কথাসাহিত্যিক শরৎবাবু আধুনিক বাংলাসাহিত্যের বিরাট একটা স্থান জুড়ে আছেন, তাতে সন্দেহ নেই। তার সবচে’ বড় কীর্তি এই যে, কলমের ধার ও সাহিত্যের ভার তিনি হিন্দুসমাজের যুগযুগের বহু কুসংস্কার দূর করার সাধনায় ব্যয় করেছেন এবং কিছু পরিমাণে সফলও হয়েছেন। তবে নির্মম হলেও সত্য যে, তার সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজের তখনো কিছু পাওয়ার ছিলো না, এখনো নেই, মাঝে মধ্যে দু’একটি বিদ্রূপ ও কটুক্তি ছাড়া।
শরৎবাবুর তিনচারটে বই তরুণ- বয়সে পড়েছি, এখনো পড়ি এবং বলতে দ্বিধা নেই, তার লেখা থেকে আমি যথেষ্ট পরিমাণে উপকৃত হয়েছি। আমাদের অবশ্য এছাড়া উপায়ও ছিলো না। তখন তো বাংলাসাহিত্যে বাবুদেরই ছিলো একচ্ছত্র অধিকার, এখনো তাদের দখল খুব একটা শিথিল হয়নি। যদি বলো, এখন তো অনেক মুসলিম লেখক লিখে লিখে রীতিমত ‘তারকাখ্যাতি’ অর্জন করেছেন! এজন্য অবশ্য, উঠতে বসতে তারা সাতচল্লিশের যে দেশ- ভাগের ‘পিন্ডি চটকান’ সেটার কাছেই সর্বাংশে ঋণী। কিন্তু আমি বলবো, মুসলিম নাম ধারণ করে এ দেশে যারা এখন নির্বিঘ্নে ‘সাহিত্য করছেন’ তারাও ‘বাবু’ বটেন। ওরা হিন্দু বাবু, এরা মুসলিম বাবু। তদুপরি এই বাবুরা সেই বাবুদের কৃতার্থ অনুগামী মাত্র; যেমন চিন্তা-চেতনায় তেমনি ভাষা ও সাহিত্যে। সুন্দর কথা, সুন্দর ভাষার আড়ালে বিষের পরিমাণ ওখানে যেমন অনেক, এখানেও প্রচুর। তাই আমি ভেবেছি, পড়তেই যখন হবে তখন ‘অর্জিনাল’ বাবুদেরটাই পড়ি না কেন! ‘নেশাই যদি করো, মাতালই যদি হও, তবে ‘দিশি’ কেন, কেন নয় বিলিতি?’
তবে আমার কাছে যারা জানতে চায় তাদের আমি ‘আকুতি, কাকুতি, মিনতি’ এবং আরো যা কিছু শব্দ আছে সব জড়ো করে বলবো, দোহাই আল্লাহর, সাহিত্যচর্চার নামে কোন প্রকার বাবুরই সংস্পর্শ গ্রহণ করতে যেয়ো না। তাতে সাহিত্যচর্চা যদি বা কিছু হয়, ঈমান, আমল ও আখলাক এবং চিন্তা, চেতনা ও মূল্যবোধ চর্চার অপমৃত্যু ঘটবে। আগে তো সেই মহামূল্যবান সম্পদ রক্ষা করার চেষ্টা করতে হবে, যার প্রচারের বাহনরূপে ভাষা ও সাহিত্যচর্চা তুমি করতে চাও। ‘আত্মপ্রশংসা করছি’ এ নিন্দার ভয়ে একটি প্রয়োজনীয় সত্য বলবো না, তা কি সঙ্গত?! সুতরাং শোনো, যে বয়সে বিচার-পর্যালোচনার বোধ ও বুদ্ধি থাকে না, যে বয়সটা আপাতসুন্দর সবকিছুতে মুগ্ধ হওয়ার জন্য ভারি উপযুক্ত সেই ঝুঁকিপূর্ণ বয়সে সাহিত্যচর্চা করার জন্য নিরাপদ আয়োজন পুষ্পের কল্যাণে এখন মোটামুটি সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং আমার ছাত্রদের অবশ্যই বলবো, নিরাপদ পরিমন্ডলেই বাস করো এবং কাজ করো। তাতে যদ্দুর সাহিত্যচর্চা হয় তারই উপর শোকর করো। এ বয়সে এর চেয়ে বেশীর, সত্যি বলছি, প্রয়োজন নেই।
***
যাক বলছিলাম শরৎবাবুর কথা। তার লেখা যদি আমরা সত্যিকার নিরপেক্ষ সমালোচকের দৃষ্টিতে পড়ি তাহলে তাতে ভাষার সৌন্দর্য যেমন অনেক চোখে পড়ে তেমনি ত্রুটিও নযরে পড়ে কিছু কিছু। সেদিন তার ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসটি অনেকবারের পর আবার পড়লাম। তাতে শব্দের সৌন্দর্য ও ভাষার মাধুর্য এমনই উপচে পড়া যে, মনে হলো, এই প্রথম পড়ছি এবং একশ্বাসে পড়তেই থাকি; যদিও মধুর মধ্যে মিশে আছে বিষ এবং তার ক্রিয়া মধুর কারণে মোটেও কমেনি।
বাবু যদি আজ বেঁচে থাকতেন, বইটি পড়ার পর একজন পাঠক হিসাবে অবশ্যই তাকে আমি ধন্যবাদ জানাতাম, প্রথমত ভাষার সৌন্দর্য ও বক্তব্যের গভীরতার জন্য, দ্বিতীয়ত বইটির সার্থক নামকরণের জন্য। ভাষার সৌন্দর্য এমন যে, পাঠকের দৃষ্টি মন্ত্রমুগ্ধের মত পাঠ করে যায়; বক্তব্যের গভীরতা এমন যে, পাঠকের হৃদয় পরম নির্ভরতায় তা গ্রহণ করে যায়।
তারপর নামকরণের এমনই সার্থকতা যে, শুরু থেকে শেষ, পুরো বইটির চিত্রটি তাতে জীবন্ত হয়ে উঠে এসেছে। দীর্ঘ আলোচনার তো অবকাশ নেই; শুধু বলা যায়, বইটিতে চরিত্রহীনতার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে এবং চরিত্রহীনতার প্রতি একটি সদয় ও সহনশীল অনুভূতি জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে। লেখক তার বইয়ের নামটি দ্বারা এত কিছু বলতে চেয়েছেন যা শব্দে, বাক্যে ও বক্তব্যে তুলে ধরতে গেলে ছোট্ট আরেকটি বই হয়ে যেতে পারে। তিনি বলতে চেয়েছেন, বাহ্যিক আচরণের কারণে আপতদৃষ্টিতে যাকে আমরা চরিত্রহীন বলে ঘৃণা করি সে হয়ত ততটা ঘৃণার পাত্র বা পাত্রী নয়। পরিবেশ পরিস্থিতির অনিবার্যতায় বাইরের চরিত্রে যদিও কিছুটা দোষ-কলুষ মেখে যায়, কিন্তু তার ভিতরের চরিত্রটা থাকতে পারে বাইরের অনেক চরিত্রবানের চেয়ে অনেক বেশী নিষ্কলুষ।
ধন্যবাদজ্ঞাপনের পর বাবুকে প্রথম যে প্রশ্নটি করতাম তা হলো, আমিও তো আপনার লেখার একজন মুগ্ধ পাঠক, কিন্তু আপনার লেখায় আমি কোথায় শরৎবাবু? পুরো বইয়ে ‘খালাসী, চট্টগ্রামবাসী মুসলমান’ এই একটি মাত্র বাক্যে ছাড়া আর কোথাও যে আমাকে খুঁজে ‘পেলুম না’ শরৎবাবু! কেন? কী আমার অপরাধ? বাঙ্গালী সমাজে আমাদের জনসংখ্যাটা কি আপনার জানা নেই বাবু?! আপনার বইয়ে কোথাও আমরা ‘ছিলুম না’ সে এক ভালো, কিন্তু ‘খালাসী’! আমরা কি ‘শুদ্ধমাত্র’ খালাসী শরৎবাবু?! ঐ একটি জায়গায় নাই বা ‘থাকতুম’! ‘মুসলমান’ শব্দটা ওখানে না থাকলে আপনার লেখার সাহিত্যমূল্য তো কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হতো না শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাবু!
আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন,‘চরিত্রহীন’-এর মাধ্যমে (হিন্দু হোক, মুসলিম হোক) সমাজের কাছে, বিশেষ করে এর যুবক অংশটির কাছে আপনি কী বার্তা পৌঁছাতে চেয়েছেন শরৎবাবু? ‘চরিত্রহীনতাকে যদি ঘৃণা করো, চরিত্রহীনকে ঘৃণা করো না’, এজাতীয় কিছু তো! কিন্তু আমার যে ভারি আশঙ্কা, বড় একটা ভুল বার্তাই পাঠক বইটি থেকে গ্রহণ করবে এবং চরিত্রহীনতার প্রতি প্রচ্ছন্ন উৎসাহই লাভ করবে, যা আপনি নিশ্চয় কামনা করেন না!
***
শরৎবাবুর চিতা জ্বলেছে অনেক কাল হলো, সে চিতার ছাইভষ্ম তখনি ভাসিয়ে, বা ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে গঙ্গার জলে। তিনি মরে গেছেন, তার শবদেহের চিতাও নিভেছে তখনি, কিন্তু তার সাহিত্য হয়ে আছে অমর, তার সাহিত্যের চিতা চিরবহ্নমান। কারণ তিনি যা কিছু লিখেছেন খ্যাতি ও অর্থ উপার্জনের জন্য লেখেননি, তার সমাজের সংস্কার সাধনের মহৎ উদ্দেশ্য থেকেই লিখেছেন। সাহিত্যের প্রতি তিনি একনিষ্ঠ ছিলেন। সুতরাং সাহিত্যের অঙ্গনে অবশ্যই তিনি শ্রদ্ধার পাত্র। কিন্তু .. কিন্তু আমাকে বলতেই হবে, তার সাহিত্যসম্ভারে একজন মুসলিম পাঠকের জন্য তিনি কোন ‘নিমন্ত্রণপত্র’ রেখে যাননি। না তিনি, না অন্য কোন বাবু। তাতে আমার কোন ক্ষোভ নেই। লজ্জা শুধু এই যে, আমাদের লজ্জা নেই! ‘খালাসি মুসলমান’ তবু হতে চায় বিনা দাওয়াতের মেহমান, (বলা উচিত ছিলো, বিনা নিমন্ত্রণের অতিথি।)
***
অনেক কথা বলা হলো এবং অনেক কথা রয়ে গেলো। কখনো আবার যদি অবকাশ হয়, না বলা কথাগুলো আরো খানিকটা বলার ইচ্ছে আছে। এখন এখানে তার লেখার দু’একটি বাক্যের কিছু সাহিত্যগত দিক শুধু আলোচনা করছি। চরিত্রহীন-এর একস্থানে (একটি স্ত্রীলোকের যবানিতে) তিনি লিখেছেন-
‘যা সত্য, তাকেই সকল সময় সকল অবস্থায় গ্রহণ করবার চেষ্টা করবে। তাতে বেদই মিথ্যা হোক, আর শাস্ত্রই মিথ্যা হয়ে যাক। সত্যের চেয়ে এরা বড় নয়, সত্যের তুলনায় এদের কোন মূল্য নেই। জিদের বশে হোক, মমতায় হোক, সুদীর্ঘ দিনের সংস্কারে হোক, চোখ বুজে অসত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করায় কিছুমাত্র পৌরুষ নেই। (১১৯ পৃষ্ঠা)
এখানে প্রথম বাক্যে ‘তাকেই’-এর বিন্যাসবিচ্যুতি ঘটেছে বলে মনে হয়। যদি বলি, ‘যা সত্য, সকল সময়, সকল অবস্থায় তাকেই গ্রহণ করবার চেষ্টা করবে।’ তাহলে ভালো হয়। আরো ভালো হয় যদি বলি, ‘যা সত্য, যা শাশ্বত, সকল সময়, সকল অবস্থায় তাকেই গ্রহণ করবার চেষ্টা করবে।’ তবে সেজন্য পরবর্তী অংশগুলোতেও কিছু পরিবর্তন আনতে হবে।
জিদের বশে হোক/ মমতায় হোক/সুদীর্ঘ দিনের সংস্কারে হোক/চোখ বুজে অসত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করায় কিছুমাত্র পৌরুষ নেই।
পুরো বাক্যটি চার পর্বে বিভক্ত। প্রথম তিনটি পর্ব হচ্ছে হেতু বা কারণ; চতুর্থ পর্বটি হচ্ছে ফল। লেখক বলতে চাচ্ছেন তিন কারণের যে কারণেই হোক অসত্যকে গ্রহণ করা ঠিক নয়। এখানে চারটি পর্বকে যে জ্যামিতিক মাপে সাজানো হয়েছে তা হচ্ছে ক্রমসম্প্রসারণ; অর্থাৎ প্রতিটি পরবর্তী পর্বকে পূর্ববর্তী পর্বের চেয়ে দীর্ঘ করা। সে হিসাবে তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বের মাপ ঠিক আছে, কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে তা রক্ষিত হয়নি, বরং প্রথম পর্বের চেয়ে ছোট হয়ে গেছে। ফলে পুরো বাক্যটির জ্যামিতিক সৌন্দর্য ও তার গদ্য-ছন্দ নষ্ট হয়েছে। যদি বলা হতো-
‘জিদের বশে হোক/মমতার টানে হোক/সুদীর্ঘ দিনের সংস্কারে হোক ... তাহলে বাক্যের পর্বগত ত্রুটিটা সেরে যেতো।
আরেকটি ত্রুটি এই যে, জিদ হচ্ছে আরবি, ফারছি ও উর্দু শব্দ, যদিও বাংলায় তা সুপরিচিত, কিন্তু পুরো বাক্যে একটি মাত্র বিদেশী শব্দ, কিছুটা হলেও বেমানান মনে হচ্ছে। আমার মনে হয়, এখানে জিদ শব্দটির অনুপযোগিতার বিষয়টি শরৎবাবুর চিন্তায়ও ছিলো; কিন্তু উপযুক্ত কোন বিকল্প তার হাতে ছিলো না। যেমন সবচে’ সুন্দর বিকল্প হতে পারতো ‘হঠকারিতা’, কিন্তু এত বিশাল দেহ নিয়ে এখানে তা বসবে কীভাবে! আর হতে পারতো ‘গোঁড়ামি’। অপেক্ষাকৃত বড় হলেও শব্দটি চলনসই ছিলো, কিন্তু ‘জিদের বশে’ যেমন চলে, ‘গোড়ামির বশে’ তেমন চলে না। ‘ঝোঁকের বশে’ বেশ ছিলো; দু’পৃষ্ঠা পরে তিনি নিজেও তা ব্যবহার করেছেন-
‘ঝোঁকের বশে কিরণময়ী আজ এই অসময়ে সুরবালার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিল।’ কিন্তু জিদ আর ঝোঁক তো এক নয়। তবু মনে হয় খুঁতটা অপেক্ষাকৃত লঘু হতো।
‘ক্রোধের বশে’ শরৎবাবুর চিন্তায় এসেছিলো কি না, জানি না; এসে থাকলে কী বিবেচনায় বাদ দিয়েছেন, বুঝতে পারছি না।
বাংলাভাষার সুদীর্ঘ শব্দতালিকায়, শিশির ও মমতা-এর মত কোমল ও স্নিগ্ধ শব্দ খুব কমই আছে। কিন্তু এখানে মমতা শব্দটি তেমন সুপ্রযুক্ত নয়। তার চেয়ে মায়া বা অনুরাগ- ভালো। ‘জিদের বশে হোক, মায়ার টানে হোক (কিংবা, জিদের বশে হোক, অনুরাগের কারণে হোক) ...’ ভালোই তো মনে হয়!
যদি বলা হয়- অভ্যাসে হোক/অনুরাগে হোক/ বদ্ধমূল সংস্কারে হোক/...। তাহলে প্রথম তিনটি পর্বের অন্তে ‘একার’-এর সুরছন্দ ভালো লাগতো। এখানে জ্যামিতিক মাপটি হলো, প্রথম দুটি পর্ব সমান, পরের দু’টি পর্ব ক্রমে বড়।
‘সুদীর্ঘ দিনের সংস্কার’, এর চেয়ে ‘বদ্ধমূল সংস্কার’, বেশী ভালো মনে হয়, অন্তত এখানে। কারণ, প্রথমত তৃতীয় পর্বটি আগের দু’টির তুলনায় বেশী বড় হয়ে যায়; যেহেতু তিনটি পর্ব একই সূত্রে গাঁথা সেহেতু এ তিনটি কাছাকাছি আয়তনের হওয়া ভালো। দ্বিতীয়ত ‘সুদীর্ঘ দিন’ বললে শুধু সময়ের দৈর্ঘ্যই বোঝায়, গভীরতার দিকটি তাতে প্রত্যক্ষ হয় না। পক্ষান্তরে ‘বদ্ধমূল’ বললে সংস্কারের শিকড় মনের গভীরে প্রবিষ্ট হওয়ার বিষয়টি প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে।
তিনটি পর্বে তিনটি ‘হোক’ একই ভাবে আনা হয়েছে, তার চেয়ে তৃতীয় ‘হোক’টিকে এগিয়ে আনলে কেমন হয় ভেবে দেখা যেতে পারে, যেমন- ‘জিদের বশে হোক/মমতার টানে হোক, কিংবা হোক বদ্ধমূল কুসংস্কারের কারণে...।
পুরো বাক্যের জ্যামিতিক মাপটি পরিবর্তন করে এভাবেও বলা যায়, ‘ক্রোধ, অনুরাগ ও বদ্ধমূল সংস্কার, যে কারণেই হোক, চোখ বুজে অসত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করায় কিছুমাত্র পৌরুষ নেই।’
পৌরুষ শব্দটির ব্যবহার এখানে খুবই সুন্দর হয়েছে। অন্য কেউ এখানে হয়ত বলতেন, ‘বাহাদুরি নেই’, বড় জোর, ‘কৃতিত্ব বা গৌরব নেই’। কিন্তু পৌরুষ শব্দটি এখানে সত্যি অতুলনীয়।
‘সত্যকে অসত্য’ এবং ‘অসত্যকে সত্য’- এদু'য়ের মধ্যে সুরে, ছন্দে ও মসৃণতায় কোনটি ভালো? প্রথমটি। কিন্তু শরৎবাবুকে বাধ্য হয়েই বলতে হচ্ছে ‘অসত্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করায়...।’ তিনি বলতে পারতেন, ‘মিথ্যাকে সত্য বলে...।’ কিন্তু ‘অসত্য’-এর চেয়ে মিথ্যা অধিক শ্রুতিকটু, বিশেষ করে এখানে। তবে তিনি বিন্যাস পরিবর্তন করে বলতে পারতেন, ‘অসত্যকে চোখ বুজে সত্য বলে বিশ্বাস করায় কোন পৌরুষ নেই।’ তাতে সুরের ও মসৃণতার সমস্যাটা আর থাকে না।
০ ‘তাতে বেদই মিথ্যা হোক, আর শাস্ত্রই মিথ্যা হয়ে যাক’ এখানে দ্বিতীয়বারও তিনি যদি ‘মিথ্যা হোক’ বলতেন, তাহলে গতি ও জোর থাকতো না। বিষয়টি গভীরভাবে লক্ষ্য করার মত।
০ ‘সত্যকেই সকল সময় সকল অবস্থায় গ্রহণ করবার চেষ্টা করবে।’ কিংবা ‘সকল সময় সকল অবস্থায় সত্যকেই গ্রহণ করবার চেষ্টা করবে।’ এর চেয়ে অনেক জোরালো হয়েছে ‘যা সত্য তাকেই সকল সময়... এ বাক্যটি।
০ শরৎবাবু প্রথমে ব্যাবহার করেছেন ‘গ্রহণ’ শব্দটি, দ্বিতীয়বার ব্যবহার করেছেন ‘বিশ্বাস’ শব্দটি। বিপরীত ব্যবহার করে দেখো, ভালো লাগবে না। তদ্রূপ উভয় স্থানে অভিন্ন শব্দও ভালো হবে না।
০ ‘সত্যের চেয়ে এরা বড় নয়, সত্যের তুলনায় এদের কোন মূল্য নেই।’
এখানে একই বিষয়ের দু’টি বাক্য বক্তব্যকে অনেক জোরালো ও আবেদনপূর্ণ করেছে। শুধু একটি বাক্য হলে তা হতো না। প্রথম বাক্যের চেয়ে দ্বিতীয়টিতে একটি শব্দ বেশী, আবার হরফসংখ্যায় আরেকটু বড়। সমান হলেও অসুবিধা ছিলো না, কিন্তু ছোট হলে অসুন্দর হতো।
তুলনায় ও মোকাবেলায়- দু’টোই চলতে পারে। কিন্তু মূল্যপ্রসঙ্গে মোকাবেলা-এর চেয়ে ‘তুলনা’ বেশী উপযোগী। ‘সত্যের মোকাবেলায় অসত্য চিরকালই দুর্বল’, এখানে তুলনা-এর চেয়ে ‘মোকাবেলা’ বেশী উপযোগী। শব্দনির্বাচনে এভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, যা অনেকেই করেন না।
***
এতক্ষণ তো বাক্যটির কিছু সাহিত্যগত দিক আলোচনা করলাম। এবার এখানে লুকিয়ে থাকা ‘বিষ’ সম্পর্কে কিছু কথা। শরৎবাবু তার বক্তব্য এত জোরালো করে, এমন আবেদনপূর্ণ ভাষায় বলেছেন এবং পূর্বাপর পরিবেশটিও এমনই ‘স্পর্শী’ যে, কোন তরুণ হৃদয় এর হাতছানি এড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু হিন্দুধর্মের যে কোন পণ্ডিৎ শরৎবাবুকে প্রশ্ন করতে পারেন, বেদ ও শাস্ত্র যখন সত্যাসত্য নির্ণয়ের মাপকাঠি থাকলো না তখন কে তা নির্ণয় করবে? বুদ্ধি ও যুক্তি? একটু পরে শরৎবাবু অবশ্য তাই বলেছেন। যেমন- ‘তাই বলে এমন কথাও মনে ভেবো না যে, আমি অসত্য বলে বুঝেছি বলেই তা অসত্য হয়ে গেছে। আমার মোট কথাটা এই যে, সত্য-মিথ্যা যাই হোক, তাকে বুদ্ধিপূর্বক গ্রহণ করা উচিত।’
ভালো কথা, কিন্তু কার বুদ্ধি এবং কোন্ যুক্তি? বুদ্ধিতে বুদ্ধিতে যখন শুরু হবে লাঠালাঠি, এবং যুক্তিতে যুক্তিতে শুরু হবে চুলাচুলি, তখন কে এসে মিটমাট করবে?
যাক হিন্দুদের বিষয় হিন্দুরা বুঝুন, কিন্তু কোন তরলমতি মুসলিম তরুণ পাঠক যদি এখান থেকে এ শিক্ষা গ্রহণ করে, ‘যা সত্য, তাকেই সকল সময় সকল অবস্থায় গ্রহণ করবার চেষ্টা করবে। তাতে হাদীছ-কোরানই মিথ্যা হোক, আর শরীয়তই মিথ্যা হয়ে যাক। সত্যের চেয়ে এরা বড় নয়, সত্যের তুলনায় এদের কোন মূল্য নেই। (নাউযু বিল্লাহ) তাহলে কোথায় যাবে আমাদের দ্বীন, ঈমান ও বিশ্বাস?! কোন্ গন্তব্যে গিয়ে শেষ হবে আমাদের তরুণপ্রজন্মের সাহিত্যচর্চা?!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)