জ্ঞান মানবজীবনের অমূল্য সম্পদ, আর তা শুধু সাধনার মাধ্যমেই অর্জিত হয় না, অদৃশ্যের দানরূপেও অর্জিত হয়। দীর্ঘ জীবনের সাধনা ও চিন্তা-গবেষণা মানুষকে যা দিতে পারে না, অনেক সময় অদৃশ্যের সামান্য একটু আলোক-উদ্ভাস থেকে মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশী পেয়ে যায়।
আমার জীবনের শুরুতে একটি অমূল্য জ্ঞান আমি লাভ করেছিলাম। তাতে আমার চেষ্টা-সাধনার কোন ভূমিকা ছিলো না এবং ছিলো না কোন মানুষের অবদান, বরং তা ছিলো আসমানের দয়া ও আকাশের দান, যা বদলে দিয়েছিলো আমার জীবনের গতিধারা এবং সমৃদ্ধ করেছিলো জীবনের প্রতিটি অঙ্গন, যা আমার ভাব ও ভাবনা, আমার চিন্তা ও চেতনা এবং আমার আবেগ ও হৃদয়বৃত্তি, এসবের প্রতিপালন ও পুষ্টিসাধনের ক্ষেত্রে পালন করেছিলো বিরাট ভূমিকা, সর্বোপরি ধীরে ধীরে আমার কলমকে দিয়েছিলো গতি ও শক্তি; দিয়েছিলো ...!
এই দয়া ও দানের জন্য, করুণার এই শিশির-বর্ষণের জন্য আকাশের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। শুধু ‘কৃতজ্ঞ’ শব্দে যেন অন্তরের কৃতজ্ঞতার পূর্ণ প্রকাশ ঘটে না। তাই বলতে চাই, আসমানের প্রতি আমি ‘শোকরগুযার’।
শুনতে চাও, কী ছিলো আসমানের সেই দান? কী ছিলো আকাশের সেই দয়া ও করুণা? তা হলো শৈশবে আমার রোযনামচা লেখার ধারণা! হাঁ, হঠাৎ একদিন কাঁচা হাতে, আঁকা-বাঁকা বর্ণে ‘অবুঝ’ রোযনামচা লিখতে শুরু করেছিলাম। কেউ বলেনি, কেউ দেখিয়ে দেয়নি। আমি লিখেছি হঠাৎ জেগে ওঠা আমার ভিতরের তাগিদে, আমার অন্তর-প্রেরণায়; আর সেই তাগিদ ও প্রেরণা এসেছে আকাশ থেকে; এসেছে করুণার শিশির-বর্ষণের মত।
আকাশের এই দান আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলাম; রোযনামচাকে আমি হৃদয়ের ভালোবাসা দিয়ে বরণ করেছিলাম এবং আমি কৃতজ্ঞ যে, রোযনামচা আমাকে সেই ভালোবাসার প্রতিদান দিয়েছিলো। প্রতিদিন আমি লিখতাম আর অনুভব করতাম একটা ধীর পরিবর্তন, একটা ক্রম-উন্নতি ও সমৃদ্ধি, আমার লেখায়, চিন্তায়, চেতনায়, ভাব ও ভাবনায়, এমনকি আমার আত্মিকতায়। সবকিছুতে যেন নতুন প্রাণ ও প্রেরণা! নতুন আভাস! নতুন সুবাস!
যখন আগের লেখা পড়তাম; একমাস, একবছর, বা আরো আগের কোন লেখা; আনন্দে, বিস্ময়ে, কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হয়ে যেতাম! ধীরে ধীরে আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে চলেছি!
বৃষ্টিতে একা ভেজার আনন্দ আছে, কিন্তু একসঙ্গেভেজার আনন্দ! কোন কিছু একা ভোগ করার স্বাদ আছে, কিন্তু একসঙ্গে ভোগ করার স্বাদ! তাই ইচ্ছে হলো, আকাশের দয়া ও করুণার এ দান আমি সবার মাঝে বিতরণ করবো। আমি ডেকেছি, সবাইকে বলেছি, তোমরাও গ্রহণ করো আকাশের দান, কিন্তু কেউ গ্রহণ করেনি, খুব কাছের মানুষেরাও না।
রোযনামচা আসলে একজন কল্যাণকামী বন্ধু, একজন সদয় শিক্ষক এবং একজন দরদী সংশোধক। তোমার অজান্তেই রোযনামচা তোমাকে প্রতিদিন একটু একটু বদলে দেবে, কিছু না কিছু শিক্ষা দেবে এবং কিছু না কিছু সংশোধন করবে। এভাবে একসময় নীরব এক বিপব সাধিত হবে তোমার ভাব ও ভাবনায়, তোমার চিন্তা ও চেতনায় এবং তোমার কলমের গতিময়তায়।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার খুব কাছের মানুষও নিয়মিত রোযনামচা লেখে না। কেউ কেউ লেখে, কিন্তু যেন দায়ে পড়ে, ভিতরের প্রেরণা ও ভালোবাসা থেকে নয়। তারা ভালোবাসে না, তাই ভালোবাসার প্রতিদান পায় না। কলমকে ভালোবেসে, কাগজের পাতাকে হৃদয়ের পাতা ভেবে কেউ যদি রোযনামচা লিখতে পারে তাহলে এই একটি নিয়মিত সাধনা জীবনের ধারা পরিবর্তন করে দিতে পারে। আমার এ কথাটা কেউ বুঝতে পারেনি, হয়ত আমিই ঠিক মত বোঝাতে পারিনি। তুমি কি হে বন্ধু, বুঝতে পেরেছো আমার কথা! বুঝতে পেরেছো আমার হৃদয়ের ব্যথা!