দ্বিতীয় অধ্যায়
পথ প্রদর্শন, না সম্পদশোষণ?
পৃথিবীর সকল ধর্মহীন সরকার চরিত্রগত দিক থেকে মূলত একটি উন্নত, সুশৃঙ্খল ও সুরক্ষিত বাণিজ্যকেন্দ্র ছাড়া আর কিছু নয়। নীতি ও লক্ষ্যের দিক থেকে এসকল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজা-শাসন ও জনকল্যাণের জন্য নয়, বরং প্রজাশোষণ ও গণলুণ্ঠনের জন্য। শুরু থেকেই তাদের কাছে নীতি ও নৈতিকতার কোন বার্তা থাকে না এবং থাকে না সংস্কার ও সংশোধনের সাধারণ কোন উদ্দেশ্য। দেশ ও জাতির আত্মিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি, মানুষের
হিদায়াত ও আত্মশুদ্ধি এবং মানবতার প্রকৃত সেবা ও কল্যাণ- চিন্ত তো অনেক পরের কথা। উদ্দেশ্যগত কারণে স্বভাবতই তাদের মন ও মনোযোগ সম্পূর্ণরূপে নিবদ্ধ থাকে আয়- আমদানির নতুন নতুন উৎস সন্ধান করা এবং সম্পদ বৃদ্ধি ও রাজকোষের সমৃদ্ধির নতুন নতুন পথ বের করার দিকে। এ উদ্দেশ্যে নির্দ্বিধায় তারা নীতি, নৈতিকতা, চরিত্র ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে এবং মানবতা ও মানবিকতা পশ্চাতে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। যেখানেই সুনীতি ও অর্থনীতির সঙ্ঘাত দেখা দেয়, অর্থনীতিকেই তারা অগ্রাধিকার দেয়। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয় নিছক বৈষয়িক ও অর্থনৈতিক। নগ্নতা ও যৌনতাকেও তারা স্বচ্ছন্দে বৈধতা দান করে। অবশ্য প্রয়োজনে কিছু বিধিনিষেধ আরোপিত হয়, যা অপরাধ ও অনৈতিকতাকে রোধ করে না, শুধু নির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ রাখে। দেহব্যবসা তাদের কাছে শুধু বৈধই নয়, বরং একটি আকর্ষণীয় রাজস্বখাতও বটে। রাষ্ট্র নিজেই
ব্যাপক ও সুসংগঠিত সুদ-বাণিজ্যে জড়িত থাকে এবং বিভিন্ন ভদ্র-পোশাকি নামে জুয়াখেলার অনুমতি দেয়। নামের ভদ্রতা রক্ষার উদ্দেশ্য থাকে শুধু সরকারের স্বার্থ ও মুনাফা নিরাপদ করা। কোন নৈতিক অপরাধ ও অসামাজিক কার্যকলাপ রাষ্ট্রের চোখে অপরাধ বলে গণ্য হয় না, যদি তা ‘অর্থপূর্ণ’ হয়। মদের শুধু অনুমোদনই নয়, বরং এ ব্যবসাটি সরকার নিজের নিয়ন্ত্রণেই রেখে থাকে। এমনকি মদ-জুয়া বিরোধিদের উপর খড়গহস্ত হতেও পিছপা হয় না। চলচ্চিত্রশিল্প, যা যাবতীয় সামাজিক অপরাধের উৎস এবং নগ্নতা ও যৌনতার প্রবণতা সৃষ্টির প্রধান কারণ বলে স্বীকৃত, এটা সরকারের এমনই আকর্ষণীয় রাজস্বখাত যে, এর নৈতিক ক্ষতির ভয়াবহতা জেনেও সরকার তা বন্ধ করার কথা কল্পনা করতে পারে না। রেডিও-টিভি চরিত্র সংশোধন ও নৈতিক শিক্ষার বাহন হওয়ার পরিবর্তে সসত্মা বিনোদনের মাধ্যম হয়ে থাকে এবং সর্বস্তরে সুস্থ বোধ ও রুচিবোধ সৃষ্টির পরিবর্তে রুচিবিকৃতিকেই আরো বেশী উসকে দেয় এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সসত্মা বিনোদনের মানসিকতা সৃষ্টি করে। সংবাদপত্র ও প্রকাশনা তদারকের জন্য গঠিত সরকারী সংস্থা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তো অতিসংবেদনশীলতার পরিচয় দেয়। ফলে ন্যূনতম সমালোচনাও সহ্য করতে পারে না, অথচ মূল্যবোধ ও নৈতিকতার বিষয়ে হয়ে থাকে অতি-উদারতার। দায়িত্বহীন লেখক-সাংবাদিক এবং অশস্নীলতার প্রচারক সাহিত্যিকের দল তুচ্ছ বৈষয়িক লাভের জন্য সমাজে নৈতিক অবক্ষয় ও চরিত্রহীনতার মহামারি ছড়িয়ে দেয়, কিন্তু পানি মাথার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার আগে সরকার থাকে নির্লিপ্ত, বরং যথেষ্ট প্রশ্রয়ী। এধরনের সরকারে চরিত্র ও নৈতিকতার সঙ্গে সঙ্গে জাতির স্বাস্থ্যও হয়ে পড়ে অনিরাপদ। বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চরিত্রবিধ্বংসী পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি এমনসব স্বাস্থ্যহানিকর সামগ্রীও বাজারজাত করে যা জাতির, বিশেষত যুবসমাজের চরিত্র সমূলে শেষ করে দেয়। সরকার দেখেও দেখে না। কারণ, যারা দেখবে তারাই বাঁধা পড়ে যায় উৎকোচ উপঢৌকনের জালে। তাছাড়া বিভিন্ন সরকারী খাত, জাতীয় প্রতিষ্ঠান ও ক্রীড়া-অঙ্গনের পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে আইনের পাকড়াও থেকেই শুধু তারা বেঁচে থাকে না, বরং সামাজিক সম্মান ও প্রতিষ্ঠাও অর্জন করে থাকে। এসব হতে পারে শুধু এজন্য যে, আত্মিক ও নৈতিক কল্যাণের পরিবর্তে আর্থিক সুবিধা ও বাহ্যিক মুনাফাই হলো সরকারের চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু।
এমন রাজনীতি ও শাসননীতির অনিবার্য ফল দাঁড়ায় এই যে, চরিত্র ও নৈতিকতা দিন দিন নীচে নামতে থাকে এবং একসময় ভয়াব নৈতিক ব্যাধি ও অবক্ষয় দেখা দেয়। জাতির সর্বস্তরে মুনাফাবৃত্তি, সুবিধাবাদিতা ও বাণিজ্যি-মানসিকতা ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যবসায়িক লুটতারাজের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সবার তখন লক্ষ্যই থাকে বৈধাবৈধ যে কোন উপায়ে অন্যের চেয়ে বেশী মুনাফা অর্জন করা। নীতি ও নৈতিকতা তখন সবার দৃষ্টিপথ থেকেই সরে যায়।
পক্ষান্তরে যে শাসনব্যবস্থা মিনহাজে নবুয়ত বা নববী তরীকার উপর প্রতিষ্ঠিত, তার বুনিয়াদ ও ভিত্তি হয় তিজারাতের পরিবর্তে হিদায়াতের উপর। হযরত উমর বিন আব্দুল আযীয (রহ.)-এর খেলাফত ছিল মাত্র দু’বছরের, কিন্তু তা ছিল খেলাফতে রাশেদার অনুসরণে মিনহাজে নবুয়তের উপর প্রতিষ্ঠিত। একবার তাঁর কাছে অনুযোগ করা হলো যে, বর্তমান নীতি-ব্যবস্থায় বাইতুল মালের রাজস্ব আয় ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং রাষ্ট্র বিরাট আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তখন তিনি যে ঐতিহাসিক বাক্যটি বলেছিলেন তা হলো-
চুপ কর, মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো প্রথপ্রদর্শকরূপে প্রেরিত হয়েছেন, রাজস্ব আদায়কারীরূপে নন।
এই সংক্ষিপ্ত একটিমাত্র বাক্যের মধ্যেই মিনহাজে নবুয়তের উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সরকার ও শাসনব্যবস্থার মূলনীতি ও রূপরেখা সুস্পষ্টরূপে এসে গেছে।
দ্বীনী হুকুমতের আসল লক্ষ্যই হলো দ্বীন ও আখলাক। এখানে আগে দেখা হয়, কিসে মানুষের নৈতিক উন্নতি ও আখেরাতের কল্যাণ সাধিত হবে। রাজস্ববৃদ্ধি ও সম্পদসমৃদ্ধি এখানে মূল লক্ষ্য নয়, বরং আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির পথে এবং সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়কমাত্র।
এখানে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজস্বনীতি, সবই শরীয়তের অনুগত। তাই দ্বীনী ও আখলাকী মূলনীতিগুলো সর্বদা বিষয় ও বস্ত্তর উপর প্রাধান্য পায়। এই হুকূমত তার শাসন- সীমানায় সুদ, জুয়া, মদ, ব্যভিচার, পাপাচার, নগ্নতা ও বেহায়াপনা এবং এর সকল প্রকার প্ররোচিকা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং ঐ সব আর্থিক লেনদেনকেও অপরাধ মনে করে যা ব্যক্তির জন্য উপকারী হলেও সমষ্টির জন্য ক্ষতিকর। তাই ওগুলো সে বন্ধ করে দেয়, যদিও তাতে বিরাট আর্থিত ক্ষতি হয় এবং সরকারী কোষাগার বিপুল রাজস্ব-আয় থেকে বঞ্চিত হয়। এই হুকূমত সংস্কার ও সংশোধন- মূলক বিভিন্নমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করে এবং তা বাস্তবায়নে সর্বপ্রকারে সচেষ্ট হয়। তার দৃষ্টি শুধু মানুষের সাধারণ জীবনযাত্রার উপরই নিবদ্ধ থাকে না, বরং নৈতিকতা ও চিন্তা-চেতনার উপরও নিবদ্ধ থাকে। কারণ এটাই মানুষের জীবন ও কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং নৈতিকতা ও চিন্তা-চেতনার পরিশুদ্ধি ছাড়া কর্মের সংশোধন এবং অপরাধ ও দুষ্কৃতিরি মূলোৎপাটন কিছুতেই সম্ভব নয়। একারণেই ইসলামী হুকূমত সর্বপ্রথম ঐ সব বিষয়ের উপর বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে যা সমাজকে ভোগ-বিলাস, প্রবৃত্তিপরায়ণতা, আইনলঙ্ঘন ও অপরাধ প্রবণতার দিকে নিয়ে যায়। তার দৃষ্টিতে তারাও বড় অপরাধী এবং দেশের বড় শত্রু যারা সমাজের প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে নগ্নতা, বেহায়াপনা ও পাপপ্রবণতার পরিবেশ তৈরী করে, হোক তারা লেখক -বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী, কিংবা ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও পেশাজীবী। এই হুকূমত শান্তি-শৃঙ্খলা, সুবিচার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেমন সচেষ্ট তেমনি আত্মিক ও নৈতিক তত্ত্বাবধানের প্রতিও সমান যত্নবান। কেননা ইসলামী হুকূমতের যিনি প্রধান তার ভূমিকা শুধু পুলিশ ও চৌকিদারের নয়, একজন আদর্শ শিক্ষক ও আধ্যাত্মিক দীক্ষকেরও।
পৃথিবীর কোন ভূখন্ডে এই পদ্ধতির হুকূমত প্রতিষ্ঠিত হলে তার অগ্রাধিকারমূলক কাজ কী হবে? কোরআনের ঘোষণা অগ্রবর্তী মুহাজিরদের সম্পর্কে-
‘(এই মযলূম মুসলমান) তারা যাদেরকে যদি আমি ভূখন্ডে ক্ষমতা দান করি, তাহলে তারা ছালাত কায়েম করবে এবং যাকাত আদায় করবে এবং অন্যায়কর্ম হতে বিরত রাখবে। আর আল্লাহরই হাতে সকল বিষয়ের পরিণতি।’
নৈতিকতা ও শিল্প-বাণিজ্যের বিরোধ
আজ সম্পদস্ফীতির সঙ্কটকালে, কিংবা লর্ড ম্যাকলের অর্থপূর্ণ ভাষায়, ‘সম্ভাব্য দ্রুত সম্ভাব্য অধিক সম্পদ’ এই দর্শনে বিশ্বাসী মানুষের ক্ষমতার যুগে সর্বত্র এক উন্মত্ত বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা চলছে; যার ফলে শিল্পকারখান থেকে বিনোদন, প্রসাধন ও বিলাসসামগ্রী ঢলের মত শহরে, জনপদে এসে আছড়ে পড়ছে। রাজধানীর আলোঝলমল দোকানে শুধু নতু ফ্যাশান ও নতুন ডিজাইন শোভা পায়। কিন্তু আজকের নতুনই কালকের সেকেলে। তার জায়গায় আসে আরো নতুন, কিংবা নামেমাত্র নতুন কিছু। শোভা ও সৌন্দর্যের এবং ফ্যাশান ও আধুনিকতার পরিবর্তন হতেই থাকে। এর পিছনে আসল রহস্য হলো পুঁজিপতি ও শিল্পপতিদের উন্মত্ত প্রতিযোগিতা ও লাগামহীন মুনাফালিপ্সা, যা সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ এবং মানুষের প্রকৃত প্রয়োজন ও ক্রয়ক্ষমতা সম্পর্কে একেবারেই লা-পরোয়া। ফলে, এখন জীবনযাত্রার মান যেমন ক্রমউচ্চমুখী তেমনি তার ব্যয়ও ঊর্ধ্বমুখী। জীবনের চাহিদা ও কাল্পনিক প্রয়োজন এমনই মাত্রাছাড়া যে, কোন আয়ই আর যথেষ্ট নয়। ফলে অল্পেতুষ্টি নামে একসময় যে একটি অর্থপূর্ণ শব্দ ছিলো তা এখন অর্থহীন হয়ে পড়েছে এবং হারিয়ে গেছে জীবনের স্বস্তি ও শান্তি। প্রত্যেকের সামনে এখন জীবন -যাত্রার উচ্চতর স্তর এবং তা অর্জন করাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। সমাজ ও পরিবেশও এটাই দাবী করে এবং এ দাবী পূরণে যারা ব্যর্থ তাদের মর্যাদার অযোগ্য মনে করে। আরো মর্মান্তিক বিষয় এই যে, বৈধ-অবৈধ সর্বপ্রকার চেষ্টা-তদ্বির করে যখন সে ঐ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উপনীত হয় তখন দেখা যায়, জীবনের চাহিদা ও জীবনযাত্রার মান আরো উপরে উঠে গেছে। তাই জীবন এখন হয়ে পড়েছে এক অন্তহীন দৌড়ঝাঁপ ও অসুস্থ প্রতিযোগিতার নাম যা মানুষের কর্মশক্তিকে শুধু শুষে নেয়, কোন সুফল দেয় না। এর মনসত্মাত্ত্বিক ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, যে জীবন হতে পারতো স্বস্তি ও শান্তির, তাই হয়ে পড়েছে অস্থিরতা ও অশান্তির এবং যে পরিবার হতে পারতো দুনিয়ার জান্নাত, সেটাই হয়ে গেছে জাহান্নামের নমুনা, যেখানে জ্বলছে শুধু চাহিদার আগুন।
পক্ষান্তরে নৈতিক কুফল হয়েছে এই যে, সামাজিক সকল ঐতিহ্য ও নৈতিক মূল্যবোধ বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। হালাল-হারাম ও বৈধাবৈধের ন্যূনতম সীমারেখাও মুছে গেছে। সীমাবদ্ধ আয় যেহেতু সীমাহীন চাহিদা পূরণে অক্ষম সেহেতু বিভিন্ন নামে ও ছদ্মনামে ঘুষ- উৎকোচ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজ জীবনে কী মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে তা তো দিবালোকের মতই সুস্পষ্ট।
এটা যেহেতু জীবনের বৈধ ও স্বাভাবিক চাহিদা-প্রয়োজনের ফল নয়, বরং অবাস্তব দাবী ও চাহিদার ফল সেহেতু দুর্নীতিদমনের শুধু আইনগত ব্যবস্থা দ্বারা পরিস্থিতির পরিবর্তন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। এর জন্য আসল দায়ী হলো ঐ জীবনব্যবস্থা যা দীর্ঘ দিন থেকে আখলাকি হিদায়াত ও নৈতিক দিকনির্দেশনা থেকে এবং আখেরাতের শাস্তি-পুরস্কারের ধারণা থেকে বঞ্চিত। এর জন্য দায়ী ঐ বস্ত্তসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা যা মানুষের মধ্যে নৈতিক চেতনা ও বিবেকবোধ জাগ্রত করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। আর দায়ী ঐ শাসনব্যবস্থা যা আয় ও উৎপাদনের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখাকে তো কর্তব্য মনে করে, কিন্তু জীবনের বৈষয়িক চাহিদা ও আত্মিক প্রয়োজনের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার তাগাদা অনুভব করে না।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
আত্মহত্যার পথে ইউরোপ
আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের যুগ
ইতিহাসের বিভিন্ন যুগকে যদি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা দ্বারা যদি চিহ্নত করা যায় তাহলে আমরা অবশ্যই বলতে পারি যে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও প্রাযুক্তিক উদ্ভাবনের দিক থেকে আজকের যুগ হচ্ছে মানবজাতির ইতিহাসের বিশিষ্টতম যুগ এবং এ কারণে অতি সঙ্গতভাবেই একে আমরা আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের এবং তার ও বেতার যন্ত্রের যুগ বলতে পারি। আর এ ক্ষেত্রে ইউরোপের নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বও অনস্বীকার্য। ইউরোপের জ্ঞানী-বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক ও উদ্ভাবকদের যোগ্যতা ও প্রতিভা যে অন্তত এখনকার জন্য আমাদের ধরা-ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে তাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
তবে অতিউৎসাহীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আধুনিক ইউরোপের অগ্রগতির যতই স্ত্ততি-বন্দনা করুন এবং ইউরোপীয প্রতিভার অবদানে যতই কেননা আমরা মুগ্ধ হই, এ সত্য আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যাবতীয় আবিষ্কার-উদ্ভাবন জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নয়, বরং নিছক উপায় ও মাধ্যম। সুতরাং নিজস্ব সত্তায় এগুলো ভালো-মন্দ কিছুই নয়। উপায় ও মাধ্যমের ভালো-মন্দ নির্ধারিত হয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মানদন্ড। সুতরাং বিচারে বসতে হলে আমাদের দেখতে হবে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং তা সৎ, সন্দর ও কল্যাণপ্রসূ কি না?
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের জীবনে কী ভূমিকা পালন করে? এককথায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের অজ্ঞতা ও দুর্বলতা দূর করে; জগতের অজানা সব রহস্য উদ্ঘাটন করে; প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তি ও সম্পদ আয়ত্তে আনে এবং জীবনের গতিকে দ্রুততর ও সহজতর করে।
যেমন একসময় মানুষ পায়ে হেঁটে, তারপর ঘোড়ায় চড়ে পথ অতিক্রম করতো। কিন্তু তার চাই আরো গতি, আরো স্বস্তি। এক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এগিয়ে এলো তার সেবায়। তাই মানুষের হাতে এখন এমন বাহন ও যানবাহন এসে গেছে যা মানুষের দূরতম কল্পনায়ও ছিলো না। এখন দূরত্ব অতিক্রমের এই গতি ও স্বস্তিকে যদি মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহার করা হয় তাহলে নিঃসন্দেহে তা আল্লাহর বিরাট নিয়ামত। যেমন ইরশাদ হয়েছে-
‘আর এই সকল পশু-বাহন তোমাদের বোঝা বহন করে নিয়ে যায় এমন সব শহরে যেখানে তোমরা পৌঁছতে পারতে না প্রাণান্ত কষ্ট ছাড়া। নিঃসন্দেহে তোমাদের প্রতিপালক অত্যন্ত স্নেহময়, করুণাময়। আর (তিনি সৃষ্টি করেছেন) ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা যেন তাতে তোমরা আরোহণ করতে পারো এবং শোভারূপে গ্রহণ করতে পারো। আর তিনি সৃষ্টি করবেন এমন কিছু যা তোমরা জানো না।’
দেখুন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে গতি ও স্বস্তির সফরকে মানুষের উপর তাঁর একান্ত দয়া ও অনুগ্রহ বলে উলেস্নখ করেছেন। তারপর দেখুন, ‘সৃষ্টি করবেন যা তোমরা জানো না’ বলে কী আশ্চর্য প্রজ্ঞার সঙ্গে কী অপার সম্ভবানার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন!
আরো ইরশাদ হয়েছে-
‘আর অতি অবশ্যই বনী আদমকে আমি মর্যাদা দান করেছি এবং তাকে স্থলে ও জলে ‘বাহন’ দান করেছি এবং তাকে রিযিক দান করেছি উত্তম বস্ত্ত হতে এবং যে সকল মাখলূক আমি সৃষ্টি করেছি, তন্মধ্য হতে অধিকাংশের উপর আমি তাকে অত্যন্ত শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।
অন্যত্র সোলায়মান আলাইহিস্-সালামের প্রতি অনুগ্রহের উলেস্নখ- প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে-
‘আর সোলায়মানের জন্য আমি বাতাসকে অনুগত করে দিয়েছিলাম, তার সকালের যাত্রা ছিলো এক মাসের পথ, আর সন্ধ্যার যাত্রা ছিলো এক মাসের পথ।’
প্রকৃতির সকল শক্তি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যাবতীয় আবিষ্কার-উদ্ভাবন, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হচ্ছে সেগুলো সম্পর্কেও একই কথা। এ বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা খুবই সুস্পষ্ট। কারণ إني جاعل في ألأرض خليفة বলে আদম ও বনী আদমকে আল্লাহ তা‘আলা ‘খলীফাতুল্লাহি ফিল আরদি’- এর মর্যাদা দান করেছেন। তারপর তিনি ঘোষণা করেছেন যে, তাঁর আদেশে বিশ্বজগতের সব কিছু মানবের সেবায় নিয়োজিত এবং প্রকৃতির সকল শক্তি ও সম্পদ মানুষের অনুগত। ইরশাদ হয়েছে-
‘আল্লাহ ঐ মহান সত্তা যিনি আসমানসকল ও যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং আসমান থেকে পানি বর্ষণ করেছেন, অনন্তর তা দ্বারা ফলফলাদি হতে তোমাদের জন্য রিযিক বের করেছেন এবং অনুগত করেছেন তোমাদের জন্য জলযানকে, যেন চলে তা সমুদ্রে তাঁর আদেশে। আর অনুগত করেছেন তিনি তোমার জন্য নদ-নদীকে। আর দান করেছেন তিনি তোমাদের, ঐ সকল বস্ত্ত হতে যা তোমরা তাঁর কাছে চেয়েছো। আর যদি তোমরা গণনা করো আল্লাহর নেয়ামত, তা শুমার করতে পারবে না।’
জগত-প্রকৃতির সকল শক্তি-সম্পদ মানুষ ব্যবহার করবে এটাই তো স্বাভাবিক। কারণ সব কিছু আল্লাহ মানুষেরই জন্য সৃষ্টি করেছেন। তবে একজন মুমিন, যে আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করে, তার মধ্যে এবং অবিশ্বাসী ও অবাধ্য মানুষের মধ্যে চেতনাগত ও আচরণগত বিরাট পার্থক্য রয়েছে। আপন অনুসারীর প্রতি ইসলামের হিদায়াত এই যে, জগত-প্রকৃতির সকল শক্তি-সম্পদ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যাবতীয় উপায়-উপকরণ ব্যবহার করার সময় তার অন্তরে এ চেতনা জাগ্রত থাকবে যে, এসব আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ। সে ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হোক বা গাড়ীতে; জাহাজে আরোহণ করুক, বা উড়ো- জাহাযে, সে আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ করবে এবং তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করবে, যিনি এগুলোকে তার অনুগত করে দিয়েছেন। বস্ত্তত তিনি যদি তাকে জ্ঞান, বুদ্ধি, যোগ্যতা ও প্রজ্ঞা দান না করতেন, এগুলোর অর্জন, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হতো না-
سبحن الذي سخرلنا هذا و ما كنا له مقرننين.
(চিরপবিত্রতা ঐ সত্তার যিনি আমাদের অনুগত করে দিয়েছেন এটিকে, অথচ আমরা সেটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম ছিলাম না।)
সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, যত উন্নত বাহনেই সে আরোহণ করুক, জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে যেখানেই বিচরণ করুক তার পরিণতি হলো- و إنا إلى ربنا لمنقلبون
(আর অতি অবশ্যই ফিরে যাবো আমরা আমাদের প্রতিপালকের দিকে।)
জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুমিনের আচরণ একথা প্রমাণ করে যে, শক্তি, সম্পদ ও উপায়-উপকরণ হচ্ছে আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ এবং আল্লাহর পক্ষ হতে পরীক্ষার বিষয়। তার প্রতিটি আচরণ যেন ঘোষণা করে- ‘এটা তো আমার রবের পক্ষ হতে অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন, আমি কি শোকর করি, না অ-শোকর! আর যে শোকর করে সে নিজেরই জন্য শোকর করে, আর যে না-শোকরি করে, (সে জেনে রাখুক) আমার রব তো নির্মোখাপেক্ষী, মহান।’
শক্তি, সম্পদ ও উপায়-উপকরণকে মুমিন সঠিক ক্ষেত্রে, সঠিক লক্ষ্যে ব্যবহার করে। আর তার একমাত্র উদ্দেশ্য হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং মানবতার কল্যাণ সাধন। কারণ এটাই হচ্ছে জগত-প্রকৃতির সকল শক্তি-সম্পদ এবং যাবতীয় উপায়- উপকরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। ইরশাদ হয়েছে-
‘আর আমি লৌহ ‘অবতারণ’ করেছি; তাতে রয়েছে মানুষের জন্য বিভিন্ন উপকার। আর (এগুলো মানুষের অনুগত করে দেয়ার উদ্দেশ্য এই যে,) যেন আল্লাহ জেনে নেন, কে তাঁকে এবং তাঁর রাসূলকে সাহায্য করে, না দেখে। (প্রকৃত বিষয় তো এই যে,) নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্বশক্তির অধিকারী, প্রতাপশালী।’
আল্লাহর কোন নেয়ামতকে মুমিন কখনো অন্যায় কাজে, অন্যায়কারীর সাহায্যে ব্যবহার করতে পারে না। যেমন বলেছেন আল্লাহর নবী মূসা আলাইহিস্-সালাম- ‘হে রব, যেহেতু আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন সেহেতু কিছুতেই আমি অপরাধীদের সাহায্যকারী হবো না।’
মোটকথা নবী ও নবুয়ত এবং দ্বীন ও শরী‘আতই একমাত্র পথ যা মানুষের অন্তরে আল্লাহর পরিচয় এবং আল্লাহর প্রতি ভয় সৃষ্টি করে, আর সকল সৃষ্টির স্রষ্টা ও জগতের প্রকৃত নিয়ন্তার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করে এবং তাকে এ শিক্ষা দান করে যে, মানুষ কোনকিছুর মালিক নয়, রক্ষকমাত্র। একদিন তাকে তার মালিকের সামনে দাঁড়াতে হবে এবং জওয়াব দিতে হবে যে, এসকল শক্তি, সম্পদ ও উপায়-উপকরণ সে কোথায়, কী কাজে ব্যবহার করেছে? দ্বীন ও শরী‘আতই শুধু পারে মানুষকে শক্তির উন্মাদনা ও ক্ষমতার অপপ্রয়োগ থেকে বিরত রাখতে এবং সম্পদ ও উপায়-উপকরণের সঠিক ব্যবহারক্ষেত্র নির্ধারণ করতে, যাতে তা মানবজাতির জন্য কল্যাণপ্রসূ হয়। দ্বীন ও শরী‘আতই পারে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও নৈতিকতার মধ্যে এবং ব্যক্তিস্বার্থ ও সামষ্টিক কল্যাণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির ঔদ্ধত্বের পরিবর্তে বিনয় ও আবদিয়াতের শান পয়দা করতে। আলকোরআনে উভয় তরফের নমুনা পেশ করা হয়েছে। হযরত ইউসুফ (আ.) তাঁর বাদশাহাতের পূর্ণ শান ও জালালের সময় বলেছেন-
‘হে রব! আপনি আমাকে রাজত্ব দান করেছেন এবং আমাকে বক্তব্যের মর্ম অনুধাবন শিক্ষা দান করেছেন। হে আসমান-যমীনের সৃষ্টিকারী, আপনি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার অভিভাবক। আপানি আমাকে মুসলিমরূপে ওয়াফাত দান করুন এবং আমাকে আপনার নেক বান্দাদের সঙ্গে যুক্ত করুন।’
হযরত সোলায়মান (আ.) যখন শাহানশাহির শান-শৌকত ও দবদবা দেখলেন তখন ‘বে-সাখতা’ তাঁর যবানে এসে গেলো-
‘হে রব, আমাকে তাওফীক দান করুন, যেন আপনার নেয়ামতের শোকর আদায় করতে পারি, যা আপনি দান করেছেন আমাকে এবং আমার পিতা-মাতাকে; আর যেন এমন আমল করতে পারি যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। আর আপনি আমাকে আপনার করুণাবশে নেক বান্দাদের মধ্যে দাখিল করুন।’
পক্ষান্তরে দ্বীন ও শরী‘আতের আলো থেকে যারা বঞ্চিত, যাদের অন্তরে নেই আল্লাহর ভয় ও পরিচয় তারা ছিলো ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির গর্বে গর্বিত। কারণ তারা ভাবতো না যে, তাদের উপরে আছে কোন শক্তি যার কাছে তাদের জবাবদেহি করতে হবে। ইরশাদ হয়েছে-
‘আর কাউমে আদ, তারা যমীনে বড়াই করেছিলো অন্যায়ভাবে, আর বলেছিলো, শক্তিতে আমাদের চেয়ে প্রচন্ড! তারা কি দেখতে পায়নি যে, আল্লাহ, যিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন তিনিই শক্তিতে তাদের চেয়ে প্রচন্ড! আসলে তারা আমার নিদর্শনসমূহ অস্বীকার করতো।’
বিগত যুগের সম্পদগর্বে গর্বিত একব্যক্তির ঘটনা এভাবে বলা হয়েছে-
‘যখন তার কাউম তাকে বললো, বড়াই করো না; আল্লাহ বড়াইকারীদের পসন্দ করেন না। আর আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন তা দিয়ে পরকালের ঘর তালাশ করো, অবশ্য দুনিয়া থেকে তোমার প্রাপ্য অংশও ভুলো না। আর সদাচার করো, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি সদাচার করেছেন। আর যমীনে ফাসাদের অপচেষ্টা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ ফাসাদকারীদের পসন্দ করেন না।’
লোকটি ছিলো বনী ইসরাঈলের কারূন। সে দম্ভভরে জবাব দিলো, আমার প্রতি কারো কোন দান ও দয়া নেই। যা কিছু দেখো, তা আমার জ্ঞান-বুদ্ধি ও হুনর-হেকমতের ফল।
শক্তির অনুভূতি ও ক্ষমতার দম্ভ এবং উর্ধ্বশক্তির অস্তিত্ব অস্বীকার করার ফলে মানুষের মধ্যে এমন এক নেশা
ও উন্মাদনা সৃষ্টি হয় যে, সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কোন উপদেশ ও নীতিকথা, কোন মানবিক আবেদন ও সাধুবাদ তখন তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। তার ক্ষমতার দাপটে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে, দুর্বল জনগোষ্ঠী তার পদতলে পিষ্ট হতে থাকে। যেমন কাউমে আদকে তাদের পায়গম্বর বলেছিলেন, ‘যখন তোমরা কাউকে ধরো শক্তিমত্ত অবস্থায় ধরো।’
ফেতনা-ফাসাদ, অনাচার-স্বেচ্ছাচার ও মনাবনিপীড়নই হয়ে থাকে এর অনিবার্য ফল। যেমন ফেরআউন সম্পর্কে বলা হয়েছে-
‘নিঃসন্দেহে ফির‘আউন (তার) রাজ্যে মাথা তুলেছিলো এবং রাজ্যের অধিবাসীদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে রেখেছিলো। তাদের একটি দলকে সে দুর্বল করে রাখছিলো, (অর্থাৎ) তাদের পুত্রদের যবাই করছিলো, আর তাদের নারিদের জীবিত রাখছিলো। নিঃসন্দেহে সে ছিলো ফাসাদীদের অন্তর্ভুক্ত।’
নবী ও নবুয়তের নূর, দ্বীন ও শরী‘আতের হিদায়াত এবং আখলাকি তারবিয়াত ছাড়া যখন জ্ঞান-বুদ্ধি ও শিল্প-প্রযুক্তির উন্নতি হতে থাকে তখন তার স্বাভাবিক পরিণতি সেটাই হয় যা উপরে বর্ণনা করা হলো।
মোটকথা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতি মানবজাতিকে আজ যে মহাধ্বংস ও বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে চলেছে তাতে এই জড়যন্ত্রগুলোর কোন অপরাধ নেই। কেননা এগুলো তো আগাগোড়া মানুষের ইচ্ছা ও চাহিদা এবং নীতি ও নৈতিকতার অনুগত। স্বকীয় সত্তায় এগুলো না ভালো, না মন্দ। মানুষই তার ব্যবহার দ্বারা সেগুলো ভালো বা মন্দ বানায়। যন্ত্র অনেক সময় স্বকীয় সত্তায় ভালো হয়ে থাকে, কিন্তু মানুষ তার নিজের ভিতরের কদর্যতা ও অপব্যবহার দ্বারা সেটাকে মন্দে পরিণত করে। সুতরাং গলদ যন্ত্রের মধ্যে নয়, ব্যবহারকারী ও ব্যবহারের উদ্দেশ্যের মধ্যে।
এই যে আজ বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা চলছে, এই যে শহরে, জনপদে বিমান থেকে বোমা বর্ষিত হচ্ছে আর সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে; এই যে ডুবো জাহাজগুলো শান্তিকামী যাত্রীদের জলযান ও বাণিজ্যজাহাজ ডুবিয়ে দিচ্ছে, আর এই যে বেতার যন্ত্র (এবং বর্তমানে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবস্থা) মিথ্যাচার, পাপাচার, নগ্নতা ও বেহায়াপনার প্রসার ঘটাচ্ছে, তো পশ্চিমা সমাজ এবং তাদের অনুসারীদের বলা যায়- ‘তোমাদের কুফল তোমাদের সঙ্গে।’ কারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তো বিভিন্ন শক্তি মানুষের আয়ত্তে এনে দেয় এবং বিভিন্ন যন্ত্র তার হাতে তুলে দেয়। এতটুকুই তার কাজ। এখন কোথায়, কীভাবে ও কী উদ্দেশ্যে এগুলোর ব্যবহার হবে, এটা শিক্ষা দেয়া এবং এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কাজ নয়। যেমন দেয়াশলাই মানুষের হাতে আগুনের দাহ্যক্ষমতা তুলে দেয়। মানুষ এখন চুলার আগুন জ্বেলে খাবার প্রস্ত্তত করতে, কিংবা ঘর গরম করতে পারে, আবার পারে সমগ্রজনপদ জ্বালিয়ে দিতে। মানুষ তার আয়ত্তের শক্তি-সম্পদ কোথায় কীভাবে ব্যবহার করবে, কোন উপায়ে তা থেকে যথার্থ উপকৃত হবে সেটা শিক্ষা দিতে পারে একমাত্র দ্বীন ও শরী‘আত।
কিন্তু এই ‘মহাসম্পদ’ থেকে ইউরোপ আজ বঞ্চিত। তাদের সামনে তাই নীতি ও নৈতিকতার কোন বাধা নেই এবং নেই দ্বীন ও ধর্মের কোন নিষেধবাণী, এমনকি নেই আসমানী জ্ঞানের অধিকারী কোন ব্যক্তি যিনি তাদের সঠিক পথ দেখাবেন। তারা তাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং জীবনের পরিণতি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছে। তাদের মতে, ‘এই পার্থিব জীবন ছাড়া আর কোন জীবন নেই, আর আমাদের পুনরুত্থিত করা হবে না।’
এই বিশ্বাসের অনিবার্যতায় তারা ধরে নিলো যে, ভোগ-উপভোগ, আয়েশ-বিলাস, বস্ত্তগত উপকৃতি এবং ক্ষমতা ও আধিপত্য বিসত্মার, এ ছাড়া মানবজীবনে আর কোন উদ্দেশ্য নেই। বিশ্বজগত যেন রাজাহীন এক রাজ্য, বা মালিকানা -হীন কোন পতিত ভূমি। সুতরাং দখল করো, আর ভোগ করো।
ফলে ইউরোপ তার যাবতীয় জ্ঞান ও শক্তি ব্যয় করলো ভোগা-বিলাসের উপায়-উপকরণ তৈরীতে, কিংবা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য মারণাস্ত্র উৎপাদনের কাজে। এ ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের মধ্যেও চলতে থাকলো অস্ত্র ও যন্ত্র উদ্ভাবন ও উৎপাদনের উন্মত্ত প্রতিযোগিতা, যার শুরুআছে, শেষ নেই। এভাবে চলতে চলতে একসময় লক্ষ্য ও উপলক্ষ এবং উদ্দেশ্য ও মাধ্যমের পার্থক্যই মুছে গেলো, আর তারা বিশ্বাস করে নিলো যে, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, উপায়-উপকরণ এবং বস্ত্ত ও যন্ত্র, এগুলো কোন উদ্দেশ্যের মাধ্যম নয়, বরং সত্তাগতভাবে নিজেই উদ্দেশ্য। ফলে এ নিয়েই তারা এমন মেতে উঠলো এবং মজে থাকলো যেমন খেলনা নিয়ে মেতে থাকে শিশু। তারা ধরে নিলো, ‘ভোগই হলো সভ্যতা’, তারপর আরো এগিয়ে ভাবতে শুরু করলো ‘গতিই হলো সভ্যতা’। প্রফেসর জুড বলেন, ‘ডিযরেইলীর মতে তার যুগের সমাজ ভাবতো যে, সভ্যতার মূল কথা হচ্ছে ভোগ, কিন্তু আমরা মনে করি, সভ্যতা মানে গতি। গাতিই হচ্ছে আধুনিক যুবকের উপাস্য এবং গতির যূপকাষ্ঠে নির্দয়ভাবে তারা বলি দিতে পারে সর্বপ্রকার সুখ, স্বস্তি ও শান্তি, এমনকি অন্যের প্রতি দয়া-মায়াও।
ইউরোপে নীতি ও শক্তির ভারসাম্যহীনতা
দুর্ভাগ্যক্রমে ইউরোপে বহু শতাব্দী থেকে নীতি ও চরিত্র এবং শক্তি ও সম্পদের মধ্যে, তদ্রূপ জাগতিক জ্ঞান ও যুক্তি এবং ধর্ম ও পরকাল- চিন্তার মধ্যে ভারসাম্য গুরুতরভাবে নষ্ট হয়ে আছে। নবজাগরণের পর থেকে চরিত্র ও ধর্মচিন্তার বিপরীতে জড়শক্তি ও জাগতিক জ্ঞান দ্রুত বিসত্মার লাভ করেছে, আর অধঃপতনের দিকে এগিয়ে গেছে। যদি দাড়িপাল্লার দু’দিকের কথা ভাবি তাহলে বলতে হয়, শক্তি ও জ্ঞানের পাল্লা ভারি হয়ে শুধু নীচে নেমে এসেছে, আর ধর্ম ও চরিত্রের পাল্লা হালকা হয়ে উপরের দিকে উঠে গেছে। এভাবে একসময় এমন একপ্রজন্ম সামনে এলো যারা জ্ঞান ও শক্তির চর্চায় যেন আকাশের উচ্চতাকে ছুঁয়ে ফেলে, পক্ষান্তরে ধর্ম ও চরিত্রের বিষয়ে হয়ে আছে ভূমিলগ্ন। এ প্রজন্ম একদিকে জ্ঞান ও প্রযুক্তির অভিযাত্রায় এবং পদার্থ ও প্রাকৃতিক শক্তিকে আয়ত্ত করার সফলতায় যেন অতিমানবীয় কোন জাতি; অন্যদিকে কর্ম ও চরিত্রে, লোভ-লালসা ও ভোগ-বিলাসিতায় এবং নিষ্ঠুরতা ও নির্দয়তায় যেন চতুষ্পদ ও হিংস্র পশুর চেয়ে নীচে। জীবনযাপনের সব উপায়-উপকরণ তাদের হাতে, কিন্তু তারা জানে না, জীবন কীভাবে যাপন করতে হয়। জড়জীবনের ভোগ-বিনোদন ও নান্দনিকতার চূড়ান্তসীমারও জ্ঞান আছে তাদের, অথচ মানবিক জীবন এবং সভ্যতা ও চরিত্রের প্রাথমিক নীতি ও মূলনীতি সম্পর্কেও তারা অজ্ঞ। তাদের জ্ঞানের উন্নতি ও চরিত্রের অবনতি দু'টোই ছিলো অবিশ্বাস্য রকমের। প্রযুক্তি ও শিল্পের অগ্রযাত্রায় তারা যেন তারকালোকে পৌঁছে যেতে চায়, অথচ তারা জানে না, পায়ের নীচের মাটি কীকরে হবে বাস-উপযোগী? বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তাদের দিয়েছে অন্তহীন শক্তি, কিন্তু তার সুন্দর ব্যবহার ও সুপ্রয়োগের যোগ্যতা দান করেনি। প্রফেসর জুড বড় সুন্দর বলেছেন, ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান আমাদের এমন শক্তি দান করেছে যা দেবতাদের উপযোগী, কিন্তু আমরা তা ব্যবহার করছি শিশুর ও হিংস্র পশুর বুদ্ধি দ্বারা।’
সুতরাং এর বেশী আর কী হতে পারে যে, সম্পদ নষ্ট হবে, আর লাশ ছিন্নভিন্ন হবে!
অন্যত্র তিনি লিখেছেন, ‘একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা, অন্যদিকে লজ্জাজনক সামাজিক ‘শিশুতা’; উভয়ের মধ্যে এই যে বিরাট ব্যবধান, জীবনের মোড়ে মোড়ে আমরা এর মন্দ পরিণতির সম্মুখীন হচ্ছি। একদিকে আমরা ঘরে বসে মহাদেশ থেকে মহাদেশে কথা বলি; ছবি আদান-প্রদান করি; সিলনে বসে রেডিওতে লন্ডনের বড় ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পাই; ভূমি ও সমুদ্রের উপরে-নীচে বিচরণ করি; নিঃশব্দ টেলিপ্রিন্টার ব্যবহার করি; বিদ্যুতের সাহায্যে ফসল ফলাই; এক্স-রের সাহায্যে দেহের অভ্যন্তরে উঁকি দেই; ছবি এখন কথা বলে, গান গায়; বেতার যন্ত্রের সাহায্যে অপরাধী সনাক্ত হয়; উড়ো জাহাজ ও ডুবোজাহাজ দক্ষিণমেরু ও উত্তরমেরুতে যায়। এত কিছু হয়, হয় না শুধু এইটুকু যে, বড় বড় শহরে এমন কিছু মুক্ত মাঠ তৈরী করি যেখানে গরীব শিশুরা মনের আনন্দে নিরাপদে খেলাধূলা করবে। ফল এই যে, প্রতি বছর আমরা দু’হাজার শিশুকে হত্যা করি এবং নববই হাজার শিশুকে আহত করি।
একবার এক ভারতীয় দার্শনিকের সঙ্গে আলাপকালে আমি আমাদের সভ্যতার প্রশংসা করছিলাম। তখনকার ঘটনা, একজন গাড়ীচালক বালুসড়কে ঘণ্টায় চারশ মাইল অতিক্রম করার রেকর্ড গড়েছেন এবং একজন বিমানচালক মস্কো থেকে নিউইয়র্কে সম্ভবত বিশঘণ্টায় উড়ে এসেছেন। সব শুনে তিনি বললেন, হাঁ, তোমরা বাতাসে পাখীর মত উড়তে পারো এবং পানিতে মাছের মত সাঁতরাতে পারো, শুধু জানো না, কীভাবে মাটির উপরে হাঁটতে হয়!
যা ক্ষতিকর তাই শেখে
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এসব আবিষ্কার-উদ্ভাবন যদি এমন মানুষের হাতে ব্যবহৃত হতো যারা কল্যাণ- অকল্যাণে পার্থক্য করতে পারে এবং কল্যাণের পথে নিবেদিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে, তাহলে নিঃসন্দেহে এগুলো মনাবজাতির জন্য হতো ‘আশীর্বাদ’, কিন্তু মানুষেরই ব্যবহারদোষে কল্যাণের পরিবর্তে মানবজাতির জন্য তা বিপর্যয় ডেকে আনছে। বাবেলের জাদু সম্পর্কে যেমন কোরআন বলেছে- ‘যারা ঐসব বিষয় শিক্ষা করতো যা উপকার না করে ক্ষতি করতো।’
দেখুন প্রফেসর জুড কীভাবে প্রযুক্তি-সম্পদের স্বরূপ উদ্ঘাটন করে এর বস্ত্তনিষ্ঠ সমালোচনা করছেন-
‘আমরা এখন অভাবনীয় গতিতে দূরত্ব অতিক্রম করতে পারি, কিন্তু খুব কমই আমাদের গন্তব্য হয়ে থাকে আদর্শ গন্তব্য। পর্যটক ও পরিভ্রমণকারীর জন্য পৃথিবী ছোট হয়ে এসেছে ঠিক এবং সকল জাতি ও জনগোষ্ঠী এখন এত কাছাকাছি যে, সবার অঙ্গন যেন অভিন্ন। কিন্তু ফল? শুধু এই যে, পারস্পরিক সম্পর্কের আরো বেশী অবনতি ঘটেছে। আর যেসকল উপায় ও সুবিধার সাহায্যে আমরা পরস্পর পরিচিত হতে পেরেছি সেগুলোই আসলে বিশ্বকে যুদ্ধের আগুনে নিক্ষেপ করেছে। আমরা রেডিও বেতার উদ্ভাবন করেছি এবং প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছি, কিন্তু প্রতিবেশী দেশের আকাশ ও বাতাস ব্যবহার করা হচ্ছে তারই বিরুদ্ধে ‘প্রচারযুদ্ধে’ এবং নিজেদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে।’
‘এই বিমাটি দেখুন আকাশে ঘোরপাক খাচ্ছে, প্রথমে যারা তাতে উড্ডয়ন করেছিলো, কোন সন্দেহ নেই যে, তাদের সাহস ও মেধা ছিলো অতুলনীয়। কিন্তু এখন কী উদ্দেশ্যে তা ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে? বোম ফেলে শহর জনপদ ধ্বংস করার জন্য, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সবকিছু ভষ্মস্তূপ করার জন্য, অসংখ্য মৃতদেহ ছিন্নভিন্ন করার জন্য। এটা তো হয় নির্বোধ লোকের কাজ, কিংবা শয়তানের কাজ।’
‘আগামীকালের ঐতিহাসিক আমাদের সম্পর্কে কী লিখবেন? লিখবেন, কীভাবে বেতারতরঙ্গের সাহায্যে সোনার খনি আবিষ্কার করতাম, সোনা আহরণ করতাম এবং কী অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে সোনা ওজন করতাম, আর কীভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে পরাস্ত করে বিভিন্ন রাজধানীতে সোনা হস্তান্তর করতাম। তিনি আরো লিখবেন, মানুষরূপী এই হিংস্র পশুরা, যারা শিল্প ও প্রযুক্তিগত অগ্রাভিযানে যেমন ছিলো কুশলী তেমনি ছিলো দুঃসাহসী, কিন্তু তারা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠায় ছিলো অক্ষম, যা স্বর্ণবণ্টন ও স্বর্ণসংরক্ষণের দাবী ছিলো। তারা বরং একটা জিনিসই বুঝতো, আর তা হলো যথাসম্ভব দ্রুত খনিগুলো দাফন করে দেয়া; অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকার খনি থেকে তারা সোনা তুলে আনতো, আর লন্ডন, নিউইয়র্ক ও প্যারিসের ব্যাঙ্কগুলোতে তা দাফন করে ফেলতো।’
জ্ঞান, শিল্প ও প্রযুক্তি এবং ধর্ম, চরিত্র ও মানবতার মধ্যে বর্তমান পশ্চিমা সভ্যতা যে বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি করে রেখেছে এবং মানবতার কল্যাণসাধনে যে অমার্জনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে অন্য এক পশ্চিমা পণ্ডিৎ, যিনি দর্শনশাস্ত্র ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান উভয় বিষয়ে বৈদগ্ধ অর্জন করেছেন, তিনি আরো সূক্ষ্ম-গভীর শৈলী ও দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বিশেস্নষণ করেছেন। তিনি ডক্টর আলেক্সস কেরল, তিনি লিখেছেন-
‘বর্তমান জীবনব্যবস্থা মানুষকে শুধু সম্ভাব্য সকল উপায়ে সম্পদ অর্জন প্রলুদ্ধ করে, কিন্তু মানুষকে সম্পদের উদ্দেশ্য পর্যন্ত পৌঁছায় না, বরং তার মধ্যে একটা স্থায়ী উত্তেজনা ও জৈবিক চাহিদা সৃষ্টি করে এবং সেটাকে প্রশমিত ও পরিতৃপ্ত করার একটা অপরিপক্ব তাড়না সৃষ্টি করে। ফলে মানুষ ধৈর্য ও স্থৈর্য থেকে বঞ্চিত হয় এবং এমন যে কোন কাজ থেকে সে দূরে সরে থাকে যা কিছুটা কষ্টকর ও ধৈর্যসাপেক্ষ। আধুনিক সভ্যতা যেন এমন মানুষ সৃষ্টিই করতে পারে না যার মধ্যে সৃজনশীলতা, সাহস ও মেধা রয়েছে। প্রত্যেক দেশে দেখা যায়, যে শ্রেণীটি দেশ পরিচালনা করে এবং যাদের হাতে দেশের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা, তাদের মধ্যে নৈতিক ও চিন্তানৈতিক সক্ষমতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি যে, আধুনিক সভ্যতা ঐ সকল বৃহৎ আশা-আকঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে সক্ষম হয়নি যা তার কাছে মানবজাতির কাম্য ছিলো। আধুনিক সভ্যতা এমন মানুষ সৃষ্টি করতে পারেনি যাদের মধ্যে সাহস আছে এবং মেধা ও যোগ্যতা আছে; যারা এই সভ্যতাকে ঐ দুর্গম চড়াই-উৎরাইপূর্ণ পথে নিরাপদে নিয়ে যেতে পারবে যেখানে এখন সভ্যতা শুধু ঠোকর খাচ্ছে এবং একের পর এক স্খলনের শিকার হচ্ছে। প্রকৃত ঘটনা এই যে, মানব সম্প্রদায় ঐ পরিমাণ দ্রুততার সঙ্গে উন্নতি করতে পারেনি যেভাবে মনাবমস্তিষ্ক থেকে জন্মলাভ করা প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নতি করেছে। এটা মূলত রাজনৈতিক নেতৃবর্গের নৈতিক ও চিন্তানৈতিক ত্রুটি-বিচ্যুতিরই ফল এবং ঐ মূর্খতার ফল যা আজকের সকল জাতি ও সম্প্রদায়কে বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আজ যে পরিবেশ ও পরিপার্শ্ব তৈরী করেছে তা মানুষের উপযোগী নয়। কেননা তা গড়ে উঠেছে তাৎক্ষণিকতার উপর, কোন পূর্বপরিকল্পনা ও চিন্তা-ভাবনার উপর নয়। মানুষের ব্যক্তিসত্তা ও চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতির বিষয়টি সেখানে চিন্তা করা হয়নি। এই পরিবেশ ও পরিপার্শ্ব, যা শুধু আমাদের মেধা ও বুদ্ধি এবং প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনার ফসল, তা আমাদের আকার-আকৃতি ও দেহাবয়বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ অবস্থায় আমরা খুশী ও সুখী নই। আমরা এক নিরন্তর নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অধঃপতনের স্বীকার। যে সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে শিল্পসভ্যতার বিকাশ ঘটেছে এবং যারা উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির চূড়ায় উপনীত হয়েছে তারা কিন্তু আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং দ্রুত বন্যতার দিকে ধাবিত হচ্ছে, কিন্তু তাদের সে অনুভূতি নেই। ঐ ক্ষিপ্ত ও উন্মত্ত পরিবেশ-পরিপার্শ্ব থেকে কোন শক্তি এখন তাদের বাঁচাতে পারবে না, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তাদের চারপাশে বেষ্টনীর মত তৈরী রেখেছে।
সত্য এই যে, পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর মত আমাদের বর্তমান সভ্যতাও জীবনের জন্য এমন কিছু শর্ত আরোপ করে রেখেছে, যা বিভিন্ন অজ্ঞাত কারণে জীবনকে অসম্ভব করে তোলবে। আমরা জড়বস্ত্ত সম্পর্কে যতটা জ্ঞান অর্জন করেছি তার তুলনায় জীবন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই অল্প। আমরা আসলে জানিই না যে, মানুষের কীভাবে জীবনযাপন করা উচিত। এ বিষয়ে আমাদের জ্ঞান এখনো অনেক পিছনে এবং এই জ্ঞানদৈন্যই আমাদের সর্বনাশ করেছে। এর মাশুল আমাদের দিয়েই যেতে হবে।
উদ্ভাবিত যন্ত্রের যত দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে, তা থেকে সেভাবে উপকার গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান ও রসায়নশাস্ত্রের আবিষ্কারগুলোকে বেশী গুরুত্ব দিয়েও কোন লাভ নেই। কারণ আমাদের সভ্যতার ভোগসামগ্রী, বিলাসপ্রাচুর্য এবং সৌন্দর্য ও নান্দনিকতাকে গুরুত্ব দিলেই বা কী হবে যদি নিজেদেরই দুর্বলতার কারণে তা থেকে আমরা উপকৃত না হতে পারি এবং মানব-কল্যাণে নিয়োজিত করতে না পারি! জীবন থেকে যদি চরিত্র ও নৈতিকতার দিকটি এবং সর্বোত্তম মানবীয় গুণাগুলো সম্পূর্ণ বের করে দেয়া হয় তাহলে সেই জীবন- ব্যবস্থাকে সুসংহত করে কী লাভ? আমাদের জন্য তো বেশী ভালো ছিলো দ্রুতগামী বিমান, আরামদায়ক গাড়ী, সসত্মা রেডিও এবং দূর মহাকাশের অনুসন্ধানী টেলিস্কোব তৈরী করার চেয়ে নিজের প্রতি অধিক মনোযোগী হওয়া। কোন বিমান যদি সল্পতম সময়ে দূরতম কোন স্থানে পৌঁছে দেয় তাতে আমাদের প্রকৃত কী উন্নতিটা অর্জিত হবে? আমাদের জন্য কি খুব জরুরি যে, আমরা উৎপাদন বাড়িয়েই যাবো, যাতে মানুষ অধিক হারে অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ব্যবহার করতে থাকে? এতে কি সামান্যতম সন্দেহ আছে যে, যন্ত্রবিজ্ঞান, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও রসায়নশাস্ত্র আমাদেরকে মেধা ও প্রজ্ঞা দান করতে পারে না এবং পারে না নৈতিক ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যবিধান, স্নায়ুবিক ভারসাম্য ও শান্তি-নিরাপত্তা দান করতে?
যন্ত্র ও প্রযুক্তির ধ্বংসযজ্ঞতা
বিভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে, যার কিছু বিবরণ পিছনে তুলে ধরা হয়েছে, পাশ্চাত্যের জনপদে শুভ ও শুভ্রতা এবং কল্যাণ ও উত্তমতার প্রতি আগ্রহ-অনুরাগ প্রায় লোপ পেয়ে গেছে। সভ্যতা ও নৈতিকতার সুস্থ-সুন্দর নীতি ও মূলনীতিগুলো বহু আগেই তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। দায়িত্বহীন ও ভ্রান্ত সাহিত্য তাদের হৃদয় ও হৃদয়বৃত্তিকে ভুল পথে নিয়ে গেছে। অমত্মঃসারশূন্য ও নাস্তিকতামুখী দর্শন তাদের চিন্তা-চেতনাকে ভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট পথে পরিচালিত করেছে। ফলে তাদের মন ও মনন, সংস্কার ও সংস্কৃতি এবং রুচি-রোচ্যতায় এমন ধ্বস নেমেছে যে, কল্যাণ ও সুকৃতির কোন যোগ্যতাই তাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট থাকেনি। ফলে অসুস্থ পাকস্থলীর জন্য যেমন সুখাদ্যও ক্ষতিকর তেমনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা এবং জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির উদ্ভাস ও বিকাশ স্বয়ং ইউরোপের জন্য এবং সাধারণভাবে মানবজাতি ও মানবসভ্যতার জন্য চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিস্টার এডেন ১৯৩৮ সনে তার এক ভাষণে বড় সুন্দরভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন-
‘কিছু বুঝে ওঠা এবং কিছু সংশোধন করার আগেই হয়ত মানুষ এ শতাব্দীর শেষভাগে সেই অসভ্যতা ও বর্বরতার যুগে ফিরে যাবে, যা পৃথিবীতে একসময় বিরাজমান ছিলো। হয়ত আজকের আধুনিক মানুষ প্রাচীন পৃথিবীর জঙ্গলী গুহাবাসিদের জীবনই গ্রহণ করবে। কী আশ্চর্যের কথা! সকল জাতি ও রাষ্ট্র মারণাস্ত্র থেকে বাঁচার জন্য পানির মত অর্থ ব্যয় করছে। এসব অস্ত্রের ধ্বংসযজ্ঞতার বিষয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত তো সবাই, কিন্তু সেগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা কেউ ভাবছে না। কখনো কখনো অবাক হয়ে ভাবি, যদি ভিনগ্রহের কোন বুদ্ধিমান প্রাণী এখন পৃথিবীতে নেমে আসে, তাহলে সে কী দেখবে এবং কী ভাববে? সে দেখবে, আমরা নিজের হাতে নিজের ধ্বংসের সরঞ্জাম তৈরী করছি! আবার তথ্যবিনিময় করছি যে, এসব নারকীয় অস্ত্রের, আরো উন্নয়ন ঘটিয়ে, কীভাবে আরো কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়।
মিস্টার এডিন যখন কথা বলছিলেন তখন হয়ত তার কল্পনায়ও ছিলো না যে, উন্নত বিশ্ব ও তার অভিভাবক আমেরিকা, মুখে যারা শান্তির দাবিদার, ঐই যুদ্ধেই এমন অস্ত্র ব্যবহার করবে, যার ধ্বংসযজ্ঞতা সব মারণাস্ত্রকে ছাড়িয়ে যাবে, যার বীভৎসতা স্বয়ং বিজ্ঞানীদেরও ধারণাকে হার মানাবে। স্রষ্টার সঙ্গে যাদের সম্পর্ক নেই, নিজেদেরই যারা মনে করে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির স্রষ্টা তাদের সেই ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ সৃষ্টির নাম হলো পারমাণবিক বোমা।
কয়েক বছরের সুপরিকল্পিত গবেষণা ও চেষ্টা-সাধনা এবং বিপুল অর্থব্যয়ের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত আমেরিকা পারমাণবিক বোমার ‘জনক’ হলো। এবার আধুনিক প্রযুক্তির এই নতুন দৈত্যটির ধ্বংসযজ্ঞতার পরীক্ষার পালা। প্রথম পরীক্ষাটি সম্পন্ন হলো ১৯৪৫-এর ১৬ই জুলাই ভোর পাঁচটায় নিউ মেক্সিকোর জনমানবহীন মরুভূমিতে। তারপর চূড়ান্ত পরীক্ষার জন্য অত্যন্ত ঠান্ডামাথায় বেছে নেয়া হলো জাপানে কয়েক লক্ষ মানুষের শন্তিপূর্ণ দু’টি জনপদকে। কারণ এর পিছনে পাশ্চাত্য তার সর্বোচ্চ মেধা ও প্রযুক্তি ব্যয় করেছিলোই তে এ জন্য যে, শত্রুজাতি যেন সন্ত্রস্ত হয়ে পরাজয় মেনে নেয়, হোক না তাতে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষের দেহ ভষ্ম!
১৯৪৫-এর ৬ই আগস্ট জাপানের দুর্ভাগা শহর হিরোশিমা হলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের প্রথম শিকার, দ্বিতীয় শিকার হলো নাগাসাকি, ঠিক তিন দিন পর! যে সভ্যতা মানুষকে শিক্ষা দেয় শুধু বর্বরতা, ধিক তাকে ধিক! যে বিজ্ঞান, যে প্রযুক্তি বয়ে আনে এমন ধ্বংস, এমন মৃত্যু, ধিক তাকে শত ধিক!
বোমাবিস্ফোরণের মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ মানুষের বিশাল সমৃদ্ধ জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়ে গেলো। না প্রাণ অবশিষ্ট ছিলো, না কোন প্রাণী; না মাকান অক্ষত ছিলো, না কোন ‘মাকীন’। চোখের পলকে মানুষ, পশু, জড়পদার্থ সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো। বিস্ফোরণের বিকট ‘ধামাকা’, আলোর তীব্র ঝলকানি, বাতাসের চাপ ও ধোঁয়া সব মিলিয়ে বলা যায়, জাহান্নামের বিভীষিকা ছিলো। ধূলোবালি ও ধোঁয়ার কয়েক মাইলব্যাপী যেন সুউচ্চ এক পাহাড়, যার নীচে জ্বলছে জাহান্নামের আগুন, যা সবকিছুকে, শাব্দিক অর্থেই সবকিছুকে, ছাইভষ্মে পরিণত করে ফেলেছে।
নিক্ষিপ্ত বোমার ধ্বংসলীলা উপভোগ করার লোভ ছিলো বিমানচালকের, কিন্তু বোমা ফেলেই তাকে সরে যেতে হয়েছে নিরাপদ দূরত্বে। নইলে বিমান ও চালক ‘গলিত পদার্থ’ হয়ে নীচে পড়ে যেতো। বোমার ধামাকা এত বিকট ছিলো যে, বোমাবর্ষণকারীদেরও অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। ভয়-ভীতি ও হতভম্বতার অবস্থায় মুখ থেকে ‘হায় খোদা’- এই একটিমাত্র শব্দই বের হতে পারলো। কিন্তু মিশনের সফলতার খবর শোনামাত্র মিত্রশক্তির শিবিরে শুরু হয়ে গেলো নৃত্য ও আনন্দ-উল্লাস। ধ্বংস ও উল্লাসের এ বীভৎস দৃশ্য শয়তানের জন্য ছিলো কত না আনন্দের!
১৯৪৯ সালের ২০শে আগস্ট হিরোশিমার নগরপ্রধান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ৬ই আগস্টে তাৎক্ষণিকভাবে যারা এ বোমার নির্মম বলি হয়েছিলো তাদের সংখ্যা দু’লাখ দশ হাজার থেকে চল্লিশ হাজার।
মিস্টার স্টুয়ার্ট গিল্ডার ভারতের স্টেটম্যান পত্রিকার ১৬ই সেপ্টেম্বর (১৯৪৫) সংখ্যায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এটম বোমার ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন-
‘যদিও বিশদ বৃত্তান্ত জানা ছিলো না, তবু বিজ্ঞানীরা এতটুকু অবশ্যই জানতেন যে, যে বোমা তারা ফেলতে যাচ্ছেন তার পার্শ্বপ্রতি- ক্রিয়া এই হবে যে, মানবতার ধ্বংস রোধ করা আর সম্ভব হবে না। বিশদ বিবরণ জানতে হলে হিরোশিমার ধ্বংসপরবর্তী যে সকল রিপোর্ট সংবাদদাতাদের হাতে এসেছে তা দেখুন। বোমা বিস্ফোরণের এটমিক প্লেগ সম্পর্কে তারা লিখেছেন-
‘বহু মানুষ, যারা বোমার বিস্ফোরণ ও তাপবিকিরণের প্রতিক্রিয়ায় তাৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেনি, তারা এখন নিয়মিত মারা যাচ্ছে এবং মৃত্যুর কারণ এই যে, তাদের রক্ত ‘বিশ্লিষ্ট’ হয়ে যায়। প্রথমে শ্বেত কণিকা, পরে লোহিত কণিকা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যায়। তাদের চুল পড়ে যায়, আর যত দিনই বেঁচে থাকে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শুকিয়ে যেতে থাকে এবং ক্রমে মৃত্যুর থাবা এগিয়ে আসে এবং তারা মৃত্যুর শিকার হয়। এর কারণ, সম্ভবত বিস্ফোরণের পর বাতাসে কিছু তেজষ্ক্রিয় পদার্থ রয়ে গেছে এবং দেহের ত্বকে শোষিত হয়ে বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে অনুপ্রবেশ করছে।’
‘এ খবর সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। এর আগ পর্যন্ত পৃথিবী এ বোমার ভয়াবহতা সম্পর্কে যেমন কিছু জানতো না তেমনি তেজষ্ক্রিয়তার ক্ষতি সম্পর্কে অবগত ছিলো না, কিন্তু বিজ্ঞানীরা তো ত্রিশ বছর আগেই জানতেন যে, এটা হবে এমন এক মারণাস্ত্র যার কোন প্রতিরোধ ও পাল্টা ব্যবস্থা নেই, যা পক্ষ-প্রতিপক্ষ সমগ্র মানবজাতির জন্য ধ্বংসকর প্রমাণিত হতে পারে।
জাপানীরা নাকি তেজষ্ক্রিয়তার প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য গৃহে প্রস্ত্তত মুখোশ ব্যবহার করেছে। সম্ভবত এগুলো হচ্ছে প্রচ- শীত থেকে রক্ষার মুখাবরণ, যা তারা এত দিন ব্যবহার করে এসেছে, কিন্তু তা কোন কাজেই আসেনি; যেমন কাজে আসেনি ইথিওপীয় বাহিনীর নাক-পেঁচানো রুমাল, যা তারা হানাদার মুসোলিনীয় বাহিনীর বিমান থেকে ছোঁড়া বিষাক্ত গ্যাস থেকে আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করেছিলো।
বোমা নিক্ষেপকারী বৈমানিকের মতে বিস্ফোরণের পর ধূলো ও ধোঁয়ার কুন্ডুলী শূন্যে নয় মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রফেসর প্লেসেস বলেন, বিস্ফোরণক্ষেত্র থেকে একশ মাইল দূরের লোকেরাও এর মরণছোবল থেকে নিরাপদ নয়। সুতরাং তাদেরও মেডিকেল পরীক্ষা হওয়া দরকার এবং নিবিড় বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণে রেখে দেখা দরকার যে, কোনভাবে তারা এর তেজষ্ক্রিয়তার শিকার হয়েছে কি না।
এটা মোটেও অসম্ভব নয় যে, পৃথিবীর মানুষ একভোরে ঘুম থেকে জেগে খবরের কাগজে পড়বে যে, জাপান থেকে হাজার মাইল দূরের বসতিতেও এটমিক প্লেগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে।
একটি ছোট্ট এটম বোমার ধোঁয়া ও ধূলা যদি নয় মাইল পর্যন্ত পরিবেশকে বিষাক্ত করতে পারে তাহলে এটা ভাবা খুবই যৌক্তিক যে, আরো বড় বোমা আরো বিসত্মৃত অঞ্চলজুড়ে প্রভব ফেলবে।
বার্মিঙহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম, ভি ওলে ফিনেট, এটমবোমা শিল্পসংস্থার সদস্য, বলেন-
‘কেউ যদি এটা ভাবে তাহলে খুবই হাস্যকর যে, ব্রিটেন বা অন্য কেউ এটমবোমার কৌশল ও রহস্য গোপন রাখতে পারবে। যে সব সূত্রের উপর ভিত্তি করে এ বোমা তৈরী হয়েছে তা এখন প্রতিটি দেশের জন্য ‘খোলা পাতা’। ব্রিটেন ও আমেরিকা পূর্ববর্তীদের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পারমাণবিক শক্তি অর্জন করেছে। তো নির্দ্বিধায় বলা যায়, একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর তা সামরিক গোপনীয় বিষয় কিছুতেই থাকবে না, বরং প্রতিটি শিল্পোন্নত দেশ সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের মধ্যে এ বোমা বানাতে পারবে। আর যদি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সর্বশক্তি এ প্রকল্পেই নিয়োজিত করা হয় তাহলে দু’বছরই যথেষ্ট।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে, অতি অল্প সময়ে বিশ্ব এমন বোমা দেখতে পাবে যা প্রথমটি চেয়ে দশ হাজার টন বেশী বিস্ফোরক শক্তির অধিকারী হবে। এর পর আসবে এমন বোমা যার বিস্ফোরণ শক্তি হবে দশলক্ষ টন। কোন সতর্কতা ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাই তখন আর কাজে আসবে না। আর এধরনের মাত্র ছয়টি বোমা পুরো ইংল্যান্ডকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার জন্য যথেষ্ট। রুশবোমাও এখন আর খুব দূরে নয়।
সম্প্রতি আমেরিকা আরেকটি বোমা উদ্ভাবনে সফল হয়েছে, হাইড্রোজেন বোমা, যার শক্তি ও ধ্বংসকরতা এটম বোমা থেকে অনেক বেশী। ১৯৫৪ সালের ২৬শে মার্চ প্রশান্ত মহাসাগরে দ্বিতীয়বারের মত এর পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। প্রতিরক্ষা সচীব মিস্টার চার্লস ই উইলসন বলেছেন, পরীক্ষার ফল ছিলো অবিশ্বাস্য পর্যায়ের।
আমেরিকার পারমাণবিক শক্তি কমিশনের প্রধান মিস্টার লুয়াইস স্ট্রাস বলেন, একটি হাইড্রোজেন বোমা নিউইয়র্কের মত বিশাল শহর মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারে।
প্রখ্যাত প্রকৃতি বিজ্ঞানী এবং নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান, সাহেব সিং নতুন দিল্লীতে বলেছেন, চারটি হাইড্রোজেন বোমা, যার প্রতিটির ওজন একশ টন, ভূপৃষ্ঠের প্রতিটি মানবসন্তানকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট। আর সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, রাশিয়া নাইট্রোজেন বোমা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে যার ধ্বংসবীভৎসতা হাইড্রোজেন বোমা থেকে অনেক বেশী।
যা খবীছ তা খবীছ ছাড়া আর কী দেবে? পিছনের বিশদ আলোচনা থেকে এটা খোলা হয়ে গেছে যে, ইউরোপীয় সভ্যতার বুনিয়াদ এখন নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। যতই দিন দিন তার উচ্চতা যতই বৃদ্ধি পাচ্ছে তার দুর্বলতা, ভঙ্গুরতা ও পতনঝুঁকি ততই বেড়ে চলেছে। আর এটাই স্বাভাবিক। কারণ এ সভ্যতার বীজ নষ্ট বীজ; সুতরাং তার বৃক্ষ যেমন ভালো হতে পারে না তেমনি তার ফলও উত্তম হতে পারে না।
‘আর উত্তম শহর তার উদ্ভিদ (উত্তমরূপে) অঙ্কুরিত করে, কিন্তু যা খবীছ তা তো খবীছ ছাড়া আর কিছু অঙ্কুরিত করতে পারে না।’
উপমহাদেশের প্রখ্যাত এক মুসলিম স্কলার সংক্ষেপে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরেছেন-
‘যে ভূখ- ও জনগোষ্ঠীতে পাশ্চাত্য সভ্যতা আত্মপ্রকাশ করেছে সেখানে আসমানি হিকমত ও ঐশী প্রজ্ঞার কোন স্বচ্ছ ও সুমিষ্ট ঝর্ণাধারা ছিলো না (যা হৃদয় ও আত্মার পিপাসা নিবারণ করতে পারে, যার সম্পর্কে বলা যায়, ‘একবার পান করে আর পিপাসা ধরে না’)। সেখানে ধর্মনেতা কম ছিলেন না, কিন্তু তারা জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও আসমানি শরী‘আতের অধিকারী ছিলেন না। তাদের কাছে ছিলো ধর্মের কিছু আবছা ছায়া, যা চিন্তা ও কর্মের সরল পথে মানব- জাতিকে পরিচালিত করতে যদি ইচ্ছাও করতো, পারতো না। তবে তার উচিত ছিলো না জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক ও ‘হোঁচটখাওয়া পাথর’ হওয়া, কিন্তু ধর্ম নামের ঐ বস্ত্তটি তাই হয়েছিলো। ফল এই দাঁড়ালো যে, যারা বিজ্ঞানের অভিযাত্রায় বদ্ধপরিকর ছিলো তারা ধর্মের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে দিলো এবং একটি পথ ও পন্থা গ্রহণ করলো যেখানে অবলোকন ও পরীক্ষা এবং গবেষণ ও নীরিক্ষা ছাড়া তাদের আর কোন প্রমাণ ও প্রদর্শক ছিলো না। এই প্রমাণ ও প্রদর্শক-এর উপরই তারা নিঃশর্ত আস্থা স্থাপন করেছিলো, অথচ এগুলো নিজেই ছিলো প্রমাণসাপেক্ষ এবং হিদায়াত ও নূরের মুহতাজ। অবলোকন, নিরীক্ষণ ও পরীক্ষণ- এসকল প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই তারা চিন্তা-গবেষণা, সন্ধান-অনুসন্ধান ও নির্মাণ-বিনির্মাণের পথে অগ্রসর হলো এবং চেষ্টা-সাধনায় আত্মনিয়োগ করলো। কিন্তু প্রতিটি দিকে, প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পদক্ষেপই ছিলো ভ্রান্ত। ফলে জ্ঞান ও বিজ্ঞান সাধনার সর্বঅঙ্গনে তাদের অভূতপূর্ব সফলতা এবং চিন্তা-গবেষণার পথে তাদের সকল প্রয়াস-প্রচেষ্টা তাদেরকে সঠিক লক্ষ্যে উপনীত করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। তারা যাত্রা শুরু করলো জড়বাদ ও নাস্তিকতা, এই বিন্দু থেকে। বিশ্বজগতকে তারা দেখলো এই বিশ্বাস থেকে যে, এর কোন স্রষ্টা নেই এবং অবলোকন ও অনুভবের বাইরে কোন কিছুর উপস্থিতি নেই এবং এই যে দৃশ্য পর্দা, এর আড়ালে অদৃশ্য কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। পরীক্ষা- নিরীক্ষার মাধ্যমে তারা প্রকৃতির নীতি ও সূত্র অনুধাবন করতে তো সক্ষম হলো, কিন্তু প্রকৃতির নিয়ন্তা-শক্তির পরিচয় অর্জন করতে ব্যর্থ হলো। বিদ্যমান বস্ত্ত, পদার্থ ও ব্যবস্থাকে তারা ‘নিয়ন্ত্রিত’ দেখতে পেলো এবং বিভিন্ন কাজেও লাগালো, কিন্তু এ কথা ভুলে গেলো যে, তারা এগুলোর মালিক নয়, প্রকৃত মালিকের প্রতিনিধিমাত্র। তাই তাদের মনেই হলো না যে, এ বিষয়ে তাদের কোন দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা আছে এবং কোন ঊর্ধ্বশক্তির কাছে তাদের জবাবদেহি করতে হবে। ফলে তাদের তাহযীব ও সভ্যতার ভিত্তিতেই গলদ রয়ে গেলো। স্রষ্টার তারা উপাসনার ছেড়ে মেতে উঠলো আত্মপূজায়। প্রবৃত্তিই হলো উপাস্য, আর তা তাদের নিক্ষেপ করলো এক মহাফিতনার আবর্তে, যা থেকে উদ্ধারের কোন উপায় থাকলো না। বরং মন-মনন ও চিন্তা-চেতনার সকল ক্ষেত্রেই আপাত সুন্দর, কিন্তু বড় ভয়ঙ্কর পথে টেনে নিয়ে গেলো, যার পরিণতি ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নয়।
এটাই জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে বিকৃত ও বিনষ্ট করেছে। ফলে মানব-কল্যাণের মাধ্যম না হয়ে তা হয়ে পড়েছে মানবতার ধ্বংসের বাহন। একারণেই আখলাক ও চরিত্র আজ হয়ে পড়েছে খাহেশাত ও প্রবৃত্তির অনুগামী এবং নগ্নতা ও স্বেচ্ছাচারের অপর নাম। সর্বোপরি জীবন ও জীবিকা এবং সমাজ ও সামাজিকতা, সবকিছুর উপর চেপে বসেছে কৃপণতা, স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার শয়তান। শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে আত্মপূজা, আত্মকেন্দ্রিকতা, আত্মঅহমিকা ও ভোগ-লালসা। একারণেই রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতিতে চলছে বর্ণবাদ,
জাতীয়তাবাদের জিঘাংসা ও উন্মাদনা, চলছে শক্তিদেবতার পূজা ও বন্দনা, যা মানবতার জন্য আজ সবচে’ বড় অভিশাপ।মোটকথা, নবজাগরণের পর ইউরোপের মাটিতে যে দুষ্ট বীজ বপন করা হয়েছিলো, কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই তা এক বিরাট বিষবৃক্ষের রূপ ধারণ করে ফেলেছে এবং স্বাভাবিক ফল দিতে শুরু করেছে, যা বাইরে সুন্দর, কিন্তু ভিতরে তিতা ও বিষে ভরা, যার শাখা-প্রশাখা সবুজ পাতায় ছাওয়া, কিন্তু তা অক্সিজেন নির্গত করে না, বিষাক্ত গ্যাস ছড়ায় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহের রক্তে গিয়ে মিশে যায়।
পাশ্চাত্য জাতি, যারা নিজেরাই এ দুষ্ট বৃক্ষ রোপণ করেছে, এর বিষাক্ততায় আজ অতিষ্ঠ ও দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কেননা জীবনের সকল ক্ষেত্রে তা অসংখ্য সমস্যা ও সঙ্কট সৃষ্টি করেছে এবং করে চলেছে। যেই তারা একটি সমস্যার সমাধান করতে যায়, সেখান থেকে নতুন নতুন সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটি ডাল যদি বা কাটে, সেখান থেকে আরো অসংখ্য ডাল-কাঁটা গজিয়ে ওঠে। আজ তাদের অবস্থা হয়েছে সেই হতভাগ্য চিকিৎসকের মত যে রোগ দিয়ে রোগের চিকিৎসা করে এবং কাঁটা দিয়ে কাঁটার আঘাত সারাতে চায়।
তারা যখন পূজিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো তখন কমিউনিজম জন্ম নিলো। যখন গণতন্ত্রের মূলোৎপাটন করতে চাইল তখন একনায়কত্ব আজদাহার মত মুখ হা করলো। যখন সামাজিক সঙ্কটের সমাধান করার চেষ্টা করলো, তখন সমাধান তো হলোই না, বরং দানা বেঁধে উঠলো নারীর পুরুষায়ন ও জন্মনিরোধ আন্দোলন। নৈতিক অনাচার দূর করার জন্য যখন আইন ও বিধান তৈরী করলো তখন অপরাধ ও আইন অমান্যের প্রবণতা হলো সর্বগ্রাসী। ফলে একটি মন্দ আরেকটি মন্দকে এবং একটি ফাসাদ আরো বড় ফাসাদকেই শুধু ডেকে আনতে লাগলো। এভাবে এ বিষবৃক্ষ তাদের জীবনে বিষ ও বিষাক্ত কাঁটাই শুধু ছড়িয়ে চলেছে এবং নিত্য নতুন বিপদ ও বিপর্যয় ডেকে আনছে। ফলে পাশ্চাত্যের সমাজদেহ আজ তাদের চিন্তানায়ক ও বিদগ্ধ পণ্ডিৎদের মতেও দগদগে ঘা ও পূজপূর্ণ ক্ষতে এমনভাবে ভরে গেছে যে, ক্ষত ধোয়া ও মলম লাগানোরও উপায় নেই। ‘তান হামা দাগ দাগ শুদ, পুম্বা কুজা কুজা নিহাম’- সারা দেহে ক্ষত, তুলো ও মলম লাগাব কোথায়? রোগ-ব্যাধি এখন চিকিৎসককেই যেন দিশেহারা করে ফেলেছে এবং ছেঁড়া-ফাড়া রিফুকারীকে হতভম্ব করে ফেলেছে। পাশ্চাত্য আজ রোগে, শোকে, ব্যথায়, যন্ত্রণায় কাতর। অস্থিরতায় শুধু ছটফট করছে, কিন্তু উপশমের উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। তার হৃদয় শান্তির জন্য ব্যাকুল এবং তার আত্মা অমৃতজলের জন্য পিপাসার্ত, কিন্তু জানা নেই কোথায় জল ও জলাশয়?! কোথায় অমৃত, কোথায় আবেহায়াত?!
পাশ্চাত্যের বিদগ্ধ সমাজ সাধারণভাবে ধারণা করে থাকে যে, সমস্যার উৎস হচ্ছে গাছের ডাল-পালায়। তাই তারা ডাল-পালা কাটতেই ব্যস্ত এবং এতেই তাদের সময়, শ্রম ও মেধার অপচয় ঘটে। তারা জানে না, কিংবা জানতে চায় না যে, ফাসাদ ও নষ্টতা ডাল-পালায় নয়, গাছের গোড়ায়। আর এটা কোন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নয় যে, নষ্ট বীজ থেকে উত্তম বৃক্ষ এবং মন্দ মূল থেকে উত্তম শাখা আশা করা হবে।
কতিপয় জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি অবশ্য সত্য অনুধাবন করতে পেরেছে, কিন্তু যেহেতু তারা বহু শতাব্দী ধরে এই বিষবৃক্ষের বিষাক্ত ছায়ায় প্রতিপালিত হয়েছে এবং এর ফল দ্বারা তাদের অস্থি-মাংস তৈরী হয়েছে তাই তারা চাইলেও বিষবৃক্ষের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। দুর্বল চিন্তা ও অসুস্থ বুদ্ধি তাদের একথা ভাবারই সুযোগ দিচ্ছে না যে, জীবন ও সভ্যতার নতুন নির্মাণের জন্য নতুন কোন ভিত্তি ও বুনিয়াদ থাকতে পারে, কিংবা থাকতে পারে অন্য কোন সুস্থ বীজ যা থেকে জন্ম লাভ করবে একটি উত্তম বৃক্ষ, যার প্রতিটি শাখা-প্রশাখা হবে উত্তম, প্রতিটি ফল-পাতা হবে উত্তম। এজন্য উভয় পক্ষের পরিণামই হচ্ছে অভিন্ন। উভয় পক্ষই সন্ধান করছে রোগ নিরাময়ের সঠিক উপায়, কিন্তু কেউ জানে না, প্রকৃত আরোগ্য কোথায়?
( চলবে, ইনশাআল্লাহ )