্ষায় ছিলো। অল্প সময়ে এসে গেলো টেকনাফ উপজেলা ক্লিনিক।ক্লিনিকে তখন আলো নেই। চিকিৎসক সাহেবকে ঘুম থেকে জাগানো হয়েছে বলে ‘নারায’ হলেন। তারপর তো ‘রোহিঙ্গা বুড়ি’কে দেখে ...! অনেক কাকুতি মিনতির পর রোগীকে একটু যেন নেড়ে চেড়ে দেখলেন। তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে বলে দিলেন, এখানে সম্ভব না। হাসপাতালে যান। আবার কাকুতি মিনতি, ‘একটু অক্সিজেনের ব্যবস্থা যদি হতো!’ এবং হলো। বৃদ্ধা তাতে একটু যেন স্বস্তি বোধ করলেন।এর পর .. নাহ্ আর কিছু বলতে চাই না। শুধু কামনা করি এমন চিকিৎসকের ...।শেষ পর্যন্ত কোন উপায় না পেয়ে সবচে কাছের আশ্রয় শিবিরে  নেয়া হলো ফজরের সময়। আর ফজরের কিছু পর তিনি ...! তার সব কষ্ট যেন দূর হয়ে গেলো। যেন তিনি শান্তির জান্নাতে পৌঁছে গেলেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। আল্লাহ তাকে এবং তাঁর কাছে যাওয়া সব মজলুমানকে রহমতের ছায়া দান করুন। ঐ বৃদ্ধার মেয়ে দু’টিকে এবং সব অসহায় মানুষকে আল্লাহ নিরাপদে রাখুন, আমীন।

***

কাফেলার দ্বিতীয় প্রধান সদস্য হলেন মাওলানা যাহিদ। তিনি তার কাজে নিযুক্ত ছিলেন নীরবে। একদিন বিকেলে তিনি ফোন করলেন। একে তো  মাওলানা ফায়রোযের পরিবর্তে তিনি ফোন করছেন, তার উপর সালামের আওয়ায থেকেই মনে হলো গুরুতর কিছু! তিনি বললেন, এখন আমরা নাফনদীর তীরে মুহাজিরীনের অপেক্ষায়। ঐ পারে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে দাউ দাউ আগুনে! ...সভ্য পৃথিবীর চোখের সামনেই ঘটছে এই পাশবিকতা! এই হিং¯্রতা ও নৃশংসতা!! এই গণহত্যা ও জাতিগত নিধনযজ্ঞ!!কোন মুসলিম দেশের তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ ঘটনায় যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের গন্ধ পায়, আর সম্পদ জব্দ করে সাজা দিতে চায় তাদের নাকে কেন যায় না এখন আরাকানী জনপদের এই ভয়াবহ আগুনের ধোঁয়া?!এই সেদিন ইরাকে যায়দী সম্প্রদায়কে ‘গণহত্যা থেকে রক্ষার জন্য’ ছুটে গেলো পশ্চিমা বিমান খাবার, পানি, আগুন ও বোমা নিয়ে, তারা আজ ‘বার্মা’র কাছে এমনকি অস্ত্রবিক্রিও বন্ধ করতে রাজি না! কারণ এখনো  গণহত্যা বলার মত পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি! তামাশা আর কাকে বলে!!আসলে একসাগর রক্তও তুচ্ছ যদি তা হয় মুসলিমরক্ত।ওদের দোষ দিয়ে কী হবে। ওরা তো যা করার তাই করছে। দুঃখ তো হয় নিজেদের উপর। এখনো আমাদের ‘জোট’ ইয়ামেনে বোমা ফেলে, কাতারকে রুটি-পানিতে মারার ফন্দি করে!মুহাজিরীনের একেকটি দল আসে, আর সঙ্গে নিয়ে আসে নিষ্ঠুরতা, হিংশ্রতা ও নৃশংসতার নতুন নতুন ঘটনা। কিন্তু সবচে’ বেদনাদায়ক হলো যখন আমাদের মুহাজির ভাইয়েরা সর্বশেষ নিগ্রহের শিকার হয় আমাদের কাছে এসে আমাদেরই হাতে!!নৌকার মাঝি মাঝনদীতে এসে দাবী করে আরো বেশী ভাড়া। দিতে না পারলে ছিনিয়ে নেয় এমনকি সঙ্গে করে আনা অলঙ্কার। হুমকি দেয়া হয় নৌকা ডুবিয়ে দেয়ার এবং দেয়ও!! আবার পরিবারের একদু’জনকে আটকে রেখে অন্যদের বলা হয়, টাকা এনে ছাড়িয়ে নাও!!এরূপ পরিস্থিতিতে কিছু হৃদয়বান মানুষ চেষ্টা করছেন মুহাজিরদের পক্ষ থেকে অর্থ আদায় করতে, যাতে অন্তত শেষ মুহূর্তের যুলুম থেকে তাদের বাঁচানো যায়।আব্বু বললেন, চেষ্টা করে দেখো, স্থানীয় লোকদের সাহায্যে নৌকা ও মাঝি খরিদ করা যায় কি না!চেষ্টা করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা হলো তা এখানে না লেখাই বোধহয় ভালো।ভয় লাগে, কিছু মানুষের ‘অমানুষতা’ তো পুরো জাতিরও সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে!! কিন্তু কে আছে বলবার?! কে আছে শোনবার?!মাওলানা ফায়রোয বললেন, শাহপরীতে খুব জোরে শোরে মাইকিং হচ্ছে ‘কোন রোহিঙ্গাকে কেউ জায়গা দেবেন না। কারো ঘরে যদি কোন রোহিঙ্গা থাকে, এখনই বের করে দেন। অন্যথায় শাস্তির সম্মুখীন হবেন!!ইয়া আল্লাহ! ইয়া রাহমান!! আমরাই আবার বলছি, ‘শরণার্থী জীবনের কষ্ট আমাদের চেয়ে বেশী কে বোঝবে?!’ভাবলেই লজ্জায় এতটুকুন হয়ে যাই যে, এ ঘোষণা শুনে নিরাশ্রয় অসহায় মানুষগুলোর মনের অবস্থা কেমন হতে পারে? উদ্দেশ্যই বা কী এ অমা...?! মাওলানা ফায়রোয চিন্তিত হয়ে পড়লেন ঐ অসুস্থ অন্তঃসত্ত্বা মহিলার জন্য যাকে ভাড়াঘরে রাখা হয়েছে।আব্বু বললেন, চিন্তা করো না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।

*** 

২৫শে আগস্টের পর প্রায় একমাস পার হয়েছে। সাগরে কখনো জোয়ার, কখনো ভাটা; কিন্তু মুহাজিরীনের স্রোতে কোন ভাটা নেই।দু’এক দিন থেকে দেখা যাচ্ছে, তাদের আসার সংখ্যা কমে আসছে। এ সম্পর্কে বিভিন্ন কথা শোনা যায়, পত্রপত্রিকায়ও লেখা হয়। আরাকান নাকি এখন বিরান হয়ে গেছে। গণহত্যা থেকে যারা বেঁচে গিয়েছেন তারা প্রায় সবাই এসে গিয়েছেন। আবার শোনা যায়, মগদস্যুরা এখন কাউকে আসতে দিচ্ছে না নতুন কোন কৌশলের কারণে। হয়ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য ‘চোখধোলাই’-এর ব্যবস্থা!*্আল্লাহর ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত হলো আরেকটি কাফেলা পাঠানোর, যা প্রথম কাফেলার সঙ্গে যুক্ত হবে। আব্বু আমাকে বললেন, বাবা, আমি তো বিমার বুড়া! আমার দিলের তামান্না, তুমি এই খিদমতের ময়দানি জিহাদে শরীক হয়ে আসো।আমি তো খুশিমনেই রাজি!কাফেলায় আছেন সালমান ভাইয়া, সঙ্গে আমাদের তালিবে ইলম, ভাই যোবায়র।চট্টগ্রামে রাত যাপন করে ফজর-বাদ কক্সবাজার হয়ে টেকনাফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। কক্সবাজার থেকে টেকনাফের পুরোনো পথে এখন কেউ তেমন একটা যায় না। সবাই যেতে চায় নতুন সড়ক মেরিনড্রাইভ দিয়ে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফের সাবরং পর্যন্ত আশিকিলোমিটার দীর্ঘ সুন্দর পথ। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মত। পর্যটন- শহরের উপযোগী বনাঞ্চল তৈরী করা হয়েছে।হাঁ, পর্যটনশহর! দেশের কিছু মাথায় নাকি এখন ব্যথা শুরু হয়েছে, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে পর্যটনশহর হুমকির মুখে’, ‘পরিবেশের উপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব’, বনাঞ্চল ও গাছপালা শেষ’!স্বঘোষিত সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকটি তো সেদিন তথ্য-উপাত্তসহ’ লম্বা এক প্রতিবেদনই ছেপে ফেললো! রোহিঙ্গাদের কারণে মারাত্মক পরিবেশ-বিপর্যয়। পুরো একটা মুসলিম জনগোষ্ঠী জাতিগত নিধনযজ্ঞের শিকার হলো! যারা বেঁচে আছে তারা প্রতিবেশী মুসলিমদেশে আশ্রয় নিলো, আর তুমি কাঁদছো পরিবেশবিপর্যয়ের কান্না! যদি বলো, এটা তো আমাদের সমস্যা না, আমরা আমাদের পরিবেশের বিপর্যয় মেনে নেবো কেন? ভালো কথা! ভারতও যদি বলতো একই কথা, একাত্তরে!! কী করতে তুমি? সাগরে ঝাঁপ দিতে?!টেকনাফের পথে পথে অনেক সাহায্যকারী কাফেলা নযরে পড়লো। কেউ সাহায্য দিচ্ছে, কেউ দিতে যাচ্ছে। পত্রিকায় ছবি দেখেছি বিস্কুটের প্যাকেট ছুঁড়ে দেয়ার, আর ক্ষুধার্ত শিশুদের কাড়াকাড়ির। যারা দিচ্ছেন,  দেখা গেলো, দৃশ্যটা তারা উপভোগ করছেন! আরেকটা ছবি ছিলো এরকম। ত্রাণ দাতারা ফিরে গেছেন ত্রাণ বিতরণ করে। কিছু শিশু ছিটিয়ে পড়ে থাকা চালডাল কুড়োচ্ছে!মনে পড়লো, রওয়ানা হওয়ার সময় আব্বু বলেছেন, তোমরা কিছু দিতে যাচ্ছো না, কিছু নিতে যাচ্ছো! তাদের হাতে একটুকরো রুটি দেবে, আর তাদের হাত থেকে ইনশাআল্লাহ জান্নাত নেবে! সুতরাং শেষ বিচারে তারা দাতা, তোমরা গ্রহীতা!টেকনাফ হয়ে শাহপরীর দ্বীপে পৌঁছলাম জুমার সময়। পথে পথে সেই সব মর্মান্তিক দৃশ্য, যা এ ক’দিন পত্রিকায় পড়েছি। ঠিকানাহীন অসংখ্য নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ। সন্তানকোলে মায়েরা, যেমন জীর্ণ-শীর্ণ তারা তেমনি তাদের কোলের সন্তান। যেন চলার শক্তিটুকুও আর নেই। তবু চলছেন যেন এক সমাপ্তিহীন পথে!! কেউ ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পথের পাশে বসে আছেন কোলের সন্তানকে মাটিতে বসিয়ে। কোলটারও তো বিশ্রাম দরকার!! তাদের নির্বাক দৃষ্টি সামনের দিকে! কী দেখতে চায় তারা! তাদের সামনে কিছু নেই ভবিষ্যতের অন্ধকার ছাড়া!!শাহপরীর পথে ‘ভাঙ্গা’ থেকে নৌকায় ওঠার জন্য আমরা যখন গাড়ী থেকে নামছি ধুলিমলিন ছোট ছোট শিশু, গায়ে কিছু আছে কি নেই, ছুটে এসে আমাদের ঘিরে ধরলো। কে জানে কিসের আশায়! সন্তান কোলে কয়েকজন মা এগিয়ে এলেন, তবে ধীর পদে, দ্বিধা-সঙ্কোচের পর্দা ধারণ করে। এরপর দেখলাম...! আল্লাহর শোকর, মানবতাকে ধন্য করা এমন দৃশ্যটি আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। দেখলাম একটু দূরে একজন মা, সন্তান তার বোরকার নীচে। একটু এগিয়ে আবার যেন থেমে যাওয়া। মনে হলো, সঙ্কোচের কাছে প্রয়োজন  পরাজিত হলো। হায়া ও শালীনতা যেন তাদের ...আমাদেরও যেন চলার শক্তি রহিত হয়ে গেলো! শিশুদের, মায়েদের, প্রতিটি মুখ, প্রতিটি চোখ, প্রতিটি দৃষ্টি যেন জীবন্ত, জ্বলন্ত কিছু অভিযোগ, কিছু অনুযোগ!লাগাতার সতর্ক করা হচ্ছে রাস্তায় যেন কিছু না দেয়া হয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাদের কথাও তো সত্য! কী করা যায়! অসহায় চোখের অসহায় দৃষ্টিগুলো যে সারা জীবন আমাদের বিবেককে...।হঠাৎ মনে হলো, আমরা তো দেবো না, আমরা তো নেবো! সালমান ভাইয়া আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে ‘নেয়া’ শুরু করলেন। আল্লাহর শোকর, কোন কষ্ট হলো না, কিছু নষ্ট হলো না!শাহপরী থেকে ফেরার পথে একটি দৃশ্য! যখনই মনে পড়ে কান্না পায়। নিজের অস্তিত্বটাকেই ঘিনঘিন লাগে এজন্য যে, এ দৃশ্য দ্বারা আমার দৃষ্টি অপবিত্র হয়েছে!এক মা! কোলে সন্তান, হাতে কিছু ‘সামান’!! হেঁটে যাচ্ছেন, সবার ক্ষেত্রে যেমন মনে হয়, অনিশ্চিত গন্তব্য! ক্লান্ত, শ্রান্ত, শ্লথ পদক্ষেপ!একজন ‘মানুষ’ ডাক দিলো, এই শোন্! হয়ত কিছু দেবে, আশা করেই এগিয়ে গেলেন। অবস্থা দেখে মনে হয়, বড় কোন ‘সমাজসেবক’ বা ত্রাণবিতরণ-কারী।মায়ের চেহারায় তখন আশার একটু আভা। লোকটি পকেটে হাত দিলো, মায়ের চেহারা যেন একটু উজ্জ্বল হলো। পকেট থেকে তিনি একটি নোট বের করলেন। দেখে আমিও খুশী হলাম। তারপর তিনি কী করলেন, মায়ের চোখের সামনে নোটটা ধরে বললেন, বল্ তো কয়টাকার নোট? মা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, পাঁচশ! লোকটি তখন .. হায় আল্লাহ, লোকটি তখন অট্টহাসি দিয়ে ‘বললো’, চিনলি কেম্নে? সত্য কইরা ক’ তো কবে আইছত্?বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে থাকলাম। সন্তানকোলে ঐ মায়ের মুখম-লে সেদিন কষ্টের, অপমানের, বিষাদের যে কালো ছায়া পড়েছিলো তা মনে হলে, ইচ্ছে হয় বলি, ‘ধরণী দ্বিধা হও’!! আকাশ যদি তখন ভেঙ্গে পড়তো! ভূমি যদি কেঁপে উঠতো!!আব্বুর মুখে কতবার শুনেছি, ‘কোন মাকে অন্তত তার সন্তানের সামনে লজ্জিত করো না।’কী দরকার ছিলো এমন উপহাসের?! তোমার যদি মনে হয়, পুরোনো, প্রয়োজন নেই। দিও না। কিন্তু ...!!আল্লাহর শোকর! মনে হলো, আমি তো পারি এই মায়ের অপমানের জ্বালাটা একটু কমাতে!! পিছনে পিছনে কিছু দূর গেলাম। পাঁচশটাকার একটা ‘কাগজ’ এগিয়ে দিয়ে বললাম, দয়া করে নিলে খুশী হবো।একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন!! জানি না কী ভাবলেন, চোখ দু’টো বোধহয় ভিজেও উঠলো। হাত বাড়িয়ে নিলেন। যে ভাষা বুঝি না সে ভাষায় দু‘আ করলেন।এরকম বেদনাদায়ক দৃশ্য পথে পথে কত যে ...।ভাঙ্গা থেকে নৌকায় ওঠার একটু আগে একস্থানে  স্রোতের টানে কিছু মাটি সরে গিয়ে গর্তের মত হয়েছে। অল্প একটু জায়গা। সেটা অতিক্রম না করে নৌকায় ওঠা যায় না। তো আল্লাহর কোন এক বান্দা বাঁশ দিয়ে ছোট একটি নড়বড়ে সাঁকো তৈরী করে দিয়েছেন। ভাবলাম, যারাই করেছেন, বড় একটা খেদমত করেছেন। কাছে গিয়ে  দেখি, দু’জন ‘খাদেম’ মজবূতভাবে দাঁড়িয়ে খেদমতের ‘যাকাত’ উশূল করছেন। বিশফুটের মত জায়গার উপর ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকো, জনপ্রতি দশটাকা! মুহাজিরদেরও ছাড়া নেই। দাঁড় করিয়ে রাখছে। এখানেও আল্লাহর কিছু বান্দা মুহাজিরদের খিদমত করলেন। আমরাও শরীক হলাম। জানি, বলে লাভ নেই। তবু সংযমে থাকা সম্ভব হলো না। বললাম, অন্তত মুহাজিরদের অবস্থার উপর একটু দয়া করেন। Ñআমাদের বলে কী লাভ। আমরা শুধু পঁয়সা উশুল করি! শুনে আমি তো অবাক! এখানেও ‘বড়’দের ...। সত্যি, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি...!শাহপরীর দ্বীপে কিছু সময়ের মধ্যে যা উপলব্ধি হলো তা এই যে, আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ক্ষুদ্র কাফেলাকে অনেক বড় খেদমতের তাওফীক দিয়েছেন। স্থানীয় লোকেরাও একবাক্যে বললেন, আপনারা সবচে’ জরুরি ক্ষেত্রে সবচে’ জরুরি খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। এখন ভেবে অবাক হই, আব্বু ঢাকা থেকে কীভাবে খেদমতের স্থান নির্ধারণ করেছেন! আবার আসার সময় বলে দিয়েছেন, এখন শাহপরীর দ্বীপে তেমন কাজ নেই। তোমরা আশ্রয়শিবির -গুলোতে যাও। এখন খেদমতের আসল স্থান ওখানে। পরে দেখা গেলো, এটাও ছিলো সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত।পুরো সফরে আমরা অনুভব করেছি তিনি যেন সব দেখে দেখে নির্দেশনা দিচ্ছেন। আরো সঠিক হবে যদি বলি, ‘তিনি না থেকেও যতটুকু ছিলেন, আমরা থেকেও ততটুকু থাকতে পারিনি।’তবে চেষ্টা করেছি প্রতিটি বিষয় আব্বুকে জানিয়ে তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে এবং আলহামদু লিল্লাহ্, খুব উত্তমরূপে আমরা এর সুফল পেয়েছি। তবে যে জিনিসটা তাঁর কাছ থেকে আমার এবং আমার ‘ভাইদের’ শেখা উচিত তা এই যে, কখনো তিনি আদেশের আন্দাযে কিছু বলেন না। পরামর্শের আন্দাযে বলেন, আবার আমাদের মতামতও গুরুত্বের সঙ্গে শোনেন। ব্যস, এই একটি জিনিস যদি আমাদের জীবনে এসে যায়, পুরো জীবন আমাদের শোধরে যায় এবং ইজতিমায়ী যিন্দেগি আসান হয়ে যায়।শাগিরদ হিসাবে আমাদের প্রতি Ñবিশেষ করে সন্তান হিসাবে আমার প্রতিÑ আল্লাহ তা‘আলার বড় ইহসান এই যে, আমরা পরামর্শ দিই, তাতে আমাদেরও চিন্তার অনুশীলন হয়, তবে করণীয় নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব আমাদের কাঁধে চাপে না। হাঁ, আমরা সিদ্ধান্ত ‘গ্রহণ’ করি আমাদের হাকীম মুরুব্বি ও প্রাজ্ঞ দিকনির্দেশকের কাছ থেকে। তারপর আল্লাহর উপর ভরসা করে নিশ্চিন্ত মনে আমল শুরু করি। আমাদের জন্য এটা আরো সহজ হয়েছে এজন্য যে, পাহাড়পুরী হুযূরের সঙ্গে আব্বুর এরূপ আচরণই দেখেছি যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছি। এখন আব্বু বলেন, হায়, কী শান্তির দিনগুলো ছিলো! সিদ্ধান্ত গ্রহণের কঠিন দায়িত্ব ছিলো আমার মুরুব্বির হাতে। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে নিশ্চিন্ত মনে কাজ করে যেতাম। এখন তো নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হয়ই, অন্যদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়ও আমাকে ভোগ করতে হয়!

***

দুই তালিবে ইলম ভাইকে শাহপরীর যিম্মাদারি অর্পণ করে আমরা আহলে মাদরাসাকে জাযাকুমুল্লাহ বলে টেকনাফের উদ্দেশ্যে বিদায় নিলাম। আব্বুর পরামর্শে ফায়রোয ভাই আগেই পর্যবেক্ষণ করে বালুখালি পাহাড়ে আমাদের কর্মক্ষেত্র নির্ধারণ করে রেখেছেন।  ফজরের পর আমরা বালুখালির মুহাজির শিবিরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।আব্বুর ফোন এলো। তিনি বললেন, আমি দু‘আ করি, আল্লাহ যেন সবকাজ তোমাদের পক্ষ হতে তিনি নিজে করে দেন। তোমরা খুব বিনয়ের আচরণ করবে। খুব লক্ষ্য রাখবে, প্রয়োজন তোমাদের, এটা যেন প্রকাশ পায় এবং এটা যেন বিশ্বাসের মধ্যেও থাকে। আর আরাকানী শিশুদের জন্য চকোলেট নেয়ার কথা যেন মনে থাকে।আলহামদু লিল্লাহ প্রতিদিনই আমাদের মনে ছিলো। প্রতিদিন আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ চকোলেট নিতাম, আর বালুখালি পান- বাজার থেকে কাজের ক্ষেত্রে পৌঁছা পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে (একটুকরো স্নিগ্ধ হাসির সঙ্গে) চকোলেট বিতরণ করতাম। সামান্য একটা চকোলেট, তাতেই ‘ক্ষুধার্ত’ শিশুদের চোখে মুখে আনন্দের এমন উদ্ভাস! উত্তরবঙ্গেও দেখেছি এ অপূর্ব দৃশ্য। শেষে তো এমন হলো, দূর থেকে দেখেই বলে উঠতো, ঐ যে চক্লেট হুযূর!!আব্বুর আচরণ থেকে আমার শেখা হয়েছে, সবসময়, সবকাজে শিশুদের কথা আলাদা করে ভাবতে হয়।উত্তরবঙ্গে বন্যাদুর্গত ভাইদের খেদমতের জন্য কাফেলা রওয়ানা হওয়ার সময়ও  আব্বু খুব তাকীদ করে বলেছিলেন, ‘দেখো, তোমাদের সফরের কামিয়াবি কিন্তু নির্ভর করছে এলাকার শিশুদের খুশির উপর। এই যে ঈদ এলো, ঈদ গেলো, ওদের কিন্তু ঈদের আনন্দ নেই। তোমরা যদি এই শিশুদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারো তাহলে এটা তোমাদের জন্য কত কল্যাণ বয়ে আনবে কল্পনাও করতে পারবে না।আমাদের হালাত দেখে আব্বু বললেন, আমি তো বারবার বলছি শিশুদের কথা, চেহারা দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে, কথাটা এখনো তোমাদের দিলে দাখেল হয়নি।শিশুদের জন্য ঈদের হাদিয়ারূপে চকোলেটের সঙ্গে পঞ্চাশটাকার নতুন নোটও আব্বু দিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের কিছু না বলে তিনি নিজেই ব্যবস্থা করেছিলেন।কিন্তু আমাদের অযোগ্যতার কথা কী আর বলবো, আব্বুর আশঙ্কা সত্য হলো। প্রথম কেন্দ্রেই শিথিলতা হয়ে গেলো! বে-বরকতিও হলো। তবে আল্লাহর শোকর দ্বিতীয় কেন্দ্র থেকে খুব মনে ছিলো এবং আমরা সবাই এর সুফল সাদা চোখেই দেখতে পেয়েছি।তবে মুহাজিরীনের খেদমতে সফরে যেখানেই আমরা কাজ করেছি শিশুদের নিষ্পাপ হাসি অর্জনের চেষ্টা করেছি, তাতে মায়ের মুখেও ফুটেছে তৃপ্তির হাসি! আর ফায়দা ও বরকত! সুবহানাল্লাহ!একজন আরাকানী নারীর হাতে কিছু অর্থ দিয়ে হয়ত তার কিছু প্রয়োজন পূর্ণ করেছি, কিন্তু শিশুর হাতে চকোলেট দিয়ে বহু মায়ের দু‘আ নিজের কানে শুনেছি।বালুখালি মুহাজির শিবিরে যাওয়ার পথে এক মসজিদের সামনে থামলাম। মাওলানা আছেম ছাহেব আমাদের সঙ্গে চললেন রাহবার হিসাবে। তিনি এখানে বহুদিন থেকে কাজ করছেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বহু কাফেলার রাহবারি তিনি এবং তাঁর সাথীরা করে থাকেন। তাতে আগত কাফেলার জন্য সুষ্ঠু সুশৃঙ্খল-ভাবে কাজ আঞ্জাম দেয়া সহজ হয়ে যায়। আমাদের কাজে তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা অনেক সাহায্য করেছেন جزاه الله أحسن الجزاء মসজিদের সামনে ‘হামজিন্স’ বহু মানুষ দেখলাম। কথা বলার সুযোগ বা পরিস্থিতি ছিলো না। তবে শুধু চোখের দেখাতেই খুশি লাগলো। মাশাআল্লাহ, আলেম ওলামার জাম্মে গাফীর! কোন প্রচার নেই প্রচারণা নেই, অথচ ব্যাপক উদ্যোগ আয়োজন! আছেম ভাই এখান থেকে রাহবার দিয়ে খিদমতের বিভিন্ন স্থানে তাঁদের পাঠান।আসলে এটাই হলো আহলে ইলমের, বরং যে কোন মানুষের ইয্যত ও মর্যাদা লাভের পথ। ছদর ছাহেব রাহ. বলেছেন, খেদমতের রাস্তা ছেড়ে দেয়ার কারণেই আমাদের আজ এত যিল্লতি।ছদর রাহ. আরো লিখেছেন, প্রথম অহী লাভের পরপর হযরত খাদীজা রা. উৎকণ্ঠিত পেরেশান নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত¦না দিয়ে বলেছেন, ‘না, আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে কখনো ‘অপ্রস্তুত’ করবেন না। আপনি তো ‘ছিলারাহমি’ করেন। অন্যের বোঝা বহন করেন। উপার্জনহীনকে উপার্জনের ব্যবস্থা দেন। মেহমানকে আপ্যায়ন করেন। বিপদে দুর্যোগে সাহায্য করেন।’চড়াই-উতরাই ও কাদাপানিতে পিচ্ছিল দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার পর দূর থেকে দৃষ্টিগোচর হলো বালুখালি মুহাজিরশিবির।পাহাড়ের উপরে বা ঢালে ঢালে ঘর। ঘর মানে ঝুপড়ি। ঝুপড়ি মানে আমাদের বস্তিগুলোতে যা তাও নয়। শুধু পলিথিনের ছায়া। বড়জোড় চারপাশে পলিথিনেরই বেড়া। চারকোণে চারটা বাঁশ অবশ্য আছে। তেরপালও দেখা গেলো মাঝে মধ্যে। খুব কম। এই সব ঝুপড়ি ঘরে অসাহয়ের মত বসে আছে মুহাজির নারী-পুরুষ ও ছেলে-মেয়ে। বহু পরিবারে পুরুষ নেই। আরাকানেই তাদের রেখে আসাতে হয়েছে ‘শহীদানে যুল্ম’ অবস্থায়। কারো দাফন-কাফন হয়েছে; অনেকেরই হয়নি। কেউ কেউ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।বালুখালি মুহাজিরশিবিরটি গড়ে উঠেছে প্রায় একই উচ্চতার অসংখ্য পাহাড়ে। চূড়ায় এবং ঢালে খাঁজ কেটে। পাহাড়সারির ঢেউয়ের সঙ্গে যেন মিশে আছে মুহাজিরদের ‘ ভেন্নাপাতার ছানি’! দৃষ্টিসীমার শেষ পর্যন্ত একই দৃশ্য।আমরা যেখানে খেদমতের নিয়তে এসেছি সেটা বালুখালির ‘পানবাজার’ থেকে পশ্চিমে দু‘ কিলোমিটার দূরে। পানবাজারে নেমে বাকিটা হাঁটা পথ। পথ অবশ্যই নেই, আছে শুধু হাঁটা।তাই ত্রাণ বিতরণকারীরা সাধারণত হাঁটাহাঁটির কষ্টে না গিয়ে পথে গাড়ির উপর থেকেই জড়ো হওয়া মানুষের মাঝে ‘বিতরণ’ করে ফিরে যায়। তবে আল্লাহর কিছু বান্দা এমনও আছেন যারা ‘ওখানেই বেঁধেছেন ঘর’। তারা নিজেরাও করছেন, অন্যদেরও উৎসাহ দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছেন। তারা যা করছেন, বিনয়ের সঙ্গে, ইকরামের সঙ্গে করছেন এবং ... হাঁ, এবং কৃতজ্ঞতা ও শোকরের অনুভূিতর সঙ্গে করছেন। তাই তারা ‘সামান্য কিছু’ বিতরণ করেন, আর অনেক বেশী আহরণ করেন। এটাই বোধহয় পার্থক্য খেদমতে খালক আর ‘সোশাল ওয়ার্ক’-এর মধ্যে।

***

মুহাজিরশিবিরে ব্যবস্থাটা হলো মাঝিকেন্দ্রিক। মোটামুটি শতাধিক পরিবার একজন মাঝির অধীনে। ওরা ‘মাঝি’ বলে। মূলত তিনি ব্যবস্থাপক ও তত্ত্বাবধায়ক। মাঝি বা সরদারই হলেন প্রশাসনের সঙ্গে সবার যোগাযোগের মাধ্যম। তুলনামূলক ‘শিক্ষিত’, চৌকশ ও সপ্রতিভ ব্যক্তিটিই য়স্বংক্রিয়ভাবে মাঝি হয়ে যান। তো আমাদের উদ্দিষ্ট পাহাড়ের মাঝি, ভাই সাদিকের সঙ্গে আগেই যোগাযোগ হয়েছে। তিনি নিজেই ‘অসহায়’; তার মধ্যে অসহায় মানুষের সেবার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। পরবর্তী দিনগুলোতে তার আত্মমর্যাদা, বিনয়-নম্রতা, সরলতা ও সকৃতজ্ঞ আচরণ আমাদের মুগ্ধ করেছে। পানবাজারে তিনি তার লোকদের নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। ত্রাণের বস্তাগুলো তারা কাঁধে তুলে নিলেন। আমরা তাদের পিছনে চললাম নির্দিষ্ট পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। পথে যতগুলো পাহাড় অতিক্রম করলাম, কেউ ছুটে এলো না ত্রাণের বস্তা দেখে। শুধু সালাম করলো হাসিমুখে। ওখানে অভাবের তো শেষ নেই। তবে একটি জিনিসের অভাব ছিলো না, অন্তত আমি যতটুকু দেখেছি। সালামের কোন অভাব ছিলো না। ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এসে এমন সুন্দর করে হেসে এমন বিশুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দিতো যে, প্রাণ শীতল হয়ে যেতো! বলতে ইচ্ছে করে أطفال أركان جاؤونا بالرحمة والسلام যখন সালামের উত্তর দিতাম, অবাক হয়ে তাকাতো। মনে হয় ওরা শুধু সালাম দিয়েই অভ্যস্ত, উত্তর পেয়ে নয়! অন্তত এরূপ তস্বঃস্ফূতর্তার সঙ্গে তো নয়ই!! মাওলানা ফায়রোয বললেন, যে শিশুরা (এবং বড়রা) সালাম দিচ্ছে তারা নতুন! পুরোনোরা এখানকার ‘আছর’ পেয়ে গেছে! এমনই হয়!! সালামের সঙ্গে ছোট্ট একটা চকোলেট তাদের দিকে এগিয়ে যায়, কী এক অপ্রত্যাশিত আনন্দ যে তাদের চোখে মুখে ঝিলিক দেয়!! একটি করে চকোলেট দেই, একটি করে শিশুর আনন্দে উদ্ভাসিত মুখ দেখি, আর আব্বুর কথা মনে পড়ে!! আমরা যে পাহাড়ে বিতরণ করবো সে পাহাড়ের লোকেরাই এসেছে সামান বহন করে নিতে। সুতরাং তাদের তো আলাদা কিছু প্রত্যাশা করার কথা না। করেওনি। কিন্তু আব্বু! আমার আব্বু ফোনে বললেন, কেউ যেন ‘অখুশী’ না থাকে। যারা বহন করেছে তাদের যেন আলাদা কিছু প্রাপ্তি থাকে। আলহামদু লিল্লাহ, এ আচরণ অপ্রত্যাশিতই ছিলো তাদের কাছে এবং খুশির প্রকাশও সেই পরিমাণ ছিলো! এ পর্যন্ত আমাদের চার কাফেলা চারবার সেখানে খেদমত করেছে। প্রতিবার এই আমলটা করা হয়েছে। আমাদের পাহাড়ে যখন পৌঁছলাম, চূড়ায় দাঁড়িয়ে চারদিকে একবার চোখ বুলালাম। সুবহানাল্লাহ! বাংলাদেশেও আছে এমন দৃশ্য!! পাহাড়ের পর পাহাড়! শুধু পাহাড় আর পাহাড়!! প্রতিটি পাহাড় সবুজে ঢাকা!! এখন যদিও সবুজ কিছুটা ‘হালকা’ হয়েছে, তবে সঙ্গে নতুন একটি মাত্রা যুক্ত হয়েছে। পলিথিনের অসংখ্য ছাউনী, চূড়ায়, ঢালে! অসংখ্য মানুষ, যদিও দেখা যায় অল্প। এখন পাহাড়ের গাম্ভীর্য আর নেই। দু’দিন আগেও যা ছিলো গহীন ‘পর্বতারণ্য’ এবং পশুদের ‘অভয়ারণ্য’ এখন তা অসহায় মানুষের নিরাপদ আশ্রয়! যদিও একদু’বার বন্য হাতিরা হামলে পড়েছে এবং একদু’জন নিহত হয়েছে। আমার শুধু মনে হলো, সভ্যতার রাজ্য থেকে একদল মানুষ পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে আজ হিংশ্র পশুর রাজ্যে!! কেন? সভ্য মানুষের হিং¯্রতা থেকে আত্মরক্ষার জন্য!! ক্লান্ত, শ্রান্ত, ক্ষুধার্ত বিপর্যস্ত বোবাকান্নার এই মানবস্রোত দেখে কেউ যখন ক্ষোভ প্রকাশ করে সবুজ পরিবেশের বিপর্যয়ের কথা বলে, মনে হয়, মানুষ এবং অমানুষের মাঝে পার্থক্যরেখাটা ধীরে ধীরে আরো অস্পষ্ট হয়ে যায়। সাদিক মাঝির সহায়তায় পুরো পাহাড়ের ঝুপড়িতে ঝুপড়িতে গিয়ে কাগজ বিতরণ করা হলো, কোন পরিবার বাদ না রেখে। নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্টস্থানে সবাই একত্র হলেন। পরবর্তী দিনগুলো এভাবেই কাজ হয়েছে। খাদ্য- সামগ্রী বা তেরপাল বিতরণের ক্ষেত্রে সবার হাতে কাগজ দিয়ে আসা হয়েছে, আর নগদ অর্থ বিতরণের ক্ষেত্রে আমরাই ঘরে ঘরে ‘খাম’ পৌঁছে দিয়েছি। উত্তরবঙ্গে বন্যাদুগর্ত ভাইদের মাঝে যে খাম (প্রতিটি খামে তিন- হাজার করে ১২শ খাম) বিতরণ করা হয়েছে তার গায়ে ছাপার অক্ষরে লেখা ছিলো ‘দেশের আলেমসমাজের পক্ষ হতে বন্যা দুর্গত ভাইদের জন্য’। এখানে ছিলো সাদা খাম। খাম বা সামগ্রী যাই বিতরণ করেছি, আব্বুর হিদায়াত মনে রাখার চেষ্টা করেছি যে, আমাদের ‘ত্রাণ’ ওদের প্রয়োজনের সমুদ্রে বিন্দুর চেয়ে বেশী নয়। হয়ত তিনদিনের প্রয়োজনও পুরা হবে না। কিন্তু জীবন তো তিনদিনের নয়! তাদের সামনে তো পড়ে আছে পুরো একটা আলোহীন অনিশ্চিত জীবন! তাই যা করবে কুণ্ঠার সঙ্গে করবে।

***

আগামীকাল যে পরবর্তী পাহাড়ে খেদমত করার কথা, শেষ বিকালে সেটা একটু দেখে আসার জন্য বের হলাম। দুই পাহাড়ের মাঝে সঙ্কীর্ণ একটা গিরিপথ। আমাদের পাহাড় থেকে নামার সময় যে মর্মস্পর্শী দৃশ্যটি দেখলাম, জানি না কীভাবে হতে পারে তার শব্দায়ন! ছোট ছোট চারটি ছেলেমেয়ে বসে আছে একটুকরো পলিথিনের উপর। তাদের মা, একজন অসহায় মা তাদের জন্য পলিথিনের একটা ছাউনী তৈরীর চেষ্টা করছেন। শিশুগুলো মগ্ন তাদের শৈশবের ‘চঞ্চলতায়’। পৃথিবীতে রোদের তাপ বোঝার সময় তো তাদের হয়নি! তারা হয়ত জানতেও পারবে না, অথবা ভুলে যাবে তাদের জীবনকে একটু ছায়ায়, একটু ছাউনীতে আনার জন্য অসহায় মাতৃত্বের এই অক্ষম প্রচেষ্টার কথা! আমরা যেমন ভুলে যাই আমাদের মায়েদের ....!! যাদের সঙ্গে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে ছিলেন তিনচার দিন। এখন চেষ্টা করছেন সন্তানদের জন্য কিছু একটা করার! সেই কিছু একটা তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি!! এই চারটি সন্তান ছাড়া তার জীবনে আর কিছু নেই। াস্বমী, ভাই, মা-বাবা সবাই ...!! তবু তিনি ভাগ্যবতী ঐ মায়ের চেয়ে, চারসন্তান নিয়ে যিনি আসতে চেয়েছিলেন। আসতে পেরেছেন শুধু কোলেরটিকে নিয়ে। পথে পথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে তিনটি সন্তান!! পাহাড়ে অন্ধকার নেমে আসছে। আমরা লাখো মুহাজিরীনকে সেই অন্ধকারে রেখেই ফিরে চলেছি।পথের পাশে আমাদের অপেক্ষায় আছে আরামদায়ক গাড়ি এবং ‘হালকা দস্তরখান’! গাড়ি থেকে নেমে রয়েছে আরাম ও বিশ্রাম!! বালুখালির মুহাজিরশিবিরে মুহাজিরীনের সান্নিধ্যে আজকের দিনটি ছিলো আমার জীবনে মোড় পরিবর্তনকারী অনন্য একটি দিন! .... গাড়ীতে ওঠে আব্বুর সঙ্গে যোগাযোগ হলো। দিনের কারগুজারি বলা হলো। এবং বলা হলো কিছু অনুভব-অনুভূিত!! আব্বু বললেন, বাবা, এ মাকছাদকে সামনে রেখেই তো তোমাদের পাঠানো হয়েছে! খাল্কের খিদমতের মাধ্যমে খালিকের রিযা ও ছোহবত!! আল্লাহ্ তোমাদের ভরপুর তাওফীক দান করুন, আমীন।

***

আমরা প্রতিদিন ফজরের পর টেকনাফ থেকে বালুখালি শিবিরে যাই। সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় ফিরে আসি। সন্ধ্যার পর ওখানে ‘বাইরের’ কারো থাকা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পথে যাদের সঙ্গে দেখা হয়, এমনকি আমাদের ‘হামজিন্স’ প্রশ্ন একটাই? রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দিতে এসেছেন? আমরা বলি, ‘মুহাজিরীনের খিদমতে এসেছি।’ যেন বোঝা গেলো না কী বলছি, এমনভাবে তাকায়! আমরাও বুঝতে পারতাম না, যদি আমাদের ‘প্রদীপ’ থেকে এ আলো না পেতাম যে, ‘তারা মুহাজির, আমরা আনসার’, এ জাযবা নিয়ে যারা কাজ করবে তারাই শুধু ... অবচেতন মনে হলেও যাদের আমরা ‘রোহিঙ্গা’ বলে কিছুটা তাচ্ছিল্য বা করুণা প্রকাশ করছি, তারা আসলে মুহাজির হয়ে এসে আমাদের দান করেছেন ‘আনছার’এর মহামর্যাদা! তাদের প্রতি শোকরের জাযবা লালন করা আমাদের কর্তব ্য। একজন আলিম বা তালিবে ইলম, মনে হলো, নেক সরল মানুষ। তার প্রশ্নের উত্তরে একথাগুলো বললাম। তিনি খুশী হয়ে বললেন جزاك اللهকয়েক দিনের মধ্যে, আলহামদু লিল্লাহ কিছু মানুষের চিন্তায় পরিবর্তন এলো। তারাও বলতে শুরু করলেন, ‘মুহাজির, খিদমত, আনছার, শব্দগুলো!!
 

***

প্রতিদিন রাতে আমরা পরবর্তী দিন বিতরণের জন্য সামান প্রস্তুত করি। তার মধ্যে থাকে শিশুদের জন্য আলাদা কিছু সামান। সকালে সেগুলো াস্থনীয় দোকানের মাধ্যমে পৌঁছে যায় বালুখালি পানবাজার। সেখান থেকে মুহাজির ভাইয়েরা বহন করে নিয়ে যান বিতরণের পাহাড়ে। ওখান থেকেই বহনকারী ভাইয়েরা আসেন। আমরা তাদের ‘ঘাম’কে সম্মান করার চেষ্টা করি। চল্লিশ কেজি ওজনের বস্তা মাথায় বা কাঁধে করে দু’কিলোমিটার পাহাড়ি পথ অতিক্রম করা ‘কী জিনিস’ তা তো আমাদের বুঝতে পারার কথা নয়। তবে একদিন আল্লাহ একটু ব্যবস্থা করলেন যাতে কিছুটা বুঝতে পারি। অর্ধেক পথ অতিক্রম করার পর, অপেক্ষাকৃত কমবয়সী এক ভাই, তার পক্ষে আর সম্ভব হলো না বহন করা। প্রতিটি বস্তার ভিতরে দশকেজি ওজনের চার প্যাকেট। আমরা চারজন চার প্যাকেট ভাগ করে নিলাম। তাতেই আমাদের যাকে বলে ‘ঘাম ছুটে গেলো’! ‘ঘামের মর্যাদা’ কথাটার মর্ম আজ যেন নতুন করে উপলব্ধিতে এলো। আব্বুর কাছ থেকে এত দিনের পাওয়া শিক্ষাটা আজ যেন দিলে শিকড় গেড়ে বসলো।
***

আমরা এখানে থেকেও যা বুঝিনি, আব্বু সেখান থেকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, দেখো পুরুষেরা তো পুরুষ! আসল কষ্টটা তো হয় মেয়েদের, মায়েদের!! যত দ্রুত পারো, অন্তত দশটা হাম্মামের ব্যবস্থা করো। অর্ধেক ছেলেদের, অর্ধেক ...। আর মেয়েদের জন্য পর্দাসহ
গোসলখানার ব্যবস্থা করো। সবকিছু যেন ওখানের বিচারে খুব উন্নত হয়। মুহাজির ভাইদের সাহায্যেই সব করা হলো। ইট-বালু-সিমেন্ট তারাই বহ করেছেন। তারাই কাজ করেছেন। আব্বুর তাকিদ ছিলো, একজন পূর্ণ শ্রমিকের পূর্ণ মজুরি যেন তাদের দেয়া হয়। মাওলানা আছেম ভাই হাসতে হাসতে বললেন, আপনারা তো মাশাআল্লাহ যেভাবে..., পরে না আমরা আবার কষ্টের মধ্যে পড়ে যাই! হাম্মাম ও গোসলখানার ব্যবস্থা হওয়াতে, বিশেষ করে মা-বোনেরা এত খুশী হলেন, এত দু‘আ দিলেন যে, ...
***

একসন্ধ্যায় আমরা পাহাড় থেকে ফিরে আসছি। একটু বিলম্ব হয়ে গিয়েছিলো। বিজলি চমকাচ্ছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এক পাহাড় থেকে নেমে আরেক পাহাড়ে উঠছি, এমন সময় শুনি, দূর থেকে চিৎকার করে একজন ছুটে আসছেন আমাদেরই দিকে। আমরা থামলাম। তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে এলেন। কথা আর বলতে পারছেন না! শেষে জানা গেলো, ীস্ত্রর অবস্থা গুরুতর। প্রসবের সময়ও ঘনিয়ে এসেছে। এখনই যদি পানবাজারে নেয়া যেতো হয়ত কিছুটা চিকিৎসা হতো! কিন্তু ... ‘কিন্তু’টা তো জানা কথা! রিক্তহস্ত!! আমরা চিন্তা করছি দেখে খুব কুণ্ঠার সঙ্গে বললেন, আপনারা কষ্ট করে নিজের চোখে দেখে আসতে পারেন। হায়রে মানুষ! হায়রে মানুষের অসহায়ত্ব!! বললাম, দেখতে হবে না, আপনার চেহারাই সব বলছে। মাওলানা ফায়রোয তার হাতে দশহাজার টাকা দিয়ে বললেন, এখনই নিয়ে যান। আর যা লাগে সব ব্যবস্থা আগামীকাল হবে ইনশাআল্লাহ! ইয়া আল্লাহ! কল্পনা করাও কি সম্ভব! এই পরিবেশ, পরিস্থিতি! পাহাড়ের চূড়ায় পলিথিনের ছাউনীর নীচে আসন্নপস্রবা এক নারী, এক মা! এই বৃষ্টির রাতে, পিচ্ছিল পাহাড়ি পথে কীভাবে নেয়া হবে এত দূরের পথ! উহ, আর ভাবতে পারি না!! সারাটা পথ, এবং রাতে সবাই আমরা দু‘আ করলাম খুব দিল দিয়ে, আল্লাহ যেন সাহায্য করেন। পরের দিন ভয়ে ভয়ে গেলাম। কে জানে কী খবর অপেক্ষা করছে! জীবন না মৃত্যু, কী শোনবো আমরা?! পাহাড়ের চূড়ায় উঠে ঝুপঁড়িটার সামনে দাঁড়িয়েই শুনলাম, ‘জান্নাত থেকে নেমে আসা পৃথিবীর কান্না’!! কীভাবে, কোথায় হলো?! পানবাজারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো, এবং হাঁটিয়ে! কিন্তু পথেই সময় হয়ে গেলো মায়ের উদর থেকে মায়ের কোলে আসার!! আল্লাহ্ এত সাহায্য করেছেন যে, ঐ কাদামাটির মধ্যে, পলিথিনের বিছানায় কোন রকম জটিলতা ছাড়াই সব হলো!! একটুকরো মলিন কাঁথায় শুয়ে থাকা শিশুটিকে দেখলাম, ‘কখনো যেন ভুলে না যাও তোমার মায়ের এই একটি রাতের কষ্টের কথা!! বাবার মাধ্যমে মায়ের অনুরোধ এলো নাম রাখার জন্য। একটু শুধু বিব্রত হলাম যে, এটা তো হবে আমার জীবনের প্রথম ঘটনা! তারপর কিচ্ছু না ভেবে বললাম, আব্দুলাøহ! আব্দুলাøহ বিন মুহাম্মাদুলাøহ আরাকানী!! ফোনে রাতের কারগুযারিতে আব্বুকে যখন বললাম, এমন নির্বাক হলেন যে, উৎকণ্ঠায় পড়ে গেলাম। দেখতে চেষ্টা করলাম তাঁর মুখম-ল! অনুভব করতে চেষ্টা করলাম তার চিন্তার...! দীর্ঘ নীরবতার পর বললেন! কী করেছো বুঝতে পেরেছো?! এত দুর্বল কাঁধে এত বড় দায়িত্ব! একটি শিশুর এমন একটি শিশুর নাম রাখার দায় ও দায়িত্ব কতো জানো! আরো কিছু কথার পর আব্বু বললেন, আগামীকাল ‘তোমার আব্দুল্লাহর মা আর বাবাকে বলবে, তাদের সন্তানের যে কোন প্রয়োজনে তারা যেন আমাদের স্মরণ করেন, আমরাও ইনশাআল্লাহ্ চেষ্টা করবো খবর রাখতে। সফর থেকে ফেরার পর আল্লাহর শোকর এখন পর্যন্ত আব্বু খোঁজ খবর রাখছেন। আমাকেও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। একটি শিশুর নাম রাখা আসলে কী অর্থ বহন করে, তার কিছুটা উপলব্ধির ফলে এখন অবাক হয়ে ভাবি, আমরা এত সহজে এত নাম রাখি কীভাবে!! আব্বুর কাছে সবকিছু এত গভীর এবং এত গম্ভীর কেন?!
***

আমাদের ফিরে আসার দু’দিন আগে। যে পাহাড়ে কাজ করছি সেখান থেকে অবসর হয়ে, হাতে কিছু সময় আছে বলে ভাবলাম, পাশের পাহাড়টা একটু দেখে আসি। মাত্র একটা দু’টো ঘর দেখা যাচ্ছে। কিছু অর্থ নিয়ে মাওলানা ফায়রোয এবং আমি গেলাম। গিয়ে তো হতবাক! একই অবস্থা! একশর কম হবে না, পলিথিনের ছাউনী!! অনেকে জড়ো হলো। কেউ কিছু চাইলো না। কিন্তু বিষণœ মলিন চেহারাগুলো বলছে...! জিজ্ঞাসা করায় শুধু এইটুকু জানা গেলো. একটু ভেতরে তো! তাই এখানে কেউ আসেনি! তেমন কোন ‘ত্রাণ’ তারা পায়নি। একটু দূরে মনে হলো কিছু মানুষ মাটি সমান করছেন। মাথার টুপিতে মনে হলো...!! ঠিকই মনে হলো। তারা আরাকানের আলেম! একটা মসজিদ তৈরী করার চেষ্টা করছেন! আমার ভিতরের সত্তা আর কখনো এমন কঠিন ঝাঁকুনি খায়নি!! কোথায় আমরা, কোথায় এঁরা!! একদিকে ক্ষুধার যন্ত্রণা! একদিকে আল্লাহর ঘরের জন্য এমন অস্থিরতা!! জিজ্ঞাসা করলাম, সামান কোথায়?! সবার যিনি মুরুব্বি, তিনি বললেন, আমরা শুরু করেছি।আল্লাহর কাজ আল্লাহই ব্যবস্থা করবেন। লজ্জার সঙ্গে উপলব্ধি হলো, এভাবে জিজ্ঞাসা করা সঙ্গত হয়নি। রাতের কারগুযারিতে আব্বু যখন শুনলেন, প্রথমে বললেন, আলহামদু লিল্লাহ। তারপর বললেন, আসলে আল্লাহ তোমাদের ঐ পাহাড়ে নিয়েছেন তাঁর মুখলিছ বান্দাদের গায়ব থেকে সাহায্য করার জন্য, আর তোমাদের দিলকে যিন্দা এবং ঈমানকে তাজা করা এই মানযার দেখানোর জন্য। এখন আল্লাহ দেখতে চান তোমরা কী করো?! ইনশাআল্লাহ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা আল্লাহর ঐ মুখলিছ বান্দাদের সঙ্গে আছি। কিন্তু আমাদের হাতে তো ... বাবা, এখন তারাদ্দুদের নয়, তাওয়াক্কুলের সময়। দেখো, আমাদের পর্দা করে সবকিছু আল্লাহ নিজে করে দেবেন।

***

আরেকটি পাহাড়ে আমাদের খেদমত সম্প্রসারিত হলো। মুহাজিরগণ উচ্চস্বরে আল্লাহর শোকর আদায় করলেন, আর বললেন, ‘আমরা তো কাজ শুরু করেছি আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে। আল্লাহ আপনাদের পাঠিয়েছেন তাঁর রহমতরূপে।’ আমি শুধু ভাবছি নিজেদের কথা। কত তুচ্ছ, সুখী সচ্ছল আমরা এই মযলূম অসহায় মানুষগুলোর তুলনায়!! আজকের দিনটি যার কেটেছে অর্ধাহারে, যার ঘরে আগামী কালের আহার নেই, তিনি শরীরে মাটি মেখেছেন আল্লাহর ঘর মসজিদের জন্য!! আল্লাহর রহমতে মসজিদ তৈরী হলো এবং ওখানকার বিচারে সুন্দর মসজিদই তৈরী হলো। কল হলো, হাম্মাম হলো। তিনপাহাড়ের মাঝখানে হওয়ার কারণে জামাতও অনেক বড় হলো। কয়েকদিনের সান্নিধ্যে আশ্চর্য এক মুহাব্বাতের বন্ধন তৈরী হয়ে গেলো সবার সঙ্গে। বিদায় তো নিতেই হবে। বিদায় নিলাম একথা বলে, ইনশাআল্লাহ আবার আমরা আসবো ফিরে এই পাহাড়ের কোলে তোমাদের কাছে! শাহপরীর দ্বীপে যারা মুহাজিরীনের ইসতিকবালের খিদমতে নিয়োজিত ছিলেন তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিলো। মাওলানা ফায়রোয একবার গিয়ে দেখেও এসেছেন। মাশাআল্লাহ সবাই সুচারুরূপে খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। আল্লাহ চাহে তো একটি মোবারক সফর সমাপ্ত হলো। আমারা মাদরাসাতুল মাদীনায় ফিরে এলাম। কয়েকদিন পর খবর পেলাম। মুহাজির মাওলানারা তাদের মসজিদে মকতব শুরু করে দিয়েছেন। তিন পাহাড় থেকে চারশ মুহাজির তালিবে ইলম Ñছেলে-মেয়েÑ মক্তবে আসে পড়তে। বিশদিন পর পরবর্তী কাফেলা নিয়ে মাওলানা ফায়রোয গেলেন। মাওলানাদের খুব উৎসাহ দিয়ে এলেন যবানে এবং আমলে। মাওলানা ফায়রোয দু’দিন আগে চতুর্থ কাফেলা নিয়ে গিয়েছেন শীতবস্ত্র বিতরণের এবং মসজিদের মেঝে পাকা করার উদ্দেশ্যে। মক্তব এবং মুহাজির মাওলানাদের মেহনত সম্পর্কে মাওলানা ফায়রোয বললেন, ‘বাগানে ফুল ফুটতে শুরু করেছে।’ আর বললেন, ‘আমার আব্দুল্লাহ আরাকানী এখন শুধু কাঁদে না, সুন্দর করে হাসে!!
অবিরত সুন্দর সূচনা এবং সুন্দর সমাপ্তি তোমার কাছে প্রার্থনা করি হে আল্লাহ্! হে রাহমান! হে রাহীম!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট